আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কত দিন দেখিনি তোমায়

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
খুব ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে লিখতে বসেছি। অনেক দিনের মাঝে এমন শরিফ মেজাজের আমাকে কে আমি নিজেই দেখিনি। শরিফ মেজাজের একটি কারন হলো প্রশংসা। স্তুতি বা প্রশংসায় পাথরের দেবতাও গলে যান, আর আমি তো কোন ছার। ছেলে সেদিন ফোনে বলেছিলো,”মা আপনার লেখা গুলো পড়লাম, ভালো লেগেছে, এখন আমার কথা কিছু লেখেন দেখি”।

তখনই মনে হলো ওর জন্মদিনে ওকে নিয়ে কিছু লিখবো। টুকটাক লিখা তো সেই কবে থেকেই লিখছি, কিন্তু আমার পরিবারের কেউ কি সে লেখা পড়ে দেখেছে? কন্যা তার সংসার, চাকরী, বিচ্ছুগুলোকে সামাল দিয়ে নেটে বসার অবসর পায়না। তাই ছেলের এই প্রশংসায় আমি তো একেবারে বিগলিত করুনা জাহ্নবী যমুনা হয়ে গিয়েছি। কলিংবেলের মুহুর্মুহু শব্দে আমার মনসংযোগ বিঘ্নিত হলো। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, কেউ দরজা খুলতে এগিয়ে এলো কিনা।

যখনি ফোন বা কলিংবেল বাজে তখন আমার ঘরের মানুষ গুলো বধির হয়ে যায়। অগত্যা আমি যখন এগিয়ে যাই ঠিক সেই মুহুর্তেই সব এক সাথে দৌড়িয়ে আসে। না, আজ কারো নড়াচড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। কলিংবেলটা তারস্বরে সালাম দিয়ে বলেই যাচ্ছে অনুগ্রহ করে দরজা খুলুন। বিষম বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলাম।

ভেবে ছিলাম এসময় ডিস লাইন ঠিক করার মানুষ ছাড়া আর কে হবে? আমার বাড়ির ফোনের যন্ত্রনায় ওরা অস্থির থাকে। এবং আমাদের উপর প্রচন্ড বিরক্তও থাকে। দরজা খুলে আমি অবাক। এ আমি কাকে দেখছি? এই ছ’ফুট লম্বা, সুদর্শন যুবক মাথাটা একদিকে কাত করে মিটিমিটি হাঁসছে, একে কি আমি চিনি? বাবাই কেমন করে আসবে? কালই তো ওর সাথে কথা হলো, কিছু তো বল্লনা আসার কথা। “কিগো মা, চিনতে পারছেন না? ছেলে কে ভুলে গেলেন”? বাবাই? দুহাতে আমায় জড়িয়ে ধরলো।

বুকে এক ধরনের চিনচিনে অনুভুতি ছড়িয়ে পড়লো। এটাই কি সুখানুভুতি? কেমন আছিস সোনা? ওরে আমার জানবাচ্চাটা! কত দিন তোকে দেখিনি! আমার উচ্চস্বরে ঘুম ভেঙ্গে কুম্ভকর্ন উঠে এলো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমার আবার কান্না টান্না আসেনা। বাবাই যেদিন গেলো, সেদিন তো ওর বাবা সাতসকালে উঠেই বাড়ির বাইরে, বিদায় দিতে পারবেনা বলে।

এমনিতে তাঁর আবেগ বোঝা যায়না। সে মনে করতো স্নেহ, মমতার প্রকাশ হলে সন্তান বিগড়ে যাবে। এখন অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পারে। বাবাই হয়েছে আমার মতই। ওকে আমি কবে শেষবার কাঁদতে দেখেছি মনে পড়েনা।

বছর তিনেক বয়সে একবার থুতনি কেটে তিন/চারটা সেলাই দিতে হয়েছিলো। তখনও এক ফোটা কাঁদেনি। ডাক্তাররাও অবাক হয়েছিলো। সাতদিন পর সেলাই খোলার কথা থাকলেও তিন চারদিন পর নিজেই টেনে টেনে ঐ কালো কালো সুতোগুলি খুলে ফেলে আমায় বলছিলো, “মা আমাল দালি”। মানে মা আমার দাড়ি।

