আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের উদ্দেশ্যে [যাদেরকে লেখাপড়া করতে দেয়া হয়নি]



কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার সুবাদে আমার জানার ও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ই-লার্নিং সম্পর্কে। দেখেছি পড়া লেখাকে কত মজা করে উপস্থাপন করা সম্ভব। আজ আমার ছোট ভাইয়ের স্কুলের একটা ব্যাপার নিয়ে অনেকদিন আগের সেই স্কুলের কথা মনে পরে গেল। সেই দিনগুলোর কথা যখন পড়ালেখার মত প্রচন্ড অনাসক্তির একটা ব্যাপারের সাথে নিশ্চুপ হয়ে আপোস করেছি । স্কুলে টিচারের ভয়, স্যার কি বলে- তা না বুঝার ভয়, প্রশ্ন করলে যদি স্যার ব্যঙ্গ করে- তার ভয়, বাড়ির কাজ জমা না দিলে- বেতের ভয়, ক্লাস টেস্ট খারাপ হলে -কানমলার ভয়।

ভয় ভয় আর ভয়। এখন আমার মনে হয় আমি শুধু আমার প্রান প্রিয় বন্ধুগুলোর টানেই স্কুলে যেতাম, যদিও আমার বন্ধুদের অনেকেই উচ্চমাধ্যমিক এর পর আর এগোতে পারে নি। আমার এক বন্ধুর কথা বলি যে এখন চট্টগ্রামে এখন তার মামার ব্যবসা দেখে। ও ছিল আমাদের সেকেন্ড বয়, ওর বাবা ছিল না। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সে তার মামার ওখানেই থাকত।

খুব ভাল ছাত্র ছিল। আমি ওকে পছন্‌দ করতাম তার রাফ এন্ড টাফ মানসিকতার কারনে। ওর একটা চমত্‌কার দিক ছিল সে সব সময় মজা করতে পারত, সবাইকে হাসির উপর রাখতে পারত। আমরা তখন ক্লাস নাইন শেষ করে টেনে উঠলাম। অনেকদিনের ছুটির পর আবার সেই বন্ধুময় চাঙ্গা স্কুল ফিরে আসতে শুরু করেছে, কিন্তু আমার ঐ বন্ধুটির কোন দেখা নেই।

কয়েকদিন পর আমি ও আমার আরও দুজন বন্ধু ঠিক করলাম ওর মামার দোকানে গিয়ে ওর খোজ নিব। চলে গেলাম মামার দোকানে, মামা তখন দোকানে ছিলেন না, একটা কাজের ছেলে ছিল। ছেলেটি আমাদের সমবয়সী হবে। ও বলল সাদেক দোকানে এসেছিল, কিছুক্ষন আগে বাসায় গিয়েছে। দোকানে কেউ না থাকায় ছেলেটি আমাদেরকে মামা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলল।

কিছুক্ষন পর মামা আসলে ও আমাদেরকে নিয়ে সাদেকের বাসার উদ্দেশে বের হয়। বাসাটা দোকান থেকে খুব দূরে নয়। আমরা এসেছি শুনে ও বেরিয়ে এল। ওখানেই একচোট সাইজ করে নিলাম ওকে। আমরা লক্ষ্য করলাম ও কেমন যেন উদাসিন।

কারন জানতে চাইলে ও যা বলল তা শুনে আমরা কিছুক্ষনের জন্য নির্বাক হয়ে গেলাম। বলল সে আর স্কুলে যাবে না। আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে কারনটা আর্থিক। ওর মামা কিছু বলেনি পড়া বন্ধ করার ব্যাপারে, কিন্তু ওর মা চাইছিল যে সে তার মামার সাথে দোকানে সময় দিয়ে ওর মামাকে সাহাযা করুক। ওরা দুজন মানুষ ওর মামার সংসারে, তার উপর সাদেকের পড়ার খরচ তার মামাকে বহন করতে হত।

