আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের ক্রীড়া সাংবাদিকগণের বাস্তবতাবোধ!!

ডাকে পাখি, খোলো আঁখি। দেখো সোনালী আকাশ, বহে ভোরেরো বাতাস।

শুরু হয়ে গেলো আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আজ রাতেই বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ। যথারীতি নিজ দলের জন্য আশা আর উৎকন্ঠার মধ্যে আছি।

সকালে 'প্রথম আলো' হাতে পেয়েই প্রথম পাতার একটা রিপোর্টে চোখ আটকে গেলো। শিরোনামটা হলো 'আশা উইকেট অনুপ্রেরণা জিম্বাবুয়ে'। শিরোনাম দেখেই কিছুটা কৌতুহল বোধ করলাম। তবে অল্প কয়েক লাইন পড়ার পরেই বহু দিনের পরিচিত একটা তিক্ততায় মনটা ভরে গেলো। বলাই বাহুল্য যে এরপর ওই রিপোর্টের বাকি অংশের আর কিছুই পড়ার ইচ্ছা হয় নি।

রিপোর্টের সারমর্মটা সবারই খুব পরিচিত। ম্যাচের আগে আশার বেলুনে মাত্রাতিরিক্ত হওয়া যুগিয়ে যাওয়া। ক্রিকেটীয় সম্ভাব্যতায় অযৌক্তিক কিছু যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ দলের জয়ের সম্ভাবনাটা যে কতোটা উচ্চতর সেটার উপরই বারবার জোর দেয়া। সেই সাথে বাংলাদেশ দলের সমর্থক গোষ্ঠী যেন জয়ের আশায় বুক বেঁধে খেলা দেখতে টেলিভিশন সেটের সামনে বসে পড়ে সেই রেওয়াজটা মনে করিয়ে দেয়ারও একটা ছোটখাটো পরিবেশনা। সচরাচর যা হয়ে থাকে আর কি! রিপোর্টের শুরুর দিকের অংশে উল্লেখ আছে যে বাংলাদেশ দলের দুই গ্রুপ প্রতিপক্ষ যথাক্রমে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুতি ম্যাচে জিম্বাবুয়ের কাছে পরাজিত।

সুতরাং জিম্বাবুয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে যা করতে পেরেছে তা আমাদের টাইগাররা টুর্নামেন্টের অফিসিয়াল ম্যাচে কেন করে দেখাতে পারবে না? এই অংশটুকু পড়ে আমার মনে প্রশ্ন আসলো যে রিপোর্টার সাহেব কি ম্যাচ প্রিভিউ লিখছেন নাকি কোন গাণিতিক সম্ভাব্যতার অঙ্ক কষছেন? ক্রিকেট সম্বন্ধে যাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে তারা ভালো করেই জানেন যে ক্রিকেটকে বলা হয় 'অনিশ্চয়তার খেলা'। এই অনিশ্চয়তার আওতাটা শুধুমাত্র ম্যাচ চলাকালীন স্কোরকার্ডের গতিবিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না বরং ম্যাচপূর্ব সম্ভাব্যতাতেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থ্যাৎ এই খেলাতে আগাম কোন পূর্বাভাস চলে না। সেটা কিভাবে? আসুন, গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের দুই প্রতিপক্ষ যথাক্রমে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক কিছু রেকর্ড পর্যালোচনা করা যাক। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে।

সেবারও মূল টুর্নামেন্টের আগে সবগুলো দলই অনেকগুলো প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিলো। পাকিস্তান তখন সব কয়টা প্রস্তুতি ম্যাচেই পরাজিত হয়। এই প্রসঙ্গে টেলিভিশন সেটের সামনে খেলা দেখতে দেখতে আমার এক সহপাঠী মন্তব্য করেছিলো যে দল একটা প্রস্তুতি ম্যাচেও জিততে পারে না সেই দল মূল টুর্নামেন্ট খেলে আর কি করবে! এ কথা শুনে আমি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম ক্রিকেট দুনিয়ায় পাকিস্তান দলের Unpredictable Team বা 'অনিশ্চয়তার দল' হিসেবে পরিচিতির কথা। এই দলটি ক্ষণে ক্ষণে তাদের রূপ পাল্টায়। এক ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে কখনই এটা অনুমান করা সম্ভব নয় যে পরের ম্যাচে পাকিস্তান দল কি রকম নৈপুন্য দেখাবে।

