আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাসিনার ভারত সফর: যৌথ ঘোষণার ব্যবচ্ছেদ



প্রথম পর্বের জন্য Click This Link দ্বিতীয় পর্ব: আগের পর্বে বলেছি কেন আমার বিশ্বাস যৌথ ঘোষণা ড্রাফট ভারতীয় সাউথ ব্লকের করা। সেই সন্দেহের কারণ হিসাবে দুই একটা উদাহরণ ওখানে বলেছি। এবার যৌথ ঘোষণা লেখার ষ্ট্রাকচারের দিকে পাঠকের মনোযোগ নিব। আগের পর্বে বলেছি ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে কী কী বাড়তি সুবিধা নিতে চায় যেগুলোকে আর বাড়তি সুবিধা না বলে কিভাবে আমাদেরকে বেধে দাসখত লিখিয়ে নিতে চায় তা বলাই ভাল - এর একটা তালিকা আগের পর্বে দিয়েছি। যৌথ ঘোষণার লেখার ষ্ট্রাকচারও তৈরি হয়েছে ভারতের ঐ একই চাওয়া পাওয়ার নিরিখে।

এটা একটা যৌথ ঘোষণা অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের স্বার্থ দেখার দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল যেখানে যেখানে থাকবে কেবল সেগুলোই ওখানে থাকতে, প্রতিফলিত হতে পারে; কেবল ভারতের স্বার্থের দলিল হয়ে ওতে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করার কোনই কারণ থাকতে পারে; যদি থাকে তবে ওটা দাসখত; তাই হয়েছে, যৌথ ঘোষণার মানে হয়ে গেছে দাসখত লিপি। ধারাবাহিকভাবে যৌথ ঘোষণায় ভারতের যে স্বার্থ ও তা দেখার দৃষ্টিভঙ্গী আছে তা ওর ৫১ পয়েন্ট ধরে কথা বলব। এক. ভারতের গ্লোবাল ও লোকাল ভিশনে চাওয়া পাওয়া, যৌথ ঘোষণার ১২ নম্বরের বিষয় এটা। নীতিগত ধরনের এই ১২ নম্বর পয়েন্টের পর, এটাকে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে পরের ৪৭ ও ৪৮ নম্বরে। এসবে বিষয় এখানে ভারতের মুল লক্ষ্যের বিষয় হলো, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের ভেটো ক্ষমতাধারী সদস্যপদ লাভের খায়েস।

বলা হয়েছে, shared their outlook on the strengthening and reform of multilateral institutions in which developing countries, [আমি কেবল গুরুত্ত্বপূর্ণ শব্দ বা শব্দাবলী এখানে টুকছি। পুরা যৌথ ঘোষণা Click This Link এখানে দেখতে পারেন। ] multilateral institutions মানে জাতিসংঘ, জলবায়ু সম্মেলন ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে, এখানে সুনির্দিষ্টভাবে জাতিসংঘের কথা মনে করা হয়েছে কারণ ওরই reform এর কথা এখন বাজারে চলতি এবং এখানে তথাকথিত reform শব্দের আড়ালে ভারত নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভেটো ক্ষমতা পাবার জন্য আকাঙ্খী - এটাই মুল কথা। আমাদের রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখলে এটা একটা বদ আকাঙ্খা; কারণ, ভেটো ক্ষমতা না থাকতেই গায়ের জোড়ের উপরে দাড়ানো ভারতীয় কুটনীতি চালিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলে গলা টিপে মারা, জোড়জবরদস্তি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, পছন্দের সরকার কায়েম ও দাসখত লিখে নেবার কারবার চালাচ্ছে; এর উপর তাতে ভেটো ক্ষমতা আমারা আন্দাজ করতে আমাদের কী অবস্হার ভারত আমাদেরকে ফেলতে পারে; ফলে আমাদের দৃষ্টিতে এটা একটা "বদ আকাঙ্খা"। এতে জাতিসংঘের কাছে নালিশ উপস্হাপনের দরকার বা সুযোগ থাকলে সে সুযোগটাও আর থাকবে না।

