আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা

আমরা কারও তােবদাির করিনা

গত শনিবার রাত থেকেই টঙ্গীর তুরাগতীরের দিকে ছিল মানুষের স্রোত। চারদিকের সড়ক ধরে অজস্র নারী-পুরুষ, কিশোর, যুবক বা বৃদ্ধ; কেউ যাচ্ছিলেন একা, কেউ বা দলবেঁধে। রোববার সকালে এই স্রোত বেড়েছে কয়েক গুণ। মানুষের চাপে গতকাল সকাল ১০টায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তুরাগতীরের ১৬০ একরের ইজতেমা ময়দান ছাপিয়ে মানুষের জমায়েত আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

দুপুর সোয়া ১২টায় আখেরি মোনাজাত শুরু হয়। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের সর্বোচ্চ পরিষদ আমলি শুরার সদস্য ভারতের মাওলানা যোবায়রুল হাসান মোনাজাত পরিচালনা করেন। মোনাজাতে মুসল্লিদের জানা-অজানা সব গুনাহ্ মাফ করতে আল্লাহ্র কাছে আকুতি জানানো হয়। মুসল্লিরা এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। মোনাজাতে যা বলা হলো: মাওলানা যোবায়রুল মোনাজাতে সারা বিশ্বের সুখ-শান্তি ও উন্নতির জন্য দোয়া করেন।

সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিয়ে ইসলামের সঠিক পথে ফিরে আসার হেদায়েত করতে তিনি আল্লাহ্র করুণা কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্, তোমার অজানায় কিছু হচ্ছে না, তুমি সবই জানো ও বোঝো, তুমি আমাদের সবার দোয়া কবুল করো। ...আমাদের সবার গুনাহ্ মাফ করে দাও, সবাইকে হেদায়েত করো, সবার অন্তরে প্রেম দাও, তোমার উম্মতকে সঠিক পথে নিয়ে আসো, পুরো মানবজাতির ওপর শান্তি বর্ষিত করো, আমাদের ঈমানকে মজবুত করো, আমাদের সব পেরেশানি দূর করে দাও। ’ ইজতেমা ময়দানে নারীদের বসার ব্যবস্থা না থাকলেও আশপাশের সড়ক, বিভিন্ন বাড়িঘর ও ছাদে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন বয়সের অনেক নারী মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাত শুরুর ঘোষণা হওয়া মাত্রই রাজপথ, ফুটপাত, বাড়ির ছাদ ও বারান্দা, গাড়ি, খোলা ট্রাক, রাস্তার ধারের দোকান, দোকানের সামনের একচিলতে খালি জায়গা—সবখানে লোকজন মোনাজাতে শরিক হন।

অনেকে মুঠোফোনে নিকটজনদের মোনাজাত শোনান। টিভি চ্যানেলগুলো আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে। মোনাজাতের আগে বয়ান: গতকাল সকাল থেকে উপস্থিত লাখো মানুষের উদ্দেশে বয়ান করেন তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশের শুরা সদস্য মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম ও আমলি শুরার সদস্য ভারতের সাদ আহমদ, বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের শুরা সদস্য মাওলানা যোবায়ের বয়ান তরজমা করেন। মাওলানা ওয়াসিফ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। আর মাওলানা সাদ আহমদ তাবলিগের ছয় অসুল—কালেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিহে নিয়ত ও তাবলিগ সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

আখেরি মোনাজাতের আগে মাওলানা যোবায়রুল হাসান হেদায়েতি বয়ান করেন। কিশোরগঞ্জ থেকে আসা নাজমুল আরেফিন জানান, এবারের ইজতেমায় মুরব্বিরা ‘পায়েদল সফর’ (হেঁটে হেঁটে ইসলামের বাণী প্রচার) করে ইসলামের বাণী প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রতিবছরের মতো এবারও তিন হাজারেরও বেশি জামাত গঠন করা হয়েছে। এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ইসলামের বাণী প্রচার করবে, দেশের বাইরেও যাবে কোনো কোনো দল। ভিআইপিরাও শামিল মোনাজাতে: রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ইসলামি রাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

ইজতেমার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত র্যাব-পুলিশের সদস্যরাও মোনাজাতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী ইজতেমা মাঠের অদূরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সদর দপ্তরের ভবনের ছাদে, রাষ্ট্রপতি ইজতেমা মাঠে মূল মঞ্চের পাশে ও বিরোধীদলীয় নেত্রী এটলাস ফ্যাক্টরির ছাদে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। আওয়ামী লীগের জেলা নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর বাটা জুতা কারখানার ভেতরে আসার কথা থাকলেও মুসল্লিদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। ফেরার ভোগান্তি: মুসল্লিদের আসল ভোগান্তি শুরু হয় ফেরার পথে। শহরমুখী মানুষের ঢলে রাজপথে সৃষ্টি হয় বিশাল ‘জনজটের’।

