আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃখবোধের অসীম সীমা ...



গতকাল ব্যক্তিগত কিছু কারনে মনটা খুব বিখিপ্ত ছিল...অশান্ত ছিল। ভালো লাগছিলো না কিছুই। আগের রাতেও ঠিক মত ঘুম হয়নি। তাই অফিসেও সেই খারাপ লাগা বিদ্যমান ছিল। সারা দিন প্রায় অফিসের টিভি রূম এ কাটিয়ে দিলাম বাংলাদেশের খেলা দেখে।

লাঞ্ছ টাইমে ২ঘন্টা বাইরে কাটিয়ে আসলাম। অতঃপর আবার খেলা দেখা, টুকটাক কাজ শেষ করলাম। যথারীতি ৭ টা ৩০ এ অফিস থেকে বের হলাম। গতকাল ভয়াবহ জ্যাম ছিল। বাসে করে ফিরছিলাম কিন্তু রাস্তায় জ্যাম ভয়াবহ।

কতখনে পৌছাবো তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। প্রতিদিনের মত আজ বিরক্ত হচ্ছি, গালাগালি করছি। বিরক্ত হতে হতে টায়ার্ড হয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ঘন্টাখানেক পরে ঘুম ভাঙ্গার পরে দেখলাম আমি এখন মহাখালির উড়ালসেতুর বনানির মাথায়। আমি আবার বিরক্ত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

বাস ঠেলাগাড়ির মত ধাক্কাতে ধাক্কাতে চলছে। চলতে থাকুক। এই যাত্রা যেন শেষ না হয়। এক সময় বাসে উঠা হকার এর কাছ থেকে বাদাম আর ছোলা বুট কিনে চিবুতে থাকলাম। রাত ১০টার দিকে নামলাম।

একে তো মন খারাপ তার উপরে সারাদিন বাজে কাটার পর নিজেকেই মনে মনে গালি দিচ্ছিলাম। রিক্সা ঠিক করতে যেয়ে মনটা খিচড়ে গেল। ১০-১২ টাকার ভাড়া চায় ১৫-২০টাকা। মনে মনে ক্রমাগত গালি দিয়ে যাচ্ছি। অতঃপর একটু খোজার পরে ভাড়া নিয়ে কিছু বলার আগেই ১২টাকায় ১রিক্সাচালক যেতে রাজী হল।

আমিতো মহা খুশী । আগষ্ট-সেপ্টেম্বরের হাল্কা ঠান্ডা বাইরে । আমি রিক্সায় উঠে যবুথবু হয়ে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করেছে আর আমি ভাবনার জাল বুনতে শুরু করেছি । হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পরলো চালকের অদ্ভূত ভঙ্গিতে ।

এবার আমার অবাক হবার পালা। দেখলাম রিক্সাচালক অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে রিক্সা চালাচ্ছে। তার দিকে ভালো করে তাকাতেই আমার ঘুমঘুম ভাব, শীত, বিরক্তি সব নিমষেই উধাও হয়ে গেল। আমি আরও অবাক হয়ে খেয়াল করলাম রিক্সাচালকের ১পা নাই প্রায় রানের কাছাকাছি থেকে । সে এক পা নিয়ে একটু কসরত করে খুব সাবলীল ভাবে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে।

যেখানে সে অবলীলায় ভিক্ষা করতে পারতো সেখানে সে একরকম একটা কষ্টের পেশা বেছে নিয়েছে। নিজের সব খারাপ লাগা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। ভাবছিলাম কতই না ছোট মানসিকতার আমরা। কত খুদ্র বিষয়ে আমরা ভেঙ্গে পড়ি অথচ কত কষ্ট করে মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি যে সে কিভাবে এক পা দিয়ে এই কষ্টের কাজটা সাবলীল ভাবে যাচ্ছে যেখানে ২পা দিয়ে এই কাজ করতেও অনেকে গলদ্ঘর্ম হয়ে যাবেন।

ইচ্ছে করছে এখনি ভাড়া দিয়ে নেমে যাই। তার কষ্ট দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। গন্তব্যে আসার আগেই তাকে বললাম বায়ে রাখতে। রিক্সা থেকে নেমেই তাকে প্রশ্ন করলাম আপনার কি এক পা নাই? সে বলল - জি না। আমার অবাক হওয়া আরও বাকী ছিলো।

তাকে আবার প্রশ্ন করলাম কতদিন ধরে রিক্সা চালান? সে বলল - ২০ বছর। সাথে সাথে আমি ফিরতি প্রশ্ন করলাম পা ছাড়া কতদিন রিক্সা চালান? তার নির্লিপ্ত উত্তর - ২০ বছর । গলার কাছে আটকে থাকা বাতাসটুকু হুশ করে বের হয়ে গেল। এও কি সম্ভব!!! জিজ্ঞাসা করলাম পা হাড়ালেন কিভাবে? বলল - গাছ থেকে পড়ে গেছিলাম। হাত পা ২টাই ভেঙ্গে গেছিলো।

হাতের জোড়া ভালো হইছে। পায়ে পচন ধরছিলো। কেটে ফেলতে হইছে। আর বলল - আর রিক্সা চালামুনা। দেশে গিয়া অন্য ব্যাবসা করমু।

কথাগুলো বলতে বলতে কখন যে তার হাত ধরেছিলাম বলতে পারবো না। মানিব্যাগ থেকে ৩০টাকা বের করে তার হাতে গুজে দিলাম। ফিরতে ফিরতে তার কথাই ভাবছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম ৫০টাকা দিলে তার হয়ত একটু উপকার হত...আমার কি খুব ক্ষতি হত?? দৌড়ে আবার রাস্তার কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু খুজে পেলাম না তাকে।

অপরাধবোধ নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়...কিন্তু বার বার মনের পর্দায় মুখ ভর্তি দাড়ি ওয়ালা ১পা ছাড়া মানুষটার ছবি ভেসে আসছিলো, তার অদ্ভুত ভাবে রিক্সা চালানোর ভঙ্গি...তার বলা কথাগুলো ..ভাবতে ভাবতে মনে হলো ৫০টাকা দিলে আমার কি খুব ক্ষতি হত??? কতটাই নিচ আমি... পরে অনেকদিন তাকে খুজেছিলাম কিন্তু আজ অবধি পাইনি!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।