আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কারাম পরব (উৎসব): এর আদ্যপ্রান্ত ::: উত্তরবঙ্গের প্রায় ৩৮টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব (শেকড়ের সন্ধানে)

[img|https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/images/thumbs/nostalzia_1368958868_1-Karam_cover.jpg কারাম পরব (উৎসব) আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের একটি ঐতিহ্যবাহি উৎসব। আদিবাসী জাতিস্বত্তা যেমন ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, মালো, মাহাতো, রাজোয়াড়, ভূমিজসহ প্রায় ৩৮টি জাতিস্বত্ত্বার মানুষ কারাম উৎসব পালন করে থাকে। কারাম উৎসবটি ভাদ্র একাদশীতে হয় বলে উত্তরবঙ্গে এটি কারাম পরব ও ভাদই পরব নামেও অভিহিত। কারাম পরবের অর্থ বৃক্ষের পূজা উপলক্ষ্যে উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সমাজের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী হয়ে ওঠে নৃত্যচঞ্চল, সঙ্গীতমুখর ও পানাহারে মত্ত।

ভাদ্র মাসে এই ব্রত উদযাপন করা হয়। উত্তরবঙ্গের প্রায় সকল আদিবাসী গ্রামেই কারাম পরব পালন করা হয়। তবে দিন দিন নানা কারনে কারাম পরব তার নিজস্ব জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের গণসংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ১৯৯৪ সাল থেকে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় কারাম পরব পালনের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আজ প্রতিবছর সেখানে হাজার হাজার আদিবাসী ও বাঙ্গালিদের মাঝে উৎসবের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আদিবাসীদের ভেতর নানান আয়োজনে কারাম উৎসবটি পালিত হয়।

গ্রামের দশ জন মিলে যখন ভাদ্রের একাদশীতে কারাম করা হয় তাকে দাশ কারাম/দশ কারাম/দাশাহার কারাম বলে। পারিবারিক ও ব্যাক্তিগতভাবে আয়োজিত কারাম আপান কারাম নামে পরিচিত। কারাম পরবের ভেতর সবচেয়ে কঠিন হল জিতিয়া কারাম। এতে সাতটি ঘিয়ের বাতি লাগে, তাছাড়া এটি আয়োজন করতেও প্রচুর খরচ হয়। মনসা পূজার পরের দিন অর্থাৎ ভাদ্র সংক্রান্তিতে এটি আয়োজিত হয়।

ভাদ্রের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত আয়োজিত কারামই হল ভাদই কারাম, এটি দশে মিলে করা হয় বলে দাশ কারাম নামেও পরিচিত। শারদীয় দূর্গাপূজার সময় আদিবাসীরা আয়োজন করেন দশমীতে দাশাই কারাম। দূর্গাপূজার দশমীতে মাদল ও টামাক (নাগরা) বাজিয়ে সাঁওতাল নারী-পুরুষেরা দাশাই নাচের আয়োজন করে। ভাদ্র মাসের অন্ধকারে (অমাবস্যা) অষ্টমী তিথিতে জিতিয়া কারাম করা হয়। এটি জিমুত বাহান নামেও পরিচিত।

তবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে অধিকাংশরাই কারাম করেন ভাদ্রমাসে। কারাম গাছকে কেন্দ্র করেই কারাম উৎসবের আয়োজন। প্রতি আদিবাসী গ্রামের এক বৈশিষ্ট্যময় চিহ্ন হল এই কারাম বৃক্ষ। পবিত্র এই গাছকে কারাম পরবের ভেতর দিয়েই আদিবাসী নারী-পুরুষেরা বংশ থেকে বংশে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আগে প্রায় বাড়িতেই কারাম গাছ ছিল।

কিন্তু এখন অনেক গ্রামেই কারাম গাছ নেই। ভাদ্র মাসে এর গাছভর্তি কদমের মতো রোয়া ওঠা একধরনের হলুদ রঙের ফুল থাকে। বাংলাদেশে ওঁরাও-সাঁওতাল-মুন্ডা আদিবাসী গ্রাম ছাড়া প্রাকৃতিক বনে এই গাছ একেবারেই বিলুপ্ত। নিুে উল্লিখিত ধাপে কারাম পূজা কিভাবে সম্পন্ন হয় তা বর্ণনা করা হল: ১. জাওয়া জাগানো পর্ব কারাম উৎসবের একেবারে শুরুই ঘটে জাওয়া জাগানোর মাধ্যমে। যদি ভাদ্র মাসের একাদশীর দিন কারাম পূজার আয়োজন ঠিক করে গ্রামের দশজন মিলে তবে এর তিন/পাঁচ/সাতদিন আগেই অবিবাহিত কিশোরীরা জাওয়া ডালি বসায়।

গ্রামের আশেপাশে যেসব জমিনে ফসল ফলে সেই জমিনের মাটি নিয়ে এসে একটি বাঁশের ডালিতে রাখা হয়। বিভিন্ন জাতের যব-হলুদ-মাষকালাই-ধান-ডাল সহ শস্য ফসলের বীজ সেখানে পুঁতে রাখা হয়। মূলত একটি বাড়িকে কারামের বাড়ি নির্বাচন করা হয়, গ্রামে যার বাড়িতে কারাম গাছ থাকে এবং যে পরিবার নিয়ম আচার পালন করে কারাম পরব পালন করবে, যার বংশে কারাম করার সামাজিক অধিকার আছে সেই বাড়িতেই জাওয়া জাগানো হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কিশোরীরা স্নান সেরে একত্রে জাওয়া ডালিতে কাঁচা হলুদ মেলানো জল ছিটিয়ে প্রার্থনা করে এবং জাওগা জাগানোর গীত গায়। এভাবে চলে প্রায় তিন থেকে সাত দিন।

