আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাজিম হিকমত : দ্রোহ, প্রতিরোধ এবং স্বপ্ন

গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু

হিকমতের বিখ্যাত কবিতা ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শুরু করা যাক। মৃত্যু........../দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ/আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু/কিন্তু, প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো/জল্লাদের লোমশ হাত/যদি আমার গলায়/ফাঁসির দড়ি পরায়/নাজিমের নীল চোখে/ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়/অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়/আমি দেখব আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব/আমার সঙ্গে কবরে যাবে/শুধু আমার এক অসমাপ্ত গানের বেদনা। বধু আমার/তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি/চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি/কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম/ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়/বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে/আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়/ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে। .................. নাজিম হিকমত-সংগ্রাম ও বিপ্লবের যোদ্ধা। এবং কবি।

জীবনজুড়ে একাধিকবার সত্যের দায়ে তাকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু, এসবের গ্লানি কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। বরং, লড়ে যাওয়ার অনুভুতি বারবার ফুটে উঠেছে। তার কবিতায় শোষক শ্রেণীর নির্মমতার ভয়ঙ্কর ক্যানভাস উন্মোচিত হতে দেখা যায়। প্রতিকূলতাকে জয়ের স্পৃহা তার বিভিন্ন চরণে অনবদ্যরুপে ফুটে উঠেছে।

জীবনভর অসত্যের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। তাঁবেদার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় জীবনের বেশ কিছু বছর তিনি বর্হিদেশে নির্বাসন কাটাতে বাধ্য হন। নিপীড়ন, নির্বাসন, কারাবরণ, এমনকি মৃত্যুর শীতল স্পর্শও তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে তিনি ২০ বছর কারাদণ্ডে অন্তরীণ থাকেন। বিদ্রোহের দায়ে তাকে সর্বমোট ৫৬ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।

যা তার নিজ বয়সের চেয়ে বেশি। তুরস্কের কবি হিসেবে চি‎হ্নিত হলেও তিনি বিশ্বব্যাপী অসম্ভব জনপ্রিয়তা পান। কবিতার পাশাপাশি নাটক এবং উপন্যাসও রচনা করেছেন। তার অধিকাংশ রচনা কারাগারে সৃষ্ট। তার কবিতা ইতিমধ্যে পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

সৃষ্ট কবিতায় ভাবাবেগের তীব্রতার জন্য তাকে রোমান্টিক কমিউনিস্ট বা রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। হিকমত ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান গ্রীসের সেলোনিকা অঞ্চলে। সেলোনিকা গ্রীসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে বিখ্যাত। তৎকালীন সময়ে ওই অঞ্চল তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

বাবা হিকমত বে ছিলেন পেশায় সরকারি কর্মকর্তা। তার পড়াশুনা শুরু হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। ১৯১৮ সালে তিনি ইস্তাম্বুলে অবস্থিত তুর্কিশ নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার শর্ত অনুযায়ী তিনি ওই সময় তুর্কি নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ওই সময়কার পটভূমিতে দেখা যায়, গোটা বিশ্ব অস্থিরতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল।

তা থেকে তুরস্কও মুক্ত ছিল না। ১৯১৯ সালে হিকমত স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। ফলে শারীরিক কারণে তিনি ১৯২০ সালে নেভাল সার্ভিস থেকে অব্যাহতি পান। হিকমত সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন ১৯২১ সালে। ওই সময় তার বন্ধু ভালা নুরেট্টিন, ইউসুফ জিয়া অরর্থাক এবং ফারুক নাফিজসহ আনাতোলিয়া অঞ্চলের ইনেবুলু এলাকায় যান।

মূলত, ওই অঞ্চল তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তুরস্কের জাতীয় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ আন্দোলন ১৯১৯-এর ১৯ মে থেকে ১৯২৩-এর ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে, হিকমত এবং তার বন্ধুরা তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় তৎকালীন কিংবদন্তি মুস্তাফা কামাল পাশার (আতাতুর্ক) সাথে সাক্ষাত করেন। কামাল পাশা জাতীয় আন্দোলনে যুক্ত কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের কবিতা লিখতে অনুরোধ করেন। তাদের সৃষ্ঠ ওইসব কবিতা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

এরপর নাজিম হিকমত এবং তার আরেক বন্ধু মিলে জর্জিয়ার বাটোমি এলাকায় যান। তৎকালীন সময়ে এ দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। নাজিম হিকমত আগে থেকে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অপার আগ্রহে এ দেশে আসেন। ১৯২২ সালের জুলাইয়ে তিনি মস্কো যান।

এখানে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করেন। ‘কমিউনিস্ট ইউনির্ভাসিটি অব দ্যা টইলার্স অব দ্যা ইস্ট’ (Communist University of the Toilers of the East)-এ অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। উল্লেখ্য, এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ২১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে বিভিন্ন উপনিবেশিক দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের পড়াশুনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এখানে হিকমতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত কবি ভ্লদিমির মায়াকোভস্কি এবং থিয়েটার বিশারদ ভেসেভুলুড মেয়েরহোল্ডে সাথে পরিচয় হয়।

