আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রস+আলো’র প্রস্তুত প্রণালী

আপনারা দেখছেন আদনান মুকিত দীপ্র'র ব্লগ

[এই লেখাটা অনিক ভাই(অনিক খান-বিশিষ্ট ছড়কার, রেডিও ব্যক্তিত্ব ও পথভ্রষ্ট তরুণ এবং ক্লোজ বড় ভাই)- এর নতুন পত্রিকা তবুও('তবুও'-দেশের একমাত্র অমুল্য পত্রিকা) তে ছাপা হয়েছিল। লেখা ছাপানোর জন্য অনিক ভাইকে অমূল্য ধন্যবাদ, জ্বি ধন্যবাদ!] আজকাল প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার সাথে ফাও হিসেবে ফান ঁঁম্যাগজিন বের করাটা একেবারে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকা পড়েনা কিন্তু পত্রিকার সাথে দেয়া ফান ম্যাগজিন বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ে এবং ‘ধুর, কি যে লেখে, একটুও ফান নেই’-এই টাইপের সমালোচনা করে এমন লোকের সংখ্যাও একেবারে কম না। অনেকে মনে করে, ‘এইসব হালকা জিনিস বের করার মানে কি? সিরিয়াস জিনিস দেশ থেকে ধামাধাম উঠে যাচ্ছে দেশটার যে কি হবে!’ আর কিছু বিশিষ্ট বোদ্ধা টাইপের বুদ্ধিজীবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ফান ম্যাগজিন বের করাটা কোন ব্যাপারই না। খুবই ভুল ধারণা।

একটা ফান ম্যাগাজিন বের করা বিরাট ঝামেলার কাজ। সম্পাদক বললেন ‘বের হও’, আর একটা ফান ম্যাগাজিন সুরসুর করে বেরিয়ে গেল- ব্যপারটা মোটেও এমন না। ফান ম্যাগাজিনের সম্পাদককে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। কি নিয়ে সংখ্যা হবে, কোন পাতায় কী আইটেম যাবে, কার্টুনিস্ট কখন আসবে, বিজ্ঞাপন কয়টা ছাপা হবে, আদৌ ছাপা হবে কি না, এসব জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাতের কোন স্পর্শ ছাড়াই সম্পাদকদের মাথার কালো চুল সাদা হয়ে যায়। রস+আলোর সম্পাদক সিমু নাসেরের অবস্থাও একই রকম।

তবে মাথার চুলের চেয়ে রস+আলোর আইটেম নিয়েই তাকে বেশি চিন্তা করতে দেখা যায়। সপ্তাহে একদিন সম্পাদকের সভাপতিত্বে রস+আলোর মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ৪ টায় মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনদিন তা ৪ টায় শুরু হয় নি। এই মিটিং এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার- পরবর্তী রস+আলো কি নিয়ে হবে এ নিয়ে আলোচনা করা। তবে সে বিষয় নিয়ে কখনোই তেমন আলোচনা হয় না।

এ্যাভাটার না পেয়ে হার্ট লকার কেন অস্কার পেল, কোন হোটেলের ডালপুরিতে সত্যি সত্যি ডাল থাকে, কিংবা ভিকারুন্নিসার ছাত্রীদের সাথে অভিভাবক থাকা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই নিয়েই চলে মারাত্বক তর্ক। হঠাৎ সম্পাদকের খেয়াল হয়, ‘আরে! পরবর্তী সংখ্যা নিয়ে তো কেউই কিছু বলছে না’, তিনি বাঘের মত গর্জে ওঠার একটা চেষ্টা করে বলেন, ‘খামোশ! নেক্সট ইস্যু কি হবে?’ এতন ধরে যে প্রাণবন্ত আলোচনা চলছিল তা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে তখন উপস্থিতি খাতায় সাইন করা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। কেউ কেউ এমনভাবে টিউব লাইটের দিকে তাকায় যেন ওইখানেই লুকিয়ে আছে শত শত আইডিয়া। এখনই টিকটিকির লেজের মত দুএকটা খসে পড়বে।