বীজ থেকে অংকুর এবং চারা গজাতে থাকে। জাওয়া ডালি মানকচুর পাতা দিয়ে ঢেকে ঘরের ভেতর পবিত্র স্থানে রাখা হয়। মূলত জমিনে শস্য ফসল রোপণের পূর্বেই এই পার্বন শুরু হয়। সাদ্রী ভাষায় বন্ধুত্ব বা সই পাতানোকে জাওয়া ডালি বা ফুলনডার বলে। এটি নতুনকে বরণ করে নেয়ার একটি প্রতীকী রীতি।

কারাম পূজার দিন সন্ধ্যার সময় এই জাওয়া ডালি ঘরের বাইরে বের করে আনবে উপবাসী মেয়েরা, তারপর কারাম পূজার আখড়ায় এই ডালি রাখা হবে। এই ডালি বিসর্জন দেয়া হয় পরবের পরে। কারাম পূজার আগের দিন রাত থেকে অধিবাস করে তারপর কিশোরী মেয়েরা যারা কারামের ডাল বহন করবে তারা উপাস থাকে। ২. দুরবা ফুল আনেক পর্ব কারাম পূজার দিন উপবাসী কিশোরী ও ছোট ছেলেরা মিলে আশেপাশের গ্রামীণ বন থেকে ধানের পাতা, কাদোফুল, দুপুর ফুল, সন্ধ্যামালতী ফুল, ঠুরো ফুল (সাদা শাপলা), জবা ফুল, গোলাচি ফুল, তুলসী পাতা, দুরবা পাতা, বেলপাতা সংগ্রহ করে আনে। এগুলো দিয়ে ‘ফুলঝাড়ি’ তৈরী করা হয়।

পূজার সময় অঞ্জলি নিতে এই ফুলপাতা ব্যবহৃত হয়। কারাম পূজায় কোনো ফুটন্ত— ফুল চলে না। আবার একেবারে কচি কলি হলেও চলে না। এমন কলি নির্বাচন করতে হবে যা ফোটার সম্ভাবনায় রয়েছে। কিশোরী ও বয়:সন্ধিকালের নারীর সুরক্ষাকে বিবেচনা করেই প্রতীকীভাবে এই অফুটন্ত ফুলের ব্যবহার।

ঠুরো ফুল ওঁরাও সমাজে পবিত্র ফুল হিসেবে মান্য করা হয়। ৩. কুন্দ কামনা / চুঞ্জনা ও আশমা মেঃক্খানা পর্ব পিঠা, ইরপান বানানোর জন্য আতপ চালের গুড়ি তৈরী করা হয়। কারাম উৎসবে বাড়ি বাড়ি পিঠা বানানো হয়। তালের পিঠা, তেলে ভাজা পিঠার আধিক্য বেশী দেখা যায়। সাধারনত: নারীরা পিঠা বানান এবং উপবাসী কিশোরীরা তাদের সহযোগিতা করে।

কারাম পরবে উপস্থিত সকলকেই পিঠা খেতে দেয়া হয়। ৪. গাদ্যি আরর্খনা/আলখানা পর্ব কারামের আখড়ার ঠিক মাঝ বরাবর মাটিতে কারাম ডাল পুঁতার জন্য একটি গর্ত করা হয়। কারাম পরবে এই গর্ত ছাড়া অন্য কোথাও কারাম ডাল পুঁতা যাবে না। অন্য সময় কারাম ডাল বিসর্জনের আগ পর্যন্ত উপবাসীদের হাতেই রাখতে হবে। এই গর্ত পুরুষেরাই করেন।

প্রবীণ ওঁরাও জ্ঞানপুস্তকদের সাথে আলাপ করে দেখেছি গর্ত করার বিষয়টি তারা ভূমিজননীর নাভীতে কারাম বৃক্ষ রোপণ হিসেবে দেখেন অনেকেই। ৫. আখড়া সাজাঔনা পর্ব কারাম গাছ তলার কাছাকাছি বাড়ির উঠানে, গ্রামের খোলা প্রশস্থ স্থানে কারামের আখড়া তৈরী করা হয়। ওঁরাওদের নিজস্ব কুরুখ ভাষায় অনেকেই এখন আর কথা বলে না। সাদ্রী এবং আঞ্চলিক বাংলা মিলে একটি চলমান ওঁরাও ভাষা তৈরী হয়েছে যা চলতি সময়ে অধিকজন ব্যবহার করছেন। আখড়াকে ওঁরাওদের অনেকেই ছায়ামন্ডপ বলে।

কারাম পূজার দিন বিকালে মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা আইট্টা কলা গাছ কেটে এনে চার কোনায় চারটি কলাগাছ পুঁতে পূর্বমুখী করে এই আখড়া তৈরী করেন। এখানেই কারাম ডাল পুঁতা হয়, পূজা হয় এবং এটি ঘিরেই রাত দিন নৃত্য গীত চলে। আমপাতা দিয়ে কিশোরীরা আখড়ার চারদিক সাজায়। ঠুরো ফুলের ডাঁটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিনিসূতোর মালা তৈরী করে। চলতি সময়ে সাজসজ্জার ক্ষেত্রে পাতলা রঙীন কাগজসহ অনেকে সামর্থভেদে ডেকোরেটর দিয়ে প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জা চলে এসেছে।

উপবাসী মেয়েরা সন্ধ্যার আগেভাগে ছায়ামন্ডপের জায়গায় মাটি তুলে উঁচু বেদী তৈরী করে পুরো উঠান গোবর জল দিয়ে লেপে দেয়। আখড়ার চারধারে উঠান জুড়ে রঙীন কাগজ, আমপাতা পানখিলির মত করে ঝুলিয়ে সাজানো হয়। চলতি সময়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কারাম উপলক্ষ্যে পোস্টার প্রকাশ করে বলে ঐ পোস্টারও দড়িতে ঝুলিয়ে কারাম বাড়ির সাজসজ্জা করা হচ্ছে। ৬. ডাঢ়ি বাছনা পর্ব র্কারাম পরবের এক উল্লেখযোগ্য দিক কারামের ডাল বাছাই করা। প্রতি বছর একটি গাছ থেকে যদি কারাম ডাল কাটা হয় তবে গাছটির পরবর্তী অবস্থা কি হবে তা বিবেচনা করে ডাল বাছাই করা হয়।