সে তখন আমার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও পরে সবাই দেখলো যে প্রস্তুতি ম্যাচের সব কয়টিতে হারা দলটিই শেষ পর্যন্ত মূল টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শুধু এই একটিমাত্র উদাহরণই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের এই রকম আরও অনেক উদাহরণ পড়ে আছে যেখানে স্পষ্টতই প্রমানিত হয় যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সব চেয়ে বড় নিশ্চয়তাই হচ্ছে তাদের চিরন্তন অনিশ্চয়তা। বাংলদেশের আরেক গ্রুপ প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই। ২০০৩ বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে নিয়ে রিকি পন্টিং ঘোষণা দিয়েছিলেন যে পরের বিশ্বকাপের শিরোপাটা তারাই জিতবে এবং কার্যক্ষেত্রেও ঠিক তাই দেখা গেলো। হতশ্রী অবস্থা থেকে উঠে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস তাদেরও কম সমৃদ্ধ নয়।

২০০৭ এর বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে অস্ট্রেলিয়া যখন নিজেদের মাটিতে ভিবি সিরিজ ফাইনাল ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইট ওয়াশ হলো তখন সব পরিসংখ্যানবিদেরা তাদের বাদ দিয়ে বিশ্বকাপে অন্য দলগুলোর সম্ভাব্যতা নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কি হলো? সব হিসেবের পাশার দান উল্টে অস্ট্রেলিয়াই শেষ পর্যন্ত শিরোপার হাসি হাসলো। সকল অনিশ্চয়তাকে জয় করে সাফল্যের শেষ হাসি হাসার এতো ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে যে দুটি দলের, সামান্য গুরুত্বহীন প্রস্তুতি ম্যাচে জিম্বাবুয়ের কাছে হার তাদের সাফল্যের পথে নিশ্চয়ই বড় কোন বাঁধা হতে পারে না। প্রস্তুতি ম্যাচের বাঘ বাংলাদেশ দলের আসল দৈন্য দশাটা যে মূল টুর্নামেন্ট শুরু হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ে সেটা এখন আর কারো অজানা নয়। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগে সব কয়টা প্রস্তুতি ম্যাচে জয়লাভ করেও মূল টুর্নামেন্টে কানাডা, কেনিয়ার মতো দলের বিপক্ষে হার, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ও সর্বশেষ গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে হার যার প্রকৃষ্ট প্রমান।

প্রস্তুতি ম্যাচের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কেবলমাত্র প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মূল টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে একে ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো। বাংলাদেশ দলের অন্যসব শুভানুধ্যায়ীদের মতো আমিও কায়মনোবাক্যে নিজ দলের সাফল্য প্রত্যাশা ও প্রার্থনা করি। বাংলাদেশ দলের জয় প্রার্থনা করে অতীতে এমনকি বর্তমানেও আমি যে কতো রকম বাতিক আর মুদ্রাদোষের উদাহরণ সৃষ্টি করেছি এবং করে চলেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। সব কিছুর শেষে আমি আমার বাংলাদেশ দলকে বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছাড়তে দেখতে চাই।

কিন্তু বাস্তবতার মাত্রাকে অতিক্রম করে স্বপ্ন দেখলে সেটা বেদনারই নামান্তর হবে। বাংলাদেশ দলে এখনও ইনজামাম-পন্টিংদের মতো গ্রেট খেলোয়াড় নেই যারা মুলতান-ফতুল্লার মতো করে প্রতিপক্ষকে প্রায় কাঁদিয়ে অসম্ভব ম্যাচ জিতিয়ে দিয়ে যাবে। তাই বড় বড় দলগুলোর বিপক্ষে খেলতে নামার আগে আবেগমিশ্রিত আশার চেয়ে দলের সাফল্য বুভুক্ষু প্রত্যয়টাই বেশি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের ক্রীড়া সাংবাদিকদের উচিত হবে ম্যাচ প্রিভিউতে সম্ভাব্যতার ঢাক-ঢোল না বাজিয়ে দলের প্রকৃত সামর্থ আর শক্তির নিরিখে প্রতিটি খেলোয়াড়ের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা। কারণ খেলোয়াড়েরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের করণীয়টা ঠিক মতো করতে পারছে কি পারছে না সেটার উপরই নির্ভর করবে দলের জয়-পরাজয়।

তা না করে অলীক সাফল্যের ধোঁয়ায় সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখলে পরাজয়ের পর সর্ব সাধারণের প্রতিক্রিয়াটা জয়োৎসবের মতোই বাঁধ ভাঙ্গা হতে পারে। ক্রীড়া সাংবাদিকতার এই বিষয়টি নিয়েও এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। আশা করি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সুদৃষ্টি পড়বে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.