আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সচলায়তনে কমিউনিটি ফ্যাসিজম : ব্লগারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে

আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে...

শৈশবকাল পার হতে না হতেই অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখলাম, বাংলা ব্লগ কিংবা অনলাইন ফোরাম তার মূল নীতিকে বড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কমিউনিটি ফ্যাসিজম (চরমপন্থা) চর্চার মোক্ষম জায়গা হয়ে উঠেছে। ঘরের কাছের সচলায়তন তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। দিনে দিনে এটা হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদীদের দোকান। ভালো লেখক, ভালো লেখা- একদা এই ধোঁয়া তুলে সামহোয়্যারইন-পালানো কিছু ব্লগার এই দোকান খুলেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, সামহোয়ারইনের পরিবেশ ভাল নয়, এটা নিম্ন রুচির জায়গা, গালাগালি হয় এবং সেখানে সবাই ছাগু-হাগু ইত্যাদি।

সুতরাং এর বিপরীতে এমন একটা ফোরাম থাকা দরকার যেখানে উৎকৃষ্ট লেখা ও লেখক গিজগিজ করবে। ক্ল্যাসিক লেখার জন্য লেখকের হাত নিশপিশ করবে। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য পাঠক ভুঁড়ি বাগিয়ে বসবে! আর এজন্য দরকার একটা লৌহকঠিন মডারেশন, যার ফাঁক দিয়ে মশাও গলে পালাতে পারবে না, গালাগালি তো দূরের! লেখক যশোপ্রার্থীরা যেভাবে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে বানানোর পর কারিগরেরা ফোরামের দাওয়াত দিয়েছেন ভাল লেখকদের। নবিশ লেখক ছাড়াও স্বনামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত লেখক সুমন রহমান, ফারুক ওয়াসিফ, ইমরুল হাসানসহ আরো অনেকেই সচলায়তনে লিখতে শুরু করেন তখন। ক্রমে তারা একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেন সেখানে।

এতে চোখ টাটায় দূর্গাধিপতিদের। তারা তো লেখকের খ্যাতি চান, লিখতে পারেন কি না পারেন সেই হিসেব পরে। তাদের জায়গা তাদের জমি, আর তালি পাবে অন্য লোক! শেষে তারা নিজেরাই নিজেদের 'উন্নতমানের লেখক' হিসেবে সাব্যস্ত করলো। ছড়ির মুখে সেটা আবার সবাইকে মানতেও বাধ্য করলো। নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদরা তাদের কাছে শ্রেফ 'সাহিত্যবেশ্যা'।

যেন লেখালেখি করার আগে দেশের প্রথিতযশা সব সাহিত্যিককে বিশেষ সনদ ও অনুমোদন নিতে হবে সচলায়তন থেকে! যেভাবে শুরু হল কমিউনিটি ফ্যাসিজম শুরু হল কমিউনিটি ফ্যাসিজম। দিনে দিনে এরা হয়ে উঠল এক একটা ব্লগমোল্লা, লালসালুর পাতা থেকে উঠে আসা একেকজন মজিদ। দেশ, জাতীয়তা, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়কে সুকৌশলে ব্যবহার করে করে তারা তাদের 'বন্ধুসভা' তৈরি করেন। ক্রমে বিষয়টা দাঁড়াল এমন যে, হিমুর বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাওয়া! সুমন চৌধুরীর লেখায় এক রেটিং দিলেই 'তুই রাজাকার!' এসএম মাহবুব মুর্শেদের বিরুদ্ধে কিছু বললে জনসমক্ষে তুলে দেওয়া হয় ব্লগারের আইপিসমেত ঠিকুজি। এভাবে প্রধানত হিমু, সুমন চৌধুরী, হাসান মোরশেদ, আনোয়ার সাদাত শিমুল, ধূসর গোধুলী, ইশতিয়াক রউফসহ আরো কয়েকজন মিলে তৈরি হল অভিন্ন এক মণ্ড, যেখানে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তুচ্ছ বিষয়।