তবে আসল কথা হল আলোচনার চেয়ে কখন চা-বিস্কুট, পুরি-সমুচা আসবে সেদিকেই সবার আগ্রহ বেশি থাকে। বাধ্য হয়ে সম্পাদককে চা-বিস্কুটের অর্ডার দিতে হয়। রস+আলোর বেশির ভাগ আইডিয়াবাজ ‘খাওয়া শেষ তো মিটিংও শেষ’- এই নীতিতে বিশ্বাসী। খাওয়ার পরেই সবাই কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘বস, আমাকে একটু বাজারে যেতে হবে।

আম্মা বলেছিল পুঁই শাক আর লাউ কিনতে,’ কিংবা, ‘হায় হায়, আমারতো কালকে পরীা আছে, মনেই ছিল না’-এই টাইপের কথা বলে আইডিয়াবাজরা দ্রুত মিটিং ত্যাগ করতে চায়। সম্পাদক করুন মুখে বলে, ‘তো জিনিসটা কি দাঁড়ালো? আইটেম তো কিছুই রেডি হল না। ’ আইডিয়াবজরা হাসিমুখে আশ্বাস দেয়, ‘ওইটা নিয়া কোন চিন্তা করবেন না বস। সোমবার দিন দিয়ে যাবো। আই প্রমিজ।

’ সম্পাদক মুখটা আরও করুন করে বলে, ‘বৃহষ্পতিবার কিন্তু পেস্টিং। ’ আইডিয়াবাজরা আবারো হাসিমুখে আশ্বাস দেয়। রাজনীতিবিদদের সাথে এই একটা জায়গায় আমাদের(আইডিয়াবাজদের) দারুন মিল। আমরাও খুব ভালো আশ্বাস দিতে পারি। সোমবার আইটেম(লেখা) জমা দেওয়ার নিয়ম।

তবে এইদিনে কেউ লেখা জমা দিয়েছে এমন ঘটনা রস+আলোর ইতিহাসে বিরল। লেখা দেওয়ার কথা থাকলেও ‘বস, আমি তো বাসার বিদ্যুত বিল দিতে আসছি, আজকে আসতে পারছি না’ সবাই এ ধরনের অজুহাত দেয়। লেখা দেওয়ার চেয়ে অজুহাত দেওয়াটা বেশ সহজ। আর এভাবে অজুহাত দিতে দিতেই মঙ্গলবার পার হয়ে চলে আসে বুধবার। তখন আমাদের হুঁশ হয়।

আমরা রস+আলো কার্যালয়ে এসে একে অপরকে ফোন দেই, ‘ওই, মিয়া, তাড়াতাড়ি আসেন, কোন কিছুই লেখা হয় নাই। সিমু ভাইতো মোটামুটি ফায়ার হয়ে আছে, আর একটু হইলেই ফায়ার এ্যালার্ম বেজে উঠবে। দৌড় দেন, দৌড়!’ সবাই মিলে বসে কিছু একটা করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের স্বভাবতো ভালো না। কাজ ফেলে আড্ডা দেওয়াটাকে আমরা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করি।

ফলে আবার আড্ডা শুরু হয়। ততনে সম্পাদকের মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। পরেরদিন পেস্টিং, এখনও তেমন কোন আইটেমই রেডি হয় নি, কি হবে? তিনি আমাদের রুমে এসে উঁকি দেন। তাকে দেখেই আমরা আড্ডাউড্ডা ভুলে আইনস্টাইনের মত ভাবতে ভাবতে বলি, ‘হ্যা, হ্যা, আইডিয়াটা কি যেন বলছিলে? ভালোইতো...!’ সম্পাদক কোনমতে রাগ চেপে মুখে একটা হাসি এনে বলেন, ‘আড্ডা মারতেছেন না? আড্ডা মারলে হবে? কালকে পেস্টিং, আপনদের তো কিছু হবে না, ধরা খাব আমি, আর আপনারা খাবেন ডালপুরি। ’ আমরা কোনমতে বলি বস, এই তো সব রেডি, আপনি কার্টুনিস্টকে ডাক দেন।

