আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাবাখেলার কাহিনী

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

দাবাখেলা- পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন খেলাগুলোর একটি। খেলাটা আবিষ্কার হয়েছে বহু বহু শতাব্দী আগে। সুতরাং এর সম্বন্ধে যে অনেক কাহিনী থাকবে এতে আর আশ্চর্য কী। আর কাহিনীগুলোর বেলায় যা হয়, সেগুলোর সত্যি-মিথ্যা জানা অসম্ভব হয়ে উঠে। এগুলির একটা বলছি।

গল্পটা বুঝতে অবশ্য দাবা খেলা জানার দরকার নেই, একটা ছক-কাটা বোর্ডে ৬৪টা ঘর থাকে, এটুকু জানলেই হবে। এক পুরাবৃত্ত বলে, দাবাখেলাটা এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। একটা খেলায় যে কতরকম বুদ্ধির চাল দেয়া যায় তা দেখে রাজা শেরাম খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। এর উদ্ভাবক তাঁরই এক প্রজা জানতে পেরে, এই অপূর্ব আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দেবেন ঠিক করে রাজা শেরাম তাঁকে তাঁর সামনে হাজির করতে আদেশ করলেন। খুব সাধাসিধে পোশাক পড়া এই লোকটির নাম ছিল সেসা।

শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। সেসা এসে উপস্থিত হলেন রাজার সামনে। রাজা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, "আপনার অদ্ভূত আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দিতে চাই আপনাকে। " সেসা মাথা নুইয়ে নমস্কার জানালেন। রাজা বললেন, "আপনার মনের যে কোন কামনা পূর্ণ করার মতো ধনসম্পদ আমার আছে।

কী চাই আপনার তাই শুধু বলুন, তাই দেব আপনাকে। " সেসা নীরব রইলেন। রাজা উৎসাহ দিয়ে বললেন, "লজ্জার কী আছে? বলন না কী চাই আপনার। আপনার আকাঙ্খা পূর্ণ করতে কোন ত্রুটিই হবে না। " সেসা উত্তর দিলেন, "মহারাজ, আপনার দয়ার সীমা নেই, কিন্তু একটু ভাবতে সময় দিন আমাকে।

ভালভাবে চিন্তা করে কাল আমার প্রার্থনা জানাব আপনাকে। " পরদিন অতি তুচ্ছ এক অনুরোধ জানিয়ে রাজাকে আশ্চর্য করে দিলেন সেসা। তিনি বললেন, "প্রভু, দাবার প্রথম ছকের জন্য এক দানা গম পেতে চাই আমি। " "সাধারণ এক দানা গম?" রাজা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। "হ্যাঁ প্রভু।

সাধারণ এক দানা গম প্রথম ছকটির জন্যে, দ্বিতীয়টির জন্যে দুটো, তৃতীয়টির জন্যে চারটে, চতুর্থটির জন্যে আটটা, পঞ্চমটার জন্যে ১৬টা, ষষ্ঠটার জন্যে ৩২টা....." বিরক্ত হয়ে রাজা উত্তর দিলেন, "আচ্ছা, আচ্ছা, দাবার ৬৪টা ছকের জন্যই আপনার ইচ্ছেমত গমের দানা আপনি পাবেন। প্রতিঘরের জন্য এর আগের ঘরের চাইতে দ্বিগুণ, এই তো? কিন্তু জেনে রাখুন, আপনার প্রার্থনাটা ঠিক আমার ইচ্ছের উপযুক্ত হলো না। এইরকম একটা নগণ্য পুরস্কার প্রার্থনা করে আপনি আমাকে অসম্মান করলেন। সত্যি বলতে কি, একজন শিক্ষক হিসেবে রাজার উদারতাকে আরও একটু বেশি সম্মান দেখাতে পারতেন আপনি। আপনি যান! আমার ভৃত্যরা আপনার গমের থলি পৌঁছে দেবে।

