আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঘাইছড়িতে ইউএনও’র ওপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর : ১৪৪ ধারা বহাল, আরও ১ লাশ উদ্ধার : বাঙালিরা আতঙ্কে



রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে বাঙালিদের ওপর উপজাতি সন্ত্রাসীদের হামলা ও ভাংচুর অব্যাহত রয়েছে। সন্ত্রাসীদের আঘাত থেকে খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও রেহাই পাননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে মারধরের পর তার গাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন আগের দিন জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল রেখেছে। সন্ত্রাসকবলিত এলাকা থেকে গতকাল আরও একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

উপজেলার দুর্গম রাসেল স্কয়ার, বাঘাইহাট, সীমানাছড়ি ও গঙ্গারাম এলাকার সবুজ অরণ্যঘেরা জনপদ এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে আশপাশের লোকালয়গুলোতে। এসব এলাকার বাঙালি পল্লীগুলো ধ্বংসস্তূপ ও ছাই নিয়ে শুক্রবারের তাণ্ডবের সাক্ষী হয়ে সুনসান নীরবতায় ভুতুড়ে পল্লীতে পরিণত হয়েছে। এদিকে গতকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার সন্ত্রাসকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গেলে উপজাতিরা তাকে ঘেরাও করে পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানায়। অবিলম্বে এ দাবি মেনে নেয়া না হলে তারা সশস্ত্র সংগ্রামেরও হুমকি দেয়।

গতকাল বাঙালি পাড়াগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সবাই ভয় ও আতঙ্কে রয়েছেন। তারা এ ঘটনার জন্য উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী ও আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থাকে দায়ী করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে বাঙালিদের কোনো নিরাপত্তা ও নাগরিক মর্যাদা নেই। সন্ত্রাসী ঘটনা চলাকালে দিল্লি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনার অর্থই হচ্ছে এখান থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ করা। একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরবে না বলে জানান বাঙালি নেতারা। তারা বলেন, বাঙালিদের বিতাড়িত করতেই প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ মদত ও পৃষ্ঠপোষকতায় উপজাতি সন্ত্রাসীরা গোটা পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেছে।

শনিবার দিনভর সেনাবাহিনী ও উপজাতিদের মধ্যে বাঘাইছড়িতে ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে এক সেনা কর্মকর্তাসহ বহু আহত হয়। উপজাতিরা বাঙালিদের দু’শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেনাবাহিনী ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থাকলেও গতকাল পর্যন্ত প্রশাসন দু’জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে শনিবার পাওয়া গেছে শান্তি চাকমার (২৭) লাশ এবং গতকাল পাওয়া যায় লক্ষ্মী বিজয় চাকমার (৩২) লাশ।

গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়ে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপির গাড়িবহর চার জায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বঙ্গলতলীর বটতলা থেকে ফেরার পথে মাচালং এলাকায় বাঘাইছড়ির ইউএনও এএসএম হুমায়ুন কবিরের গাড়িতে পাহাড়িরা হামলা চালায়। এখান থেকে দ্রুতবেগে ভাইভাইছড়ায় গেলে পাহাড়ি নারী-পুরুষরা আবারও ইউএনওর গাড়ি হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। ইউএনও তাদের হামলা থেকেও রেহাই পাননি। সন্ত্রাসীরা তার গাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়।

প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি এ সময় দ্রুত স্থানত্যাগ করলেও ইউএনও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পাহাড়িরা ইউএনও এএসএম হুমায়ুন কবিরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করলে পুলিশের সহযোগিতায় তিনি খাগড়াছড়ি ফিরে আসেন। অগ্নিসংযোগ ঘটনা পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানানোর জন্য গতকাল সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি ও শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় পাহাড়িরা রাস্তায় গাছ ফেলে পথ অবরোধ করে। শনিবারের সংঘর্ষে নিহত লক্ষ্মী চাকমার লাশ এনে মন্ত্রীর সামনে হাজির করে পাহাড়িরা। তারা রাস্তায় শুয়ে পথ অবরুদ্ধ করে রাখে।

