আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবর্তনের ফলে মানব দেহে রয়ে যাওয়া কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং মাস্‌ল।

Everyone is entitled to my opinion.
বিবর্তনের চিহ্ন হিসাবে এখনও আমাদের দেহে বেশ কয়েকটি অঙ্গ এবং মাসল্‌ রয়ে গেছে যেগুলা কিনা আমাদের কোন কাজেই লাগে না। এদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এ্যাপেনডিক্স। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদান্তের সংযোগ স্হলে থলের মত অঙ্গটির (সিকাম) শেষপ্রান্তে টিস্যু দ্বারা গঠিত চিকণ পেন্সিলাকৃতির যে অংশটি দেখা যায় তারই নাম এ্যাপেনডিক্স। বিবর্তনের রেখে যাওয়া অন্যান্য অঙ্গ/মাসলের মত আমাদের দেহে এ্যাপেনডিক্সের আকারও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মানুষের দেহে এটি ১ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ১ ফুট পর্যন্ত লম্বা পর্যন্ত হতে পারে।

আবার কেউ কেউ এ্যাপেনডিক্স ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে থাকে তবে তাদের সংখ্যাটা খুবই অল্প। কোয়ালা, খরগোশ কিংবা ক্যাঙ্গারুর মত তৃণভোজী প্রাণীদের সিকাম এবং এ্যাপেনডিক্স আমাদের তুলনায় অনেক বড় হয়ে থাকে। পত্রভোজী প্রাইমেটদের যেমন লিমার, লারিসেস, এবং স্পাইডার মাঙ্কি ক্ষেত্রেও একথাটা সত্যি। বৃহদাকৃতির এই থলে বা সিকাম প্রাণীদের ক্ষেত্রে সেলুলোজকে ভেঙ্গে শরীরের জন্য উপযোগী শর্করায় পরিণত করতে সাহায্য করে। যে সমস্ত প্রাইমেটদের খাদ্যাভাসে পাতার পরিমাণ কম থাকে যেমন ওরাং উটাং বা ম্যাকি, তাদের সিকাম এবং এ্যাপেনডিক্সের আকার অনেক ছোট হয়।

আর আমরা যেহেতু তৃণভোজী না বা সেলুলোজ হজম করতে পারিনা তাই আমাদের দেহে এ্যাপেনডিক্সের আকার খুবই ছোট। একটা প্রাণী যত কম তৃণভোজী হবে তার এ্যাপেনডিক্সের আকারও তত ছোট হয়ে থাকে। আমাদের দেহের এ্যাপেনডিক্স হলো আমাদের তৃণভোজী পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া একটি অঙ্গ যার গুরুত্ব আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে থাকলেও আমাদের কাছে একেবারেই নেই। এ্যাপেনডিক্সের আদৌ কোন গুরুত্ব কি আছে? যদি থেকেও থাকে তবে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ্যাপেনডিক্স কেটে ফেললে তার কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া আমাদের শরীরে হয় না।

বরঞ্চ মলাশয়ের বিভিন্ন রকমের সমস্যার পরিমাণ অনেক কমে যায়। প্রত্নতত্ববিদ আলফ্রেড রোমার তার বিখ্যাত টেক্সট ব্ই “The vertebrate Body”তে এ্যাপেনডিক্স নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে কৌতুক করে বলেছেন, "এ্যাপেনডিক্সের সবচাইতে বড় উপকারীতা হলো এটা শল্য চিকিৎসকদের অর্থ উপার্জনে সহায়তা করে। " কারও কারও মতে আমাদের দেহে পরিপাক তন্ত্রে ইনফেকশন হলে কখনও কখনও কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া হয়ত এ্যাপেনডিক্সে আশ্রয় নিয়ে থাকে। তবে এই ছোট উপকারটি এ্যাপেনডিক্স থাকার কারণে যে অসুবিধাগুলো হতে পারে তার তুলনায় কিছুই না। সংকীর্ণতার কারণে খুব সহজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে যা কিনা ইনফেকশন এবং প্রদাহের কারণ হয়ে থাকে, যাকে আমরা বলি এ্যাপেনডিসাইটিস।

সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। উনিশ শতকে ডাক্তাররা এ্যাপেনডিক্স অপসারণের পদ্ধতি আবিস্কার করার আগে মৃত্যুর হার ছিলো ২০% এর উপরে। মোদ্দাকথা অপারেশন করে এ্যাপেন্ডিক্স অপসারণ করার আগে প্রতি ১০০ জনে ১'র অধিক মানুষ এ্যাপেনডিক্সের কারণে মারা যেত, যা কিনা প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মানব বিবর্তনের একটা বিশাল সময় (৯৯% এর বেশী সময়) ধরে এ্যাপেনডিক্স অপসারণের জন্য কোন শল্য চিকিৎসক ছিলোনা। বলতে গেলে তখনকার মানুষেরা পেটের ভিতর যেকোন সময় ফাটার অপেক্ষায় থাকা একটি টাইম বম্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, যার থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিলো না।

যদি এ্যাপেনডিক্সের উপকার এবং অপকারের মধ্যে একটা তুলনামূলক আলোচনা করি তবে দেখা যাবে আমাদের দেহে এটা থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই। তবে সেই আলোচনা বাদ দিয়েই বলা যায় এ্যাপেনডিক্স হলো বিবর্তনের রেখে যাওয়া একটি অঙ্গ যা কিনা যে কাজের উদ্দেশ্যে এর উদ্ভব সেই কাজ এখন আর সে পালন করেনা। তাহলে কেন এটা এখনও আমাদের দেহে রয়ে গেল? একটা কারণ হতে পারে এটা বিবর্তনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। কিন্তু সার্জারীর কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এ্যাপেনডিক্স আছে এমন মানুষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে সেটা হয়ত এখন আর সম্ভব না। আমাদের দেহে এখনও এমন আরও কিছু মাস্‌ল দেখা যায় যা কিনা প্রাইমেট বা উঁচু স্তরের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পূর্বপুরুষের দেহ থেকে আমাদের দেহে রয়ে গেছে।

বিবর্তনের ফলে এরকমই আরেকটি রয়ে যাওয়া মাস্‌ল হলো কক্সিস (Coccyx) যা কিনা "Vestigial Tail" নামেও পরিচিত। মেরুদন্ডের শেষপ্রান্তে বেশ কয়েকটি হাঁড় সংযুক্ত হয়ে যে ত্রিভূজাকৃতির একটি অস্হিকাঠামো তৈরী করে সেটাই কক্সিস নামে পরিচিত। এই অঙ্গটি এক সময় আমাদের প্রাইমেট পূর্ব পুরুষদের দেহে লেজের অংশ হিসাবে অনেক কাজে লাগলেও এখন তা আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতিচিহ্ন। আশ্চর্য্যজনক হলেও একথা সত্যি যে কিছু কিছু মানুষের দেহে খুবই বেসিক লেভেলের লেজের মাস্‌ল পাওয়া যায় যা কিনা বানর এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের লেজের সাথে হুবুহু মিলে যায়। যেহেতু আমাদের হাঁড়ের অংশটা নড়েনা তাই এই মাস্‌ল গুলোও কোন কাজে আসে না।

আর যাদের মধ্যে এই মাস্‌ল গুলি আছে তারা নিজেরাও হয়ত জানেনা যে এই মাস্‌ল নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে কয়েকদিন আগে ব্লগে দেখা একটা ইন্টারেস্টিং পোস্টের লিঙ্ক দিলাম। চাইলে দেখে আসতে পারেন। আমি নিশ্চিত বেশিরভাগ ব্লাগারেরই এসম্পর্কে কোন আইডিয়া ছিলোনা বা নাই। এরকম আরেকটি মাস্‌লের উপস্হিতি টের পাওয়া যায় শীতকালে অথবা খুব বেশী ভয় পেলে।