" হেসে বেরিয়ে গেলেন সেসা। তারপর তোরণের কাছে তাঁর পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দুই খাবার সময় সেসার কথা মনে পড়ল রাজার। সেই 'বেকুব' আবিষ্কারক তার নগণ্য পুরস্কার পেয়ে গেছে কি না জিজ্ঞেস করলেন তিনি। তাঁকে জানান হল, "প্রভু! আপনার আদেশ পালন করা হচ্ছে।

কতগুলো গমের দানা তিনি পাবেন, পন্ডিতেরা তা হিসাব করছেন। " রাজা ভুরু কুঁচকালেন। এত ধীরে ধীরে তাঁর আদেশ পালন করা হচ্ছে, এতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। রাতে শোবার আগে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি, সেসাকে তাঁর গমের থলিটা দেয়া হয়েছে কি না। উত্তর শুনলেনঃ "প্রভু! আপনার হিসেবনবীশরা হিসাব করে চলেছেন একটানা, তাঁরা আশা করছেন সকালের আগেই হিসাবটা শেষ হবে।

" রেগে উঠে রাজা প্রশ্ন করলেন, "এরা এত দেরি করছে কেন? আমার ঘুম ভাঙবার আগেই যেন সেসাকে কড়ায় ক্রান্তিতে সব শোধ করে দেয়া হয়। একটা দানাও যেন বাকি না থাকে। আমি দুবার আদেশ দেই না!" সকালবেলায় রাজাকে বলা হল, রাজসভার প্রধান হিসেবনবীশ দেখা করতে চেয়েছেন। রাজা তাঁকে আসতে আদেশ করলেন। রাজা শেরাম প্রশ্ন করলেন তাঁকে, "আপনার দরকারী কথা শোনবার আগে, সেসাকে তাঁর প্রার্থনা মতো নগণ্য পুরস্কার দেয়া হয়েছে কিনা, সেটা জানতে চাই।

" বুড়ো পন্ডিত উত্তর করলেন, "সেজন্যেই তো এত ভোরে আপনার সামনে আসতে সাহস করেছি। সেসার প্রার্থনা মতো গমের দানার সংখ্যাটা বের করতে একটানা খেটেছি আমরা। সে একটা বিরাট..." অধৈর্য হয়ে রাজা তাঁকে বাধা দিলেন, "হিসাবটা যত বিরাটই হোক না কেন, আমার শস্যের গোলাগুলো থেকে তা সহজেই দেয়া যাবে। তাঁকে এই পুরস্কার দিব কথা দিয়েছি। আর তা দিতেই হবে।

" "মহারাজ, সেসার প্রার্থনা পূর্ণ করা আপনার ক্ষমতার বাইরে। সেসা যা চেয়েছেন তত দানা আপনার গোলায় নেই। আপনার সমস্ত রাজ্যেও ততটা দানা নেই। সত্যি বলতে কি, সারা পৃথিবীতেও নেই। যদি আপনার কথা রাখতেই হয় তাহলে সমস্ত সাগর ও মহাসাগরের জল ছেঁচে, উত্তরের মরুভূমিগুলোর তুষার আর বরফ গলিয়ে ফেলে সারা পৃথিবীর সমস্ত জমিতে গমের চাষ করতে আদেশ করুন।

যদি এই সমস্তটা জমিতেই গমের চাষ করা যায় তাহলে হয়তো সেসাকে দেয়ার মতো গমের দানা পাওয়া যাবে। " অবাক বিস্ময়ে পন্ডিতের কথা শুনছিলেন রাজা। "কত দানা?" চিন্তান্বিতভাবে বললেন তিনি। পন্ডিত উত্তর করলেন, "মহারাজ, সংখ্যাটা ১,৮৪,৪৬,৭৪,৪০,৭৩,৭০,৯৫,৫১,৬১৫!" তিন গল্পটা হল এই। এরকম কোন ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল কিন তা আমরা জানি না তবে পুরস্কারটা যে এরকমই একটা কিছু দাঁড়াবে তা আমরা হিসাব কষে দেখতে পারি।