যা পরবর্তীতে তার শিল্প চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির ইলিচ লেনিনের মতাদর্শ হিকমতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে বেশ সমৃদ্ধ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি তার সমস্ত জীবনে প্রয়োগ হতে দেখা যায়। কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তার কবিতা আরো জোরালো হয়ে উঠে। ১৯২৪ সালে তুরস্ক স্বাধীনতা অর্জন করে।

এরপর মুক্ত তুরস্কে হিকমত ফিরে আসেন। ওই সময় তিনি একটি বামপন্থি পত্রিকায় কাজ করেন। সেখানে বাম মতাদর্শে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু, হিকমত তুরস্ক থেকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ওই সময় তিনি বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কবিতা এবং গান রচনা করেন।

১৯২৮ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেয়া হলে তিনি আবার তুরস্কে ফিরে আসেন। কিন্তু, ততদিনে তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে সবসময় নজরবন্দি করে রাখত। কিন্তু, এতকিছুর পরও হিকমতকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শোষিত মানুষ এবং নিপীড়িত জনতার কণ্ঠস্বর তার কবিতায় দেখা যায়।

ফলে তুরস্কের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের কাছে তিনি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। ১৯২৮ সাল পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তাকে পাঁচ বছর কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। এত বিপত্তির পরও হিকমত ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যান। এ সময় তিনি নয়টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। কাব্য চর্চায় তার অনুভব তুরস্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী স্পর্শ করে।

প্রতিক্রিয়াশীলরা তাকে জেলে বন্দি রেখেও স্বস্থি পায়নি। ১৯৩৮ সালে হিকমতকে দীর্ঘমেয়াদে গ্রেফতার করা হয়। এবারের অভিযোগ গুরুতর। শাসক শ্রেণীর মতে, তার কবিতা সামরিক বাহিনীতি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে, তার কবিতা মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং বিপ্লবের চেতনা জন্ম দিয়েছে।

বিচারে তার ২৮ বছর সাজা হয়। ১৯৪৯ সালে চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা, গণসঙ্গীত শিল্পী পল রবসন এবং দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রে তার মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুক্তির দাবিতে তারা আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। ১৯৫০ সালে হিকমত নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার জিতে নেন। এ বছর তিনি আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান।

তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে তিনি মুক্তি অর্জন করেন। কিন্তু, প্রতিক্রিয়াশীলরা তার পিছু ছাড়ছিল না। তাকে দু’বার হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরবর্তীতে তিনি আবার রাশিয়ায় পালিয়ে আসেন। ওই সময় তুরস্কের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।

১৯৬৩ সালের ৩ জুন হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এ মহান কবি মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন। নাজিম হিকমত হয়তো যথাসময়ে জন্মগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, তার দৃষ্টি এবং অনুভব বর্তমান গণ্ডি অতিক্রম করে অনেক সুদূরপ্রসারী ছিল। যার উদাহরণ তুরস্কে সম্প্রতি দেখা যায়। পঞ্চাশ বছর পর তুরস্ক সরকার তাকে আবার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু, হিকমত তখন মহাকালের অপর সীমান্তে। ২০০০ সালে পাঁচ লাখ তুর্কী নাজিম হিকমতের দেহাবশেষ তুরস্কে ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়। তার বিখ্যাত কবিতা আমি জেলে যাবার পর এখানে দেয়া হল জেলে এলাম সেই কবে তার পর গুণে গুণে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে - ‘কিছুই নয়, অণুমাত্র কাল। ’ আমি বলব - ‘না , আমার জীবনের দশটা বছর।

’ যে বছর জেলে এলাম একটা পেন্সিল ছিল লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি। পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে : ‘একটা গোটা জীবন। ’ আমি বলব : ‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ। ’ যখন জেলে এলাম খুনের আসামী ওসমান কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল তারপর চোরাই চালানের দায়ে ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল আবার খালাস হল। কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।

আমি জেলে আসবার সময় যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল আজ তারা দশ বছরের বালক। সেদিনকার রোগা ল্যাংপেঙে ঘোড়ার বাচ্চাগুলো এখন রীতিমত নিতম্বিনী। কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল আজও তারা তেমনি শিশু। আমি জেলে যাবার পর দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক আর আমার বাড়ির লোকে এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায় সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি। যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম রুটি ছিল তুলোর মত সাদা তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ এখানে এই জেলখানায় লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল আজ আবার অবাধে কিনতে পারো।

কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি। যে বছর আমি জেলে এলাম দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়। টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়। আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল। কিন্তু আমি জেলে যাবার পর আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন।

আর অন্ধকারের কিনার থেকে ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ। আমি জেলে যাবার পর সূর্যকে গুণে গুণে দশ-বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে যা লিখেছি সব তাদেরই জন্যে যারা মাটির পিঁপড়ের মত সমুদ্রের মাছের মত আকাশের পাখির মত অগণন, যারা ভীরু, যারা বীর যারা নিরক্ষর, যারা শিক্ষিত যারা শিশুর মত সরল যারা ধবংস করে যারা সৃষ্টি করে কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে। আর যা কিছু -ধরো, আমার জেলের দশটা বছর- ওসব তো কথার কথা ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.