গ্রামবাসী ১৪৪ ধারা ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, ঘটনার বিচার, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানায়। মন্ত্রী এ ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে ৭ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। প্রায় ৩৫ মিনিট অবরুদ্ধ থাকার পর মন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে পথ ছেড়ে দেয় উত্তেজিত উপজাতিরা। এরপর সাজেক ইউনিয়ন পরিষদে পাহাড়ি-বাঙালি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রতিমন্ত্রী। রাসেল স্কয়ারে বসবাসরত ৪০টি বাঙালি পরিবারকে সরিয়ে নেয়া না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দেয় উপজাতিরা।

সেখানে মন্ত্রীর সঙ্গে উপজাতি নেত্রী সোনামনি চাকমা কথা বলেন এবং রাসেল স্কয়ার থেকে ৪০ বাঙালি পরিবারকে তুলে দেয়া, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও পার্বত্য চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান। বাঙালি পরিবারগুলোকে তুলে নেয়া না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে তারা হুমকি দেন। পাহাড়ি নেতারা দাবি করেন, বাঙালি পরিবারগুলো তুলে নেয়া না হলে বাগাইহাট বাজার তারা কিছুতেই চালু হতে দেবে না। অপরদিকে বাঙালি নেতারা বলেন, গত দুই মাস উপজাতিরা বাঘাইছড়ি বাজার বয়কটের নামে চারদিকে পাহারা দিয়ে জনগণকে বাজারে আসতে দিচ্ছে না। এতে ওই বাজারের প্রায় আড়াইশ’ বাঙালি দোকানদার প্রায় অর্ধকোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে।

গত এক মাসে ওই এলকার বাঙালিদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ক্ষেতের ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া, গবাদিপশু লুট করে নেয়া এবং অবরুদ্ধ করে রাখাসহ উপজাতিরা অন্তত ১৪ বার বাঙালিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শুক্রবারও তারা রাতভর বাঙালিদের অবরুদ্ধ করে রাখে। সকালে প্রশাসনের লোকজন গেলে তাদের লক্ষ্য করে তারা উঁচু পাহাড় থেকে গুলিবর্ষণ করলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। প্রতিমন্ত্রী বাঘাইহাট ইউপি কার্যালয়ে গেলে সেখানে বাঙালিদের পক্ষ থেকে ডা. নাজিম কথা বলেন। তিনি গত এক মাসে বাঙালিদের নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন ও অবরোধ করার বিবরণ তুলে ধরেন।

মন্ত্রী তাদের শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার আহ্বান জানান। এ সময় বাঙালিরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন। মন্ত্রি যাদের ঘরবাড়ি পোড়া গেছে তাদের পরিবারপ্রতি ২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। এজন্য তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, পাহাড়ি ও বাঙালিদের একটি কুচক্রী মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে।

তিনি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ ও সর্তক থাকার আহ্বান জানান। মন্ত্রীর সঙ্গে এ সময় খাগড়াছড়ির এমপি শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারমান জ্যোতিন্দ্রলাল ত্রিপুরা, দুই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দুই জেলা প্রশাসক ও রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। এদিকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতিবাদে আজকের সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে দিয়েছে ইউপিডিএফ। এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার কারণে অবরোধ একদিন পিছিয়ে আগামীকাল পালন করা হবে বলে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এছাড়া ঘটনার প্রতিবাদে আজ কালোব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন, ২৪ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে প্রদীপ প্রজ্বলন, ২৫ ফেব্রুয়ারি স্কুল কলেজ বয়কট ও ২৬ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

ওদিকে বাঘাইছড়ির বাঘাইহাট ও গঙ্গারামে বাঙালিদের বসতঘর জ্বালিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে রয়েছে আজ সকাল ১১টায় রাঙামাটি জেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, আগামীকাল খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সম্মুখে মানববন্ধন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ৩ পার্বত্য জেলায় নৌ ও সড়ক অবরোধ। পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আলমগীর কবির জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে নেতারা বলেন, উপজাতি কিছু সন্ত্রাসী পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুত করেছে। তাদের কাছে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীও হার মানতে বাধ্য হচ্ছে।

বাঙালি নেতারা আরও বলেন, বিদেশি কিছু সংস্থা পাহাড়ের পরিবেশ অশান্ত করে তুলছে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে তারা পাহাড়িদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। দিল্লি থেকে বলা হচ্ছে এ ঘটনায় ৫ জন নিহত হয়েছে। এতে পাহাড়িরা আরও উত্তেজিত হয়ে বাঙালিদের ওপর হামলা ও তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।