ভারতীয় ভেটো নিরাপত্তা কাউন্সিলের যে কোন সিদ্ধান্তের নিয়ামক হয়ে উঠবে। এর মানে দাড়ালো, এটা ভারতের প্রতি আমাদের কোন ঈর্ষা কাতরতার প্রশ্ন নয় যে ভারত ভেটো ক্ষমতা পেলে আমাদের গা জ্বলতেই হবে, সেজন্য "বদ আকাঙ্খা" বলা হচ্ছে। সাধারণভাবে বললে, বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে যদি দেখতে চাই, ভারত এই অঞ্চলের একজন ভেটো ক্ষমতাধারী হবার আকাঙ্খা করার আগে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে আমাদেরও স্বার্থের দিকে তার খেয়াল আছে, খেয়াল করে, একটা লং টার্ম ভিশন তার আছে যার মধ্যে আমরাও আমাদের স্বার্থ দেখতে পাই ফলে, আমাদেরও প্রতিনিধি সে হতে পারে - তবেই না আমরা ভারতের আকাঙ্খার মধ্যে আমাদেরও স্বার্থ দেখব, সমর্থন জানানোর প্রশ্ন তখন আসতে পারে। অথচ আমরা কী দেখছি, ভারতের কূটনীতি এখনও পেটি দোকানদারের মত, অন্যের স্বার্থের দিকে তাকালেও যে নিজের আরও বড় স্বার্থ হাসিল হবার সুযোগ তৈরি হতে পারে - এটা কোন ছোট দোকানদারের ভাবনার অতীত, নীচু সংকীর্ণ মানুষের যেমন নগদের লোভে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে এদের মনে এসব ভাবনা ধরা পরার কথাও নয়। সামরিক ক্ষমতার জোড় দেখিয়ে আমাদের বর্ডারে নির্বিচারে আইনকানুন তোয়াক্কা না করে আমাদের মানুষ মারছে - এই হলো আমাদের অ"সৎ" প্রতিবেশী; আর একেই নাকি আমরা নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভেটো ক্ষমতায় দেখতে চাই - এই অসুস্হ ভাবনা বদ আকাঙ্খা আবার আমরা নাকি শেয়ার করি - হাসিনা সেই দাসখতের কাগজে সাক্ষর করে এসে দাবী করছেন তাঁর সফর নাকি ১০০ ভাগ সফল! - সত্যিই এটা আত্মস্বার্থ ভুলে খিদমতের একটা এক তুলনাহীন নজির, নবম আশ্চর্যও হয়ত।

ভারতের পিনাক রঞ্জনকে একটা কারণে আমার ভালই লাগত, ভারতীয় কুটনৈতিক চিন্তার ষ্টাইল বা লেভেল বুঝার জন্য তিনি একজন আদর্শ প্রতিনিধি, আমি মানি। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি "আগে নিজে না খেয়ে তো আপনাদেরকে চাল দিতে পারব না" - নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। সিডওর পর আমরা কিন্তু ভারত তার চাল পয়সা দিয়ে আমরা কিনে, আমাদের আমদানি করতে দেক এমন প্রস্তাবও আমরা করিনি; শকুনের সহমর্মিতা দেখাতে এসে - পিনাক যার অধীনে চাকরি করে নিজের অন্নের ব্যবস্হা করেন - সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জ্জি যেচে আহ্লাদিত হয়ে একথা বলে গিয়েছিলেন। অথচ পিনাক সেই অসভ্যতার নজির দেখালেন আমাদের; নিজের হাঁড়িতে যদি চাল না থাকে তবে দাওয়াত করার শঠতাকে আমরা কী বলতে পারি? এটাই হলো, ছোট মনের দোকানদার চিন্তা, ভারতীয় কূটনৈতিক চিন্তার দৌড়। আমাদের ন্যায্য হিস্যার পানি ওরা উজানের দেশ বলে বলছে, আগে ওদের প্রয়োজন মিটাতে হবে, ওরা প্রায়রিটি - এরপর যদি বাচে তখন চিন্তা করে দেখবে তা আমাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় কী না - এই হলো ওদের কূটনৈতিক ভাবনার লাইন, মিলায়ে দেখেন পিনাকের চাল-তত্ত্ব এটারই ট্রু রিফ্লেকশন, এক আদর্শ প্রতিনিধিত্ত্ব।

এই পেটি দোকানদারি কুটনৈতিক চিন্তার এবার ভেটো ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে, এটাই নাকি ভারতের সাথে বাংলাদেশের "shared their outlook" - একই দৃষ্টিভঙ্গী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থ; তাই হাসিনার স্বাক্ষর ও সফর শতভাগ সফল। এটা কি বোধ শক্তিহীনতা, লোপ পাবার ঘটনা? আমি জানি না। তবে একটা মজার ব্যাপার হলো, যৌথ ঘোষণার এই ১২, ৪৭ ও ৪৮ পয়েন্টে যেখানে ভারতের ভেটো ক্ষমতা লাভের খায়েস পরিপূর্ণ - এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কী, কেন বাংলাদেশকে ভার‌তের সাথে গলা মিলাতে তার জাস্টিফিকেশন টানতে গিয়ে যৌথ ঘোষণা নিজেই আরও ন্যাংটা হয়েছে। বলছে, in which developing countries have an effective voice and participation. - মানে developing countries হিসাবে বাংলাদেশ ও ভারত "আমরা একই নৌকার যাত্রী" এমন একটা ধুয়া তুলে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থের নৌকায় তুলতে চেয়েছে ভারত। ভারত নিজেকে, এক হবু বা হয়ে গেছে এমন, অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার মনে করে - ফলে এর সমতুল্য মাপের দুনিয়া ভাগবাটোয়ারায় প্রভাব ক্ষমতা দাবী ও সে যুক্তিতেই ভেটো ক্ষমতা চাচ্ছে।

