আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঠিয়ার মন্দির: মন্দিরের টেরাকোটা

পাখি পর্ব চলছে
শুধু রাজশক্তিই যে আমাদের সবকিছু দিয়েছে তা নয়। আমরা যাদের নিম্নবর্গ মনেকরি, যাদের অপরিশীলিত, অমার্জিত মনে করি তারাও আমাদের শিল্প ও সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। এই অপরিশীলিত, অমার্জিত সমাজের কাছ থেকে আমরা এমন একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি পেয়েছি যাকে আমরা একটা রোমান্টিকতা থেকে ‘লোকসংস্কৃতি’ বলি। এটি বহু বিতর্কিত বিষয়। বর্তমান প্রবন্ধে এই বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।

বিতর্ক ছাড়াই বরং আমরা বলতে পারি- আমাদের রাজশক্তির হাতে ছিল অর্থ আর ক্ষমতা এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ছিল মনন আর অনুশীলন। এই অর্থ আর মনন অনুশীলনজাত যে উর্বর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তারই ধারক-বাহক আমরা আজকের এই আধুনিক মানুষ। পুঠিয়া রাজবাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পুঠিয়া রাজবাড়ী সৃষ্টির নানার কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে। একটি এরকম১, নাটোর জেলার চন্দ্রকলা গ্রামে (বর্তমান নাটোর সদর থানায়) বৎসরাচার্য নামক একজন তান্ত্রিক সাধক বাস করতেন। তখন সম্রাট আকবরের রাজত্ব চলছে।

বাংলার রাজস্ব সংগ্রাহকগণ দিল্লীশ্বরের নিকট সঠিকভাবে খাজনা না পাঠানোর জন্য দিল্লীশ্বর সেনাপতি মানসিংহের নেতৃত্বে সৈন্য পাঠান বাংলায়। মানসিংহ অনেক পথ ঘুরে বৎসরাচার্যের বাড়ীতে উপনীত হন। তাঁকে খুশি করে মানসিংহ বর চান তাঁর কাছে। সেনাপতি বৎসরাচার্যকে বলেন যে তিনি বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয় করতে চান। ঘটেও তাই।

মানসিংহ খুশি হয়ে লষ্করপুর পরগনার (বর্তমান পুঠিয়া লষ্করপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল) দ্বায়িত্ব গ্রহণের জন্য বৎসরাচার্যকে অনুরোধ করেন। বৎসরাচার্য বলেন যে পার্থিব কোন কিছুতেই তাঁর আসক্তি নেই। মানসিংহ পুনরায় তাঁকে অনুরোধ করলে তিনি লষ্করপুর পরাগনার দ্বায়িত্ব তাঁর তৃতীয় পূত্র পীতাম্বরকে গ্রহণ করতে বলেন। এই পীতাম্বরই পুঠিয়া রাজবংশের স্থপতি। পীতাম্বরের পরে এই রাজবংশের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন মহারানী ভূবনময়ী দেবী, মহারানী শরৎসুন্দরী দেবী এবং তাঁর স্বামী যোগেন্দ্র নারায়ণ।

শরৎসুন্দরী দেবী এবং যোগেন্দ্র নারায়ণের পরে পুঠিয়া রাজবংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, শরৎসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয় পাঁচ বৎসর বয়সে এবং তিনি বিধবা হন তের বৎসর বয়সে। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। তিনি নাবালিকা বলে বৃটিশ সরকার তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য তিনি পরেশ নারায়ণকে দত্তক নেন।

এ কারণেই পুঠিয়ার রাজবংশের পরবর্তী ইতিহাস পরেশ নারায়ণ কেন্দ্রিক। পরেশ নারায়ণের স্ত্রী হেমন্ত কুমারী দেবী। পরেশ নারায়ণ ৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত জমিদার ছিলেন। পুঠিয়া রাজপরিবার বাংলার রাজপরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাজাদের বাহ্যিক দোষ-গুণগুলো ছিল একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তথাপি মননশীল-সৃজনশীল কাজে তাঁদের যে অবদান তাও স্বীকার করে নিতে হয়। বাংলাদেশের যে কয়েকটি মন্দিরে টেরাকোটার কাজ বর্তমান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পুঠিয়ার রাজপরিবার কর্তৃক স্থাপিত মন্দিরগুলি। অবশ্য সব মন্দির টেরাকোটা খচিত নয়। টেরাকোটাহীন মন্দিরগুলিও নির্মাণ শৈলীতে অনন্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মন্দিরগুলো ব্যাপক ধ্বংসের মুখোমুখি হয়; বিশেষত মন্দির গাত্রের মুর্তি, নকশা খচিত দরজা, চূড়া, রাজবাড়ীর ছাদের মূর্তি।

বড় শিবমন্দিরের গায়ে যে সব মূর্তি ছিল সেগুলোকে বুলেট দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। শিব লিঙ্গ উপড়ে ফেলা হয়। এই মন্দিরেরই নক্‌শা খচিত দরজা ভেঙ্গে ফেলা হয়। এ সময়ে মন্দিরে অস্থাবর সম্পদ লুঠ হয়। পরবর্তী কালে শ্রীমৎ পাগলা বাবা২ (জন্ম- ১৪ এপ্রিল ১৯৪৯ ইং) এই মন্দিরের সংস্কার করেন।

১৯৭৭-’৭৮ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় বড় শিব মন্দিরের শিবলিঙ্গ স্বস্থানে অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় শিব মন্দিরের বর্তমান দরজা নির্মিত হয়। বর্তমান পুঠিয়ায় মোট ৯টি মন্দিরের পূর্ণ অস্তিত্ব বজায় আছে। তার মধ্যে ৫টি মন্দির টেরাকোটা শোভিত। বাকি ৪টিতে টেরাকোটা নেই।

