আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালীপদ সাহা: বিহারিদের পৈশাচিক নির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী

সত্যানুসন্ধিৎসু

পাবনার ঈশ্বরদী বিমান বন্দর সড়ক যেখানে প্রায় সমকোণে বাঁক খেয়ে সাঁড়া মাড়োয়ারী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের দিকে চলে গেছে সেই বাঁকের প্রারম্ভে বাংলাদেশ রেলওয়ের পে-অফিসের সীমানা প্রাচীরের অনতিদূরে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটা লন্ড্রীর দোকান। একমনে কাপড় ইস্ত্রি করে চলেছে প্রোঢ়ত্বের শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া একটা লোক। ভীড় নেই দোকানে। একান্তই নিরিবিলি। লোকটা ডান হাতের উপর নজর পড়তেই তার হাতের কব্জির কাছে কয়েকটা বড় বড় ক্ষতচিহ্ন খুব সহজেই চোখে পড়ে।

গায়ে তার একটা সেন্ডো গেঞ্জী। গলার পাশে কলারবোনের উপরে আরো একটা ক্ষতচিহ্ন। দেখলে মনে হয় যেন কোন হিংস্র পশু স্ববলে তার তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল কন্ঠনালী ছিদ্র করার মানসে। কৌতুহলী হয়ে উঠলো মন। ধীর পায় এগিয়ে গেলাম আরও কাছে, তার ছোট্ট লন্ড্রীর দোকানের ঝাঁপের নীচে।

ওর ডান হাতটা কব্জির ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চাইলাম। হ্যাঁ, একাধিক ক্ষতচিহ্ন সেখানে, আর হাতটাও সরু সরু দেখাচ্ছে সেই জায়গাটাতে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি এদিকে। বিষন্ন গভীর দুটি চোখ। পাংশু বিষাদঘন মুখচ্ছবি।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘দাদা, কিছু বলবেন?” মনে আমার অনন্ত জিজ্ঞাসা। আদাব জানিয়ে বললাম, ‘‘দাদা, এখানে বসে একটু কথা বলতে চাই, অবশ্য যদি আপনার কাজের ব্যাঘাত না ঘটে। ” "না না, তা কেন?" জবাব দিলেন তিনি, ‘‘আপনি বসুন। ” একপাশে রাখা ছোট আকারের বেঞ্চটাতে বসে বললাম, "আসলে এ জায়গাটা আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। এর আগে এখানে তো কোনো লন্ড্রীর দোকান ছিল না।

” "না, আমি পাঁচ-ছ' বছর আগে এখানে এসেছি। ছিলাম ওই সামনে, পশ্চিম টেংরী রাস্তার মাথায়। কিন্তু ওখানে আর টিকতে পারলাম না, তাই সরে এসেছি। " জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ব্যবসা কেমন চলছে?” লোকটা মলিন হেসে বললেন, "এই চলছে আরকি!" এবার আমার কৌতুহলের কথা পাড়লাম, ‘‘দাদা, আপনার দেহে যেসব ক্ষতচিহ্ন দেখছ তাতে মনে হচ্ছে, আপনি কোন সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমার তা জানবার কৌতুহল হচ্ছে।

যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে বলবেন কি, ঘটনাটা কি ছিল?” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তারপর বললেন, "না, অসুবিধা আর কি হবে! চল্লিশ বছর তো হতেই চললো, এতো বছর ধরে এই কাহিনী বলতে বলতে ঘৃণা ধরে গেছে। " আমি বললাম, "ওই কাহিনীটাই কষ্ট করে আবার বলুন। ” মৃদু হাসলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, অনেককেই তো বলেছি, এখন আর ওসব বলতে ইচ্ছে করে না।

যাহোক, আপনাকে আর বিমুখ করি কেন? তাতে আপনিও কষ্ট পাবেন, আমিও কষ্ট পাব। " আমি তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। কালিপদ বলতে শুরু করলেন: "আমার এই ক্ষতচিহ্নগুলো একাত্তর-এ বাঙালীদের প্রতি অবাঙালীদের অত্যাচারের এক জীবন্ত ইতিহাস। যাহোক, আমার নাম শ্রী কালীপদ সাহা, পিতা স্বর্গীয় নগেন্দ্র নাথ সাহা। বর্তমানে রহিমপুরে একটা ছোট, ভাঙা বাড়িতে ভাড়া থাকি।

