আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হলো বৌদ্ধ মন্দির

আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালবাসি। ঘার টেরা লোক পছন্দ করি না।

নরসিংদী জেলার শিবপুরে প্রত্নতাত্তি্বক খননে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। বর্গাকার এ মন্দিরে মিলেছে বৌদ্ধ মন্দিরের মতো প্রদক্ষিণ পথ ও গৌতম বুদ্ধের স্মারক পোড়ামাটির একাধিক পদ্মফুল। আড়াই হাজার বছর পুরনো প্রত্নস্থল উয়ারী-বটেশ্বর থেকে শিবপুরের কামরাবো গ্রামের ধুবিরটেকে সদ্য আবিষ্কৃত এ বৌদ্ধ মন্দিরের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার।

খননকারী দলের প্রধান অধ্যাপক সুফী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ মন্দির আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মধুপুর ট্র্যাকে প্রথম কোনো বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান মিললো। এর আগে উয়ারী-বটেশ্বরে সমৃদ্ধ সভ্যতার বহু প্রত্নচিহ্ন থেকে প্রত্নতাত্তি্বকরা ধারণা করছিলেন, এ নগরীকে ঘিরে আরও কিছু স্থাপনার সন্ধান মিলবে। বৌদ্ধ মন্দির উন্মোচনের পর প্রত্নতাত্তি্বক ও গবেষকদের এ ধারণাই জোর সমর্থন পেল। উয়ারী-বটেশ্বরে গত দশ বছরের খননের নেতৃত্বদানকারী প্রত্নতাত্তি্বক অধ্যাপক সুফী মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, প্রখ্যাত গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি তার 'জিওগ্রাফিয়া' বইয়ে সৌনাগড়া নামে যে বাণিজ্য-নগরীর উল্লেখ করেছেন, তা-ই উয়ারী-বটেশ্বর। দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক পণ্ডিত ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীও একই মত ব্যক্ত করেছেন।

তিনি ভারতবর্ষে ছড়িয়ে থাকা গঙ্গাভ্যালি সভ্যতার সময়কার ৪১টি নগরীর অন্যতম হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বরকে শনাক্ত করেছেন। বাংলাদেশে গঙ্গাভ্যালি সভ্যতার সমকালীন অপর নগরী মহাস্থানগড়। চারদিকের পরিখার অবস্থান বিবেচনা করে অনেকে উয়ারীকে দুর্গনগরী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। উয়ারী-বটেশ্বরে মিলেছে রাস্তা, গর্ত, বসতির চিহ্ন, ইটের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো, পাথরের পুঁতি, বাটখারা, মুদ্রা, নবযুক্ত পাত্র, পাথর ও লোহার কুঠারসহ মূল্যবান নানা প্রত্নবস্তু। কিন্তু এবারই প্রথম কোনো ধর্মীয় স্থাপনার সন্ধান মিলল।

অবশ্য ইতিমধ্যে এখানে পাওয়া নবযুক্ত পাত্রকে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত একটি প্রত্নবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধুবিরটেকের মন্দিরের স্থানে বহুদিন ধরে একটি ঢিবি বা মাটির স্তূপ ছিল। কামরাবোর মানুষের কাছে ঢিবিটি পরিচিত ছিল 'মন্দির ভিটা' হিসেবে। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, মন্দির ভিটা নিয়ে তাদের মনে নানা প্রশ্ন ছিল। মাঝে মধ্যে তারা এখান থেকে রহস্যময় নানা শব্দ পেতেন।

গাছপালায় ছাওয়া ঢিবির রহস্য উদ্ঘাটন করতে তারা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্তি্বক দল শিবপুরে অনুসন্ধান করার সময় ঢিবিটিকে শনাক্ত করে। এবার এলাকার মানুষের সমর্থন ও প্রত্নতাত্তি্বকদের আগ্রহে উন্মোচিত হতে চলেছে ঢিবির রহস্য। ২০০৯ সালে সীমিতভাবে স্থাপনার একদিকে দেয়ালের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়। ২০১০ সালের খননে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে।

বর্গাকার একটি স্থাপনার অবয়ব। বাইরের দেয়ালের ভেতরে নির্দিষ্ট বর্গাকার ফাঁকা স্থান এবং তারপর আরেকটি বর্গাকার দেয়ালের অবস্থান দেখে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের অনুমান উঁকি দিতে থাকে প্রত্নতাত্তি্বকদের মনে। কারণ, বৌদ্ধ মন্দিরেই প্রদক্ষিণ পথ হিসেবে দুই দেয়ালের মাঝে এমন ফাঁকা জায়গার উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রদক্ষিণ পথ যুক্তি হিসেবে জোরালো হলেও আরও কিছু সাক্ষ্য চাচ্ছিলেন তারা। অপেক্ষা করছিলেন প্রমাণের।