মন্দিরের তালিকা : ১। বড় শিবমন্দির ২। ছোট শিবমন্দির ৩। বড় আহ্নিক মন্দির ৪। ছোট আহ্নিক মন্দির ৫।

বড় গোবিন্দ মন্দির ৬। ছোট গোবিন্দ মন্দির ৭। দোল মন্দির ৮। জগন্নাথ মন্দির ৯। গোপাল মন্দির যে সব মন্দিরে টেরাকোটা আছে সেগুলো হচ্ছে- ১।

বড় গোবিন্দ মন্দির- (লষ্করপুর ডিগ্রী কলেজের ভেতরে অবস্থিত) ২। ছোট গোবিন্দ মন্দির- (বেগমবাড়ীর সাথে এক রত্ন মন্দির) ৩। বড় আহ্নিক মন্দির- (ছোট গোবিন্দ মন্দিরের সাথে অবস্থিত) ৪। ছোট আহ্নিক মন্দির- (বড় গোবিন্দ মন্দিরের পেছনে অবস্থিত) ৫। ছোট শিবমন্দির- (লষ্করপুর ডিগ্রী কলেজের পেছনে অবস্থিত) বর্তমানে মন্দিরগুলির অবস্থা সংকটাপন্ন।

মন্দিরের টেরাকোটা চুরি হয় প্রতিনিয়ত। প্রয়োজনের তুলনায় রক্ষণা বেক্ষণের লোকবল কম। মন্দিরের গাত্রের টেরাকোটার মোটিফ পোড়ামাটির শিল্প মাত্রই টেরাকোটা। অধুনা টেরাকোটার অবস্থানগত দিক থেকে একে বিভিন্নভাবে দেখা হয়। যেমন- প্রাচীর চিত্র, অলংকার ইত্যাদি।

মন্দিরের টেরাকোটাগুলি অনেক খন্ড খন্ড পোড়ামাটির ফলক দিয়ে তৈরি বলেই এগুলোকে সামগ্রিকভাবে টেরাকোটা বলা হয়েছে। এবং সেভাবেই এর উপস্থাপন করা হয়েছে। সামগ্রিক শিল্পকর্মটিকে আমরা টেরাকোটা টাইপ এবং এর ভিতরে পৌরাণিক, লতাপাতা, আলপনার যে সুক্ষ্ম চিত্রগুলি আছে সেগুলিকে মোটিফ বলছি। পুঠিয়া রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বৎসরাচার্য ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। তাঁর বংশের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ শৈব বা শাক্ত হবে অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মে শক্তি উপাসনার একটা প্রবাহ থাকবে এটা স্বাভাবিক| পুঠিয়ায় ৯টি মন্দিরের মধ্যে ২টি শিব মন্দির।

একটি বড় শিব মন্দির অপরটিকে ছোট শিব মন্দির। বড় শিব মন্দিরের সাথেই কালী মন্দির ছিল, যেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বর্তমানে সেখানে একটি ‘কালীর থান’ আছে। তবে যতটা প্রকট হবার কথা ছিল এই শক্তি উপাসনা ততটা প্রকট হয়নি। কারণ, কালী বা শিব মন্দিরের তুলনায় এখানে গোপাল, দোল, গোবিন্দ, আহ্নিক মন্দিরের সংখ্যা বেশী।

তবে আহ্নিক মন্দির গুলোতে কোন দেবতার ‘আহ্নিক’ (ধ্যান) করা হয় তা বলা যায় না। কারণ, সেগুলোতে কোন বিগ্রহ নেই। শক্তি উপসনার পাশাপাশি এর রাজবংশে চৈতন্য দেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের চর্চাও হত। তাই দেখা যায় যে শক্তি এবং মানবিকতার চর্চা এ রাজবংশে সমান্তরাল ভাবে চলছে। এই মিশ্রভাবাদর্শের প্রভাব দেখা যায় বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটায়।

টেরাকোটার বৈশিষ্ট্য ছোট আহ্নিক মন্দির, বড় গোবিন্দ মন্দির এবং ছোট শিবমন্দির- এই তিনটি মন্দিরের প্রত্যেকটিই এক রত্ন মন্দির। এই তিনটি মন্দিরের চার দিকই টেরাকোটা খচিত। ছোট গোবিন্দ মন্দির এবং বড় আহ্নিক মন্দিরের তিন দিক (সামনে, ডানে ও বায়ে- পেছনে নেই) টেরাকোটা খচিত। ছোট গোবিন্দ মন্দিরটি এক রত্ন হলেও বড় আহ্নিক মন্দিরটি স্থাপত্য রীতিতে দোচালা বাংলা ঘরের অনুরূপ। (যে মন্দিরগুলোর চূড়া একটি সেগুলোই এক রত্ন মন্দির।

যে মন্দিরগুলোর উপরে চারকোণে চারটি এবং মাঝে একটি চূড়া আছে সেগুলো পঞ্চরত্ন মন্দির। অনুরূপ নবরত্ন মন্দির পর্যন্ত আছে। দিনাজপুরের কান্তজী মন্দির নবরত্ন মন্দির। পুঠিয়ার বড় শিবমন্দির পঞ্চরত্ন মন্দির)। মন্দিরগুলোর দেয়ালগুলো অসংখ্য ছোট ছোট টেরাকোটা খন্ড দ্বারা শোভিত।

খণ্ড খণ্ড টেরাকোটা মিলে এক একটি দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক মোটিফ। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি দেয়াল এক একটি বিশাল ক্যানভাস। প্রতিটি খন্ডেই রয়েছে এক একটি পৌরাণিক কাহিনীর ইমেজ। পরস্পর সম্পর্কিত ইমেজগুলো পরপর সাজিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে একএকটি কাহিনী। প্রতিটি খন্ড সাধারণভাবে দৈর্ঘে ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৩ ইঞ্চি।

