আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তবু জীবন জয়ী হয়

পায়ে তার শখের নূপুর। স্বল্প মজুরি থেকে হয়তো কয়েক দিনের খাবারের টাকা বাঁচিয়ে একটি ছোট্ট শখকে স্থান দিয়েছিল পায়ে। জানি না, এই নূপুরের শব্দ দিয়েই সে বদ্ধ কারখানার সব মেশিনের শব্দ কিংবা নিজের ক্লান্তি দূর করতে চেয়েছিল কি না? ধ্বংসস্তূপে থেঁতলে গেছে জীবন তার, বাইরে বের হয়ে আছে সেই রক্তমাখা পা, ঝুলছে সেই নূপুরটি। মেয়েটির নূপুরসমেত সেই পায়ের পাতাটুকু যেন ব্যঙ্গ করছে মানুষের চরম অমানবিকতার ইতিহাসকে, মানুষের জীবন নিয়ে রসিকতা করার নির্মম খায়েশকে। অতি মুনাফার মনস্কতা আমাদের মানবিক বোধ থেকে পরিমাপহীন দূরত্বে রাখছে।

তাই তো তাজরীনের রক্তের ছয় মাসের মাথায় সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ফাটল ধরা বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসে লাশের স্তূপে ঠাঁই পেয়েছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর শ্রেষ্ঠ কারিগরদের অনেকেই।
শ্রমিকের পরিচয় মুছে, নম্বর দেওয়া লাশ কেবলই যোগ অঙ্কের উপাদান, বেড়ে বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন শ। এই দেশে মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে কম আর সে যদি হয় ‘নিচুতলা’র মানুষ। আমরা কয়েক দিন পরপরই ফসকে যাওয়া জীবনগুলোকে আবিষ্কার করি স্তূপের নিচে, আগুনের আলিঙ্গনে। এদের বাঁচার চিৎকার শুনতে আমাদের বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়, লাশ গুনে গুনে দুর্ঘটনার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপতে হয়।

ইতিমধ্যে এক দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হয়েছে, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তির নমুনা মেলেনি। সামান্য ক্ষতিপূরণে হয় মৃত্যুর রফা। কিছুদিন আগের তাজরীনের হতভাগ্য শ্রমিকদের ঝলসে যাওয়া ১১২টি মাংসপিণ্ড এখনো আমাদের স্বপ্নে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে জ্বলে ওঠে, হাজির হয় আমাদের বিবেককে ধিক্কার দিয়ে। বহু শ্রমিককে নিখোঁজ রেখেই, তাদের ঝলসে যাওয়া দেহের ছাই পানিতে ধুয়ে-মুছে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা হয়। তাই সেই সময়ও লাশের সঠিক হিসাব করা যায়নি।

উদ্ধারকাজ শেষের ঘোষণা দিয়েই আমরা প্রস্তুতি নিই নতুন লাশ তৈরি করার দিকে। দোষী মালিকদের কারোরই এখন পর্যন্ত শাস্তি হয়নি বরং বিজিএমইএর সহায়তায় তারা কিছুদিন পালিয়ে থেকে আবারও ফিরে আসে, সেই মৃত্যুর সরঞ্জামগুলো সঙ্গে নিয়ে।

দুই.
দুহাত থেকে জীবন ফসকে যায়। বাতাসে শুধুই লাশের গন্ধ আসে। কানে শুধুই বাজে হূদয় বিদীর্ণ করা স্বজনদের আহাজারি।

হাতে আছে শেষ সম্বল, প্রিয়জনের ছবি। মৃত হলেও প্রিয়জনকে নিজের কাছে পেতে চান। সব সরকারি তৎপরতাকে তুড়ি মেরে এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা যে মানবিকতা এবং সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছে, সেটিই এই তুলনাহীন দুর্যোগের সবচেয়ে বড় বাতি। এরাই বাঁচিয়ে রাখছে মানবিক বাংলাদেশের খুঁটিটিকে। এক-একজন মানুষ উদ্ধার হয়, আর মনে হয় যেন নতুন করে বাড়তি প্রাণ পাচ্ছে বাংলাদেশ।