আমাদের প্রশ্নে জর্জরিত হয়েও নিশ্চিত কিছু বলছিলেন না। খনন চলছিল নিজ গতিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি দল শাহ সুফী মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে কাজ করছেন সেখানে। দলের সদস্য মিজানুর রহমান জামি বলেন, মন্দিরের মাঝামাঝি স্থানে গোলাকার পাপড়িমতো কিছু প্রত্নবস্তু পেয়েছেন। তারা নিশ্চিত ছিলেন না কী এটি।

কিন্তু ধীরে ধীরে সেই পাপড়ির মতো প্রত্নবস্তুই ফুল হয়ে ফুটল। ইউরেকা! একটি পদ্মফুলের আকার ধারণ করল পোড়ামাটির পাপড়িগুলো। একে একে পাওয়া গেল বেদীর ওপর স্থাপিত আরও কিছু পোড়ামাটির পদ্মফুল। মিলল প্রদীপ দান, বারান্দা, প্রবেশপথ ও বেদি। অধ্যাপক সুফী বলেন, ১৮৮৫ সালে নরসিংদী জেলার শিবপুরের আশরাফপুরে যে তাম্রলিপি পাওয়া গেছে, তাতে এ অঞ্চলে বিহারিকা চতুষ্টয়ের উল্লেখ পাওয়া গেছে।

তাম্রলিপিতে উলি্লখিত সপ্তম শতকে নির্মিত বিহারের একটি হতে পারে ধুবিরটেকের মন্দির। আশপাশের এলাকায় আরও কিছু মন্দির আছে বলে তাদের ধারণা। সুফী মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, প্রাথমিকভাবে প্রদক্ষিণ পথ ও পদ্মফুল থেকে এটি বৌদ্ধ মন্দির বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে পদ্মফুলের বিশেষ সম্পর্ক আছে। ইতিহাসবিদরা বুদ্ধের জীবনকাল হিসেবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৮৩ অব্দকে নির্ধারণ করেছেন।

কথিত আছে, জন্মের পর বুদ্ধ যেসব স্থানে পা রেখেছিলেন সেসব স্থানে পদ্ম ফুটেছিল। অনেক বুদ্ধমূর্তিতে গৌতমকে পদ্মের ওপর আসীন দেখতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মে প্রতীকবাদের উদ্ভব ঘটে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, এ সময় মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির বদলে পদ্মফুলের প্রতীক রাখা হতো। প্রথম শতকে মথুরা, গান্ধার প্রভৃতি স্থানে প্রতীকী পদ্মফুলের দেখা মিলেছে।

মুস্তাফিজুর রহমানের কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল, উয়ারী-বটেশ্বরের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে এখন থেকে ২৪৫০ বছর আগে, অর্থাৎ এটি কম-বেশি ৪৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের একটি প্রত্নস্থান। সেদিক থেকে দেখলে শিবপুরের এ বৌদ্ধ মন্দিরটি পরবর্তীকালের। এ বিষয়ে আপনার মত কী? মুস্তাফিজুর রহমান সময় বিষয়ে নানা তর্কের কথা স্মরণ করে একটু হেসে ফেললেন, বললেন, একটি নগরীর উদ্ভব ও বিকাশ শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় ও এলাকাকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। দীর্ঘ সময় ধরে নগরীটি বিকশিত হবে এবং এর চারপাশে সভ্যতার বিভিন্ন সময়ের নানা নিদর্শন মিলবে, এটাই স্বাভাবিক। এ মন্দিরের সময় এখনও নির্দিষ্ট হয়নি।

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেটি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু পরবর্তীকালের স্থাপনা হলে সেটি সমস্যা নয়। বরং এ স্থাপনাটি উয়ারীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সভ্যতার ধারণাকেই শক্তিশালী করছে। প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানে এমন আরও অনেক স্থানের কথা আমরা জানতে পেরেছি, যেখানে উৎখনন পরিচালিত হলে সমৃদ্ধ প্রত্নসম্পদ মিলবে বলে আমাদের ধারণা। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত এ প্রত্নতাত্তি্বক উৎখননে বৌদ্ধ স্থাপনার আবিষ্কারের ঘটনায় সুফী মুস্তাফিজুর রহমানের দল খুশি।

তারা মনে করেন, ব্যাপক পরিশ্রম ও ব্যয়নির্ভর এ প্রত্নস্থলে আরও খনন ও গবেষণা পরিচালিত হওয়া দরকার। আর এ জন্য সরকারি সহযোগিতার বিকল্প নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।