স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে আমার সংসার। ভাড়াবাড়ি বটে, তবে তার ছাউনি দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বর্ষায় বিছানাপত্র গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। কি করবো, এর চেয়ে ‘‘বেশি পাওয়া” যে আমার সাধ্যে কুলায় না। যাহোক, যে সময়ের কথা বলছি সে সময় ভাড়া থাকতাম বর্তমানের কাচারীপাড়ায় (যা ব্লাক পাড়া নামে পরিচিত) গফুর গার্ডের বাড়িতে।

হ্যাঁ, সেটা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ২৫ মার্চে ঢাকার বুকে পাকসেনাদের বর্বরতার পর তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে, তাদের দখল সুসংহত করতে। সে সময়ে তাদের গৃহীত পোড়ামাটি নীতি আর নির্বিচার নিধনযজ্ঞ চেঙ্গিস খাঁ, হালাকু খাঁ আর নাদির শাহের নিষ্ঠুরতাকেও যেন লজ্জা দিচ্ছিলো। বিশেষত তাদের আক্রোশ আওয়ামী লীগের লোকজন এবং এর অনুসারীদের প্রতি। তাদের হাত থেকে নিস্তার ছিল না হিন্দু সম্প্রদায়েরও।

পাক সেনারা যখন যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছলো তখন হিন্দু আর আওয়ামী লীগ পরিবারগুলো ঈশ্বরদীতে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। আমি তখন বাইশ বছরের তরুণ। দুঃসাহসী কাজের প্রতি আকর্ষণ প্রবল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গেলাম তাদের সাহায্যার্থে।

আমার নিত্য কর্ম হলো ওই সব পরিবারগুলোকে ভারত সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া। যাহোক, ঘন্টায় ঘন্টায় খবর আসছে পাক সেনারা হত্যা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে এগিয়ে আসছে ঈশ্বরদীর দিকে। লক্ষ্য করছিলাম পাক সেনারা যতই এগিয়ে আসছে অবাঙালী বিহারীরা ততই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। পাক সেনারা যখন ঈশ্বরদী ঢুকে বিমান বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে গেলো, অবাঙালীরা মিশে গেলো তাদের সঙ্গে। তখন ঈশ্বরদীতে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিহারির বসবাস।

১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর বিহার প্রদেশ থেকে এসব বিহারিরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নেয়। প্রমাদ গুণলো বাঙালীরা, অস্ত্রহাতে রুখে দাঁড়ালো তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে। নিরুপায় হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বাঙালীরা যে যার মত পালাতে থাকলো। ইতিমধ্যে অবাঙালীরা মেতে উঠেছে বাঙালীদের সহায়-সম্বল লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞে। অনেকেই সাহসে ভর করে রয়ে গেছে বাড়িতে।

আমিও তাদের শেষ ব্যবস্থা না করে বাড়ি ছাড়লাম না। লুকিয়ে রইলাম বাড়িতেই। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ভোরবেলাতেই টের পেয়ে গেল অবাঙালীরা। আমাদের পাড়ার পাশেই রেল-কলোনীতে এ-৫০ নম্বর কোয়ার্টারে থাকতো অবাঙালী পে-ক্লার্ক হামিদ।

তার ছেলে ফিকু আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকে আটক করলো। ফিকু আমার অপরিচিত নয়। কিন্তু সমস্ত পরিচয়ই তখন ঢাকা পড়ে গেছে বাঙালী ও পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অন্তরালে। নিশ্চিত মৃত্যু আমার সন্মুখে। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে কোন লাভ নেই।

তাতে মৃত্যুযন্ত্রণাই শুধু বাড়বে, এবং মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে। এমতাবস্থায় একমাত্র রক্ষাকর্তা ভগবান। তাই কায়মনে তাকেই স্মরণ করতে থাকলাম। চারদিকে চলছে অবাঙালীদের তান্ডব। লুটপাট চলছে ঘরে ঘরে।