তবে কখনো কখনো কোন কোন জায়গায় (বিশেষত কোণের দিকে) এই হিসাবের গর মিল হয়েছে। আর এটা হয়েছে মন্দিরগুলোর কাঠামোর গঠনের জন্য। আবার কখনো কখনো একটি ইমেজকে পূর্ণতা দিতেও খন্ডগুলো ছোট এবং ত্রিভুজাকৃতির করা হয়েছে। বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির এবং বড় আহ্নিক মন্দির এই তিনটি মন্দির উঁচু স্তম্ভের উপর নির্মিত। স্তম্ভগুলো প্রায় চার ফুট উঁচু।

প্রতিটি মন্দিরের কার্নিশ থেকে শুরু করে স্তম্ভ বা মাটি পর্যন্ত টেরাকোটা খচিত। কখনো কখনো এক খণ্ডে একটি ইমেজ শেষ হয় না। পরবর্তী খণ্ডে র্ধাংশ শেষ হয়। সে ক্ষেত্রে একটি ফুলের একটা পাপড়ীও যদি অপর খন্ডে যায় তাহলে তাই করা হয়েছে। কখনো কখনো ১০-১৩ টি খন্ড জোড়া লাগিয়ে একটি ইমেজ তৈরী করা হয়েছে।

যেমন- ছোট শিবমন্দিরের চারকোণে (উপরে) সাপ খেকো ময়ূরের ইমেজ তৈরি করা হয়েছে ৩টি খন্ড জোড়া লাগিয়ে। আবার ছোট আহ্নিক মন্দিরের চারকোণে যে হনুমানের ইমেজ পাওয়া যায় তাও অনুরূপ সংখ্যক খন্ড জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা। এই ঘটনা বেশী ঘটেছে লতাপাতা বা আলপনার ইমেজ তৈরির সময়। ফুল-লতাপাতা-আলপনাগুলোর বেশীর ভাগই একাধিক খন্ড জোড়া লাগিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। এতে দুই খণ্ডের মাঝের ফাঁকটুকু বাদে মনে হয় একটি পূর্ণাঙ্গ খণ্ড।

মোটিফে পুরাণের প্রভাব: পুঠিয়ার মন্দিরগুলোর টেরাকোটার মোটিফ খুঁজলে পৌরাণিক কাহিনীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যে পাঁচটি মন্দিরে বর্তমানে টেরাকোটা আছে সেগুলোর মধ্যে মোটিফগত কোন মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়ে না। প্রত্যেকটি মন্দিরেই তিন যুগের (সত্য, ত্রেতা, দাপর) পৌরাণিক কিংবদন্তী, বিভিন্ন যুদ্ধ সম্পৃক্ত কল্পিত প্রাণী (বিশেত ড্রাগন আকৃতির ঘোড়া), বিভিন্ন দেব-দেবীর ইমেজ পাওয়া যায়। দূর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, ব্রহ্মা প্রভৃতি দেব-দেবী তাদের কল্পিত প্রথাগত সাজসজ্জা এবং ভঙ্গি নিয়েই বর্তমান। মজার বিষয় হচ্ছে- পুঠিয়ার রাজপরিবারের স্থাপতি শৈব হলেও টেরাকোটার ইমেজগুলোতে শিবের চিত্র পাওয়া যায় না।

শক্তির অপর দেবী কালীরও কোন ইমেজ পাওয়া যায়না। অথচ এই দুই পৌরাণিক শক্তির দেব-দেবীর গুরুত্ব ছিল তাদের কাছে অপরিসীম। এই মোটিফগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ক. কৃষ্ণ লীলা, খ. রামায়ন কেন্দ্রিক, গ. মহাভারত কেন্দ্রিক এবং ঘ. পৌরাণিক দেব-দেবী কেন্দ্রিক। অবশ্য এই চার ভাগের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে কাহিনী কেন্দ্রিক পশু-পাখি, ফুলও লতাপাতা এবং আলপনা।

ক. কৃষ্ণ লীলা কেন্দ্রিক মোটিফ: রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী, বিগ্রহ বাংলায় সবসময় লৌকিকতায় পর্যবষিত হয়েছে। কাহিনীকার বা শিল্পীর চোখে এরা যতটা না দেব-দেবী তার চেয়েও বেশী পরিচিত ‘কৃষ্ণ লীলা’র নায়ক-নায়িকা হিসেবে। হিন্দু পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে সম্ভবত রাধা-কৃষ্ণই বেশী কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। এবং এই কাহিনীগুলি বিবর্তিত হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁচেছে যেখানে তাদের আর দেবতার মর্যাদা থাকেনি। রাধা-কৃষ্ণ সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীই পুঠিয়ার মন্দিরগুলির টেরাকোটায় স্থান পেয়েছে।

কৃষ্ণ ও রাধা এখানে পৌরাণিক চেহারা ছেড়ে লৌকিক স্তরে নেমে এসেছে। (প্রত্যেকটি মন্দিরের টেরাকোটায় কৃষ্ণ-রাধার কাহিনীই প্রাধান্য পেয়েছে)। যেমন নেমে এসেছিল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে। সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’র প্রভাব আছে টেরাকোটা নির্মাণে। কারণ, রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী নির্ভর টেরাকোটাগুলোতে বংশী খন্ড, বস্ত্র খন্ড ও নৌকাখন্ডের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশী।

এর কারণ- এই খন্ডগুলোর কাহিনীতে রয়েছে রোমান্টিকতা। যা মানুষকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। রোমান্টিক এই দৃশ্যগুলো ঠিক রোমান্টিক ভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। ছোট আহ্নিক মন্দিরের টেরাকোটায় দেখা যায় যে, রাধা নৌকায় উঠেছে সখীদের নিয়ে। মাঝি কৃষ্ণ।