এখন নিজের এই বদ আকাঙ্খার নৌকায় বাংলাদেশকে সামিল করতে ঠিক এর উল্টা - developing countries এর ধুয়া তুলে যেন আমাদের কাতারে নেমে আসার ভান করছে। অথচ হয় ভারত এক "অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার" অথবা সে আমাদেরই কাতারের কোন developing countries এর বাইরে তো কিছু ভাবার সুযোগ নাই; কিন্তু ভারত সময় সুযোগ বুঝে যখন যেটা কাজে লাগে এভাবে, আমাদের সাথে developing countries এর কাতারে নামার ভান করে আবার এখানে দাড়িয়েই সেখান থেকে দাবী করে, ওকে ভেটো ক্ষমতা দিতে আমরাও যেন দাবী করি; শুধু তাই না এটাও নাকি আমাদের দাবি; ভারতের সাথে যৌথ ঘোষণা দিয়ে হাসিনার একথা জানিয়েছে । বোশি দিনের কথা না, এই তো সর্বশেষ কোপেনহেগেন সম্মেলনে মনে করে দেখুন, ভারত চীনের সাথে রীতিমত চুক্তি করে জোট বেধে পশ্চিমের বিরুদ্ধে এক তৃতীয় পক্ষ হিসাবে খাঁড়া হয়েছিল, দাবী করেছিল দুনিয়াকে আরও কিছুদিন ধ্বংশ করতে তাদেরকে দিতে হবে, এটাই নাকি তাদের উন্নয়নের দাবি, তাদের স্বার্থ। সম্মেলন থেকে কোন প্রটোকলে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকলে তারা তা তৈরি হতে দিবে না - এই ছিল তাদের হুমকি বা আবদার। পশ্চিম এটাকেই তাদের স্কেপরুট, বের হবার সুবিধা হিসাবে ব্যবহার করে।

চীন ভারতের এই অবস্হানের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে পশ্চিমও সর্বশেষ কিয়োটো প্রটোকলে তাদের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, এই ছুতায় সেখান থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। এর নীট ক্ষতি হলো আমাদের মত দেশগুলোর; পরিস্হিতি হলো, ভাগের মা প্রকৃতির আর সৎকার বা গঙ্গা লাভ ঘটলো না। দুনিয়ায় "উন্নত আর উন্নয়নশীল" বা "ধনী ও গরীব" অর্থনীতি - এভাবে দীর্ঘদিনের এই দুই ভাগ চালু হয়ে ছিল। একালে তৃতীয় এক নাম হাজির হয়েছে। "উন্নয়ন" কারবারী বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, জি-৮ থেকে জি-২০ - এদের সবার খাতাপত্র Rising Economy এর দেশ বলে নতুন এক ক্যাটাগরি বহুদিন থেকেই চালু হয়ে গেছে।

এই গ্রুপের শীর্ষে চীন ভারত ব্রাজিল ও ইদানিং সাউথ আফ্রিকাও নিজেদের এই নতুন পরিচয়ে পুলক বোধ করে। স্বভাবতই এটা ভারতের নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন। অথচ হাসিনাকে দিয়ে দাসখত লেখায় নিতে চুপচাপ ঝুপ করে Rising Economy এর জোব্বা ফেলে developing countries এর জোব্বা গায়ে তুলে নিয়েছে, ভেবেছে কেউ টের পাবে না। নেকড়ের ভেড়া সাজার এই ছল করে ভারতের বেকুব কুটনীতি ভেবে নিয়েছে এশিয়ার ভেটো ক্ষমতার অধিকারী হওয়া খুবই সহজ কাজ। হাসিনাকে দিয়ে দস্তখত হাসিল করলেই সব হয়ে যাবে।

