আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লোকগাথার সমাজচিন্তা / বেলাল চৌধুরী



লোকগাথার সমাজচিন্তা বেলাল চৌধুরী ----------------------------------------------------------------- সমাজ সংস্কৃতিতে যে বিষয়টি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি তার জীবনের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ বিষাদ-সব কিছুতেই যা জনজীবনে প্রতিনিয়ত প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সংস্কৃতির সেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি আজও চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের অবধিগম্য। অথচ জীবনের পরতে পরতে যে সংস্কৃতির প্রভাব আমরা নিয়ত অনুভব করি সমাজ-চেতনায় যার অবদান অনস্বীকার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই লোকগাথা নিয়ে কোনও বিস্তারিত আলোচনা দেখা যায় না। লোকগাথা শব্দ বন্ধটি নতুন কিছু না হলেও এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য চির পুরাতন, আদিম ও শাশ্বত। এই গাথার মধ্যে বলতে গেলে রয়েছে এক ধরনের সাংবাদিকতা, লোকসংগীতের মিশেল।

অথচ লিখিত সাংবাদিকতা আরম্ভ হওয়ার অনেক আগেই বিশ্বের প্রায় সবদেশের লোকসাহিত্যেই মৌখিক সাংবাদিকতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার একেই এক বিশেষ অর্থে লোক সাংবাদিকতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বিশেষ অর্থ এই জন্যেই বলা হল লোক-সাংবাদিকতা লোক-সাহিত্যেরই একটি অঙ্গস্বরূপ সেই সঙ্গে লিখিত রূপেও লোকসাহিত্য মিলছে। বর্তমান যান্ত্রিক অগ্রগতির ফলে মুদ্রণ মাধ্যম ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমের রমরমা হলেও সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় লোক মাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম এবং মানবসভ্যতার সঙ্গে এইসব মাধ্যমের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। স্বভাবতই গণচেতনায় অন্য মাধ্যমগুলির তুলনায় লোক মাধ্যমের ব্যাপকতা ঢের বেশী।

মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমের তথ্য প্রচার একমুখী, ফলে গ্রহীতার কাছে এই প্রচার কতটা ফলপ্রসূ সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। সংবাদপত্রের সংবাদ নিরক্ষর দৃষ্টিহীন অভাবী লোকের কাছে আর বেতার ও টিভি চ্যানেলের সংবাদ গ্রাহক যন্ত্রহীনদের কাছে কোনো প্রভাবই ফেলে না। অন্যদিকে লোক মাধ্যম নির্বিবাদে পৌঁছে যায় সর্বস্তরের জনগণের কাছে। আদিমযুগে ঢাকের বাজনা দিয়ে দূরদূরান্তে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। এক সময়ে হিন্দু সমাজে বিপদাপদের আশঙ্কায় শঙ্খধ্বনি করে অন্যদের সতর্ক করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম বা একমাত্র মাধ্যম ছিল লোকমাধ্যম। গণচেতনা বৃদ্ধিতে তাই জনগণের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কারজনিত মৌখিক মাধ্যমই সেখানে অধিক কার্যকরী ছিল। বিশেষ করে যে দেশে শতকরা ৮০-র অধিক মানুষ বসবাস করেন গ্রামাঞ্চলে এবং শিক্ষিতের হারও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। স্বভাবতঃই গণসংযোগের ক্ষেত্রে লোকমাধ্যমেরই প্রয়োজনীয়তা তখনও অত্যন্ত বেশি। গণ শব্দের অর্থ বৃহত্তর জনসমষ্টি।

গণ শব্দের সংজ্ঞা নিরূপণ বলা হয়- A mass is not simply a lot of people. but relaiovely barg mumber of persons, spatially dispersed and anonymus reaching to one or more of the same stimuli but acting individually without reard for one another. অর্থাৎ পরস্পর ভিন্নমুখী প্রতিবলয়ের জীব হলেও একই উদ্দীপনার সম্মুখীন হলে তাদের পারস্পারিক প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। গণসংযোগের মূল সূত্র হল তথ্য বিনিময়। এই তথ্য বিনিময় বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন কোন ঘটনার বিবরণ জনগণকে শোষণের চিত্র, অনাচারও শাসকের শোষণ পীড়নের বিরুদ্ধাচারণ করা হয়েছে তেমনই দেশীয় সরকারের প্রবর্তিত নীতিরও বিরোধিতা করা হয়েছে। বল্লাল সেন কৃত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এই চতুবর্গ শ্রেণী বিভাজনের অসারতার প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনগণকে সচেতন করেছেন ফকির দুদ্দুশাহ। গানটি হল- বল্লাল সেন শয়তানী দাগায় গোত্র জাত সৃষ্টি করে যায়।

