আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি নীতিবান না, কিন্তু মাঝে মাঝে যে ’বিবেকবাবু’ ডিস্টার্ব করে......

আমি একজন সাধাসিধা মানুষ, অন্য দশজনের মতোই আমারও কিছু নিজস্ব অনুভুতি আছে, কিছু কথা আছে যা আমি সবার সাথে ভাগ করতে চাই....

বড় বড় কথা বলতে অনেকের জুড়ি নেই। ’বড় বড় কথা’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ন্যায়নীতির কথা, মানুষকে উপদেশ দেয়ার কথা, কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় - এই নিয়ে জ্ঞান দেয়ার কথা। দূর্ভাগ্যজনকভাবে (!) আমি নিজেও এই দলে পড়ে গেছি। সময় সুযোগ পেলেই মাথা থেকে ঝুড়ি (উপদেশের) নামিয়ে দেই। এমন না যে সবসময় কথার কথা বলি।

বলার সময় মন থেকেই বলি। কিন্তু কাজের সময়???? সেখানেই যে বিশাল গলদ হয়ে যায় প্রায়ই। তাতে অবশ্য সমস্যা হয়না তেমন, থাপড় দিয়ে মনটাকে সাইজ করে রাখি (All Iz Well....)। শুধু মাঝে মাঝে ’বিবেকবাবু’ একটু ডিস্টার্ব করে। কন্ তো কি করি এই নিচের অবস্থাগুলোতে...? বিবেকবাবু’র ফিসফিসানি-১ঃ আমার বউ গত দুই বছর ধরে একটা সরকারী কলেজের লেকচারার।

তার আগের ২ বছর ছিলো অন্য একটা কলেজে। তো এই নতুন কলেজে তার চ্রম ফুর্তি (আমারও)। কারণ গত ৩/৪ বছর ধরে এখানে সায়েন্সে কোন ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি হয়না। কারণটা সম্ভবত দারিদ্র্য। ফলে গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা’র মতো বিষয়ের শিক্ষকদের পোয়াবারো।

ছাত্রও নাই, তাদেরও ক্লাস নিতে হয়না। অলিখিত নিয়মের মতো তারা সপ্তাহে ১/২ দিন এসে চেহারা দেখিয়ে চলে যায়। প্রায় সবাই-ই ঢাকায় টিউশনি এবং অন্য কিছুর সাথে জড়িত। কলেজটা আবার খুবই রিমোট জায়গায়। এমনই অবস্থা যে, থাকার কোন জায়গা তো নেই-ই, খাওয়া-দাওয়া করার মতো ন্যুনতম মানের কোন হোটেলেও নেই।

তাই মহিলা শিক্ষকদের জন্য মোটামুটি ভয়ংকর অবস্থা। শিক্ষকদের না থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হল এইটা। দ্বিতীয় বড় যুক্তি হল, যে বেতন সরকার দেয়, তাতে সংসার চালানো অসম্ভব। আর যেহেতু দরিদ্র এলাকা, তাই টিউশনিরও কোন সুযোগ নেই। আমার বউ অবশ্য টিউশনি করেনা।

তার না থাকার একমাত্র যুক্তি হলো আমাদের ২টা শিশু (৪ বছর আর ২ বছর বয়সী) লালনপালন, যেটা করার অন্য কেউ নাই। আর মেয়ে বলে সে একটা সুবিধাও পায়। তাকে মাসে একবার যেতে হয়। বেতন-টেতন অবশ্য নিয়মিতই পায়। এখন সমস্যা হলো, আমি যখন আমার বাচ্চাকাচ্চাদের কথা ভাবি বা নিজের ফ্যামিলি লাইফের কথা ভাবি, তখন মনে হয়, চলছে চলুক না, ক্ষতি কি? ওর চাকরিও থাকছে, আবার আমার সংসারও ঠিকমতো চলছে।

(হ্যাপি ফ্যামিলি...হে..হে...হে..)। তাছাড়া ওখানে তো থাকা-খাওয়ার কোন অবস্থাই নেই। একজম মেয়ে কেমনে চাকরি করবে নিয়মিত? ওর যে দুইজন মেয়ে কলিগ আছে, তারা একজন স্থানীয় আরেকজনের স্বামী হলো পুলিশের বড়কর্তা। ফলে দ্বিতীয়জনের কলেজে আসার কোন বাধ্যবাধকতা নেই (বুঝতেই পারছেন)। কিন্তু যখন এইসব আনন্দে মশগুল থাকি, তখন মাঝে মাঝে ’বিবেক’ শালা ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করে, ’কাজটা কি ঠিক হচ্ছে মামু? বেতন নিয়ে যাচ্ছ, কিন্তু কাজ করছো না।

সরকারী মাল, দরিয়ামে ডাল - হয়ে গেল না?” তখন কিন্তু আর জবাব দিতে পারিনা। বরং এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দেই বিবেকবাবুর ফিসফিসানি। বিবেকবাবুর ফিসফিসানি-২ঃ এটাও আমার বউকে নিয়ে। তবে ভিন্ন বিষয়ে। আমার বাসার বাজার থেকে শুরু করে অলমোস্ট সব দ্বায়িত্বই আমার বউই পালন করে, আমি কিছুই করিনা।