মাঝ নদীতে মাঝি নৌকা উল্টে দিল। ঠিক যেমনটি ঘটেছে ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যে। কাহিনীর বর্ণনানুসারেও টেরাকোটার কারুকাজ করা হয়েছে। আবার বন্ত্র খন্ডেও দেখা যায় রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার। এই তিন খন্ডের (বংশী, বস্ত্র ও নৌকাখন্ড) বাইরেও রয়েছে রাধার কলসি কাঁখে জল আনার দৃশ্য, হাড়িতে প্রচলিত পদ্ধতিতে ননী তৈরির দৃশ্য।

বড় আহ্নিক মন্দিরের টেরাকোটাগুলোয় দেখা যায় কৃষ্ণের গরু চরানো, বন্ধুদের নিয়ে নানারকম খেলাধুলার ইমেজ। প্রত্যেকটি মন্দিরে দেখা যাবে রাধা-কৃষ্ণের অভিসারের দৃশ্য। এই ইমেজের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে রাধা-কৃষ্ণের সখা-সখীদের নানারকম নাচের মুদ্রা। কোথাও রাধার একক নৃত্য, কোথাও কৃষ্ণের একক নৃত্যের মুদ্রাও আছে। সখা-সখী পরিবেষ্টিত রাধা-কৃষ্ণ, দলীয় নৃত্যের ইমেজও পাওয়া যায় টেরাকোটাগুলোয়।

আবার হোলী ও রাস উৎসবের ইমেজও পাওয়া যায়। বাঁশি হাতে রাধা-কৃষ্ণের শাশ্বত যে যুগল মুর্তি তার ইমেজও পাওয়া যায় প্রত্যেকটি মন্দিরের টেরাকোটায়। অবশ্য এই যুগল ইমেজের নানারকমের স্টাইল পাওয়া যায়। কোথাও বংশী বাদক কৃষ্ণের একটু দূরে রাধা দাঁড়িয়ে কোথাও কৃষ্ণ রাধাকে জড়িয়ে ধরে বাঁশি শোনাচ্ছে। (ছোট গোবিন্দ মন্দিরের টেরাকোটা)।

রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির শাশ্বত রূপটি এখানে বর্তমান। রাধা-কৃষ্ণের যে লীলা তা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত। হয়তো এ কারণেই মন্দিরের টেরাকোটার বিষয় হিসেবে কৃষ্ণলীলার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। এতে দুটি দিক রক্ষা পায়- ১. দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন; ২. শাশ্বত প্রেমের গুণকীর্তন। খ. রামায়নকেন্দ্রিক মোটিফ রামায়নের কাহিনী বাংলায় খুব জনপ্রিয় এবং প্রচলিত না হলেও পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে এর আলাদা একটা গুরুত্ব সবসময় ছিল।

বিশেষত রামের বীরত্ব ও সীতার সতীত্ব হিন্দু সমপ্রদায়ের কাছে সব সময় পবিত্র ও আদরণীয়। তবে এর জনপ্রিয়তা কৃষ্ণ লীলার চেয়ে কম। রামায়নের কাহিনীতে মূলত রামের বীরত্ব, সীতার সতীত্ব, রাবনের পরাজয় এবং লক্ষণের ভ্রাতৃত্ব প্রেমই প্রাধান্য পায়। পুঠিয়ার মন্দিরগুলোতে (বিশেষত বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির ও বড় আহ্নিক মন্দিরে) রামায়ন কাহিনীর শুধু রাম-রাবনের যুদ্ধের ইমেজ আছে। স্থিরচিত্রে যুদ্ধের যে আলাদা একটা নান্দনিকতা আছে তা এই ইমেজ দেখলেই বোঝা যায়।

রাম-রাবনের ঘোরতর যুদ্ধ। বানের পর বান ছুঁড়েছে রাম, পাশে ধনুক হাতে-তুন কাঁধে দাঁড়িয়ে লক্ষণ। রামের বান কাটাতে কাটাতে বিপর্যস্ত দশ মাথাওয়ালা রাবন, দু’পক্ষেরই যোদ্ধারা যুদ্ধ করছে গদা, তলোয়ার হাতে; এই ইমেজই পাওয়া যাবে টেরাকোটাগুলোয়। রামায়ন কাহিনীর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হনুমান। রামের ভক্ত হিসেবেই যার সমধিক পরিচিতি।

এমনও বলা হয় যে রাবনের ভাই বিভীষন এবং হনুমান বাহিনীকে নাপেলে রামের লঙ্কা জয় সম্ভব হতো না। টেরাকোটাগুলোয় হনুমান নিজস্ব রূপেই বর্তমান। বিশেষত- রাম-রাবনের যুদ্ধে হনুমান যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা বোঝা যায় যুদ্ধের ইমেজগুলোয়। হনুমান আবার শক্তিরও প্রতীক। এ কারণে রামের পাশে শক্তিশালী হনুমানের ইমেজ সার্বজনীন।

রামের পাশে হনুমান না থাকলে এই ইমেজ পূর্ণতা পায়না। ছোট গোবিন্দ মন্দিরের সামনের দেয়ালের উপর দিকে দুই পার্শ্বে হনুমানের বেশ বড় ইমেজ পাওয়া যায়। তবে এই ইমেজ দেখে বোঝা যায়না এটি হনুমানের ইমেজ কিনা। কারণ, হনুমানের মুখাবয়বের সাথে এই ইমেজের খুব একটা বৈশাদৃশ্য না থাকলেও মিল নেই। তবে শরীরের গঠন, লেজ, পা দেখে অনুমান করা যায় এটি হনুমান।

এই ইমেজের ভাব বীর রস। যুদ্ধংদেহী হনুমান যুদ্ধে যাচ্ছে- এই বিষয়টিই ইমেজের ভাববস্তু। রামায়নী কাহিনীর ইমেজ খুব কম পাওয়া যায়। গ. মহাভারতকেন্দ্রিক মোটিফ মহাভারতের যুদ্ধ তথা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ভারত বর্ষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধারণা করা হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়।