অথচ, এতে বাংলাদেশের জনগণের যত ঘৃণা তাকেই আরও সে বৃদ্ধি করেছে - সুদে আসলে নিশ্চয় এর মাশুল একদিন তাকে দিতে হবে। দুই: এবার পরে প্রসঙ্গ ১৩ নম্বর পয়েন্টে যাব। এটা হলো, রক্তচোষার মত বাংলাদেশের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা আদায় করে নেবার মুখবন্ধ বা গানের মুখরার মত। শুধু ট্রানজিট সংক্রান্তই পয়েন্টই আরও - ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৩৩, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ - এই নয়টা। এই নয়টার মুখরা হলো ১৩ নম্বর পয়েন্ট, এখানে আগে নীতিগত ভাবে বাংলাদেশকে বেধে নিয়ে এরপর আরও নয়টা পয়েন্টে মারতে মারতে বাংলাদেশকে একদম ছিবড়া করে ফেলা হয়েছে।

মুখরা ১৩ নম্বর পয়েন্টে বলা হচ্ছে, peace and stability অর্থাৎ শান্তি ও স্হিতিশীলতা আমাদের দুই দেশের উন্নতির জন্য খুব দরকার। পাঠক বাক্যের গাথুনিসহ একে বুঝা আমাদের দরকার আছে, তাই নীচে এটা হুবহু তুলে দিলাম - 13. The Prime Minister of Bangladesh and the Prime Minister of India recognize that peace and stability in the region is necessary for development and well-being of the people of their respective countries. In this context, they emphasized the importance of close cooperation between India and Bangladesh and the need to effectively harness their respective resources for the good of the peoples of the two countries. সোজা বাংলায় বললে, দুই প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেন যে যার যার দেশের ভালর জন্য ও উন্নতির জন্য এ'অঞ্চলের শান্তি ও স্হিতিশীলতা দরকার। এই প্রেক্ষিতে, ভারত ও বাংলাদেশ ঘনিষ্ট সহযোগিতার গুরুত্ত্বের উপর তারা জোড় দিচ্ছেন এবং যার যার দেশের সম্পদ (resources) দুই দেশের জনগণের ভালর জন্য কার্যকরভাবে কাজে লাগানো দরকার মনে করছেন। এখন ঘটনা হলো, সম্পদ (resources) হলো যার যার (respective) দেশের কিন্তু তা কাজে লাগায় ফেলতে হবে দুই দেশের জনগণের ভালর জন্য এবং কার্যকরভাবে তা হতে হবে। এতো দেখা যাচ্ছে একেবারে ভাই ভাই, হরি আর হরের আত্মায় মিইলা একেবারে হরিহারাত্মা - সাধু সাধু।

পাঠক, যার যার বা respective শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করেন, ইংরাজি বয়ানে আমার দেয়া আন্ডারলাইন অংশে। সম্পদ বা resources এর আগে respective আছে কিন্তু কাজে লাগানোর বেলায় আর যার যার বা respective নাই, এটাকে good of the peoples of the two countries বলে ঘাপলা করে রাখা হয়েছে। অথচ বলতে পারত, "যার যার জনগণের ভালর জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করা দরকার, কারণ, সম্পদ বা resources টা কিন্তু যার যার। ফলে এটা হতে পারত, need a deep interweaven cooperation to effectively harness their respective resources for the respective good of the peoples of the two countries. - এরকম কিছু একটা। নাইলে পাঠক ভেবে দেখুন, আমার সম্পদ দিয়ে ভারতের জনগণের ভাল দেখা কী আমার কাজ নাকি, আর ভারতের সম্পদ দিয়েও আমার জনগণের ভাল দেখার দরকার নাই।

আমার জনগণের কি সে ভাল হবে সেটা আমারেই দেখতে দেন, একইভাবে ভারতেরও - তবে এই কাজে আমরা কিভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি, কি দেয়ার - কি নেয়ার বিনিময় করতে পারি, আসেন সেটা নিয়ে আলোচনা করি। এটা হতে পারে, দরকারও আছে। উনারা যেইটাতে যেইভাবে ভাল হইতেছে দেখতাছেন, সেইটাতে সেইভাবে তো আমার ভাল নাও হইতে পারে। একটা সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেই। অসম বিকাশে তলে পরা পূবের সাতবোন রাজ্যে ভারতের বাকি অংশের তুলনায় বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সংক্রান্ত একটা কমপিটিটিভ এ্যডভ্যানটেজ আছে।