জীবনের পাশে জীবন। এই হত্যাকাণ্ডের চলমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে, আর না দাঁড়ালে আমাদের এখানে জিইয়ে থাকবে আগুন লাগা বা লাগানোর সংস্কৃতি, বিল্ডিং ধসে পড়ার সংস্কৃতি, কয়েক দিন পরপর শুধু লাশ তৈরির সংস্কৃতি, জীবন নামক এক-একটি পৃথিবীকে কেবল অস্বীকারের সংস্কৃতি। আমাদের চোখ সয়ে গেছে, কান বয়রা হয়ে গেছে ঘটনাপ্রবাহে। আমরা এখন কেবল ঘটনাগুলোর অনুভূতিহীন দর্শক। জেনে গেছি ইন্দ্রিয় ভোঁতা হওয়ার জন্য আমরা শুধু বেঁচে আছি এখন।



তিন.
ধসে পড়া বিল্ডিংয়ের মালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছে। তারা প্রতিবাদ করে বলছে, ‘এভাবে বারবার আগুনে পুড়ে, ভবন ভেঙে, ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে আমাদের হত্যা করা হবে, অথচ টাকার জোরে তারা বেঁচে যাবে, এটা হতে পারে না। ’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩)। ২৮ এপ্রিল দেশজুড়ে এই ঘটনার দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবিসহ সাত দফা দাবিতে গার্মেন্টস সেক্টরে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে আটটি গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন। এই সাত দফার মধ্যে আছে শ্রমিক হত্যার অপরাধে সাভারে রানা প্লাজার গার্মেন্টসসমূহের মালিক ও ভবনের মালিক এবং তাজরীন ফ্যাশনসের মালিককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার, নিহত শ্রমিক পরিবারকে এক জীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নিখোঁজ শ্রমিকদের তালিকা প্রকাশ, সব গার্মেন্টস কারখানায় নিরাপদ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের অগ্রিম ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসন ও পরিবহন সমস্যার সমাধান করা, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন তৈরি করা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিপীড়ন বন্ধ করা।


বিশ্বজুড়ে শ্রম এবং শ্রমিকের ইতিহাসই সবচেয়ে মজবুত, সবচেয়ে পুরোনো। শ্রম জমানার ইতিহাসের অস্বীকৃতি পুঁজিবাদী দুনিয়ার শ্রমিক ও মালিক সম্পর্কের শাসন-শোষণের ভিত্তিই নয়, শ্রমিকের মৃত্যু উপত্যকা সৃষ্টির উপাখ্যান শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এখনো স্বপ্ন, জীবন ঝোলে আগুন কিংবা বিল্ডিং ধসের ফাঁসে, এত কিছুর পরও কিছু জীবন জিয়ে থাকে, লড়ার জন্য। তাই তো এত মৃত্যুকে পাশ না কাটিয়ে বরং সঙ্গে করেই তারা লড়তে চায়। কারণ, সে জানে শ্রমিকদের হারানোর কিছুই নেই। কারণ, সে লড়তে জানে, লাশের স্তূপ থেকে উঠে প্রতিবাদের ময়দানে আওয়াজ তুলতে জানে।

তারা জানে জীবন লড়ার, লড়াই করে জেতার। মৃত্যুর আগেই বেশির ভাগ মানুষ বহুবার মরে, আর কেউ কেউ বাঁচে বীরের মতো এবং মরেও বীরের মতো। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দ্রোহ সে-ই বীরের মতো জন্ম-মৃত্যুর দিকেই। কারণ, তারা জানে, তারাই শুধু পারে শ্রমদুনিয়ার মার খাওয়া ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে জীবনের পথে চলতে, মৃত্যুর কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করতে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


zobaidanasreen¦gmail.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।