আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আইনুদ্দীন : সুরের প্রস্থান : বেসুরো গান

এই ব্লগটি নোমান বিন আরমান'র দায়িত্বে প্রবর্তিত। এখানে মাঝেমধ্যে তিনি আসেন। numanbinarmanbd@gmail.com

আমি সঙ্গীতের স্বজন বা বিজন কিছুই না। অনিয়মিত একজন শ্রোতা। সঙ্গীতের জন্যে আমার ভেতরটা মুখিয়ে থাকলেও একে নিরন্তর সময় দেয়া হয় না।

তবে কখনো ভালো কোনো গান ডাকলে না তাকিয়ে পারি না। তাকে সময় দিই এবং উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সঙ্গীতের কেউ না হয়েও বিরাট এক সঙ্গীত আয়োজনে একবার জড়িয়ে পড়েছিলাম। কাহিনী এখানে বলবার দরকার হতে পারে! ব্যাখ্যার দরকার নেই Ñ তবুও পরিষ্কার থাকার জন্যে বলে নেয়া ভালো, এখানে সঙ্গীত বলতে আমরা ‘ইসলামি সঙ্গীত’কেই নির্দেশ করব। ইসলামি সঙ্গীতের অন্তরপাঠের চেষ্টা করব।

বলতে চাইবো, সঙ্গীত এবং যারা সঙ্গীত করছেন তাদের নিয়ে দু’চার কথা। শুরুতেই যেটা বললাম, আমি সঙ্গীতের স্বজন, বিজন নই। আর এই কারণেই সম্ভবত আমাদের সঙ্গীতের পুরোটা আমার জানা নেই। আমরা জানা নেই, কতজন শিল্পী কাজ করছেন এই ময়দানে। তবে ‘গণ্য’ যারা, তাদের সম্বন্ধে নগণ্য সংবাদ মাঝেমধ্যে পাই।

তাদের খবর রাখার চেষ্টা করি। এদের একজন সদ্য প্রয়াত হলেন। কাঁদালেন। আইনুদ্দীন আল আজাদের করুণ বিদায়সংবাদ ব্যথিত করেনি এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো বললাম, কারণ এই বিষয়ে আমার খানিকটা শংসয় আছে! তবে শংসয় নিয়ে এখানে কথা বাড়াবো না।

প্রথম যখন আজাদের মৃত্যু সংবাদ পেলাম, তখন থেকেই একটি বিষয় আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো, তার মৃত্যুকে আমাদের মিডিয়া (মাসিক, সাপ্তাহিক) কীভাবে কভার করে। কার চেয়ে কে বেশি আয়োজন তাকে নিয়ে করে, তা দেখার। মাসিকগুলো দেখলাম। সাপ্তাহিক (মুসলিম জাহান) চোখে পড়েনি। তাই তারা কী করলো বলতে পারবো না।

মাসিকগুলোর মধ্যে রহমত, রহমানী পয়গাম, পাথেয় দেখলাম। দেখলাম আর আহত হলাম। দেখলাম আরো দুয়েকটি পত্রিকা। তবে তাদের কৃতিত্ব মনে পড়ছে না! ক্ষুব্ধ হলাম নবধ্বনী দেখে। ক্ষুব্ধতা থেকেই এই লেখা।

এজন্যে ধন্যবাদ নবধ্বনীকে! লেখাটি নবধ্বনীতে যেতে পারতো। সঙ্গত ছিলো তা-ই। কিন্তু এখানে কেনো? এই মাজেজা বুঝতে লেখাটি এখানে আসার কারণ আমাকে বলতে হবে। আমি সেটি বলবো। আশা করবো, নবধ্বনী ভুল বুঝবে না।

যে কান্ডারি হতে প্রতিজ্ঞ; তাকে যে সম্পাদকীয় ‘পারাকাষ্ঠা’ রাখতে হয়, এটি নবধ্বনী একদিন বুঝবে Ñ এমনটি আমি এখনো প্রত্যাশা করি। ০ দুই ০ আমার ইচ্ছে ছিলো, কালকণ্ঠেও তাকে নিয়ে অন্তত ভালো একটি লেখা দেব। এজন্যে নানা জনের সাথে ফোনে কথা বলে একজনের ওপর ভরসা করলাম। এর আগ পর্যন্ত স্থির ছিলো সন্তুষজনক কাউকে পাওয়া না গেলে নিজেই লিখবো। এই নিয়তেই কথা বললাম, মাসউদুল কাদির, সালাহ উদ্দিন জাহাঙ্গীরসহ ঢাকায় আছে এমন কয়েকজনের সাথে।