মহাভারতের পাঠক মাত্রই জানেন এর ইতিহাস। আবার এমনও বলা হয় যে, যা নেই মহাভারতে তা নেই ভারতে। অর্থাৎ, মহাভারতে যে রাজনৈতিক ঘটনার কথা উল্লেখ্য নেই তা ভারতের রাজনীতিতে ঘটেনা। অবশ্য এটা এক ধরণের রোমাণ্টিক ভাবনা। মহাভারতের যুদ্ধ কুরু ও পাণ্ডব বংশের শত্রুতার পরিণতি।

কুরু বংশের কুটচাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ধর্ম পথে পরিচালিত পান্ডব বংশ প্রথমে যুদ্ধ করতে না চাইলেও পরবর্তিতে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জয়লাভ করে। পুঠিয়া মন্দিরের টেরাকোটাগুলোয় শুধু মহাভারতের যুদ্ধের ইমেজ আছে। মহাভারতের উল্লেখযোগ্য ঘটনা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কিংবা অভীমন্যু বধের ইমেজ নেই। অথচ এই দুই ঘটনা মহাভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘটনা।

রামায়নের কাহিনীর মত মহাভারতের কাহিনীও বাংলায় খুব একটা জনপ্রিয় বা প্রচলিত নয়। এবং রামায়নের মত শুধু যুদ্ধের ইমেজই প্রধান্য পেয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। মহাভারতের যুদ্ধের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রথের ব্যবহার। রামায়নের যুদ্ধেও রথ ব্যবহার করা হয়েছে তবে কম। এখানে শুধু রাবন বা তার সেনাপতিগণ রথ ব্যবহার করেছে।

কিন্তু, মহাভারতে কুরু-পান্ডব উভয় পক্ষই রথের ব্যবহার করেছে। রথ নিয়ে অনেক ঘটনাও রয়েছে মহাভারতের কাহিনীতে। টেরাকোটার ইমেজগুলোতে রথের ব্যবহার করা হয়েছে। রথগুলো ঘোড়ায়টানা। রথের সারথী এবং যোদ্ধা এই দুজনই আরোহী।

রথের ইমেজ টেরাকোটাগুলোকে একটা ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। মহাভারতের যুদ্ধের দৃশ্যগুলোর আর একটি দিক হচ্ছে গদাযুদ্ধ। তীর ধনুকের ব্যবহার আছে তবে এতে গদাযুদ্ধের ইমেজই বেশী। গদা নিয়ে দু'জন যোদ্ধার যুদ্ধই গদাযুদ্ধ। এই যুদ্ধে যোদ্ধা দুজন এবং তারা একে অপরকে যুদ্ধে আহবান জানায়।

পরাজিত হলে মৃত্যু অনিবার্য। মহাভারতের যুদ্ধে তীর-ধনুকের চেয়ে গদা যুদ্ধই বেশী হয়েছে। এজন্যই এ ক্ষেত্রে গদাযুদ্ধের ইমেজ প্রধান্য পেয়েছে। রামায়ন ও মহাভারত এ দু’গ্রন্থের মানবীয় দিকগুলো টেরাকোটায় অনুপস্থিত। শুধু যুদ্ধের ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে।

দু’ক্ষেত্রেই যুদ্ধের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন- যুদ্ধে তীর ধনুকের ব্যবহার, গদার ব্যবহার, অশ্বারোহী, গজারোহী সৈন্য, মত্তহাতি, মৃত সৈনিক, তলোয়ার যুদ্ধ ইত্যাদি। এই ইমেজগুলো উভয় যুদ্ধের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতার চিহ্নও উভয় ক্ষেত্রে বর্তমান। যেমন তলোয়ার ও গদা যুদ্ধে মৃত সৈনিক, অশ্বারোহী ও গজারোহী সৈন্যদলের পায়ের তলায় পিষ্ঠ পদাতিক সৈন্য।

যুদ্ধের ধ্বংসলীলা বা ভয়াবহতাকে খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দেখলে তাদের জন্য করুণা হবে। রামায়ন-মহাভারত উভয় মেটিফের ক্ষেত্রেই এমনটি করা হয়েছে। উভয় যুদ্ধের মোটিফে যোদ্ধাদের যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শনের স্থানগুলি খুব ঋজু। বিশেষ করে, গদা যোদ্ধার যুদ্ধ কৌশল, অঙ্গভঙ্গি এবং দু’হাতে গদা ধরার ফলে শরীরে সৃষ্ট ভাঁজগুলি খুব ঋজু। তলোয়ার এবং তীরন্দাজদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।

টেরাকোটার ইমেজগুলোর আর একটি জায়গা নজর কাড়ে, তা হলো যোদ্ধাদের পোশাক। রামায়ন-মহাভারত উভয় যুদ্ধের ক্ষেত্রেই এটি লক্ষ্যনীয়। যোদ্ধাদের কোমর বন্ধে ঝোলানো তলোয়ার, বাজুবন্ধ, গদা যোদ্ধাদের মালকোচা মারা পেশীবহুল শরীর, তলোয়ার যোদ্ধার কর্ম, শীরস্ত্রান সবই খুব সাবলিলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। ঘ. পৌরাণিক দেবদেবী কেন্দ্রিক মোটিফ বলা হয়ে থাকে ছত্রিশ কোটি দেব-দেবী আছে হিন্দু পুরাণে। তার মধ্যে কিছু আছে অভিজাত- যাদের পুজা চলে সবসময়।

