আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাত বছরে স্থাপিত ২৬ ইউনিট থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১৪১৬ মে.ও. বিদ্যুত্ : বিদ্যুত্খাত নিয়ে সরকারের মিথ্যাচার চলছেই



এম আবদুল্লাহ ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে চারদলীয় জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে ২৬টি বিদ্যুত্ উত্পাদন ইউনিট স্থাপিত হয়েছে। এসব ইউনিট চালু হয়েছে ২০০৪ থেকে চলতি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে। এ ২৬টি ইউনিটের উত্পাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত্ না আসলে বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিত। লোডশেডিং-এর মাত্রাও এখনকার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হতো।

জোট সরকারের সময়ে কার্যাদেশ দেয়া সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ৯০ মেগাওয়াটের আরও একটি বিদ্যুত্ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর দু’বছরেও চালু হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে গৃহীত কোনো প্রকল্প থেকে এখনও পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদন শুরু হয়নি। চলতি বছরের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী বছরের শুরুতে বর্তমান মহাজোট সরকারের হাতে স্থাপিত বিদ্যুত্ ইউনিট থেকে সীমিত বিদ্যুত্ পাওয়া যেতে পারে। এদিকে বিদ্যুত্ নিয়ে জনরোষের মুখে পড়া সরকার বিদ্যুত্ খাত নিয়ে মিথ্যাচার চালিয়েই যাচ্ছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোট ৭ বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পাদনের ব্যবস্থা করা হয়নি বলে অবলীলায় ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা।

তারা বলছেন, বর্তমান বিদ্যুত্ দুর্ভোগের পুরো দায় বিরোধী দলের। সরকারি মহলের এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বিদ্যুত্ খাতের প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নথিপত্রেই রয়েছে আলোচ্য ৭ বছরে বিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধির চিত্র। এমনকি বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯-এর ১১৭ পৃষ্ঠায় ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৮-০৯ পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের স্থাপিত ক্ষমতা এবং সর্বোচ্চ উত্পাদনের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তাতেও দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালে স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৫ মেগাওয়াট, ২০০৮-০৯-এ তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এতে দেখা যায়, সাড়ে ৭ বছরে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ১ হাজার ৫৫৫ মেগাওয়াট বেড়েছে।

একই সারণিতে দেখানো হয়েছে, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উত্পাদন ২০০০-০১ অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৩৩ মেগাওয়াট, ২০০৭-০৮-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৩০ মেগাওয়াটে। প্রামাণ্য এসব তথ্য-পরিসংখ্যান চেপে গিয়ে সরকার ৭ বছরে বিদ্যুত্ উত্পাদনও ১ মেগাওয়াট বাড়েনি প্রচার করে জনঅসন্তোষ বিরোধীপক্ষের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। বিদ্যুত্ খাতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কোনো সরকারই ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়াতে পারেনি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত (১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত) তিনটি সরকারই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়াতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার যেমন চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ উত্পাদনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি তেমনি বিগত জোট সরকারও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।

যার খেসরত দিতে হচ্ছে বর্তমানে দেশের অর্থনীতিকে—ভুগতে হচ্ছে জনগণকে। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তাদের প্রথম ৩ বছরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারি খাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে শেষের দিকে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারি খাতে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ও ক্ষুদ্র বিদ্যুত্ কেন্দ্র (এসআইপিপি) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ভাড়ায়ও যে বিদ্যুত্ কেন্দ্র বসানো যায় এই ধারণাটা প্রথম সামনে আসে জোট সরকারের সময়ে। এ নিয়ে তখন অনেকেই ঠাট্টা-মশকরাও করে। তবু ব্যয়বহুল রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টই বাংলাদেশের বিদ্যুত্ খাতের ক্রান্তিকালে আশীর্বাদ হয়ে আসে।

বর্তমান সরকারও ভয়াবহ সঙ্কট সামাল দিতে সেই রেন্টালের দিকেই ঝুঁকছে। পিডিবি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে জাতীয় গ্রিডে প্রথম বিদ্যুত্ যুক্ত হয় ২০০২ সালের ২৬ নভেম্বর। এ দিন বেসরকারি খাতের বৃহত্তম মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেন্দ্র চালু হয়। এ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। স্থাপনের বাস্তব কাজ শুরু হয় আওয়ামী লীগ আমলে।