এদের বলা হয় এরেক্টর পিলি (Arrector Pili)। অতি ক্ষুদ্র এই মাসলগুলো দেহের প্রতিটা লোমের নিম্নাংশে সংযুক্ত থাকে। এরা যখন সংকুচিত হয় তখন লোমগুলি দাড়িয়ে যায়, আমরা যেটাকে বলি "Goose Bump"। এরকম বলার কারণ হলো দেখতে অনেকটা পালক ওঠা হাঁসের মত লাগে বলে। "Goose Bump" কিংবা এই মাস্‌ল গুলোর কোন কার্যকারীতা আমাদের দেহে নেই।

অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে খুব ঠান্ডার সময় এগুলো তাদের লম্বা পশমকে উত্থিত করে তাদেরকে ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করে। অনেক সময় অন্য প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত বোধ করলে তাদের প্রকৃত আকার থেকে বড় দেখাতে সাহায্য করে। বিড়ালের কথা চিন্তা করলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। বিড়াল যখন আক্রান্ত বোধকরে তখন ওদের লোমগুলি ফুলে ফেপে ওঠে। আমাদের দেহেও স্মৃতি হিসাবে রয়ে যাওয়া "Goose Bump" ঠিক একই হরমোন বা উদ্দীপকের কারণে ঘটে থাকে; ঠান্ডা অথবা অতিরিক্ত এড্রেনালিন বৃদ্ধির কারণে।

আরেকটি উদাহরণ হলো: আপনি যদি আপনার কান নাড়াতে পারেন তবে তার মানে হলো আপনি বিবর্তনের স্বাক্ষী। আমাদের মাথার চামড়ার নিচে তিনটি মাস্‌ল কানের সাথে সংযুক্ত থাকে। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই এই মাসলগুলো অকেজো। বিড়াল এবং ঘোড়ার মত অন্যান্য প্রাণীরা এই একই মাস্‌ল ব্যবহার করে তাদের কান নাড়াচাড়া করে থাকে শব্দের উৎসস্হল নির্দিষ্ট করার জন্য। এই সমস্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে কান নাড়ানোর এই টেকনিকটা শিকারী প্রাণী অথবা তাদের বাচ্চাদের উপস্হিতি টের পাওয়া সহ আরো কিছু কাজে সাহায্য করে থাকে।

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এটা শুধুমাত্রই অন্যদের মজা দেয়া ছাড়া আর কোন কাজে লাগে না। নীচের ছবিটাতে উপরে উল্লেখিত অঙ্গ বা মাস্‌লগুলো সহ মানব দেহের আরও বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ঠ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলাকে মনে করা হয় আমাদের দেহে বিবর্তনের ফলে রয়ে যাওয়া কিছু অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ঠ্য। অপ্রয়োজনীয় এই অঙ্গগুলোকে শুধুমাত্রই বিবর্তনের আলোকে দেখলেই তাদের মানে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে অপ্রয়োজনীয় অঙ্গের ক্রমান্ময়ে বিলীন হয়ে যাওয়া বা নতুন কোন কাজের উপযোগী করে পরিবর্তিত হতে হলে যেরকমটি হওয়া দরকার এই অঙ্গগুলিও ঠিক সেরকম এক অবস্হায় আছে। আমরা যদি ধরে নেই যে কেউ আমাদের স্পেশাল ডিজাইনের মাধ্যমে বানিয়েছে তবে আমাদের দেহে ক্ষতিকর এ্যাপেন্ডিক্স কিংবা সিলি (Silly) কানের মাস্‌লের উপস্হিতি কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।

সূত্র: ১) Why Evolution is true: Jerry Coyne, Professor of Ecology and Evolution, University of Chicago ২) গুগল চিত্রসম্ভার
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.