আমার ধারণা ছিলো, তারা আমাকে যথেষ্ট তথ্যসহায়তা দিতে পারবে। কিন্তু তারা যথেষ্ট হতাশ করলো আমাকে। কেউই খুব কিছু বলতে পারলো না। রায়হান মুহাম্মাদ ইবরাহীম বললেন, তিনি লিখবেন। সময় নিলেন।

নির্ধারিত সময়ের তিনদিন পর জানলাম, তিনি লিখতে পারছেন না। এভাবেই মাসটি চলে গেলো। আইনুদ্দীনকে নিয়ে আমার কিছুই করা হলো না। নবধ্বনীতে মুহিব খান তাকে নিয়ে লিখছেন এটি আমার আগেই জানাছিলো। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে তাই প্রথমেই তার লেখাটি পড়া শুরু করলাম।

দু’টি লাইন পড়েই চোখ কপালে ওঠলো। পড়ব কিনা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলাম না। শেষমেশ লেখাটি পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং ‘ধৈর্যসহকারে’ লেখাটি পড়ে শেষ করলাম। এখানে বলে নেয়া সঙ্গত মনে করি, মুহিব খানের কোনো গদ্য এই প্রথম আমি পড়লাম।

প্রথম যখন তার বই (লাল সাগরের ঢেউ) পড়ি তখন আমি নবীন পাঠক। এর বছর কয়েক পর তার আরেকটি বই আমার পড়া হয়। নাম মনে নেই। আখেরি কবি/কবুয়ত এই ধরণের একটি কবিতা ওই বইয়ে পড়ে ব্যাপক বিনোদন পেয়েছিলাম। সবশেষ নবধবনীতে তার গদ্য পড়লাম।

যারা পড়েছেন, স্বীকার করবেন এখানে ‘মৃত’ আজাদকে নিয়ে বেশ খেলই খেলেছেন মুহিব। যার পুরোটাই অহেতুক। লেখার সিংহভাগ অংশ জুড়েই ছিলো আজাদ ও তার তুলনালোচনা। একটি অংশ পড়া যেতে পারে : “সেই সময় আমাদের যৌথ অনুষ্ঠানগুলো বেশ উপভৌগ্য হয়ে উঠতো শ্রোতাদের কাছে। আমার কণ্ঠে বিপ্লবী, গণজাগরণী গান এবং তার কণ্ঠে মরমী গান শুনে যারপরনাই মুগ্ধ হতো।

.... তিনি নিজের, অন্যের, প্যারোডি অনুকরণ সব ধরণের গান গাইতেন, গাইতে পারতেন। আমি শুধু নিজস্ব কথা-সুরের বিশুদ্ধ ও মৌলিক গানগুলো গাইতাম। তিনি গাইতেন ওয়াজ মাহফিল, সভা-সম্মেলন সবখানে। আমি শুধু সঙ্গীতানুষ্ঠানে। তিনি প্রোগ্রামে ছুটেছেন প্রায় সারা বছর, মাসের প্রায় সবদিনে, এমনকি একই এলাকার কয়েক স্থানে বা একই রাতে একাধিক অনুষ্ঠানে।

আর আমি বছরের সীমিত কিছু দিন, সময় ও স্থানের যথেষ্ট তফাৎ রেখে। বেছে বেছে, গুনে গুনে। ” (জুলাই-২০১০)। উদ্ধৃতি আর দীর্ঘ করতে চাইছি না। কারো ইচ্ছে হলে লেখাটি দেখতে পারেন।