যে ডাল কাটলে গাছের ক্ষতি হবে না, গাছের সহজাত বৃদ্ধি ও বিকাশ হবে সেরকম ডালই বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে ওঁরাও সমাজের প্রবীণ নারী ও পুরুষের মতামত ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। ৭. কারাম মান্যে পূজা পর্ব ঠিক সন্ধ্যায়, ভাদ্র মাসের একাদশীর চাঁদ কারাম গাছের পিছনে গ্রাম আলোকিত করে দাঁড়ায়। যার বাড়িতে কারাম গাছ আছে বা সমাজ থেকে যারা কারাম পালনের নিয়ম পেয়েছেন সেই বাড়ির পুরুষ কর্তাই কারাম পূজা করেন। এক্ষেত্রে বাঙালি হিন্দুদের বড় আয়োজনের পূজার মত বর্ণ ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন নেই।

যিনি পূজা করেন তিনি গোসাই/কাথনি কাহেক/কিচ্ছা কাথেক/ঠাকুর নামে পরিচিত। সন্ধ্যার সাথে সাথে ঠাকুর কারাম গাছ তলায় আসেন। গাছ তলায় মাটিতে তিনটি ‘দেশী বাংলা পান’ চিত করে রেখে তার উপর তিনটি সিঁদূর ফোঁটা, আস্ত সুপুরী, বাতাসা রাখেন। ঠাকুর কুরুখ/সাদ্রী ভাষায় মন্ত্র বলে বলে কারাম গাছের গায়ে সাদা সূতা বাঁধেন। এ সময় ঠাকুর মূলত আগে থেকে দশে মিলে নির্বাচন ও বাছাই করে রাখা ডাল কাটার জন্য কারাম বৃক্ষের কাছে পুনরায় অনুমতি প্রার্থনা করেন।

৮. মান্যে খান্ডাগে শাপঢ়ার না পর্ব ডাল কাটার জন্য ঠাকুরের পরিবারের কাউকে নির্বাচন করা হয়। যে ডাল কাটে তাকে অনেকেই মোড়ল বলে। সাধারনত অবিবাহিত কিশোরদেরই এক্ষেত্রে প্রাধান্য থাকে। তাকেও সকাল থেকে উপাস থাকতে হয়। কারাম গাছের নিচে পূজার পর ঠাকুর একটি নতুন গামছা বা কাপড় ছেলেটির মাথায় বেঁধে দেন।

তারপর তার হাতে কাটনি দা তুলে দেন এবং কাঁচা হলুদে রাঙানো কাপড়ের টুকরা। এটি মূলত ডাল কাটার জন্য ডাল কাটুনির সাজসজ্জা ও প্রস্তুতি পর্ব। কারন একবারে যদি ডাল না কাটে বা ডাল কেটে নিচে ফেলার সময় যদি তা কেউ না ধরে তবে অমঙ্গল হয়। তাই এক্ষেত্রে খুব সাবধানে থাকতে হয়। চলতি সময়ে ওঁরাও গ্রাম গুলোতে খুব প্রাচীন ও প্রবীণ কারাম বৃক্ষ নেই তাই কম বয়েসী নরম ডালের কারাম গাছে উঠাও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

৯. ডাঢ়ি খান্ডনা পর্ব কারাম গাছে উঠে ছেলেটি প্রথমেই নির্বাচিত ডালগুলোতে কাঁচা হলুদ রাঙানো কাপড় বেঁধে দেয়। তারপর নির্বাচিত তিনটি/পাঁচটি/সাতটি বেজোড় সংখ্যক ডাল কেটে ফেলে সে। ডাল কাটার সময় উপবাসীরা নিচে দাঁড়িয়ে গীত গায়। ডাল কাটার গীত ওঁরাওদের একটি প্রচলিত আনুষ্ঠানিক রীতি। ১০. ডাঢ়ি চিইঃনা পর্ব উপবাসী কিশোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা উপবাসী মেয়েদের হাতে দেয়।

এক্ষেত্রে যাদের হাতে ডাল এসে পড়ে বা যারা ডাল ধরতে যায় তারাই কেবলমাত্র বছরের কারামের জন্য কারাম ডাল বহনের অধিকারী হয় একেবারে বিসর্জন পর্যন্ত। এই ডাল নেয়ার সময়ও ভিন্ন গীত আছে যেখানে মেয়েরা ডাল বহনের জন্য নিজেদের ভাগ্যসম্পন্ন মনে করে। পরবর্তীতে ডাল নিয়ে তারা গীত গেয়ে গেয়ে যে ছেলে ডাল কেটেছে তার বাড়িতে গিয়ে তার থাকার ঘরের চালের উপর তিনটি ডাল রেখে তাদের বাড়ির উঠানে গীত গেয়ে গেয়ে নাচে। এসময় উপবাসী অন্য কিশোরীরাসহ অনেক নারী-পুরুষ-শিশু তাদের সাথে থাকে। ডাল তিনটি রেখে কিশোরীরা আবার ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসে।

১১. ধাবা মাইঃয়া উইনা পর্ব ঘরের চাল থেকে ডাল তিনটি নামানোর দায়িত্ব ছেলেটির। ছেলেটির বাড়িতে তখন কারাম পূজার জন্য থালি সাজানো হয়। এটি করেন বিবাহিত নারীরা। একটি কাঁসার থালায় সলতে ও তেলসহ মাটির প্রদীপ, ২টি তেলের পিঠা, ধান-দূর্বা, বাতাসা, সিদূর, ধূপ, কাদো ফুল, চিড়া, কাঁচা হলুদ রাঙানো কাপড় দিয়ে পূজার থালি সাজানো হয়। ঘরের চাল থেকে ডাল গুলো নামিয়ে আবার ছেলেটি উপবাসী তিনটি মেয়ের হাতে দেয়।

