আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই পোস্টটির লেখক এনাম মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র

মাইক্রোবায়োলজি লেকচার ক্লাস চলছিলো। হঠাৎ খুব হৈ-হুল্লোড়। নতুন কি? হাসপাতালে এরকম হয়েই থাকে। ক্লাস শেষ করে নিচে নামলাম। তখন ১০ টা।

চারদিকে এতো ভিড় কেন? অ্যাম্বুলেন্সে করে এতো মানুষ আসছে কেন? কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো। কি অবস্থা একেকটা রোগীর! তাকানো যায় না! চোখে জল টলমল করা শুরু করে দিল। ঠাহর করতে পারি নি এভাবে স্রোতের মতো অ্যাম্বুলেন্স আসবে। শক্ত হবার চেষ্টা করলাম, আবেগে গলে পড়ার সময় না এখন। ইতোমধ্যে সহপাঠী- সিনিয়র- জুনিয়র অনেকেই কাজে নেমে পড়েছেন।

অ্যাপ্রন গুটিয়ে শুরু করলাম। প্রায় সব শিক্ষক- ছাত্র- কর্মকর্তা-কর্মচারী ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছেন। এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামাতে না নামাতেই চলে আসে আরেকটা। যারা উপস্থিত সকলে যেন দিশেহারা। এত ট্রলি, এতো হুইল চেয়ার আনা- নেয়ার লোক কোথায়? কর্মচারীদের সাথে হাত লাগালো এখানেও ছাত্ররা, আশেপাশের মানুষেরা।

একেকজনের সর্বাধিক শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, কতটা দ্রুততার সাথে যে আনা- নেয়া করছিল, তা কল্পনাতীত। একেকজনের চেহারায় যে কতটা উদ্বেগ, কতটা আতঙ্ক তা বলে বোঝাবার না। এক সময় রোগীদের সংখ্যার সাথে আর তাল মেলাতে পারছিল না ট্রলি আর হুইল চেয়ারগুলো। এখন এক ট্রলিতেই দু’জন। তবুও পারা যাচ্ছে না।

এবার কোলে করে দৌড়ে ভেতরে নিয়ে যাবার পালা। তাই শুধু এখানে- ওখানে রক্ত নয়। অ্যাপ্রনগুলোতেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ; রক্তের মাখামাখি। এক সময় খেয়াল করলাম সদ্য এম,আর,সি,পি করে আসা স্যারএর অ্যাপ্রনটা ছিঁড়ে গেছে ইতোমধ্যে। ইমারজেন্সি রুমে ঢুকলাম।

কোন সুস্থ- স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সেখানে খুব বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। শুধু ডাক্তার বলেই হয়তোবা তাঁরা সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আছেন। স্যার- ম্যাডামরা, ভাইয়া-আপুরা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, যাকে বোধহয় বলে সাধ্যের সবটুকু। রোগী আসলেই নাম জিজ্ঞেস করে, প্রাথমিক পরীক্ষাটুকু করে, ব্যবস্থাপত্র লিখতে হয়। কয়েকজনকে নাম জিজ্ঞেস করি, ফ্যালফ্যাল করে এদিক- ওদিক তাকায়, কাঁদে।

নাম বলতে পারে না। শুধু বলে, আমার এ কোথায়, আমার ও কোথায়? এ না হলে মানুষ? নিজে মরে যাচ্ছে, সেটা খেয়াল নেই; প্রিয়জন কোথায় আছে, সেটা আগে জানা দরকার। একসময় ইমারজেন্সি রুমে আর সঙ্কুলান হোল না; এবার চাদর বিছিয়ে নিচে শুইয়ে দেয়া হল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রোগী এসেই চলছে। সমস্ত ওয়ার্ডগুলো রোগীতে ভরপুর।

ফ্লোরে শুইয়ে রাখতে হয়েছে। আর ওদিকে ক্রমশ বাড়ছিলো মৃতের সংখ্যা। তখন রক্ত দরকার, প্রচুর, প্রচুর। একটা টেবিল আর টুল নিয়ে বাইরে বসা হয়েছে। যারা রক্ত দেবে তাদের তালিকা করা হচ্ছে।

লিখে কূল পাচ্ছি না। পাশে থাকা আরও দুই লোক আমার সাথে লিখতে থাকলেন। শত- শত মানুষ রক্ত দিতে চলে এসেছেন, শুধু সাভার থেকে নয়; বহু দূর- দুরান্ত থেকে। কার আগে কে দেবেন, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। কে নেই রক্ত দেয়ার জন্য? কিশোর- কিশোরী, তরুণ- তরুনী, যুবক- যুবতী, বয়স্ক সকলেই।

অনেক হয়ে গেছে। তখন আর রক্তের প্রয়োজন নেই। তবুও মানুষ বলছে, আমারটা নিন, আমারটা নিন, আমি রক্ত দেবো। মানবতা নাকি আর কারও মাঝে নেই এখন? গাজীপুরের এক মাদ্রাসা থেকে ৭০ জন ছাত্র সারিবদ্ধভাবে চলে এসেছেন রক্ত দেবেন বলে। হাজার- হাজার মানুষ ভিড় করেছে হাসপাতালের সামনে।

কেউবা রোগীর স্বজন, কেউবা উৎসুক জনতা। সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা যাতে নির্বিঘ্নে দেয়া যায়, তাই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না সাধারণ মানুষদের। কিন্তু জনতার আবেগকে কি আর দমিয়ে রাখা যায়? পুলিশ আসলো, আর্মি আসলো। আর হাসপাতালের গার্ডরা তো ছিলেনই, সাথে আরও কয়েকজন স্বপ্রণোদিত স্বেচ্চাসেবক। মানুষগুলো খুব কাকুতি- মিনতি করছিল ভেতরে ঢোকবার জন্য।

শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, “I have to be cruel only to be kind.” সেটার বাস্তব প্রয়োগ দেখলাম আজ। কি বলবো আমি!! একজন হুট করে এসে পায়ে ধরে বসলেন, একটু যেন ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিই। অন্তরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার ছিল না। এরকম অনেকেই অশ্রুসজল চোখে অনেক অনেক অনুরোধ করেছেন। খুব খারাপ লাগছে।

আর ঐ মানুষগুলোর কথা কি বলবো আমি? বলে কি শেষ করা যাবে কখনও? যারা আহত, যারা নিহত, যারা তাদের স্বজন- প্রিয়জন তাদের কথা কি বলবো আমি? যে মা সন্তান হারিয়েছেন, যে সন্তান বাবা-মা হারিয়েছেন, যে স্বামী বধূ হারিয়েছেন; আমার কি ক্ষমতা আছে সেগুলো বলার মতো? আজকের দিনে ওখানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব না বিস্তারিত বর্ণনা করা। শুধু এতটুকু বলবো, টেলিভিশনের পর্দায় দেখা, আর অ্যাপ্রন গায়ে দেখা, দু’টোর মধ্যে অনেক অনেক তফাৎ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিদেশ থেকে অনেকেই ফোন করে, ইনবক্স করে আর্থিক সহায়তা দিতে চেয়েছেন। স্রষ্টা যখন তাদের ভেতরে মানবিকতার চেতনা সুদৃঢ়ভাবে বসিয়ে দিয়েছেন, সেখানে আমি না করবার কে? যে কোন ধরণের সহায়তা বা পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে ইন শা আল্লাহ্‌। দু’আ অবশ্যই করবেন, পারলে দু’রাকাত নামায পড়ে ফেলতে পারেন।

আমার বন্ধুরা এখনও কাজ করে যাচ্ছে, আমারও যেতে হবে। ধন্যবাদ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৬ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।