তবে যারা সুবিবেচনায় চলতে অভ্যস্ত তাদের ওদিকে না তাকাতেই বলবো। দরকার কী, শুধু শুধু কষ্ট পাবার। আমার মনে হয়েছে, আইনুদ্দীন স্মরণের কোনো লেখা নয় এটি। এর চে’ কোনো ‘রচনা প্রতিযোগিতা’। যার বিষয় : আইনুদ্দীন- মুহিব : শিল্পী হিসেবে কে বড়’।

এই রচনায় প্রথম পুরস্কারটি পাবার জন্যে দর্শক-শ্রোতা নয়, স্বয়ং মুহিব খান লিখতে বসেছেন। ফলত এই প্রতিযোগিতার দর্শকরা হয়েছে বিব্রত। আইনুদ্দীন থেকেছেন নিরব দর্শক। প্রশ্ন, জয় কার? সালাহ উদ্দীন জাহাঙ্গীরকে ফোন করলাম। বললাম, এই লেখাটি আপনারা ছাপলেন কী করে।

বললেন, তিনি এমনই লেখেন! আমি শক খেলাম। এ বিষয়ে ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ জানিয়ে লিখবো, ছাপবেন? বললাম তাকে। জাহাঙ্গীর বললেন, মুহিব ভাইকে না জানিয়ে ছাপতে পারবো না। তার কথায় বুঝা গেলো ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ তিনি ছাপতে পারবেন না। তখন তাকে বলে রাখলাম, আমি কিন্তু এই বিষয়টি ভুলবো না।

সুযোগ হলে এনিয়ে কথা বলবোই। এবং কড়া কিছু কথা! আজ সম্ভবত সে সুযোগটি নিচ্ছি। বলতে শুনি আজাদের সাথে মুহিবের এক ধরণের লড়াই ছিলো (নাকি দ্বন্দ্ব?)। এটা তলে তলে অনেকেই জানতেন। সকলের জানা ছিলো না।

খুব সম্ভব এই লেখাটি সেই অজানার দিন শেষ করলো। এখন পাঠক মাত্রই বুঝে গেলো তাদের এই অজানা বিষয়টি এবং তা মুহিব খানের কারণেই। মুহিব খানের এই লেখাটি বলছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে তারা কিছুদিন আগে এক হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কলরব ও হলি মিডিয়ায় দুটো বৈঠকও হয়েছে। তৃতিয় বৈঠকের পূর্বেই আইনুদ্দীন বিদায় নিলেন।

প্রকৃতিও কি এমনটাই চাইলো? আইনুদ্দীন আর মুহিব এক সময় একই সঙ্গে গান করলেও একই মঞ্চে থাকলেও সেসব তাদের শুরুর সময়ের কথা। দুজনই যখন জনপ্রিয় হচ্ছেন ব্যাপকভাবে তখন আজাদকে টপকানোর একটা কোশেশ গড়ে ওঠে মুহিব খানের ভেতর। ‘যুগের সাথে তাল মিলাতে’ ‘পূর্ণাঙ্গ কওমী আলেম’ মুহিব নিজেকে বদলাতে শুরু করলেন। আর আজাদ কওমীর আলেম না হয়েও কওমির চেতনা ও আদর্শকে ‘কঠোরভাবে’ জাগরুক রাখলেন। তার ছাত্রদেরও সেভাবে নির্মাণ করে গেলেন।

যেটিকে মুহিব খান ‘পশ্চাদপদ’ বা অনাধুনিক ভাবলেন আমরা দেখলাম তা দিয়েই আজাদ মঞ্চে দাপটের সাথে আলো বিস্তার করে চলেছেন। যেখানে মুহিব খানের আধুনিকতা করুণভাবে মার খাচ্ছিলো। এতো স্বীকার্য যে, মুহিব খান যে চলনে ও ফ্যাশনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছেন তার সাখে ‘কওমের’ দূরতম সম্পর্কও নেই। যত দূর জানি এইসব বিষয় থেকেই আজাদ মুহিবকে এড়িয়ে চলতেন। বিষয়টি সরাসরি আজাদের কাছ থেকেও আমার একবার শুনার সুযোগ হয়েছে।