এই সাত-আটজনের 'বন্ধুসভা'ই হল সচলায়তনে ফ্যাসিজমচর্চার শক্তিকেন্দ্র। তারা যা বলে তা নতজানুচিত্তে পালন করে যায় একপাল বাধ্য ব্লগার! তারা এতোটাই বাধ্য ও নতজানু এবং এতোটাই ব্যক্তিত্বহীন যে, কখনো তাদের নিজেদের কিছু বলার নেই, বলার সাহসও নেই। বরং এই নতজানু হয়ে থাকাটাকে তারা গর্বের বিষয় মনে করে। সচলায়তন যেন অনেকটা জেলখানার প্রধান ফটক, যেখানে সবাই নতজানু হয়ে ঢোকে এবং নতজানু হয়েই থাকে। ব্লগাধিপতি ও অনুচরদের তোপ একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, লেখক যশোপ্রার্থী ব্লগাধিপতি ও তাদের অনুচরদের তোপে একে একে অনেকেই স্বেচ্ছায় ব্লগ ছেড়ে যান।

এই মিছিলে সুমন রহমান, ফারুক ওয়াসিফ এবং জামাল ভাস্করের প্রস্থান কাছ থেকে দেখা। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে সেখানে যে অমার্জিত, অশালীন আচরণ করা হয়েছে, সেসব নিয়ে ফ্যাসিবাদের প্রদর্শনী করে ফেলা যায়। গালিগালাজ করে সচল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় মনজুরুল হক, রাসেল, অলৌকিক হাসানসহ আরো অনেককে। এক পর্যায়ে এসে দেখা গেল, সচলে যারা মূলত ভালো লিখতেন তাদের সবাই ছেড়ে এসেছেন ওই ব্লগ। ব্লগাধিপতিদের তবু যেন শান্তি নেই।

সামহোয়ারইন, ফেসবুক যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছে তাদের লেখায় উপস্থিত হয়ে গালাগাল দিয়ে গেছে ওই 'বন্ধুসভা'। এই সেদিনও দেখেছি, সিরাত নামের এক ব্লগারের ওপর দলবদ্ধভাবে চড়াও হওয়ার দৃশ্য। দিনের পর দিন তাকে উত্যক্ত করে গেছে এরা। সিরাতের পাশে নিতান্তই তুচ্ছ, এমন অনেকে এসে তাকে নিয়মিত জ্ঞান দানও করে গেছেন। শেষমেশ সিরাত নিজেই স্বেচ্ছানির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

অভিন্ন মণ্ডের সদস্য স্বয়ং ইশতিয়াক রউফও তার বন্ধুর লাঞ্ছনায় সচলের ওপর ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি। মাত্র কদিন আগে প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের অসম্মানের প্রতিবাদ করায় ফকির ইলিয়াসকে আক্রমণ করা হয় ফ্যাসিবাদী কায়দায়। অমি রহমান পিয়াল, বিপ্লব রহমান, আশরাফ মাহমুদসহ আরো অনেক ব্লগারেরও হয়েছে একই দশা। চরিত্রহননের সর্বশেষ উৎসব সর্বশেষ সংযোজন গত তিন চারদিন ধরে ঘটে যাওয়া সচলায়তনের ‌'সুমন রহমান উৎসব। ' সূত্রপাত এস এম মাহবুব মুর্শেদের এক সমালোচনার মাধ্যমে।

তিনি সুমন রহমানের করা এক মুভি রিভিউর পাল্টা রিভিউ করেন। সেটাকে ইস্যু করে হিমুসহ ফ্যাসিস্ট 'বন্ধুসভা' দা-বল্লমসহ অনুপস্থিত সুমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন বিপুল বিক্রমে। সেটা এতোটাই দৃষ্টিকটু ছিল যে, দলবদ্ধ আক্রমণের আশঙ্কা সত্ত্বেও কেউ কেউ প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন সচলের ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে। সেই স্বর যখন বাড়তে শুরু করল, যখন প্রকাশ্যে সচলায়তনে হিমু-ধুগোদের ফাউল প্লের দৃষ্টান্ত দিয়ে কথা বলতে থাকল সচলায়তনের ব্লগাররাই। তখন হিমু খেলল আমার দেখা সবচেয়ে জঘন্য খেলা - লাশের রাজনীতি! তিনি ডেকে আনলেন প্রয়াত ব্লগার মুহম্মদ জুবায়েরের স্ত্রীকে।