বাঙালী নারী-পুরুষ-শিশু যাকেই পাচ্ছে তাকেই কযেকজন ঘিরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে দূরে কোথাও। চিৎকার, কান্নাকাটি আর আর্তনাদে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই আগুণ জ্বলে উঠছে কোন না কোন বাড়িতে। গৃহপালিত পশুগুলো ছুটাছুটি করছে এদিক সেদিক। কোনটা আগুণে দগ্ধ হচ্ছে।

তার বিকট গন্ধ বাতাসকে বিষিয়ে তুলেছে। সে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। এ নারকীয় কাণ্ড দেখে ফেটে যাচ্ছিল বুক। তবে বেশিক্ষণ আর আমাকে এ নরককুণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। ফিকুর নেতৃত্বে কয়েকজন বিহারী আমাকে টেনে নিয়ে চললো ব্লাক পাড়া মসজিদের উত্তর পার্শ্বের পশ্চিম মুখো রাস্তা দিয়ে।

অবশেষে থামলো তারা নুরুজ্জামান গার্ডের বাড়ির সামনে জোলার ধারে। এক নরক থেকে আর এক নরকে এসে পড়লাম আমি। জোলায় লাশের স্তুপ জমেছে। কারো কারো গোঙ্গানীর শব্দ তখনও থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে তারা।

রক্তে ভরে উঠেছে জোলা। যে দিকে তাকাচ্ছি শুধু লাশ আর লাশ। অদূরে নারী কণ্ঠের চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হচ্ছে। একটুখানি দূরে চোখে পড়ল সম্পুর্ণ উলঙ্গ দু’জন নারী। কয়েকজন মিলে চাকু দিয়ে একটু একটু করে কেটে নিচ্ছে তাদের স্তন দু’টি।

আর কুৎসিত হাসিতে ফেটে পড়ছে তারা। সে দৃশ্য চোখে দেখে সহ্য করার মত নয়। চোখ ফিরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। এবারে ফিকু চিৎকার দিয়ে আমাকে বললো, এই ছালে, সো যাও। ” বুঝলাম, জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।

যাহোক, মরতে হবেই। অন্ততঃ এ বিভৎসতার প্রতিবাদ আমি করে যাব। ফিকু আমার সামনে দাঁড়িয়ে শোয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় চোখের নিমিষে, গায়ের সব শক্তি দিয়ে, ওর মুখের উপর চালিয়ে দিলাম এক ঘুঁষি। তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে মুখ ফেরালো ফিকু অন্য দিকে।

একটা দাঁত ভেঙ্গে ছিটকে দূরে যেয়ে পড়লো। রক্তে ভেসে গেল মুখ। ইতিমধ্যেই পার্শ্বে দাঁড়ানো বিহারিটা সঙ্গে সঙ্গে রাম দায়ের কোপ ঝেড়েছে আমার ঘাড় লক্ষ্য করে। ডান হাত দিয়ে তা প্রতিহত করলাম। মনে হলো ডান হাতটা কবজি থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শরীর থেকে।

আবার আঘাত এলো একই লক্ষ্যে। এবারেও সেই ক্ষতবিক্ষত হাত দিয়েই তা প্রতিহত করলাম। পরের আঘাত এলো বাম পাখনায়; পরপরই দুইটি ফালার আঘাত হানলো গলার উপরে। পড়ে গেলাম লাশের স্তুপের মধ্যে। এরপর তারা আর দাঁড়ালো না, আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চলে গেল সেখান থেকে।

সে অবস্থায় চুপচাপ পড়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আশে পাশে ওদের কেউ নেই দেখে উঠে বসলাম। তারপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। পাঁচ-পাঁচটি গভীর ক্ষত শরীরে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর।

কি করে শরীর শক্তি যোগাচ্ছে জানি না, আমি দৌড়ে চলেছি। বুক ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। কিন্তু থামবার সাহস পাচ্ছি না। আর থামলেই বা পানি পাব কোথায়। চারিদিক জনমানব হীন।

