আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুবুদের কথা ও কিছু গতানুগতিক দুঃখবেদনা

লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির

সন্ধ্যা হলেই সারা বাড়ি ভরে লুকোচুরি খেলার ধুম পড়ে যেতো। পিয়ারীবুবু আমার ছোট্ট শরীরের সবটুকু তার বুকের ভেতর লেপ্টে পেলব হাতে আমার চোখ বাঁধতেন। পোলাপানেরা দৌড়ে কোণাকাঞ্চিতে লুকিয়ে চিকন ও লম্বা 'টুউউউ' শব্দ করলে বুবু আমাকে কোল থেকে ঠেলে দিয়ে বলতেন- 'যা, ছু‌'। হাওয়ার বেগে ভোঁ ভোঁ ছুটে গিয়ে যে কাউকে ছুতে পারলেই সে 'গাভি'। পিয়ারীবুবুর বিয়ে হয়ে গেলে অনেকদিন অমন মজা করে লুকোচুরি খেলা হলো না।

পিয়ারীবুবুর বিরহে আমার খুব কান্না পেতো। যুদ্ধের সময়ে পাখিবুবুরা গ্রামে চলে এলেন। আমাদের তখন কী অস্থির সময়; কিছু বুঝি, অনেকখানিই বুঝি না। কিছুদিন পর আবারও আমাদের সন্ধ্যাগুলো মুখর হলো। আঁধার নামলেই তড়িঘড়ি জড়ো হই।

পিয়ারীবুবুদের সেই ঘরের দাওয়ায়, যেখানে বুবু আমাকে খুব ঘনিষ্ঠ করে কোলে চেপে বসতেন, পাখিবুবুও বসেন। বুবুর কাছে দৌড়ে ছুটে যাই 'গাভি' হবো বলে; কিন্তু তাঁর কৃপানজরে পড়ি না, 'গাভি'ও হতে পারি না; 'গাভি' হতে কোনো গর্ব নেই, সবচেয়ে নিঃস্ব, আর অপারদর্শী ও ছাপোষা পোলাপানই 'গাভি' হবার যোগ্যতা রাখে। 'গাভি' হবার যন্ত্রণা, কষ্ট ও বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি; 'গাভি'র কোনো আনন্দ নেই; 'গাভি'কে সবাই খাবলে খামচে ঘা করে দেয়; আমি পিয়ারীবুবুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে এক দৌড়ে সবাইকে তাড়া করেও কাউকে ছুতে পারি নি; আমি সারাজীবন খামচিখাওয়া 'গাভি'ই হতে চেয়েছি। একদিন 'গাভি' হবার বাসনায় পাখিবুবুর কোলে বসতে উদ্যত হতেই বুবু ভর্ত্‌সনা করে বলেছিলেন, 'বুইড়া পোলা...., যা সর্‌। ' পিয়ারীবুবুর জন্য আমি অনেক কেঁদেছি।

পাখিবুবুর জন্যও গোপনে গোপনে কেঁদেছি অনেকদিন। আমি 'বুড়ো' হতে হতে অনেক বড় হয়ে গেছি, বুবুরা আমাকে মনে রাখেন নি; আমিও তাঁদের ঠিকানা জানি না। যে মেয়েটি আমাকে জীবনে প্রথম ফুল দিয়েছিল, আর অপূর্ব কিছু হাসি, ভাঙা কয়েকটি শব্দে একটা চিঠি, আর বলেছিল আমাকে তার ভালো লাগে, আমি তাকে সুদীর্ঘ কিছু চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলাম। অনেক অনেক দিন পর ধলেশ্বরী নদীর তীর ধরে ধু-ধু দূরে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে মনে হয়েছিল- ওর নামই হতে পারে আফরোজা। পারুলআপা একদিন এ্যালবাম ঘেঁটে আমার সবচেয়ে ফুটফুটে ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন, 'এটা আমি নিলাম।

ঘরে ঝুলিয়ে রাখবো, বুঝলে খোকা?' আর আদর করে আমার নাক টিপেছিলেন। আমি তিনদিন চুরি করে পারুল আপার ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার বুক আজও পুড়ে যায়। পারুল আপা আমায় ফাঁকি দিয়েছিলেন। আরও একটা ঘটনা জীবনে প্রথম ঘটলো, এই সেদিন, এই অর্ধ প্রৌঢ়ে এসে।

মহীয়সী বললেন, 'আপনি চিরকালই আমার মন জুড়ে থাকবেন। ' ........... তারপর তিনিও তাঁর কথা রাখতে পারেন নি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।