তাকে বোঝালেন, সুমন রহমান তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে খুব বাজে লেখা লিখেছে। আর অমনি ওই মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুমন রহমানের ওপর। ভয়াবহ এক পোস্ট সেটা, যেখানে ঘৃণা থুথু থাপ্পড়সহ হেন কোনো খারাপ জিনিস নাই যা সুমনের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়নি! সুমনের সেই লেখাটা আমার আগেই পড়া ছিল। সেখানে সমালোচনার প্রচ্ছন্ন সুর ছিল বটে, কিন্তু কারো প্রতি অশ্রদ্ধা-অসম্মান ছিল না। এমনকি একপর্যায়ে সুমন রহমান মন্তব্যের ঘরে লিখে জানালেন যে, মিসেস জুবায়ের আহত হয়ে থাকলে তিনি দুঃখিত।

কিন্তু তার স্বামীর প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা নিয়ে সুমন লেখাটি লেখেননি। কিন্তু তাতে থুথু, ঘৃণা মোটেও থামল না। তাদের এক দফা এক দাবি, সুমন রহমানকে লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হবে। তাকে যে কোনো উপায়ে শায়েস্তা করার ধ্বনিও উচ্চারিত হল। কোনো কোনো ব্লগারের মন্তব্যে সেটা বেরিয়ে এসেছে।

অথচ সচলায়তন ব্যানের সময়ে (পরে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে সেটা সার্ভারের সমস্যা) সুমন রহমানই প্রথম সচলায়তনের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। কৃতজ্ঞ থাকার কথা তাদের। কিন্তু না, ওই যে 'আমার ঘরে হাততালি কেন অন্যে পাবে!' এই হল কমিউনিটি ফ্যাসিজমের নমুনা। ব্লগারের নিরাপত্তা নিয়ে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি কমিউনিটি ফ্যাসিজমের এই রূপ এতোটাই কদর্য যে, সুমন রহমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও আমি শংকিত হয়ে পড়েছি। কারণ এই সচলায়তনগোষ্ঠীই মানুষ খুন করানোর জন্য খুনি ভাড়া করতে গিয়ে ফোরামের মধ্যে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলার চেষ্টা করেছিল দু বছর আগে।

চোখের সামনে একটি অনলাইন ফোরামে এভাবে ফ্যাসিজমের চর্চা চলতে পারে না। এটা হেলাফেলার বিষয়ও নয়। সচলায়তনে যে ধরনের ফ্যাসিজমের চর্চা চলছে, আইনের এক ছাত্র আমাকে জানিয়েছেন, জার্মানিসহ ইউরোপীয় প্রায় সব দেশেই সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কারণ বাংলাভাষী কোনো ব্লগ বা ফোরামে এরকম পরিস্থিতি, ব্লগারের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে এমন আশঙ্কাজনক অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি।

বাংলা ব্লগের অনুরাগীদের সেটা জানিয়ে রাখা কর্তব্য বলে মনে করি। সবচেয়ে জরুরি যেটা, ফ্যাসিজমের এই বিষবাষ্প যাতে অন্য ব্লগ বা ফোরামে ছড়িয়ে পড়তে না পারে- সেদিকটা ভেবে এখনই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এই লেখা মূলত সে কারণেই, সচলায়তনের বিরুদ্ধে কোনো রাগ-ক্ষোভ থেকে নয়। কৃতজ্ঞতা মূল কার্টুনটি প্রথম আলোর 'বেসিক আলী' খ্যাত শাহরিয়ারের আঁকা। একটু রদবদল করে মনে হল সচলায়তনের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে কার্টুনটার মূল বক্তব্য মিলে যাচ্ছে।

কৃতজ্ঞতা শাহরিয়ারের কাছে। লেখাটি ফেসবুকেও একইসঙ্গে প্রকাশ করা হল। সংযুক্তি মিসেস মেহবুবা জুবায়ের, যাস্ট শাট আপ... শোকের রাজনীতি পার্ট টু

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।