২০০৮ সালের ২১ মার্চ প্রথম ইসলামিক কনসার্ট করলাম আমরা সিলেটে। উদ্যোগতা মুক্তস্বর। আমি সংগঠনটির সভাপতি। আমাদের টার্গেট ছিলো আজাদ, মুহিবসহ মশিউর ও তাদের আরেকজন শিল্পী (এখন নাম মনে পড়ছে না) নিয়ে সর্বাত্মক একটি কনসার্ট করবো। মশিউর ও তার মতের শিল্পী দাওয়াত রাখলেন।

অনুষ্ঠানের দিন বললেন আসছেন না। আমরা বুঝলাম রাজনীতিটা কোথায় হয়েছে। কথা বললাম আজাদের সাথে তিনি জানতে চাইলেন কে কে থাকছেন। তখন পর্যন্ত শুধু মুহিব খানের সাথে প্রাথমিক চুক্তি নিশ্চিত হয়েছে। দাওয়াত গ্রহণ করার জন্যে তার দাবী মত চুক্তিবাবত কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।

বললাম তার কথা। আজাদ জানালেন, মুহিব খান যে মঞ্চে ওঠবে সেখানে আমি থাকবো না। আমি তো আসমান থেকে পড়লাম। বলে কী! (তখন তাদের কারো বিষয়য়েই আমার কিছু জানা ছিলো না। কোনো সঙ্গীত অনুষ্ঠানেও কখনো আমার যাওয়া হয়নি।

) জানতে চাইলাম, কেনো? আজাদ বললেন, যার আদর্শিক পতন হয়েছে তার সাথে কোনো মঞ্চে আমি ওঠতে পারি না। কারণ আমি একটি আদর্শ নিয়ে চলি। শ্রোতা ও জনতার কাছে আমাদের কমিটমেন্ট আছে। ’ এইসব বলে মুহিব খানের সাথে একই মঞ্চে না ওঠার বিস্তারিত তিনি ব্যাখ্যা করলেন। আর বললেন, একে ছাড়া যদি আপনি উদ্যোগ নেন, তবে দেশের সকল শিল্পী নিয়ে আমি সিলেট আসতে রাজি আছি।

এখানে পাঠককে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। আজাদ না করে দেওয়ার পর মুহিব আর আজাদকে এক মঞ্চে করার একটি সম্ভাবনা আমি যাচাই করলাম। কথা বললাম, শাহ ইফতেখার তারিকের সাথে। তিনি বললেন, ‘আপনি ‘ভালো করে’ আয়োজন করলে তাদের দুজনকে এক মঞ্চে করা যাবে। আমি সে দায়িত্ব নেব।

’ আমার জানা নেই আজাদকে তিনি কীভাবে রাজি করাতেন। ০ তিন ০ বিষয়টি আমাকে খুব রকমের পীড়া দেয়। মৃতদের নিয়ে আমাদের অমার্জনীয় অবহেলা। মৃতদের জন্যে বলছি, কারণ জীবীতদের নিয়ে ভালো দুচার কথা লেখার হিম্মত আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি! কিন্তু যিনি গত হয়েছেন, তাকে উদ্দেশ করে তো ভালো কটা কথা বলায় পাপ নেই। পূণ্য আছে।

আমরা এই পূণ্যটুকু করতেও কোনো জানি রাজি নই। মৃতকেও কি তবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি! শুধু এক আজাদের কথা কেনো আমরা তো সামগ্রিকভাবে নিজেদের কোনো কৃতিমানকে নিয়েও কাজ করি না। যেটুকুই হয় তা কেবল তাদের নিজেদের কেউ কেউ করেন। সামগ্রিকতার ছাপ ও অংশগ্রহণ সেখানে লক্ষ্য করা যায় না। এই যেমন গত কয়েক বছরে বিদায় নিলেন খতিব আল্লামা উবায়দুল হক, মুফতি নুর উদ্দীন।

এদের নিয়ে তো এখনো সামগ্রিকভাবে কোনো কাজ হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। কেনো এমন হয়? নিজেদের কৃতিমানদের যদি আমরা মূল্যায়ন না করি, তবে এই জাতি এগুবে কী করে! বলে ছিলাম, সঙ্গীত নিয়েও কথা বলবো। হলো না। সামনে কোনো একদিন বলবার ইচ্ছে রাখি। নোমান বিন আরমান : সম্পাদক, কালকণ্ঠ।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।