আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উন্নয়নকামী রাষ্ট্রে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষ



উন্নয়নকামী রাষ্ট্রে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষ ফকির ইলিয়াস ======================================== সংবাদটি নিঃসন্দেহে ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত। একজন গ্রামীণ জনপদের মানুষ হাসমত আলী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর শোকাতুর হয়েছিলেন খুব বেশি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন নিজের কন্যা হিসেবে। নিজ গ্রামে, প্রচুর খাটুনি খেটে অর্থ কামিয়ে একখন্ড জমি শেখ হাসিনার নামে রেজিস্ট্রি করিয়েছিলেন।

আহা! মানবতা। আহা! মানুষের প্রতি, আদর্শের প্রতি মানুষের ভালবাসা। এ সংবাদটি একটি জাতীয় দৈনিকে পড়ার পর আমি অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম, সুদূর প্রবাসে থেকেও। গ্রামীণ জনপদের একজন মানুষের এ মহানুভবতা আমাকে স্পর্শ করেছিল গভীরভাবে। এই যে খেটে খাওয়া মানুষেরা, এরাই দেশের মেরুদন্ড।

এরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশকে। হাসমত আলী আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন তার স্ত্রী রমিজা খাতুন। সেই রমিজা খাতুনের সংবাদটি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার খোঁজ নেয়ার জন্য তৎপর হন। গণভবনে তাকে ডেকে নিয়ে তার সব ব্যয়ভার শেখ হাসিনাই গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশে ভোগবাদী মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ত্যাগী মানুষের সংখ্যাই বেশি। এই যে ত্যাগী মানুষেরা, তারা কি তাদের ন্যায্য পাওনাটি পান? না, পান না। যদি পেতেন তবে এ রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা হতো বৈষম্যহীন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার জন্যই আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন।

বাংলাদেশে ভোগবাদী মানুষ ও মানসিকতার হিংস্রতা যে দিনে দিনে বাড়ছে তার সাম্প্রতিক অনেক উদাহরণ আছে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, অবৈধভাবে দখলের পেশিশক্তি। এই পেশিশক্তিকে মদদ দিচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিমন্ডল। খবরের কাগজ খুললেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গ্রুপ-উপগ্রুপের যে রক্তাক্ত মহড়া হচ্ছে তার খবর আমরা পড়ি। কিন্তু এসব মহড়ার নেপথ্য নায়করা সংযুক্ত আরও শীর্ষপর্যায়ে।

তারা এতটাই নির্ভয় যে, এসব রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সামান্য ধারও ধারে না তারা। কারণ তারা মনে করে, রাজনীতির লেবাস তাদের রক্ষা করবে। এবং সেটাই হয়। সভ্য বিশ্বে চরম দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস না পেলেও বাংলাদেশে জঘন্য দুর্নীতিবাজরা আয়েশের সঙ্গেই সময় কাটিয়ে দেয়। সম্প্রতি পুরনো ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে যে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি হয়েছে, এ নির্মমতম ঘটনা আমাদের জানান দিয়ে গেছে, সতর্ক না হলে এ জাতিকে আরও চরম মাশুল দিতে হতে পারে।

ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। একটি ভবন নির্মাণের সময় যদি তার চারপাশে অগি্ননির্বাপক গাড়ি ঢোকার পরিসর রাখা না হয় তবে সেখানে কীভাবে আগুন নেভানো যাবে? এ ভাবনাটি মাথায় না রেখেই গড়ে উঠছে স্থাপনা। গলিপথগুলোকে এতই সরু করা হচ্ছে ক্রমে, যা দেখলে রীতিমতো ভয় পেতে হয়। অথচ এসব হচ্ছে রাষ্ট্রের 'বিল্ডিং কোড' না মেনেই। যারা এটা করছে, তারা কীভাবে তা করতে পারছে? টিভিতে দেখেছি, ঢাকার কয়েকটি হেলে পড়া ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।

দু-একটা ভবন ধসের পর এমন কিছু ভাঙার কাজ সব সময়ই আমরা দেখি। অথচ একই সময়ে শহরের অন্যপ্রান্তে এ রকম আরও অনেকগুলো ভবন গড়ে ওঠে অবৈধভাবে। নিমতলীর অগ্নিকান্ডে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। তাদের তিনজন রুনা, রত্না এবং আসমা'র দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে, প্রধানমন্ত্রী নিজে মায়ের ভূমিকায় থেকে তাদের বিয়ে সম্পন্ন করেছেন।