তারপর সকলেই ডাল, পূজার থালি এবং জাওয়া ডালি নিয়ে কারাম আখড়ায় প্রবেশ করেন। ততক্ষণে পূজার এলাকায় আলোর ব্যবস্থা করা হয়। আগেরদিনে হারিকেন বা হ্যাজাক বাতি জ্বালালেও চলতি সময়ে বৈদ্যুতিক বাতি বা জেনারেটর দিয়ে বাতি জ্বালানো হয় অধিকাংশ এলাকায়। ১২. কারাম ডাঢ়ি গাঢ়না পর্ব কারাম ডাল রোপণের পর্বটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষেরা গলায় মাদল নিয়ে বাজাতে থাকেন, নারীরা উলুধ্বনি দেন।

মেয়েরা কারাম ডাল পুঁতার গীত করে। মেয়েরা কারাম ডাল তিনটি আখড়ার ঠিক মাঝখানে আগেই গর্ত করে রাখা স্থানে পুঁতে দেয়। ডালের নিচের দিকে ঠাকুর তেলের পিঠা গুঁজে দেন। সামনে প্রদীপ বাতি, ২টি পান সুপুরী, বাতাসা এবং পূজার থালি রাখা হয়। ১৩. কারাম ডাঢ়ি পূজা পর্ব কারাম পূজার শুরুতেই ঠাকুর কারাম ডালে হলুদ রাঙানো কাপড় ও সূতা বাঁধেন।

তারপর উপবাসী মেয়েরা জাওয়া ডালিটি পূজাস্থলে বামদিকে রাখে। প্রতিজন উপবাসী মেয়ের হাতেই একটি কাঁসার থালায় কাঁচা হলুদে রাঙানো কাপড় জড়ানো কচি শোস (শসা), দূর্বা, আতপ চাল, পিঠা, চিড়া, প্রদীপ বাতি থাকে। এ থালিকে বরবতি বা উপবাসের থালি বলে। কারাম পূজায় কচি শসার ব্যবহার খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই শসা সন্তানের প্রতীক।

ক্ষীরা-শসা যেমন ভাল ফলে তেমনি যেন ফলবতী সন্তানবতী হয় সকলে এই আশা নিয়েই কারাম পূজা করে অনেকে। তাই গীতের মধ্যে বলে, আঠারি পাঠারি ক্ষীরা খয়সামি একাদশী কারাম। খয়সামি মানে কাপড়ের কোচড়। কাপড় দিয়ে শসা যেমন জড়িয়ে রাখা হয়েছে। এটিই মায়ের কোচড়।

যেন মায়ের কোচড় ভরে সন্তান আসে সুস্বাস্থ্য নিয়ে। বরবতি নিয়ে গীত গেয়ে মেয়েরা তিনবার কারাম আখড়া প্রদক্ষিন করে। তারপর তারা উপবাসের থালি সামনে রেখে গোল হয়ে কারাম আখড়ার চারদিকে বসে। এসময় অন্যারা উঠান জুড়ে বসে পড়ে। ঠাকুর মন্ত্র পড়েন এবং সকলেই কারাম পূজায় অঞ্জলী দেয় এবং প্রণাম করে।

এ পর্বে কারাম ডালের দিকে উপবাসী মেয়েরা ফুলঝাড়ি থেকে ফুল পাতা ছিটিয়ে দেয়। পূজার পরে প্রবীণ কোনো নারী বাটিতে হাঢ়ি (ওঁরাওদের ভাত থেকে বানানো ঐতিহ্যগত পানীয়) ঢেলে ঠাকুরকে খেতে দেন। তারপর প্রায় পুরুষেরাই হাঢ়ি পান করেন। কারাম পূজা শেষ করার পর উপবাসীরা গান করে। ১৪. কাথনি তেংগনা পর্ব এ পর্বের শুরুতে উপবাসী মেয়ে ও কিছু ছেলেরাও ঠুরো ফুলের মালা কারাম ডালে পরিয়ে দেয় এবং আগত সকল অতিথিকে ঠুরো ফুলের মালা পরায়।

তারপর তারা গোল হয়ে কারাম আখড়ার চারদিকে বসে। আগত সকলেই উঠান জুড়ে বসে পড়েন। এসময়েই কাথনি কাহেক/ঠাকুর/প্রবীণ কোনো পুরুষ কারামের ঐতিহাসিক কাহিনী বলা শুরু করেন। উপস্থিত সকলের সাথে প্রশ্ন-উত্তর এবং নানান ঢঙে কারামের কাহিনী বলতে থাকেন কথক। মাঝেমাঝে কারামের ডালের দিকে ফুল পাতা ছুঁড়ে মারে উপবাসীরা,নারীরা উলুধ্বনি দেন।

কিচ্ছা বলার সময় সকল বাদ্যযন্ত্র আখড়ার কাছাকাছি রাখা হয় বাজানো হয় না। কিচ্ছা শেষে উপবাসীরা পিঠা-চিড়া-ফলমূল খেতে পারে কিন্তু ভাত খেতে পারে না বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত। কাথনি-১ (কারাম এর গল্প) ‘ধারমা এবং কারমা উঁরাওদের দুই ভাই ছিল। কারমা মাঠে কাজ করে, অন্যদিকে ধরম কারামপূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন ধারমা কারাম পূজা করে নৃত্য-গীতে এমনি বিভোর হয়ে পড়ে যে, মাঠ থেকে ফিরে এসে করম ধারমার এহন আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং কারাম শাখাগুলো রাগ করে পানিতে নিক্ষেপ করে।