শুধু মাঝে মাঝে দুই একটা মালিক বিহিন মুরগী চোখে পড়ছে, কারণ গরু ছাগল অনেক আগেই অবাঙালীদের হস্তগত হয়েছে। এভাবে কিছু দূর যাওয়ার পর একটা বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম। বাড়ির দরজা জানালা খোলা। সারা বাড়ি খা খা করছে। বাড়ির জিনিস পত্র বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়ানো ছিটানো।

বুঝলাম লুটপাটের পরশ এখানেও লেগেছে। তবে বাড়ির বাইরে গরু খাওয়ানোর জন্য চাড়ি বসানো দেখে এগিয়ে গেলাম সে দিকে, যদি এক ফোটা পানি মেলে, আর তা যেমন পানিই হোক। ভগবানের করুণা, তিনি আমায় নিরাশ করলেন না। চাড়িতে অর্ধেকটা পরিমাণ পানি। উপরে কিছুটা ধানের গুঁড়া ভাসছিল।

এক হাত দিয়ে সরিয়ে আকণ্ঠ পান করলাম সে চাড়ির পানি। শরীরে একটু স্বস্তি পেলাম। আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম আবার। কতক্ষণ দৌড়ে ছিলাম, কতদূর দৌড়িয়েছিলাম বলতে পারব না। চোখ খুলে দেখলাম আমি শুয়ে আছি একটি ঝোপের মধ্যে গাছের তলায়।

আমার পাশে বসে আছে গুড়ওয়ালা শমসের ওরফে ঝন্টু। আমাকে চোখ খুলতে দেখে ঝন্টু ঝুঁকে পড়লো আমার মুখের উপর। জিজ্ঞেস করলো, আমি কেমন বোধ করছি? মাথা নাড়তে যেয়ে যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে উঠলাম। ও বললো, থাক, অল্প দূরেই আড়মবাড়িয়া, দেখি কোন প্রকারে ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। ঝন্টু উঠে গেল আমার পাশ থেকে।

আমি চোখ বুঁজে চুপচাপ পড়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ঝন্টু একটা মইসহ যুবককে নিয়ে হাজির হলো আমার কাছে; তারপর দুইজনে মিলে অনেক যত্নে নিয়ে তুললো আড়মবাড়িয়া বাজারে ছোট্ট একটা লণ্ড্রীর দোকানে। এখানে প্রাথমিক পরিচর্যা শুরু হলো। কিন্তু ডাক্তার বা ঔষধপত্রের তো ব্যবস্থা নেই। আশে পাশের সহৃদয় মানুষগুলোর সাধ্যমত ক্ষতস্থান গুলো পরিস্কার করা, দুটো ট্যাবলেট যোগাড় করে খাওয়ানো এ সবগুলো করতে থাকলো।

এভাবে তিনদিন কেটে গেল। ক্ষতগুলো আস্তে আস্তে বিষিয়ে উঠছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছি। শেষে স্থানীয় লোকজন নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে কিছু পয়সা কড়ির ব্যবস্থা করে টমটমে গোপালপুর চিনিকলের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। ক্ষতস্থানে অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলো সেখানকার ডাক্তাররা।

তাঁরাও অসহায়, কারণ দীর্ঘদিনের হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের জন্য হাসপাতালে ঔষধের অভাব প্রকট। ফলে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা ডাক্তারদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তবুও হাতের কাছে যা ছিল তা দিয়েই তারা হৃদ্যতার সাথে চিকিৎসা চালাতে থাকলো। কিন্তু সেখানেও থাকা সম্ভব হলো না। পাক সেনারা হানা দিল সেখানেও।

ফলে ত্যাগ করতে হলো গোপালপুর হাসপাতাল। কি করি, কোথায় যাই। ক্ষত স্থানগুলোতে দগদগে ঘা। ব্যথায় জর্জরিত শরীর। দেহে শক্তি নাই।