এবং হিন্দু পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে এরাই প্রধান। যেমন- ব্রহ্মান, বিষ্ণু, মহেশ্বর, দূর্গা ও তার পরিবার, শিব, কালী প্রভৃতি। পুঠিয়ার প্রতিটি মন্দিরেই এদের ইমেজ পাওয়া যায়। তবে একটি মজার বিষয় হচ্ছে যে, টেরাকোটাগুলোয় শিব বা কালীর ইমেজ পাওয়া যায় না। কালী ও শিবের ইমেজ ছাড়া মোটামুটি পরিচিত সব দেবতারই ইমেজ পাওয়া যায়।

এই দেবতাদের লৌকিক স্তরে নামিয়ে আনার কোন প্রবনতা নেই টেরাকোটাগুলোয়। এরা স্বমুর্তিতে এবং স্বমহিমায় বিরাজমান। সবচেয়ে বেশী ইমেজ পাওয়া যায় রাধা-কৃষ্ণের। অনেক স্টাইলের ইমেজ পাওয়া যায়। রাধা-কৃষ্ণের শাশ্বত যুগল মূর্তি ছাড়াও পাওয়া যায় অনেক স্টাইলের ইমেজ।

যেমন- কোথাও কৃষ্ণ একাকী বাঁশী বাজাচ্ছে, কোথাও রাধা বংশী বাদক কৃষ্ণের খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও কৃষ্ণ ব্রজ লীলায় মত্ত, কোথাও বা কৃষ্ণ সখা-সখী পরিবেষ্ঠিত- রাস লীলায় মত্ত আবার কোথাও কৃষ্ণ গরু চরাচ্ছে। কৃষ্ণের এমনি সব ইমেজ পাওয়া যায়। রাধা-কৃষ্ণ লীলার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে গাভী, বন, বাঁশি, নৌকা ইত্যাদি। পুঠিয়ার সব মন্দিরেই রয়েছে কৃষ্ণ ও রাধার ইমেজ। উল্লেখ্য প্রতিটি মন্দিরেই রাধা-কৃষ্ণের ইমেজগুলো প্রায় একই ধরনের।

অন্যান্য দেব-দেবীদের মধ্যে পাওয়া যায় ব্রহ্মা, দূর্গা, গনেশ, কার্তিক ও স্বরস্বতী| ব্রহ্মার শাশ্বত মূর্তিই হচ্ছে ধ্যান মগ্ন। ধ্যানভঙ্গ অবস্থায় ব্রহ্মার মূর্তি বিরল। টেরাকোটাগুলোতেও সেই ইমেজই বর্তমান। এখানেও শশ্রুমণ্ডিত সৌম্যকান্তি ব্রহ্মা ধ্যানে মগ্ন। চার হাত চারদিকে।

পদ্মাসনে বসা। সিংহের পিঠে দশহাত নিয়ে দূর্গর ইমেজ রয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। দশ হাতে ধারণ করা দশটি বস্তু (শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মা, ইত্যাদি)। গনেশ, কার্তিক তাদের কল্পিত ভঙ্গিতে ও বাহনেই বর্তমান। কোন ব্যাতিক্রম নেই।

হিন্দু পুরাণে বর্ণিত অবতারের ইমেজও রয়েছে টেরাকোটা গুলোয়। যেমন- নৃসিংহ অবতার, মৎস অবতার। নৃসিংহ অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহের আকৃতি। ভীষণ দর্শন। বরাহ অর্থ শুয়র।

এর আকৃতি বিরাট। অর্থাৎ বিরাটাকায় শুয়র। মৎসের আকৃতিও বিরাট। এই অবতারগুলোর শুধু ইমেজ আছে। ইমেজ এদের কোন ক্রিয়া নেই।

অর্থাৎ, এগুলো একদিকে তাকিয়ে থাকা ষ্টিল ফিল্মের মতই। দেব-দেবীদের মধ্যে আরও পাওয়া যায় বিশ্বকর্মার ইমেজ। বিশ্বকর্মা স্বর্গের রাজমিস্ত্রী। এর বাহন হাতি। এই সব দেব-দেবীর ইমেজ ছাড়াও পাওয়া যায় নৃত্যরত নারী-পুরুষের ইমেজ।

তবে এগুলো দেব-কি দেবী তা জানা যায় না। এদের বিশেষ ধরনের কোন পোশাক নেই। নাচের মুদ্রা সবারই প্রায় একই ধরনের। এদের যে ধরনের পোশাক দেখা যায় তাতে এদের দেব বা দেবী হিসেবে মনে হয় না। এগুলো হয়তো রাধা-কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার সূত্র ধরে এসেছে।

টেরাকোটাগুলোতে বিভিন্ন ফুলের মোটিফ পাওয়া যায়। ফুল সবসময়ই পবিত্রতার প্রতীক। মন্দির পবিত্র স্থান বলে ফুলের চিত্র বা ইমেজ এখানে থাকবে এটা স্বাভাবিক| প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়- বাংলাদেশের যে কয়টি মন্দির বা মসজিদে টেরাকোটা আছে যেখানে ফুলের মোটিফ রয়েছে। এই ফুলগুলো প্রায় অভিন্ন। যেমন- দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, একই স্থানের নয়াবাদ মসজিদেও ফুলের মোটিফ রয়েছে।

এবং পুঠিয়ার মন্দিরের ফুলের মোটিফের সাথে এগুলোর সাদৃশ্য আছে। ফুল ছাড়াও আলপনা পাওয়া যায় মন্দিরগুলোর টেরাকোটায়। আলপনা গুলি সরল। আশুতোষ মিউজিয়ামে রক্ষিত হুগলি থেকে প্রাপ্ত সপ্তদশ শতকের টেরাকোটার আলপনার সাথে পুঠিয়ার মন্দিরগাত্রের আলপনার মিল পাওয়া যায়। (দ্র. মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘ধ্রুপদী নৃত্যের গৌড়ীয় জন্মসূত্র’- এ ব্যবহৃত ছবি।