কিন্তু এরপর থেকেই কারমার হৃদয়ে শুরু হয় ভাবোন্মাদনা। সে কোনো কিছুতেই শান্তি পায় না। বাধ্য হয়ে ধারমা এবং কারমা দুভাই একত্রে মিলে কারাম বৃক্ষের উদ্ধারের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারা সাতদিন অনাহারে অনিদ্রায় চলতে থাকে নদীর কূল বেয়ে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় অতিষ্ঠ হয়ে দু’ভাই নদীর পানিতে নেমে পানি পান করার চেষ্টা করে।

কিন্তু তাদের ভাগ্যে পানি পান করা সম্ভব হয়না। কারন দেখা যায় পানিতে শুধু পোকা আর পোকা। বাধ্য হয়ে তারা আবার চলতে থাকে নদীর কূল বেয়ে। আরো সাত দিন সাত রাত চলার পর তারা সামনে দেখতে পেল একটা কূল(বরই) গাছ। অসংখ্য কুল পেকে আছে গাছে।

তারা অধীর আগ্রহে অনেকগুলো পাকা কূল সংগ্রহ করলো এবং খাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু না, এখানেও তাদের ভাগ্যে ফল খাওয়ার সৌভাগ্য হলো না। দেখা গেল প্রতিটি কুলেই শুধু পোকা আর পোকা। পুনরায় তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অতিষ্ঠ হয়ে কারাম বৃক্ষের শাখার সন্ধানে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। কেটে গেল আরো সাত দিন সাত রাত।

অকস্মাৎ সামনে দেখতে পেল একটি আমগাছ। সে গাছেও অসংখ্য আম পেকেছিল। তারা আশান্বিত হলো আম খেয়ে উদর পূর্তি করবে। দেবতার অভিশাপ তাই আম খাওয়াও তাদের ভাগ্যে জুটলো না। দেখা গেল প্রতিটি আমে পোকায় ভর্তি।

তারা দেবতাকে স্মরণ করলো পাপের মার্জনাও কামনা করলো। এর ফলে কিছুদূর গিয়েই দেখতে পেল কারামবৃক্ষের শাখা ভেসে যাচ্ছে। পানিতে নামলো এবং শাখাগুলো নিয়ে গৃহের দিকে যাত্রা করলো। গৃহে প্রত্যাবর্তন করে দেখলো সবাই তাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। দু’ভাই তাদের সান্ত্বনা দিল এবং সকলে মিলে কারাম বৃক্ষের শাখা সেবায় নিয়োজিত হলো।

তখন থেকেই শুরু হলো কারাম বৃক্ষের আরাধনা। ’ কাথনি-২ কারমা মানে একজন মানুষের নাম বা মানুষের কর্মকে বোঝায়। ধার্মা মানে যাহা মানুষ ধরে রাখে বা ধারণ করে বা একজন মানুষের নাম বোঝায়। কার্মা-ধার্মা দুইভাই, কার্মা বড় আর ধার্মা ছোট ভাই। দুই ভাই পিতার রাজ্য সমানভাগে অর্দেক করে অংশ অনুসারে নিজ নিজ প্রজাসহ রাজ্য পরিচালনা করতে থাকে।

ধার্মা প্রজাদের সুখের জন্য সকল প্রজাদেরকে ডেকে পরামর্শ করলেন যে, দেশের মাঝে অনাবৃষ্টি দেশে ফসল নাই কি করা যায়? অনাবৃষ্টির জন্য মাঠঘাট সব মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রজাদের ঘরে খাবার নেই। ধার্মা রাজাকে প্রজারা বিদেশে বাণিজ্য করতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ধার্মা রাজা রেঙ্গুন দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যান এবং রেংগুনের রাজার কাছে উপস্থিত হন। উপস্থিত হয়ে তিনি মহারাজকে বলেন, গোড়লাগি মহারাজ।

তিনি রেংগুন রাজাকে অনাবৃষ্টির কথা জানান। রেংগুনরাজা প্রজাসহ ধার্মা রাজাকে দেশে ফিরে গিয়ে আনন্দ করে কারাম গাছ লাগাতে পরামর্শ দেন। রেংগুন রাজা বলেন, কারাম গাছ লাগালে দেশে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। দেশে ফসল হবে প্রজাদের দু:খ থাকবে না। আর আপনাকেও বাণিজ্যে আসতে হবে না।

আপনার দেশে শান্তি ফিরে আসবে। প্রজার মুখে হাসি ফিরে আসবে। এই কতা শুনে ধার্মা রাজা নিজ রাজ্যে ফিরে এসে সকল প্রজাকে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আমন ধানের চাষের পর মানুষ যেসময় অবসর থাকে সেই সময় ভাদ্রর একাদশী তিথীতে এই কারাম বৃক্ষরোপণ করে নারী-পুরুষ যুবক-যুবতী সকলে আনন্দ করে। এইভাবে ধার্মারাজা ধারণ করে অতীব সুখে প্রজাদের পালন করেন। অপরদিকে কার্মা রাজা কোন কর্ম না করে নিজ রাজ্যের ভাগের গাছ-গাছালি কেটে লাকড়ী বাজারে বিক্রি করে নিজের দিন পথ চলে না।

তারপরে কার্মা বাণিজ্য করে দেশে ফিরে আসে। সে সময় ধার্মা ভাদ্র মাসের একাদশী তিথী মোতাবেক কারাম উৎসবে মেতে ছিল। তার বড়ভাই এসে দেখে সে নাচ গানে পাগল হয়ে আছে। বড় ভাইয়ের মনে এটা সহ্য হয় না। তিনি রাগ করে হাত দিয়ে তুলে পাক মেরে সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারে ফেলে দেয়।