পা দু’খানা পাথরের মত ভারী। সেই অস্থাতেই টলতে টলতে বের হলাম রাস্তায় ভগবানের নাম সম্বল করে। ভগবান বোধ হয় সেই সময় প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে প্রেমের প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি বাঙালীর পরস্পরের প্রতি ছিল সহমর্মিতা। ফলে সাহায্য সহযোগিতার অভাব হলো না।

কিছু মানুষের সহযোগীতায় কোনমতে আড়ানী পৌছলাম। তারপর হেঁটে বর্ডার পার হয়ে পৌঁছলাম ভারতের সাগর পাড়া। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সকল জায়গাতেই শরণার্থী অভ্যর্থনার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আর হয়েছিল অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে পৌঁছা মাত্রই এগিয়ে এলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর লোকেরা।

এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলো। তারপর আমাকে পাঠায়ে দেওয়া হলো সাগর পাড়া হাসপাতালে। ততদিনে ক্ষতস্থানগুলো অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সেখানকার ডাক্তাররা এ হাসপাতালে রাখার সাহস পেলেন না। আমার জীবন সম্পর্কে তারা আশান্বিত নন। তাই তাড়াতাড়ি পাঠায়ে দিলেন বহরমপুর হাসপাতালে।

এতদিনে ক্ষতস'ানগুলিতে পোকা ধরে গেছে। এখানকার ডাক্তাররাও শঙ্কিত হলেন। তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। একটা বিশেষ ইনজেকশন প্রতিদিন একটা করে চললো। কিন্তু এখানের অবস্থাও ভাল নয়।

কারণ বাংলাদেশ থেকে তখন দলে দলে নানা ধরণের রোগী এখানে আসছে। তাদের মধ্যে ক্ষত বিক্ষত দেহের রোগীই বেশি। শ শ রোগী এখানে মারাও যাচ্ছে। সারাক্ষণ ব্যস্ত ডাক্তার ও নার্সরা। বিরক্তও।

অনেকটা অনীহার ভাব এসে গেছে তাদের মধ্যে। নার্সরা ঠিকমত দেখে না, ডাক্তাররাও দেখতে আসে না। নার্সদের অনুনয় বিনয় করি ডাক্তারদের ডাকার কথা বললে তারা এড়িয়ে চলে। শেষে রাগে দুঃখে একদিন এক নার্সকে চড় মেরে বসলাম। উদ্দেশ্য এ ঘটনার পর নিশ্চয় কোন না কোন ডাক্তার এখানে আসবেন।

হ্যাঁ উদ্দেশ্য আমার সিদ্ধ হলো বটে। সিভিল সার্জন এলেন এবং সব কিছু দেখে শুনে এখানে রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। পাঠিয়ে দিলেন খাগড়া বাজার হাসপাতালে। এই হাসপাতালটা যথেষ্ট উন্নত লাগলো। আমাকে স্পেশাল কেয়ারে রেখে চিকিৎসা শুরু হলো।

কয়েকদিনের মধ্যে যথেষ্ট উন্নতিও হলো। বুকে কিছুটা বল পেলাম। এবারের মত প্রাণটা রক্ষা পেল বলে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। এখানকার ডাক্তার ও নার্সদের অক্লান্ত সেবা যত্নে মাস ছয়েকের মধ্যে আমি সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম। তারপর ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ালাম কলিকাতা, রানাঘাট, গোহাটি প্রভৃতি জায়গায়।

ইতোমধ্যে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। বিজয় দিবসের দুইদিন পর ১৮ ডিসেম্বর পা রাখলাম আমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে। " কালীপদ থামলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "১৮ ডিসেম্বর দেশে ঢুকে দেখলাম, চারিদিকে লুটপাটের মেলা। কতজনকে দেখলাম লুটপাট করে জিরো থেকে হিরো হয়ে গেল।