বাস, ট্রেন, নৌকা, রিকশা, ভ্যানগাড়ি—যে যেটাতে উঠতে পেরেছেন, সেটাতেই চড়েছেন। তবে এত মানুষকে ধারণ করার যানবাহন কই? তাই বেশির ভাগ মানুষকেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে হয়েছে হেঁটে। অনেক বৃদ্ধ মানুষকেও দীর্ঘ পথ হাঁটতে দেখা গেছে। তবে বিদেশ থেকে আসা কয়েক হাজার মুসল্লি আরও দু-তিন দিন আন্তর্জাতিক ছাউনিতে থাকবেন বলে ইজতেমার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়ার জন্য কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গতকাল বেশ কয়েকটি বিশেষ ট্রেন টঙ্গীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তনগর ট্রেন ঢাকায় ফেরা বা ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পথে বিমানবন্দর ও টঙ্গী স্টেশনে বিরতি দেয়। এসব ট্রেনের প্রতিটি কামরা উপচে ছাদেও বসেন মুসল্লিরা। ফেরার পথে দেখা গেছে একই অবস্থা। টঙ্গী স্টেশন থেকে যে গন্তব্যেই ট্রেন ছেড়ে যাক না কেন, যাত্রীবোঝাই এসব ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ইজতেমা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই গাজীপুরে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গাজীপুরের সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতকাল ছুটি ঘোষণা করা হয়। কষ্ট উপেক্ষা করেই এসেছেন মানুষ: আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আসা লাখো মানুষের কাছে এসব জাগতিক কষ্ট যেন কিছুই নয়। সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে এসেছেন ৯০ বছরের বৃদ্ধ রমিজ উদ্দিন। ভালোভাবে চোখেও দেখেন না। এর আগেও ৩৬ বার এসেছিলেন তিনি।

জীবনের শেষ সময়ে এসে আরেকবার আসার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি তিনি। প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আর বাঁচি না বাঁচি, শেষমেশ দেখতাম আইছি। ’ শুধু আসা বলে কথা? খানিক দেরি হয়ে যাওয়ায় ইজতেমা মাঠে জায়গা পাননি রমিজ ও তাঁর সঙ্গে আসা আরও ১০ জন। তাঁরা বয়সে প্রবীণ। তীব্র শীতে সড়কের পাশে এখানে-ওখানে তিনটি রাত কাটিয়েছেন তাঁরা।

তার পরও এ নিয়ে কোনো দুঃখ নেই কারও। রমিজ উদ্দিন বললেন, ‘আল্লাহ্র লাইগা আইছ। মোনাজাতে কইমু সারা জাহানের মানুষরে আল্লায় ভালো রাখুক। আর আমারে শান্তিতে নিক। ’ নারায়ণগঞ্জ থেকে সন্তানাদি নিয়ে এসেছেন জাহানারা বেগম।

অনেকখানে হেঁটে শেষ পর্যন্ত টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে ফুটপাতে বসার জায়গা পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘কষ্ট যদি লাগত, তাহলে আসতাম না। ’ নারায়ণগঞ্জের নিজাম উদ্দিন বললেন, ‘আল্লায় আনছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েতে আইছি, এইটাই শান্তি। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের আশায় আসা।

’ শুধু কি গতকাল? ইজতেমায় আসা মানুষেরা তিন দিন ধরে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাষণের অভাবে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছেন আগের মতোই। সাত মুসল্লির মৃত্যু: গতকাল ও আগের দিন রাতে ইজতেমা ময়দানে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার কুতুবপুরের হেলাল উদ্দিন (৫৫) কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ার তিলাপিঠার আবুল হোসেন (৪৫), নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার বালিয়া গ্রামের শহীদুল্লাহ্ (৪৫) ও কক্সবাজারের চকরিয়ার নাজিম উদ্দিন (৪৮) সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ইজতেমা শেষে বাড়ি ফেরার পথে টঙ্গী ব্রিজের নিচে ট্রলার ডুবে তিন নারী মারা গেছেন। একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। অন্য দুজন হলেন জোবেদা (৫৫) ও শাহিদা বেগম (৬৫)।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে ট্রলারটি ডুবে যায়। তিন যাত্রী নিখোঁজ আছেন বলে জানান ট্রলারের একজন যাত্রী। অস্থায়ী হোটেলে ভেজাল খাবার খেয়ে অনেকে আমাশয়-পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিন দিনে এ ধরনের প্রায় ২০ হাজার রোগীকে চিকিত্সা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইজতেমার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে ৬৯ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গতকাল বিকেলে টঙ্গী রেলস্টেশনে ট্রেনের ছাদে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে ১০ জন আহত হন। ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শ্রীপুরেও ইজতেমা: প্রতিনিধি জানান, শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামে বিশ্ব ইজতেমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই সময়ে বয়ান ও মোনাজাত করেছেন আটটি গ্রামের মুসল্লিরা। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার বয়ান ও মোনাজাত মুঠোফোনের সাহায্যে মাইকে প্রচার করা হয়। নারী-পুরুষসহ চার সহস্রাধিক মুসল্লি এতে অংশ নেন।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।