১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটাও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মাধ্যমে মাতৃরূপা শেখ হাসিনার মহানুভবতা ফুটে উঠেছে আবারও। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ঘনবসতিপূর্ণ এ রাষ্ট্রে এমন স্বপ্নভাঙার শত শত ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। সে খবর কে রাখবে? রাখা কি সম্ভব? দুই বাংলাদেশে এখন চলছে একটি রাহুশক্তির মহড়া। সে মহড়ার কিছু চিত্র আমরা সম্প্রতি টিভিতে দেখলাম।

বাংলাদেশের রাঘব বোয়াল ভূমি ব্যবসায়ী আর গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী সম্প্রতি একটি বৈঠকে বসেছিলেন। সে বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতা এবং বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধার শাহ আলম এবং প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের সঙ্গে তুমুল বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। সভা সমাপ্ত হয়েছে সিদ্ধান্ত ছাড়াই। বাংলাদেশে কীভাবে প্লট এবং ফ্ল্যাট ব্যবসা হবে তার একটা গাইডলাইন স্পষ্ট হওয়া দরকার। এখানে ব্যবসায়ীদের সরকারি অনুকম্পা চাওয়ার যেমন সুযোগ নেই তেমনি সরকারেরও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈরীসুলভ আচরণের কোন কথা নয়।

কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি, বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই ভূমি অধিগ্রহণের সরকারি নীতিমালা মানছেন না। তারা টাকার জোরে অনেক কিছুই হালাল করে নিতে চাইছেন। তার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নিজেদের মিডিয়াশক্তি। এসব মিডিয়া দ্বারা সরকারকে, রাষ্ট্রপক্ষকে এক হাত দেখে নেয়ার একটা মানসিকতা খুব দ্রুতই বাড়ছে। মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ী নেতাদের বাকবিতন্ডার খবর কিছু কিছু মিডিয়া কীভাবে প্রকাশ করেছে তা পড়লেই কারও না বোঝার কথা নয়, কার প্রতিপক্ষ কে? বাংলাদেশের মানুষের কাজ করার উদ্যম আছে।

প্রত্যয় আছে তরুণ প্রজন্মেরও। কিন্তু একটি ভোগবাদী তৃতীয় শক্তি সব সময়ই এ প্রত্যয় এবং প্রাণশক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ভোগবাদীদের দাপট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রটি স্বাধীন হলেও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা বারবার হোঁচট খেয়েই পড়ছে। জেনে বেশ আশ্বস্ত হয়েছি এবারের বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তারা যাতে আজীবন বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারেন এমন প্রস্তাবনাও সরকার বিবেচনা করছে বলে অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে বলেছেন।

একটি কথা আমাদের মানতেই হবে, ১৫ কোটি মানুষের দেশে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুব বেশি নয়। জাগতিক নিয়মে আর ৩০-৩৫ বছর পর বাংলাদেশে কোন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকবেন না। তাই এ সময়টুকু এসব সূর্যসন্তানদের সম্মানিত করতে পারলে গোটা জাতিই সম্মানিত হবে। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, যে জাতি যত বেশি প্রত্যয়ী, যত বেশি অধ্যবসায়ী, তারাই বেশি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে পেরেছেন। আর এ প্রত্যয়ের পথে পথে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় তা সরিয়ে যেতে হয় সরকার পক্ষকেই।

বাংলাদেশে হাসমত আলী-রমিজা খাতুনের সংখ্যাই বেশি। যাদের চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি নেই। এ দেশে ভূমিখেকো অজগরদের সংখ্যা কিন্তু হাতেগোনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় সেই অজগররাই। যদি হাসমত আলী-রমিজা খাতুনরা পৃষ্ঠপোষকতা পেত তবে রাষ্ট্রের চিত্র ভিন্নরকম হতো।

যে কোন দেশের সমস্যাগুলোকে বৃহৎ বিবেচনায় সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিতে হয়। একটি-দুটি ভবন হেলে পড়লেই সবাই সরগরম হবেন, আবার সপ্তাহ-দিন পরে সবকিছু ভুলে যাবেন-তা কোন স্থায়ী সমাধান আনতে পারবে না। সামগ্রিকভাবে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হলে ভোগান্তি বাড়তেই থাকবে। নিউইয়র্ক/ ১৬ জুন ২০১০ ----------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ঢাকা।

১৮ জুন ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - ক্রিস হ্যামিলটন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.