দেশ-৬ মার্চ, ১৯৯৯)। মন্দিরের আলপনাগুলির প্রকৃতি সরল। বর্তমান কালে যেমন বিভিন্ন মোটিফযুক্ত জটিল আলপনা (রাস্তায় তৈরী আলপনা-বিশেষ অনুষ্ঠানের সময়ে তৈরী) দেখা যায় তেমন নয়। সম্ভবত সরল বলে সবাই একই রকমভাবে এগুলো তৈরি করতো। যেহেতু এগুলো দেখে দেখে শিখতে হয় (আলপনা আঁকা বা তৈরি করার নির্দিষ্ট কোন গ্রামার নেই।

এটি অনেক বেশী অনুশীলন এবং সৃষ্টিশীলতার বিষয়। ) তাই মনে করা অসঙ্গত হবেনা যে এগুলো একটি নির্দিষ্ট ঘরাণার। ঘরাণার কথা এই জন্য বলছি যে, পুঠিয়ার মন্দিরের বা আশুতোষ মিউজিয়ামের রক্ষিত বা কান্তজীর মন্দিরের আলপনার টেরাকোটাগুলোর কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। হয়তো কোন উৎস থেকে এগুলো সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘকাল চলতে থাকে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে একই রকম ধারায় চলতে থাকে।

বর্তমানে যেমন পাকা ঘরের ঘুলঘুলি বা ভেন্টিলেটরের কাজ। এগুলোরও কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। (এগুলো টেরাকোটা নয়। সিমেন্ট দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের নকশা কাটা ঢাকনি)। আলপনার টেরাকোটাগুলো একই রকম হবার আরও একটি কারণ আছে তা হলো- পুঠিয়ার টেরাকোটা তৈরির জন্য বেনারস থেকে শিল্পী আনা হয়েছিলো।

কান্তর্জী মন্দিরের টেরাকোটা তৈরির জন্যও ভারত থেকে শিল্পী আনা হয়েছিল। তারা মোটামুটি একই সংস্কৃতি-বলয়ের মানুষ। একই সূত্র থেকে আলপনার ছাঁচ পাওয়া তাদের জন্য বিচিত্র কিছু নয়। আলপনা ছাড়াও এখানে বিভিন্ন লতানো উদ্ভিদের মোটিফযুক্ত টেরাকোটা পাওয়া যায়। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এগুলোর উপর থেকে নিচে বা ভূমি সমান্তরালে ডান থেকে বাঁয়ে প্রাচীরের এক প্রান্ত অন্য প্রান্তে শেষ এবং এগুলো একদিক থেকে শুরু হয়।

(মন্দির প্রাচীরের থামের কাছ থেকে নতুন ভূমি সমান্তরালে নিচ থেকে)। টেরাকোটাগুলির একটি জায়গা খুব নজর কাড়ে তাহলো অভিব্যক্তি। কি রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়, কি রামায়ন- মহাভারতের যুদ্ধ প্রত্যেকটি জায়াগায় ইমেজগুলোর অভিব্যক্তি অসাধারণ। রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর যে জায়গাাগুলোয় রোমান্টিকতা বেশী সেখানকার অভিব্যক্তি স্পষ্ট। রাধা লজ্জায় আরক্ত, কৃষ্ণ উৎফুল্ল কিংবা নৌকা ডুবে যাওয়ায় সখীদের ভয়ার্ত মুখাবয়ব, কৃষ্ণের উল্লাসের অভিব্যক্তিগুলো একেবারে টানা।

অপরদিকে যুদ্ধের ইমেজগুলোয় যোদ্ধাদের পৌশাচিকতা, ছুটন্ত ঘোড়ার ক্লান্তি, ক্রুদ্ধ হাতি, ভয়ার্ত মানুষ, মৃত-আহত মানুষের অভিব্যক্তি স্পষ্ট। যুদ্ধের ভয়াবহতার দিকটি খুব ঋজুভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। হস্তি বাহিনীর পায়ের তলায় পিষ্ট মানুষ, ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষ্ঠ মানুষ, অস্ত্রের আঘাতে মুমূর্ষু মানুষের ইমেজগুলো স্পষ্ট। উন্মত্ত হাতি মানুষকে তাড়া করছে এবং এক সময় শূঁড়ে পেঁচিয়ে বা পায়ের তলায় পিষ্ঠ করে মেরে ফেলছে। কিংবা ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের তলায় মানুষ পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।

দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে যতটা বিভৎসতা চোখে ভাসে ঠিক ততটাই বিভৎস করা হয়েছে টেরাকোটার ইমেজগুলো। এমনকি হাতির পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে মানুষ যে চিৎকার করছে, চোখ বিষ্ফোরিত এই অভিব্যক্তিগুলি স্পষ্ট বলেই যুদ্ধের বিভৎসতার বিষয়টি চোখে পড়ে। কান্তজী মন্দির ও পুঠিয়া মন্দিরের সাদৃশ্য/বৈসাদৃশ্য দিনাজপুরের কান্তজী মন্দির টেরাকোটা খচিত নবরত্ন মন্দির। এটি আঠারো শতকের মধ্যভাগে নির্মিত। মন্দিরের পেছনদিকে স্তম্ভের নিচে (মন্দিরটি একটি বেদী বা স্তম্ভের উপর নির্মিত) উৎকীর্ণ ফলকে এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৭৪ শতাব্দ বা ১৭৫২ সাল বলে উল্লেখ আছে।

এর প্রতিষ্ঠাতা দিনাজপুরের জমিদার রামনাথ রায়। এটি নবরত্ন মন্দির। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য রত্নগুলি বিনষ্ট হয়। এই মন্দিরের উত্তরের দেয়ালে আছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং পশ্চিম দেয়ালে আছে কৃষ্ণের জন্ম, রাস, কংসবধ, ঝুলন ইত্যাদির মোটিফযুক্ত টেরাকোটা। তবে এই মন্দিরের টেরাকোটাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট এতো নিচের দিকে সমকালীন বিভিন্ন ঘটনার মোটিফযুক্ত টেরাকোটা আছে।