যাদের অনেকে আজ নেতাও। কিন্তু আমার ওসবে রুচি হয়নি। আজ দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করতে করতে যখন অসহ্য লাগে তখন মনে হয়, কী পেলাম জীবনে! আজ একটা বিবাহযোগ্য মেয়ে ঘাড়ে, তার বিয়ে দেওয়ার সংস্থান নেই, সোমত্ত একটা ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়ে এগিয়ে আসে না। স্বল্প ভাড়ার ভাঙ্গা ঘরে রোদ বৃষ্টির সাথে মিতালী করে বাস করতে হয়।

সামান্য এ আয়ে চারটি মুখের আহারের সংস্থান, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাচ্চাদের লেখা পড়ার খরচ যোগাতে হিমসিম খেতে হয়। সেদিন যদি তাদের মত লুটপাটে শরীক হতাম তবে জীবনের চিত্রটা হয়ত বদলে যেত। আবার মনে হয়, কষ্ট হলেও আত্মমর্যাদা নিয়ে তো বেঁচে আছি। ভিক্ষুক, তস্করের জীবন বেছে নিয়ে আত্মগ্লানিতে তো ভুগতে হয় না। " কি সান্ত্বনা দেব তাঁকে আর কিইবা আমার ক্ষমতা? শুধু বললাম, "দাদা, ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতও তো প্রভাত হয়।

জগদীশ্বর একদিন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। সে জীবনকে আপনি কলঙ্কের কালিমায় ঢেকে দেন নি। তিনি যে আবার মুখ তুলে চাইবেন না এমন কথা কি বলা যায় ?" ---------------------------- *এটি একটি সত্য কাহিনী। সাক্ষাতকার গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন "দৈনিক ভোরের কাগজ"-এর ঈশ্বরদী সংবাদদাতা মোস্তাক আহমেদ কিরণ। ---------------------------- ফুটনোট: বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারিরা আসলে stateless একটা জাতিসত্ত্বা, '৪৭ সালে ভারতের বিহার থেকে অনেক বিহারি আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নেয় এবং পাকিস্তানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে।

১৯৭১ এর পর এরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে অস্বীকার করে এবং পাকিস্তানে যেতে চায়। ১৯৭২ সালে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে অবস্থানরত ৫,৪০,০০০ বিহারিকে পাকিস্তানে প্রত্যাবসনের সমঝোতা হয়। কিন্তু ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার মাত্র ১ লাখ ২৭ হাজার বিহারিকে নিয়ে যাবার পর প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। পাকিস্তান সরকার তখন জানায়, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে পুনর্বাসন করার মত অর্থনৈতিক সামর্থ তাদের নেই। ভারতের বিহার প্রদেশ-এর মানচিত্র এরপর বাংলাদশের তৎকালীন সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় এদেরকে পাকিস্তানে পাঠানোর চেষ্টা করে।

১৯৮৫ সালে সৌদি ভিত্তিক “রাবিতা আল-আলম আল্-ইসলামী” নামক একটি সংগঠনের সহায়তায় এই বিহারিদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ সরকার এই প্রত্যাবসনের জন্য রাবিতা'র সঙ্গে আরেকটি চুক্তি করে। কিন্তু সেদেশের জনগণের ভেতর থেকে বিহারিদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে বিরোধীতা শুরু হয়। নওয়াজ শরীফের সরকার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহন করেছিলো, যেখানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ৮ টি জেলায় ১০ মিলিয়ন রূপি ব্যায়ে ৫০,০০ ইউনিটের একটি আবাসন প্রকল্প তৈরির ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন। কিন্তু বেনজির ভুট্টো ক্ষমতায় এসে বিহারিদের প্রসঙ্গটি একেবারেই বাদ দিয়ে দেন।

ঢাকার মোহাম্মাদপুর বিহারি ক্যাম্প এরপর থেকে আর কোনও সরকারই বিহারি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন নি। আর বিহারিদের প্রত্যাবসনের ব্যাপারটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে। এই বিহারিদের মধ্যে বহুসংখ্যক রয়েছে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ তথা '৭১-এ দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর ও অসংখ্য হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আসামী ও যুদ্ধাপরাধী। এদের যথাযথ বিচারের সন্মুখীন করা ও পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যাপারে অবিলম্বে একটা ব্যবস্থা করা দরকার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।