(পারলে মনে হয় ওকে দিয়ে আমার চাকরিটাও করিয়ে নিতাম)। আমার কাজ শুধু সংসার চালানোর টাকাটা উপার্জন করা, মাঝে মাঝে ওর সাথে বাইরে যাওয়া আর বাসায় ফিরে বাচ্চাদের সাথে গেম খেলা। তো যেটা হয়, মাঝে মাঝে এতসব দ্বায়িত্বের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ও বিরক্ত হয়ে ওঠে আর আমার ওপর চড়াও হয় এই বলে যে আমি সংসারে কোন সাহায্যই করিনা। এমনকি বেসিক যেসব কাজগুলো পরিবারের পুরুষমানুষটির করার কথা, সেগুলোও করিনা। কথাগুলো যেহেতু ১৫০% সত্যি, আমি তখন ’নিরবতাই সর্বোত্তম পন্থা’ অবলম্বন করে থাকি।

জানি, যে একটু পরেই ওর রাগ পড়ে যাবে, তারপর আবার নিজেই ভুলে যাবে। সুতরাং আমি আছি মহানন্দে। কিন্তু একা থাকলে কখনও কখনও বিবেকবাবু পাশে এসে বসে। আর আস্তে আস্তে বলার চেষ্টা করে, ”তুমি কি কাজটা অন্যায় করছো না সবকিছু ওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে আর নিজে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়িয়ে? সে তো তোমার বয়সীই একজন মানুষ। তাকে এত লোড দেওয়াটা কি ঠিক করছ? নিতান্তই তোমার করার কথা যেগুলো, সেগুলো তো করতে পারো।

” আমি কিন্তু বেশিক্ষণ ওর ভ্যাদভ্যাদানি শুনিনা। বরং এক দাবড়ি দিয়ে শুনিয়ে দেই, ”আমার কি দোষ? ও তো নিজের থেকেই করে আমাকে ভালোবেসে। আর আমি তো এইসব পারিনা। ” বিবেকবাবু হয়তো চলে যায় তখন, কিন্তু ওর প্রশ্নটা আমাকে খোঁচাতেই থাকে অনেকক্ষন ধরে, ’কাজটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না’। আপনারা কি বলেন? বিবেকবাবুর ফিসফিসানি-৩ঃ আমার একটা বদঅভ্যাস হলো, আমি চট্ করে রেগে যাই।

আবার হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে যাই রাগ পড়ে গেলে। আর সবসময় যে খুব জোরালো কারনে রাগ করি, তা কিন্তু না। দেখা যায় যে, আমি হয়তো গল্পের বই পড়ছি বা কোন সিনেমা দেখছি, আমার দুই ছেলে এসে ঘাড় ধরে ঝুলাঝুলি করছে। কারন ওদের সাথে খেলতে হবে। তখন অনেক সময় হয় কি, আমি ২/৩ বার বলি সরে যেতে।

কিন্তু বাচ্চা মানুষতো, বোঝেনা, ওরা করতেই থাকে। উদ্দেশ্য বাবার সাথে খেলবে। তারপর দেখা যায়, হঠাৎ মেজাজ খারাপ করে দিলাম ধুমাধুম মার লাগিয়ে। ওরা ভয় পেয়ে, কষ্ট পেয়ে পালায় আমার কাছ থেকে। আমি যা করছিলাম, তাই করতে থাকি।

কিন্তু শান্তি নাই। ওই ব্যাটা বিবেকবাবু দেখি কানে ফিসফিস করছে, ’মাসুম বাচ্চাগুলোকে অকারণে মারলে? ওরা তো তোমার সংগ পায়না বলে সারাদিন পর তোমার কাছে আসে খেলতে। তুমি কি জানো যে তুমি ওদের কাছে কতটা প্রিয় মানুষ? আর তোমার সামান্য নিজের শখ মেটাতে তুমি এইভাবে অমানুষের মতো মারতে পারলে?” আমি তো মেজাজ খারাপ করে দেই এক ধমক শালাকে, ’ওই ব্যাটা, যা বোঝোনা তা নিয়ে কথা বলতে আসো কেন? আমি কি একটা মানুষ না? আমার রেস্ট নিতে হবে না? আমার নিজের একটু সময় লাগেনা? সবসময় ভালো লাগে এইসব করতে? তাছাড়া ওরা আমার কাছে আসে কেন, ওর মা’র কাছেও তো যেতে পারে। ” আমার ধমকে বিবেকবাবু আস্তে আস্তে চলে যায় হয়তো। কিন্তু চোখের সামনে ভাসতে থাকে আমার ছেলেদের জলভরা চোখ...যেগুলো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তাদের ’অতি প্রিয়’ বাবার দিকে, যে কিনা এই মাত্র তাদের মেরেছে।

সেই চোখগুলো শুধু একটা কথাই বলে, ’বাবা, তুমি আমাকে মারলে কেন? আমি কি করেছি?’ বলেন তো, এই বিবেকবাবুর ফিসফিসানি থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো? কেউ কি জানেন? জানলে আমাকে একটু উপকার করেন না প্লিজ....।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।