ধার্মা ঐ বৃক্ষ রোপণ কারাম উৎসব ধারণ করে থাকল। আর কার্মা বৃক্ষরোপণ না করে বৃক্ষনিধন শুরু করল। কয়েক বছরের মধ্যে কার্মা রাজা ভিখারী হয়। একদিন ভাতের জন্য কার্মা রাজা ও তার স্ত্রী এসে কাজ করে। খাওয়ার সময় খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেলেও কার্মা ও স্ত্রীর ভাগে খাবার জোটেনি।

রাগ করে তারা কাজের জায়গায় আকাম করতে থাকে। তখন একজন বিধাতা আসেন এবং বলেন কেন তোমরা এমন করছ? তখন তারা বলে আমরা ভালভাবে কাজ করার পরও আমাদের দুজনকে খেতে দেওয়া হয় নাই। তখন বিধাতা বলেন, তোমরা পিছনে গিয়ে দেখো আরো ভাল ভাবে কাজ হচ্ছে। তারা দুজনেই বিধাতার পায়ে পড়ে বলে কি ব্যাপার? তখন বিধাতা বলেন, ধার্মা বৃক্ষরোপণ করে ধর্ম করল আর তুমি তা অবহেলা করে তুলে পাক দিয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে ফেলেছ। তা যদি আবার তুলে এনে ধার্মার মতো করতে পার তবে তোমার সুখে দিন যাবে।

তুমি ফিরে গিয়ে তোমার ভাইয়ের মত কারাম উৎসব কর। অনাহার অবস্থায় ওখান থেকেই কার্মা ছুটান দিল কারাম আনতে। যেতে যেতে একখানে গোয়ালপাড়া পাওয়া যায়। সেখানে কার্মা দুধ খাওয়ার আশা করে। কিন্তু সেখানে গাই আনতে বাছুর ছুটে যায় অন্যদিকে।

আবার বাছুর আনতে গাই ছুটে যায় আরেকদিকে। এভাবে ঐখানেও কার্মাকে দুধ খাওয়া হয় না। কার্মা চলে যাওয়ার উপক্রম হলে গোয়াল বলে ভাই কার্মা তুমি কোথায় যাবে? কার্মা বলে আমার কারাম সাতসমুদ্র তের নদীর পার চলে গেছে। সেটা আমি ফিরাইয়া এনে কারাম উৎসব করবো। গোয়ালা বলে ভাই কার্মা আমি কোন একজন মানুষকে একটা দুধ খাওয়াইতে পারি না আমার এ অবস্থা কেন? আমার জন্যও একটা কারাম ডাল নিয়ে এসো ভাই।

কার্মা বলল আচ্ছা ভাই। গোয়ালপাড়া থেকে যেতে যেতে কার্মা এবার চিড়াকুটি পাড়া পায়। একটু বসে সেখানে একটু চিড়া খাওয়ার আশা করে। সেখানে যারা চিড়া কুটছে তারা চিড়া কুটছে তো চিড়া কুটছেই। তারা কার্মাকে একটু চিড়া খেতে দিতে পারে না।

কার্মা বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে যাবে এমনসময় চিড়াকুটি মানুষেরা কার্মাকে জিজ্ঞেস করে ভাই কার্মা তুমি কোথায় যাবে? কার্মা জবাব দেয়, আমার কারাম সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে এনে কারাম উৎসব করবো। চিড়াকুটিরা বলে ভাই কার্মা আমরা কেন কাউকে একটু চিড়া খেতে দিতে পারি না তার একটা বিহিত ব্যবস্থা নিয়ে এসো। কার্মা বলে আচ্ছা আমি এর একটা বিহিত ব্যবস্থা নিয়ে আসবো। এই বলে যেতে যেতে একটি ডুমুর গাছ পায়। গাছে অনেক ডুমুর পাকা অবস্থায় পড়ে আছে।

কার্মা অনেক ডুমুর কুড়িয়ে নিয়ে একটা একটা করে ভাঙ্গে আর দেখে ভেতরে অনেক পোকা। কার্মার ওখানে খাওয়া হল না, সব ডুমুর ফেলে দিয়ে আবার যাওয়া শুরু করে। তখন ডুমুর গাছ বলে, ভাই কার্মা আমার এত সুন্দর ফল কিন্তু কেউ খায় না। আমার ভেন্তি আমাকে এসে সৎকথা একটু বলে যেও ভাই। কার্মা বলে আচ্ছা আমার মুখের কথা একটু বলো যাবো ভাই বলে কার্মা আবার পথ চলা শুরু করে।

যেতে যেতে একটা বইর গাছ যায়। গাছের গোড়ায় অনেক বইর আছে কিন্তু যেটা ভাঙ্গে সেটাতে পোকা। এইভাবে কার্মার আর খাওয়া হয়না। আবার যখন সে ওখান থেকে যাওয়ার জন্য পথ ধরবে তখন বইর গাছ বলে, আমার ফল যেমন তুমি খেতে পারো নাই এরূপ অনেক মানুষ আমার ফল দেখে খেতে পারে না। এর কারন কি? এটা একটু জেনে এসে বলো ভাই।

কার্মা বলে অবশ্যই বলে যাবো ভাই। এই বলে সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করে। যেতে যেতে একটা নতুন পুকুরের পাড়ে গিয়ে রাত লাগে। সেখানে রাত থাকার পর সকালে ভাবে একটু পুকুরের জল খাবে। কিন্তু যেই জলে হাত দেয় দেখে ছোট ছোট পোকা।

তার আর পুকুরের জল খাওয়া হয় না। যখন চলে যাবে তখন পুকুরের মালিকের সঙ্গে দেখা। মালিক বলে কার্মা ভাই তুমি কোথায় যাবে? সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে আমার কারাম গোসাই আছে আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে যাবো। ফিরে এসে আমি কারাম উৎসব করবো। পুকুরের মালিক বলে ভাই কার্মা আমার এই নতুন পুকুরের জল একটিও মানুষ খায়না।