ফলে এ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জোট আমলে গ্রিডে যুক্ত হলেও কৃতিত্ব জোট সরকারের নয়, যেমনটি বর্তমান মহাজোট সরকারের বিগত ১৫ মাসে ১২টি উত্পাদন ইউনিট চালু হয়েছে, যাতে এই সরকারের কোনো অবদান নেই। জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় এগুলো চালু হয়েছে। পিডিবি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জোট সরকারের সময় নিজস্ব কৃতিত্বে প্রথম বিদ্যুত্ পাওয়া যায় ২০০৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। এদিন সিদ্ধিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি চালু হয়। এর পর ২০০৫ সালের ২৮ মার্চ চালু হয় ১০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার টঙ্গী বিদ্যুত্ কেন্দ্র।

পরের বছর ২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি গ্রিডে যুক্ত হয় দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট। একই বছরের ১৫ নভেম্বর ২৫ মেগাওয়াটের চান্দিনা সামিট পাওয়ার এবং ১৬ ডিসেম্বর ৩৫ মেগাওয়াটের মাধবদি সামিট পাওয়ার চালু হয়। প্রায় এক বছর পর ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর চালু হয় ৪৫ মেগাওয়াটের আশুলিয়া সামিট পাওয়ার। জোট সরকারের উদ্যোগের ফলে ২০০৮ সালে ৬টি রেন্টাল ও ক্ষুদ্র বিদ্যুত্ উত্পাদন ইউনিট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এর মধ্যে ১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার বগুড়া (১৫ বছর মেয়াদি) রেন্টাল ১১ এপ্রিল, ৪০ মেগাওয়াটের খুলনা রেন্টাল ১২ জুন, ৪৮ মেগাওয়াটের কুমারগাঁও রেন্টাল ২৩ জুলাই, ২২ মেগাওয়াটের টাঙ্গাইল এসআইপিপি ১২ নভেম্বর, ৫০ মেগাওয়াটের শাহজিবাজার রেন্টাল ১৩ নভেম্বর এবং ২২ মেগাওয়াটের নরসিংদী এসআইপিপি ২১ ডিসেম্বর ২০০৮ চালু হয়।

গত বছর অর্থাত্ ২০০৯ সালে ১২টি রেন্টাল ও ছোট বিদ্যুত্ উত্পাদন ইউনিট চালু হয়। এগুলো বিগত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদক্ষেপের ফলে স্থাপিত হয়। এর মধ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৫ দিন আগে ১ জানুয়ারি চালু হয় ১১ মেগাওয়াটের হবিগঞ্জ এসআইপিপি। ৯ ফেব্রুয়ারি চালু হয় ৮৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার শাহজিবাজার রেন্টাল (১৫ বছর মেয়াদি)। ২২ মেগাওয়াটের ফেনী এসআইপিপি চালু হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি।

২ মার্চ চালু হয় ১১ মেগাওয়াটের উল্লাপাড়া সামিট এসআইপিপি। ১০ মেগাওয়াটের কুমারগাঁও রেন্টাল চালু হয় ১৫ মার্চ। ২২ এপ্রিল-০৯ চালু হয় ১১ মেগাওয়াটের ফেনী এসআইপিপি (আরইবি)। মে মাসে চালু হয় দু’টি ইউনিট। এ দু’টি হচ্ছে ৩৩ মেগাওয়াটের মাওনা সামিট পাওয়ার ১২ মে এবং ২২ মেগাওয়াটের বাড়বকুণ্ড এসআইপিপি ২৩ মে।

জুন মাসেও ২টি ইউনিট চালু হয়। ৯ জুন ৩৩ মেগাওয়াটের রূপগঞ্জ সামিট এবং ২৫ জুন ৩৩ মেগাওয়াটের জাঙ্গালিয়া (কুমিল্লা) এসআইপিপি। ১২ জুলাই গ্রিডে আসে ৩৩ মেগাওয়াটের ভোলা রেন্টাল। ১৮ অক্টোবর চালু হয় ৫১ মেগাওয়াটের ফেঞ্চুগঞ্জ রেন্টাল। আর চলতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি খাতে চালু হয়েছে ইজিসিবি’র সিদ্ধিরগঞ্জ ১২০ মেগাওয়াট।

উল্লেখ্য, শেষোক্ত দু’টি বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন এবং তার সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে দাবি করেন। সরকারি খাতের আরও একটি বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রায় দু’বছর ধরে চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জে (২য় ইউনিট) স্থাপিত ৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির নির্মাতা চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পিডিবি’র বিরোধের কারণে তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কটের মধ্যেও দীর্ঘদিনে কেন্দ্রটি চালু হচ্ছে না। এ বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় বিগত জোট সরকার। Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।