বাবাই ওর পাপাকে শান্ত করে বসালো। এমন সময় আবার কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি খুলে দেখি আমার কন্যা রত্ন। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, কি যানি এখনি আবার কোন ঝড় বয়ে যাবে। আদরের ছোট ভাইটি কে কবে ফোন করেছিলো, সে ফোন ধরেনি, কবে মেসেজ দিয়েছিলো, উত্তর দেয়নি, এসব কথা প্রায়ই আমায় শুনতে হয়।

তাই এখন ভাইকে দেখে না জানি আবার কি করে। আমার কন্যা কথায় কথায় চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিতে পারে, কথায় কথায় রাগে চন্ডি রুপ ধারন করতে পারে তা আমরা সবাই জানি বিধায় ওকে সমিহ করেই চলি। মনে মনে ভাবলাম, ওরা দু ভাই-বোন শলাপরামর্শ করেই কি এসেছে? না হলে হাতে এতো কিছু বয়ে নিয়ে এলো, আবার বাবাইকে দেখে অবাকও হলো না। বাবাইকে জড়িয়ে ধরে বোনের সেই বিখ্যাত কান্না শুরু হলো। থামানোর জন্য তাড়াতাড়ি বললাম, কিরে, বিচ্ছু গুলোকে আনলিনা? চোখ মুছতে মুছতে কন্যা ফোস করে উঠলো, “ক্যানো? আপনার ছেলে গিয়ে তার ভাগ্না ভাগ্নিকে দেখে আসতে পারবেনা? আমতা আমতা করে আমি উত্তর দেয়ার আগেই বাবাই বল্লো, চলো আপু, গিয়ে ওদের আর দুলাভাইকে নিয়ে আসি।

ধরা গলায় বোন বল্লো, দাড়া ভাই তোর জন্মদিনের কেকটা কেটে যা। তুমি কি পাগল হলে? ওদের ছাড়া আমি কেক কাটবো? আমি বললাম, এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। কেক তুলে রাখো। খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে গিয়ে ওদের নিয়ে এসো, রাতে একসাথে সবাই মিলে খাওয়া হবে। এখন বল, তুই কি খাবি? “মা, আপনার হাতের আলু দিয়ে গরুর মাংস, আর চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি কত দিন খাইনি।

নিজের সাথে নিয়ে আসা গাজরের হালুয়া, আর ফির্নি ভাইয়ের সামনে বেড়ে দিলো বোনটি। আমায় বল্লো, আপনি বসেন, আমি রান্না করছি। ওদের বাবা সাথে সাথে ফোড়ন কাটলো, “তুমি যাওয়ার পর থেকে তো কাজের লোকের হাতের অখাদ্য কুখাদ্য খেয়েই বেঁচে আছি। তোমার উসিলায় সুখাদ্য জুটলেও পেটে সইবে কিনা আল্লাহ যানে! ঐ বিশ্ব বেঈমানের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলাম। অবশ্য ঐ দৃষ্টিতে তার কোনই ক্ষতি হলোনা।

খোঁচা মেরে কথা বলার সময় সে কখনোই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা। যদি বলতো, নির্ঘাত আমার অগ্নিদৃষ্টিতে ভস্ম হয়ে যেতো। এ কদিন প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় কষ্ট পেয়েছি, আজ আমার কোন কষ্ট নেই। কত দিন পর আমি মনের ইচ্ছেতে রান্না করতে এলাম। ওরা ডাইনিং টেবিলে বসেই গল্প করছে।

রান্না শেষ করে টেবিল সাজালাম। একসাথে বসে কত বছর পর আমরা সবাই খেতে বসবো...............ওদের কোন সাড়া না পেয়ে চিৎকার করে ডাকতে গেলাম, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মনে পড়ে গেলো আজ আমার বাবাই সোনার জন্মদিন। হয়তো খুব শীঘ্রয়ই আমরা একসাথে বসে এমনি করে খেতে বসবো, গল্প করবো, বাবাইএর চুলে বিলি কেটে দিবো। আমি মন খারাপ করবো না।

আমি আশায় বুক বেধে থাকবো। আমার জানবাচ্চাটা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, সে তো সব সময় এই মায়ের বুকের মাঝেই আছে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।