এর একটা বিহিত কথা দয়া করে বলো ভাই। কার্মা ওখান থেকে আবার পথ যাওয়া শুরু করে। যেতে যেতে এবার সাত সমুদ্রের পারে কার্মা উপস্থিত হয়ে দেখে সেখানে কোনো নৌকা নাই। তাহলে কেমনে ওপাড়ে যাবে। সমুদ্রে এক রাঘববোয়াল মাছ ঘোরাফেরা করছে।

সে বলে কি ভাই? কার্মা বলে আমি ওপাড়ে যাবো ভাই। রাঘববোয়াল বলে ভাই কার্মা আমার ঘাড়ে উঠো আমি তোমায় পাড় করিয়ে দেব। কার্মা রাঘববোয়ালের ঘাড়ে চাপে। ওপার হওয়ার সময় রাঘববোয়াল বলে ভাই কার্মা আমি জলে ডুবে আহার করতে পারিনা। আমার এমন অবস্থা কেন এর বিদান শুনে এসে আমাকে বলে যেও ভাই।

কার্মা বলল আচ্ছা ভাই। তারপর কার্মা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কারাম গাছের সন্ধান পায়। কারাম বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করে বলে আমি ভুল করেছি। আমার ভাই নিজ রাজ্যে বৃক্ষরোপণ করেছে সেখানে জলবৃষ্টি হচ্ছে। আর আমার রাজ্য মরুভূমি হয়ে প্রজারা হাহাকার করছে।

তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমি কারাম উৎসব করবো প্রজাদের মুখে হাসি আসবে। এই বলে কারাম গাছ নিয়ে কার্মা দেশের পথে রওনা দেয়। পথে সবাইকে তাদের বিধান শুনিয়ে শুনিয়ে যায়। প্রথমে সমুদ্রে এসে রাঘববোয়ালকে বলে তুমি অনেক মানুষ খেয়েছে। মেয়ে মানুষের অনেক সোনাদানা তোমার পেটের মধ্যে আছে।

তুমি যদি তা বের করে দিতে পারো তবে তোমার সব ভাল হয়ে যাবে। রাঘববোয়াল বলে ভাই কার্মা তুমি আমার উপকার করেছ। রাঘববোয়াল পেটের সব সোনাদানা বের করে কার্মাকে দিয়ে দেয়। তারপর কার্মা আসে পুকুর মালিকের কাছে। পুকুর মালিককে কার্মা বলে ভাই তুমি পুকুর কেটে একসন্ধ্যা গরীব লোকদের খেতে দেওনাই তাই তোমার পুকুরে মাছ চাষ হয় না আর জলের ভেতর পোকা।

তুমি যদি কাউকে খোলামনে সেবা দাও তবে তোমার সমস্যা দূর হবে। মালিক বলে ভাই কার্মা তুমি যদি একটু সেবা নাও বলে সেবা দেয়। কার্মা অনাহারে ছিল বলে পেট ভরে খেয়ে নিল। এবার বইর গাছের কাছে এসে বলে ভাই তোমার গোড়ায় অনেক সোনা আছে সেটা যদি কাউকে দিতে পারো তবে তোমার পোকা থাকবে না। বইর গাছ বলে তুমি আমার উপকার করেছ এগুলো তুমি নিয়ে যাও।

এবার ডুমুর গাছের নিকট গিয়ে বলে তোমার গোড়ায় অনেক আগের মানুষ ডাকাতের ভয়ে সোনা রেখেছিল তারা কেউ নাই। এই ফলগুলি যদি কাহাকে দিতে পারো তবে তোমার ফল মানুষ খাবে। বইর গাছ কার্মাকে সোনা দিয়ে দেয়। এবার চিড়াকুটি পাড়ায় এসে বলে তোমরা অনেক দিন ব্যাবসা করো কিন্তু কোনোদিন কাউকে ফাও একটু চিড়া দেও নাই। তারা কার্মাকে খাওয়ার জন্য কোচড় ভরে চিড়া দিয়ে দেয়।

এবার গোয়ালার কাছে এসে কার্মা বলে তোমাদের গোয়ালে বাছুর নাই কিন্তু গাই আছে। বাছুর ছাড়া গাই দুধ দিবে কিকরে? এই গাইট যদি তোমরা কাউকে দান করতে পারো তবে তোমাদের সমস্যার সমাধান হবে। গোয়ালা কার্মাকে গাইটি দান করে দেয়। এভাবে নানান দ্রব্য নিয়ে কার্মার অভাব দূর হয়ে যায়। কার্মা তার রাজ্যে ফিরে আসে।

রাজ্যে ফিরেই কার্মা কারাম বৃক্ষ রোপণ করে। আর রাজ্য জুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। মাঠ ফসল ফলে। প্রজাদের মনে হাসি ফুটে। সবাই মিলে শুরু হয় কারাম উৎসব।

১৫. ডান্ডি বেচনা পর্ব কারামের প্রতি পর্বে পর্বে গীত ও নৃত্য। কারামের কাথনি/কাহিনী বলা শেষ হলেই শুরু হয় নারী-পুরুষের নাচ ও গান। রাসনে খেলা ও পাতা খেলা এ পর্বের উল্লেখযোগ্য দিক। উপবাসীদের ভেতর যদি কেউ কোনো ভুল করে বা কোনো অমান্য করে তবে তার উপর ‘পাতা’ ভর করে। গুণীক (গুণীন) মন্ত্র দিয়ে একজনকে সামনে আনেন।

তারপর সেই ভরকারী পাতাকে অনুনয় বিনয় করে দূর করেন। ডান্ডি বেচনা পর্বে গ্রামের প্রায় সকল আদিবাসী নারী-পুরুষেরাই নৃত্য-গীতে অংশ নেন। সারারাত ধরে চলে হাঢ়ি পান আর নৃত্যগীত। অধিকাংশ গান সাদ্রী ও কুরুখ ভাষায় হলেও অনেকেই বাজার চলতি ‘জনপ্রিয়’ বাংলা গান করে থাকেন। ১৬. ইরপান ছিটনা পর্ব কারাম পূজার পরের দিন সকালে বাড়ির নারীরা আতপ চালের গুড়ার সাথে জল মিশিয়ে ইরপান তৈরী করেন।