বেদান্তে আছে কোথায়, আমরা দেখি নাই। জাতি আর সম্প্রদায় মিলে ভারত শ্মশান করিলে বিনয় করে দুদ্দু বলে, বুঝে দেখ ভাই। কৃষক এবং শ্রমিকের উপর শোষণের যাঁতাকল চেপে বসে আছে প্রথম থেকেই, কৃষক ও শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল ভোগ করছে সমাজের একদল স্বার্থপর মানুষ। এই শোষকদের মুখোশ খুলে দিতে সোচ্চার হয়েছেন লোককবি রমেশ শীল- আমার খুনে মোটর গাড়ী, তেতালা চৌতালা বাড়ী আমার খুনে রেডিও আর বিজলীবাতি জ্বলে আমি কৃষক তুমি মজুর দিনেরাতে খাটি দুই শক্তি এক হইলে তারা পিছু যাবে হটি। একসঙ্গে নিশ্বাস ছাড়ি, পর্বত উড়াইতে পারি দুশমন চক্রে চাও না ফিরি কী আছে তার মূলে ।

। পার্বত্য ময়মনসিংহ জেলার হাজোং সম্প্রদায়ের উপর সেখানকার তৎকালীন জমিদার সুসং নানা অত্যাচার চালাতো। তার প্রতিবাদে হাজোংরা বিদ্রোহ করে এবং এই বিদ্রোহের কাহিনী জনগণের দরবারে পেশ করেন লোককবি নিবারণ পন্ডিত- মোদের দু:খের কথা কাহারে জানাই সারা বছর খাট্যা মরি প্যাটের ক্ষুধায় ভাই। শুনরে ও ভাই কৃষক যত হিন্দু মুছলমান অন্নদাতা হইয়া আমরা কি পাই প্রতিদান। ম্যাঘে ভিজ্যা রইদে পুড়্যা ফলাইলাম ফসল সেই ফসলে পরের গোলা ভরিল কেবল।

ধনী বণিক জমিদার আর বিদেশী সরকার চাইর ভূতে লুইট্যা খাইল মোদের সোনার সইংসার। ঃইত্যাদি। লোককবিরা শহরের মেকী সভ্যতার ধার ধারে না। বিজলী বাতি আর কলের জল চোখে দেখে না। সংবাদপত্র আর বেতারের ওজনকরা কথার সঙ্গেও তারা পরিচিত নয়, একথা ঠিক।

কিন্তু তাদের গণচেতনা তথাকথিত বাবু ভুইঞাদের চাইতে যে কিছুমাত্র কম নয়, এ পরিচয় আপনারা শুধু টুসু গান কেন বাংলার অধিকাংশ লোকসঙ্গীতের মারফৎই পাবেন। এইসব গানই হল নিরক্ষর পল্লীবাসীদের সংবাদপত্র- এর মারফৎ তারা তাদের মত গঠন করবার সুযোগ পায়। লোকসঙ্গীতের এরকমই একজন ছিলেন চারণ কবি মুকুন্দ দাস। জন্মসূত্রে যদিও ছিলেন তিনি ঢাকার অদূরে বানারি গ্রামের। আদি বাস ছিল যঞ্জেশ্বর।

পূর্ব পুরুষরা ছিলেন নৌকার মাঝি। পিতার কর্মসূত্রে গোটা পরিবারই নতুনকরে বসতি করেন বরিশালে। প্রথম জীবনে বেয়াড়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেও একেবারে তরুণ বয়সেই তৎকালীন নায়েবে নাজির বীরেশ্বর গুপ্তের কীর্তনের দলে যোগ দিয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বরিশালে যেসব খ্যাতিমান কীর্তনীয়ার দল আসর তাদের গান শুনে শুনে কীর্তন সংগীত গ্রন্থটি প্রকাশ করে। বিশশতকের গোড়ার দিকে এক ত্যাগী সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে মুকুন্দ দাস বরিশালের মহাত্মা অস্বিনীকুমার দত্তের স্বদেশ মন্ত্রের প্রভাবে চারণ কবিতে পরিণত হন।

বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত হলেও সাধন সংগীতে শ্যাম ও শামার অপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ধর্মনিরডেক্ষতার ধারা। উপরন্তু নিজে গান ও যাত্রাপালা রচনার সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল হৈতিষী পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করে। চারণ গানের মাধ্যমে গোটা দেশকে জাগিয়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাও তার রচনায় চমৎকৃত হয়ে প্রচুর সাধুবাদ জানান। বিশেষ করে বিদেশী বর্জনে তার দেশাত্মবোধক গান ও স্বদেশী যাত্রা পালার জন্য তিনি বিদেশী শাসক শ্রেণীর কোষানলে পড়ে একের এক অগ্নি ঝরা গান বাধতে থাকেন।

যার মধ্যে মাতৃপূজা গীত অঙ্কলন তার ছিল ধান গোলা ভরা। সে ইদুরেরা করল সারা। যার জন্য তাকে কারাদন্ড ভোগ ও জরিমানা দিতে হয়েছিল। তার ছিল ছেড়ে দে বঙ্গ নারী রেশমি চুড়ি কভুতার হাতে পরার মতো অগ্নিবর্ষী সব গান। অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অন্যান্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা পুরুষ।

সাধন সঙ্গীত পল্লী সেবা ব্রহ্মচারিনী, পথ সাথী, সমাজ কর্মক্ষেত্র ছিল তার উল্লেখযোগ্য রচনা। একদিকে খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ঝড়-তুফান প্রভৃতি প্রকৃতির রোষ, অন্যদিকে অনাচার, অত্যাচার, কালোবাজারি প্রভৃতি অসৎ ব্যক্তিদের দুর্নীতি, সাধারণের জীবনকে করে তোলে অতিষ্ঠ। এদের কথা বলতে এগিয়ে আসেন লোক-কবিরাই, তাদের হাতের দোতারা, একতারা বা গুবগুবি নিয়ে আর কণ্ঠে থাকে শাণিত ক্ষুরধার শব্দের করুণ কাহিনী। অগ্নিবর্ষী গানের বাণীতে জনগণের চোখে যখন ঝরে আগুন তখন কিন্তু লোক-কবির চোখে জল, কানে তার মানুষের অসহায় কান্নার রোল। নেত্রকোনা মহকুমার কৃষক সমাবেশে আউলিয়া গায়ক রসিউদ্দীন হাজার হাজার শ্রোতার সামনে তুলে ধরে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনী- আমার দু:খের অন্ত নাই দু:খ কারে বা জানাই।

সুখের হপন ভাইঙলেরে মোর চুরাই বাজারে। বাইরে বাই, তেরশো পঞ্চাশের কথা মনে কি কেউর পরে গো, মনে কি কেউর পরে। ক্ষুধার জ্বালায় কোলের ছাওয়াল মায়ে বিক্রি করে যে, চুরাই বাজারে । । প্রশাসনিক নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথাও সোচ্চারে প্রকাশ করেছেন লোক-কবিকুল।

লোকসঙ্গীত কেবল গণচেতনা বৃদ্ধিতেই নয়, লোক-সাংবাদিকতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যেই সমুজ্জ্বল। প্রতিবাদী গান বা গণজাগরণের গান যেমন আছে, তেমনি রয়েছে স্বাদেশিকতার গান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের গান, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার গান, রয়েছে গণশিক্ষার গানও, যেমন সতীদাহ প্রথা রদ, নাবালিকা বিবাহ রদ, পরিবার-পরিকল্পনা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, জাতীয় সংহতি বজায় রাখা, পণপ্রথার বিরুদ্ধে গান, সামাজিক নানা কুসংস্কারের বিরোধী গানও। লোকগীতিতে রয়েছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সংবাদ, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা আর রয়েছে আধুনিকতার অভিশাপের নানা কাহিনী। অর্থাৎ জনজীবনে যেসব ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে তার সবকিছুই স্থান পেয়েছে লোকসঙ্গীতে। গণচেতনা বৃদ্ধিতে তাই লোক-সাংবাদিকতার অবদান অসামান্য আর লোক-সাংবাদিকতার অন্যতম অঙ্গ লোকসঙ্গীত।

[দৈনিক ইত্তেফাক /১৪ এপ্রিল ২০১০ ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.