আসলে অনেকন চা না খাওয়ায় মাথা জ্যাম হয়ে গেছে, চা হচ্ছে মাথার ট্রাফিক, ইহা ছাড়া জ্যাম ছুটবে না। ’ সিমু ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চা দিতে বলেন, আমরা এবার চা খেতে খেতে আড্ডা শুরু করি। এর মধ্যে দারুন ব্যস্ততার ভাব নিয়ে কার্টুনিস্ট এসে বসতে না বসতেই বলে, ‘ভাই, কি আইটেম দিবেন, দ্রুত দ্যান, আমার অনেক কাজ আছে। ’ ভাবটা এমন যে আমাদের কোন কাজই নেই। আমরা বসে বসে পপকর্ণ চিবাই, তৃতীয় বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করি, আর সব কাজ করে কার্টুনিস্টরা।

আরে ভাই আমরা আইডিয়া না দিলে তো তোমরা একেবারে মাঠে মারা পড়তা, সে খেয়াল আছে? কিন্তু মুখে কিছু বলি না। ভালোমন্দ যাই হোক, কার্টুনিস্টতো, আমাদের আইডিয়াটা তার হাতেই যাবে। কোনমতে সব রেডি করার পর কার্টুনিস্টকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েই আমরা চামে সটকে পড়ি। কিন্তু সিমু ভাইয়ের ঝামেলা তবুও শেষ হয় না। পেস্টিং এর আগে কার্টুন লাগবে, পরদিন কার্টুনিস্টকে ফোন দিতে গিয়ে দেখা যায়, তার ফোন বন্ধ।

মোবাইলে তার যতগুলো নাম্বার আছে সবগুলোতে বারবার চেষ্টা করতে থাকেন। এমনিতেই সম্পাদকরা কাটুনিস্টদের হাতে জিম্মি, আর তাদের ফোন বন্ধ থাকলে তো কথাই নেই। সম্পাদক ভাবেন ‘এভাবে আর না, আমি নিজেই কার্টুন আঁকা শুরু করব। আর ওই ব্যাটা কার্টুনিস্ট কে পেলে হয়, একেবারে আলু ভাজা করে ফেলব, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই!’ কিন্তু কার্টুনিস্টকে পেলেই সম্পাদকের সব রাগ উধাও হয়ে যায়। সম্ভবত কার্টুনিস্টদের উপর রাগ করার নিয়ম নেই! নির্দেশনা অনুযায়ী কার্টুনিস্ট কাজ শেষ করার পর সম্পাদক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার একটা সুযোগ পান।

ফেলেও দেন। তারপর আবার শুরু হয় কম্পোজ-গ্রাফিক্স-প্র“ফ এসব বিভাগে ছোটাছুটি। জাতীয় এ্যাথলেটিক্স এ ফান ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের সুযোগ দিলে তারা খুব একটা খারাপ করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু আফসোস, এই দেশে প্রকৃত প্রতিভাবানরা সুযোগ পায় না। কে যেন বলেছিলেন, যে দেশে প্রতিভার কদর নেই সে দেশ কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না।

যাই হোক, ছোটখাট আরও কিছু কাজের পর শনিবারে সম্পাদক একেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তারপর আবার মিটিং, আবার চা-বিস্কুট, আবার করুন মুখে লেখা চাওয়া-পুরোটাই একটা চক্র। আর এভাবেই এ চক্রটা চলছে। আড্ডা-হাসি-ফাঁকিবাজি করতে করতেই রস+আলোর ১১৫ টা সংখ্যা বেরিয়ে গেছে। পৃথিবীর সকল ফান ম্যাগাজিনই বোধহয় এরকম চক্রাকারে চলছে।

পাঠ্যবইয়ের পানিচক্র এ চক্রের কাছে কিছুই না। উৎসর্গ : অনিক খান, সিমু ভাই এবং টিম রস+আলো

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।