দোষ ও অমঙ্গল কাটানোর জন্য ঘরবাড়ি, গোয়াল, ক্ষেত, মাঠ, পানি, মানুষ সর্বত্র ইরপান ছিটিয়ে বা ছাপ দিয়ে দেয়া হয়। আগের দিনে বাতরাশ-ঝুলন-ঝিঙ্গাশাইল-দুধকলম-মাগুরশাইল ধানের চাল থেকে ইরপান বানানো হত। ইরপান ছিটানো কারামের একটি বৈশিষ্ট্য, এর মাধ্যমে সকল পাপ ও অমঙ্গল দূর করা হয় কারামের সময়। ১৭. এঃরপা কুদনা/ঘার ঘার গাও গাও কারাম ডাল ঘুড়ালায় পর্ব সকালে উপবাসী মেয়েরা কারাম আখড়ায় রাখা জাওয়া ডালি থেকে শস্য ফসলের অংকুরোদগম নিজেদর চুলের খোঁপায় গুজে দেয়। তারপর কারাম আখড়া থেকে কারাম ডাল থেকে ভেঙ্গে ছোট কারাম ডাল নিয়ে গীত গেয়ে গেয়ে পিঠাসহ বাড়ি বাড়ি যায়।

প্রতি বাড়ি বাড়ি কারাম ডাল নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামের সকলকে কারামের শুভময়তা ও গুরুত্ব জানানো এবং সকলকে অভ্যর্থনা জানানো। এ সময় প্রতি বাড়ি থেকে তাদেরকে পিঠা দেয়া হয়। প্রথমে তারা কারাম ডাল তিনটি নিয়ে বাড়ির উঠানে রাখে এবং নেয়ে গেয়ে বাড়ির সকলকে ডাকতে থাকে। বাড়ির গৃহস্থ নারীরা একটি পটে জল, সিদূর, হাঢ়ি নিয়ে আসেন। তিনটি ডাল তিন মেয়ে কাঁসার থালার উপর ধরে গীত গায়।

বাড়ির নারীরা প্রথমে কারাম গাছকে স্নান করান, তারপর ডালে সিদূর পরায়। এ সময় বাড়ির নারীরা কারাম ডাল বহনকারী মেয়ে এবং দলের সকলের দিকে চালের গুড়ার ইরপান ছিটিয়ে দেন। ডাল বহনকারী মেয়েদেরকে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেন। এ পর্বে রঙ ও কাদা খেলা হয় গ্রাম জুড়ে। কারো কাপড় কি শরীর কাদা, রঙ, হলুদ পানি ও পানি থেকে বাদ যায় না।

এ পর্বের পর ডাল বহনকারীসহ কারাম ঘুরাতে নিয়ে যাওয়া কাউকে আর চেনা যায় না। কিশোরীরা যখন কারামের ডাল ও পিঠা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে তখন তারা গীত গায়। ১৮. চোঃদা বাআনা পর্ব কারাম ডালবহনকারী মেয়েরা সহ পুরো দল গ্রাম ঘুড়ে পিঠাপুলি সংগ্রহ করে কাদা জল মেখে আবার কারাম আখড়ায় ফিরে এসে কারাম ডালের চারদিকে বিদায়ের নাচ গান করে। তারপর আখড়া থেকে কারাম ডাল তুলে নেয়া হয়। তারপর সবাই বিসজর্নের জন্য পুকুরের দিকে বাদ্যবাজনা ও গীত গেয়ে গেয়ে যায়।

১৯. ডাঢ়ি মুঔতাবাআনা/মুহুতৗবাআনা পর্ব কারামের বিসর্জন পর্বে পুকুর পাড়ে বাজনা বাজতে থাকে এবং একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলতে থাকে। কারামের ডাল আবার বিসর্জনের আগে ডালবহনকারী মেয়েরা মোড়ল ছেলেটির হাতে তুলে দেয়। মেয়েরা জাওয়া ডালি সহ পুকুরে নামে এবং মোড়ল ছেলেটি ডাল মাথায় নিয়ে পুকুরে নেমে ডুব দেয়। সকলেই ডুবিয়ে ভাসিয়ে দেয় জাওয়া ডালি ও কারাম ডাল। তারপর সকলেই স্নান সেরে সংগ্রহ করা পিঠাপুলি খেয়ে যার যার বাড়িতে যায়।

তারপর উপবাসী সকলেই ভাত খেতে পারে। কারাম পরব পালনের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে কিছু মিল অমিল দেখা যায়। যেমন অনেকে কারামের দিন রাতে রাসনে খেলা হয়, আবার কারাম পূজার সময় একটি লাল রঙের মোরগ বলী দিয়ে তার রক্ত কারাম ডালে ছিটিয়ে দিতে হয়। যদিও নঁওগা এলাকায় এই কৃত্যটি এখন করা হয় না। কারাম উৎসবের সবচে’ বড় বৈশিষ্ট্য এর প্রকৃতি ও প্রতিবেশঘনিষ্ঠতা।

বাংলাদেশে যেসকল ডাকসাইটে পুস্তকি ধর্মের উৎসব-পার্বণ হয় তার অধিকাংশই স্থানীয় প্রতিবেশ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বিবেচনা করে না। কারাম পার্বণের জন্য কারাম গাছ, কাদো ফুল, যব-ধান সহ নানান শস্য ফসলের বীজ, সাদা শাপলা ফুল, শসা, হলুদ, দূর্বা অবশ্যই লাগবে। এর একটি না হলে এই উৎসব করা যাবে না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রবীন্দ্রনাথ সরেন সাধারণ সম্পাদক জাতীয় আদিবাসী পরিষদ।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।