যেমন- মোগল সম্রাটের নৌবিহার, বাঘ শিকার, রাজ্য জয়, হাতি-ঘোড়া-উটের সম্মিলিত মিছিল। এতে টেরাকোটা শিল্পীর ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। পুঠিয়ার মন্দিরগুলির ও বেশীরভাগ বেদী বা স্তম্ভের উপর নির্মিত। এগুলোও রত্নমন্দির (পঞ্চরত্ন, এক রত্ন ইত্যাদি)। পৌরাণিক মোটিফযুক্ত টেরাকোটা এই মন্দিরগুলিরও শোভা বর্ধন করেছে।

কান্তজী এবং পুঠিয়ার মন্দিরের পৌরণিক ইমেজগুলো প্রায় এক। অর্থাৎ উভয় মন্দিরের মোটিফগুলোর মধ্যে বিষয় ও নির্মানশৈলীর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পৌরাণিক বিষয়গুলো একই রকম। ফুল, লতাপাতা ও আলপনার মোটিফগুলোর মধ্যে এতটাই মিল যে- যারা এই মন্দিরগুলো দেখেছেন তাদের কাছে এর টেরাকোটার কাজগুলো একই শিল্পীর বলে মনে হতে পারে। অথবা, দুই মন্দির নির্মানে সময়ের পার্থক্য আছে যথেষ্ট।

কান্তজী মন্দির নির্মিত হয়েছে ১৭৫২ সালে এবং পুঠিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরটির নির্মান কাল ১৬১৬ সাল বলে মনে করা হয় (বড় গোবিন্দ মন্দির প্রাচীন বলে মনে করা হয়)। কান্তজী মন্দিরের টেরাকোটায় সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের ইমেজ পাওয়া যায় (যেমন- বাঘ শিকার, রাজ্য জয়, মোঘল সম্রাটের যুদ্ধ যাত্রা ইত্যাদি)। কিন্তু, পুঠিয়া মন্দিরের সে ধরণের কোন ইমেজ পাওয়া যায় না। এখানে শুধু পৌরাণিক মোটিফযুক্ত ইমেজই পাওয়া যায়। হতে পারে এটি শিল্পীর ব্যক্তিগত চিন্তা শক্তির স্বল্পতা বা পৃষ্ঠপোষকগণের ইচ্ছা এবং রুচি।

অবশ্য- এসব অর্ডারী কাজে শিল্পীর যে খুব একটা স্বাধীনতা থাকে তাও বলা যায় না। তবে কান্তজীর মন্দিরেও যে- সমকালীন বিষয় খুব একটা প্রাধান্য পেয়েছে তাও নয়। সমকালীন বিষয়গুলো পৌরাণিক বিষয়কে অতিক্রম করতে পারেনি। কান্তাজী মন্দিরে বেদীর দিকে (নিচে) কিছু টেরাকোটায় শুধু সমকালীন কিছু বিষয় এসেছে। তাছাড়া গোটা মন্দিরই পৌরাণিক কাহিনীর ইমেজে এ ভরপুর।

এই দিকটিকে টেরাকোটার শিল্পের বিশেষত মন্দির গাত্রের টেরাকোটার দুর্বল দিক বলা যেতে পারে। কারণ, আমাদের প্রায় সবযুগের সাহিত্যেই সমসাময়িক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। দেব-দেবীর কাহিনী লিখিত হলেও সেখানে সমাজের কথা এসেছে, এসেছে বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-সংস্কারের কথা, অর্থনৈতিক অবস্থার কথা, রাজনৈতিক অবস্থার কথা। কিন্তু আমাদের এই বিশাল ঐতিহ্যময় শিল্পে সমকালীন সময়ের তেমন কোন চিহ্ন নেই। মন্দিরের টেরাকোটাগুলোয় স্থান পেয়েছে পৌরণিক কাহিনী এবং মসজিদের টেরাকোটাগুলোয় স্থান পেয়েছে ফুল, লতাপাতা, আলপনার মোটিফ।

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, মন্দির বা মসজিদ সব জায়গার টেরাকোটা নির্মাণে ধর্ম একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মন্দিরে দেবতাদের মূর্তি থাকবে এই নিয়মের বাইরে কেউই যেতে পারেনি। মসজিদের টেরাকোটাগুলোয় শুধু লতাপাতা, ফুল, আলপনা স্থান পেয়েছে। কারণ, ইসলাম ধর্মে জীবন্ত কোন কিছুর ছবি আঁকা বা মূর্তি বানানো নিষিদ্ধ। এই নিয়মেরও বত্যয় ঘটেনি কোথাও।

এখানে অবশ্য ধর্মের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সামাজিক মানসিকতা এই ধর্মীয় সংস্কৃতিই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। তখনও ধর্মনিরপেক্ষ অনেকেই ছিলেন। এ কারণেই কান্তজী মন্দিরের টেরাকোটায় অল্প পরিমাণে হলেও সমকালীন বিষয় এসেছে। পুঠিয়ার টেরাকোটা শিল্প আমাদের শিল্প চেতনার গৌরবময় একটি নিদর্শন।

এগুলো শিল্প সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। বাঙালির শিল্প সচেতনতার, সৃজনশীলতারও যে একটি গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে, তারই মূর্ত প্রতীক এই টেরাকোটা শিল্প। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলা, উপযুক্ত সংরক্ষন ব্যবস্থার অভাব, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে এই ঐতিহ্যময় শিল্প বিনষ্ট হতে চলেছে। ছবি: মানিক হাসান লেখাটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের পত্রিকা ‌‌'‌ব্রাত্য'র জন্য লিখিত।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।