সাদেক যখন ব্যপারগুলো খুলে বলছিল তখন ওর ছলছল চোখগুলো আমার এখনও মনে পরে। আমি লক্ষ্য করেছি ওর বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল যে “আমি আর স্কুলে যাব না”। আমাদের স্কুলের বেতন ভাতা খুব বেশি ছিল না, কিন্তু প্রাইভেট নির্ভর পড়ালেখাই ওর জন্য ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন না বুঝলেও আজ মনে হচ্ছে সাদেকের ঝড়ে পরার এটাই ছিল কারন। আমার স্কুল জীবনের যত বন্ধুকে হারিয়েছি তাদের বেশির ভাগই ঝড়ে পরেছিল আর্থিক অভাব অনটনের কারনে।

আরেকটা বিষয় ঝরে পরাটাকে আরও তরান্বিত করত, সেটা হল পরীক্ষায় খারাপ করা। আমাদের সার্কেলের বেশকিছু ছেলের এমন ও রেকর্ড ছিল যে কোন কোন দিনের প্রত্যেক ক্লাসে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছে, কানমলা বা স্যারের বকা শুনেছে। আমি চেষ্টা করতাম পড়া রেডি করে যেতে, কারন কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার কাছে চরম অপমান লাগত এজন্যই হয়ত আমি আপোষ করে এসেছি। কিন্তু আমার অনেক বন্ধুই চরম বিরক্তিকর এই পড়ালেখার সিস্টেমের সাথে আপোষ করতে পারে নি। বার্ষিক পরীক্ষ্মায় খারাপ করার পর ওদেরকে আর স্কুলে দেখতাম না।

একবার এরকম ঝড়েপরা এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার। যা বুঝলাম ওর পড়ালেখা ভাল লাগে না, আর এভাবে খারাপ করতে থাকলে তার পরিবারও তার পড়ালেখার পিছনে টাকা খরচ করতে রাজি না। মাঝে মাঝে ভাবতাম ইশ্‌ যদি পড়ালেখাটা আরও সহজ হত, আরও মজার হত, তাহলে আর ওদেরকে ছাড়া আড্ডা দিতে হত না। স্কুলে আমারা আরও অনেক মজা করতাম। আজ বুঝতে বাকি নেই আমরা কিভাবে লেখা পড়া করে এসেছি, কেন সাদেক আর নাজিমরা ঝড়ে পড়েছে।

কেন ওদের কাছে পড়ালেখার ভাল লাগত না [আমারও ভাল লাগত না, কিন্তু তারপরও নানা রকম শাস্তির ভয়ে করতাম]। আমরা যে সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে পড়ালেখা করেছি তা আনন্দ পাওয়ার কোন বিষয় ই ছিল না। প্রতিদিন পড়া রেডি করা, ক্লাস করা, বাড়ির কাজ রেডি করা, একই নিয়মে প্রতিদিন, একই সিস্টেমে ১০ বছরের ও বেশি সময় পার করা চরম ধৈর্য্যশীল সুবোধ ছেলে মেয়েগুলো ছাড়া সম্ভব না। আর্থিক অনটনে থাকা ওই ছেলেগুলো প্রতিদিন দুপুরে দুটাকার সিঙ্গারা টিফিন করে, ক্ষুধার্ত পেটে কিভাবে ক্লাসে মনোযোগ দিত তা ভেবে আজ খুবই অবাক হই, সাথে সাথে স্বপ্ন দেখি সেই সুদিনের যখন নাজিমের কাছে ভাল লাগবে তার পড়ালেখা, সাদেক তার মামার ব্যবসায় সাহায্য করবে সাথে সাথে প্রত্যয় আর উদ্দীপনা নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। স্বপ্ন দেখি সে দিনের যেদিন আমরা শিক্ষ্মকে আরও আনন্দময় আর সহজ করে তুলব, গরিব ধনী সকল শ্রেনীর শিক্ষারর্থীর জন্য লেখাপড়া হবে অত্যন্ত আনন্দময় ও সহজ।

[*বানান ভুলজনিত ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থী*]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।