১ থেকে শুরু করে ১,২,৪,৮....ইত্যাদি সংখ্যাগুলো যোগ করতে হবে। ২ এর ৬৩তম ঘাত যত সেটাই হল ৬৪তম ছকের জন্য আবিষ্কারকের প্রাপ্যের সমান। ২^৬৪ থেকে ১ বিয়োগ করলেই খুব সহজে আমরা শস্যদানার সংখ্যাটা পেয়ে যাব। এর অর্থ হল ২ কে ২ দিয়ে ৬৪ বার গুণ করতে হবে। হিসাবের সুবিধার জন্যে এই ৬৪টি উৎপাদককে আমরা ৬টা ভাগে ভাগ করব, প্রতিভাগে থাকবে ১০টা করে ২, সবচেয়ে শেষের ভাগে থাকবে ৪টা ২।

২^১০=১০২৪ আর ২^৪=১৬। তাহলে যে উত্তরটা আমরা চাই তা হলঃ ১০২৪x১০২৪x১০২৪x১০২৪x১০২৪x১০২৪x১৬ =১০৪৮৫৭৬x১০৪৮৫৭৬x১০৪৮৫৭৬x১৬ =১,৮৪,৪৬,৭৪,৪০,৭৩,৭০,৯৫,৫১,৬১৬ এখান থেকে ১ বিয়োগ করে পাই, ১,৮৪,৪৬,৭৪,৪০,৭৩,৭০,৯৫,৫১,৬১৫ এই বিরাট সংখ্যক শস্য রাখতে কত বড় গোলার দরকার হবে? আমরা জানি, এক ঘন মিটার গমের ভিতর থাকে ১,৫০,০০,০০০ দানা। তাহলে সেসার ইচ্ছেমত পুরস্কারের জন্য দানা রাখতে হলে ১,২০,০০,০০,০০,০০,০০০ ঘন মিটার বা ১২,০০০ ঘন কিলোমিটারের কাছাকাছি আয়তনের গোলা দরকার। যদি এমন একটা গোলাঘর হয় যা ৪ মিটার উঁচু আর পাশে ১০ মিটার. তাহলে এর দৈর্ঘ্য হবে ৩০ কোটি কিলোমিটার, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব তার দ্বিগুণ। রাজা শেরাম সেসার প্রার্থনা রাখতে পারলেন না।

কিন্তু গণিতে একটু মাথা থাকলেই তিনি এই বিরাট পুরস্কার দেয়াটাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। সেসাকেই দানাগুলো একটি একটি করে গুনে নিয়ে যেতে বললেই হত। সত্যিই সেসা যদি দিনরাত্রি একবারও না থেমে শস্যের দানা গুনে যেতেন এবং প্রতিটি দানা গুনতে তাঁর যদি সময় রাগত এক সেকেন্ড, তাহলে প্রথম দিনে তিনি গুনতেন ৮৬,৪০০টা দানা। দশ লক্ষ শস্যদানা তিনি ১০ দিনের কমে কোনভাবেই গুনতে পারতেন না। এক ঘনমিটারে যতটা গম ধরে তা গুনতে তাঁর প্রায় সময় লাগত ছয় মাস।

একবারও না থেমে ১০ বছর ধরে গুনে গেলে তিনি ৫৫০ বুশল গুনে শেষ করতেন। তাহলেই দেখা যাচ্ছে, সেসা যদি তাঁর বাকি জীবনের সমস্ত দিনগুলিও শস্য গোনার কাজে ব্যয় করতেন, তাহলেও তিনি পুরস্কারের একটা নগণ্য অংশই পেতেন। [এই গল্পটিও ইয়াকভ পেরেলমেনের লেখা। আমি এই গল্পটি ছোট বেলায় পড়ে ভাবতাম, শিক্ষকদের অনেক বুদ্ধি। আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম ছোট বেলা থেকেই।

কিন্তু বাংলাদেশে আমি শিক্ষকদের মাঝে, হাতে গোনা দুই-একজন বাদে, এমন বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাইনি। মুখস্থ বিদ্যা এখানে অনেক কাজে দেয়। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের শিক্ষকরা সেসার মত হবেন, এটাই আমার আশা। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.