অন্তত দূরত্ত্ব, পরিবহনের হাঙ্গামা ও খরচের কারণে। ব্যাটারি, সিমেন্ট, সাবান ইত্যাদিতে আমরা যতটুকু সবল হইছি তার বাজার আছে ওখানে। সারা বাংলাদেশ কিন্তু ভারতীয় পণ্যের জন্য সয়লাব বাজার হইয়া আছে। আমরা ভারতীয় পণ্যে আমাদের BSTI এর সীল নাই, কিংবা ঢাকায় বেচতে গেলে আলাদা কোন আবগারি ট্যাক্স লাগব এই বইলা কোন অশুল্ক বাধা আরোপ করি নাই। অথচ সাতবোনের এই ছোট বাজারে আমাদের অল্প কটা পণ্য - এইটাও ভারতের সহ্য হয় নাই।

তারা আমাদেরই বুকের উপর দিয়া হাইটা (আমার রিসোর্স ব্যবহার কইরা) ঐ বাজার নিজেদের দখলে নিতে চায়। আমারে কয় ট্রানজিট দেও; এটা নাকি যার যার দেশের সম্পদ (resources) দুই দেশের জনগণের ভালর জন্য কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হইতেছে! আমি যে কমপিটিটিভ সুবিধা কাজে লাগাইতে (effectively harness) আর পারব না এর বিনিময়ে আমার তো কিছু পাওয়া দরকার। এটা তো এমন হইতে পারে না, যে ভারতের দুই অংশে যাতাযাতের জন্য মাঝখানে আমি আছি বইলা এখন ভাই ভাই আওয়াজ তুইলা কইতে হইব, "শান্তি ও স্হিতিশীলতা"র স্বার্থে" যার যার দেশের সম্পদ (resources) দুই দেশের জনগণের ভালর জন্য কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হইতে হইবে! আরে, একই ভারতের দুই রাজ্যও তো পণ্য চলাচলে পরস্পর পরস্পরের উপর আবগারী ট্যাক্স বসায়ে রাখছে। আর বাংলাদেশ ও ভারত তো আলাদা রাষ্ট্র, এখানে রাষ্ট্রস্বার্থ আলাদা। এটাকে সুবিধামত ভাইভাতারি আওয়াজ তুইলা আড়াল করা যাইব না, প্রশ্নই আসে না।

গ্রাম দেশে একটা কথা চালু আছে, কয় ভাই-ভাতারি করবি না। এই যৌথ ঘোষণায় ভারত আমাগো লগে যা করছে এটা ভাইভাই না ভাই-ভাতারি। ভাইভাতারি কথার মানে হলো, কোন মেয়ের ভাইয়ের সাথে যে সম্পর্ক তা ভাতারের সাথের সম্পর্ক দিয়ে অদলবদল করা যায় না, দুটাকে মিশানো যাবে না। ভাই-সম্পর্ক ভাইয়ের সাথে, আর ভাতারসম্পর্ক ভাতারের সাথেই হতে হবে। ভাতারকে ভাই গণ্য করা যায় না, আবার ভাইকেও ভাতার গণ্য করার সুযোগ নাই।

বাংলাদেশ ও ভারত দুইটা আলাদা রাষ্ট্র, দুটো আলাদা স্বার্থ - একে শঠতায় আবেগে ভাই ভাই আওয়াজ তুললে এটা ভাই-ভাতারির মতই একটা ঘটনা। তো ১৩ নম্বর পয়েন্টে এই ভাই-ভাতারি চাতুরি রেখে পরবর্তি ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৩৩, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ - এই নয়টা পয়েন্টে ট্রানজিটের মুলনীতি রচনা করে নেয়া হয়েছে। এই নয় পয়েন্টের বিস্তারে পরে যাব এর আগে ১৪ নম্বর পয়েন্ট দেখে নিব। কারণ, ১৩ নম্বরে মুলনীতি বলে নেবার পর সেই সুযোগে ১৪ নম্বরে ভাইভাতারির চাতুরি সীমানা কেমন বিস্তার করে নেয়া হয়েছে তা দেখতে পাব। "শান্তি ও স্হিতিশীলতা"র স্বার্থে "যার যার দেশের সম্পদ (resources) দুই দেশের জনগণের ভালর জন্য কার্যকরভাবে কাজে লাগানো দরকার মনে করছেন - ১৩ নম্বরের একে যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়নে হাসিনার দাসখত নেবার পর, এইবার ১৪ নম্বর পয়েন্টে দাবী করা হয়েছে এইটা নাকি mutually shared vision for the future হয়ে গেছে।

ফলে এই ১৪ নম্বরে এরপর mutually shared vision এ কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে তার একটা তালিকা জুড়ে দিয়ে লিখছে, which would include cooperation in water resources, power, transportation and connectivity, tourism and education. ট্রান্সপোর্টেশন ও কানেকটিভিটি শব্দে বোল্ড করা আমার। পাঠক এখানে বুঝে নেন ট্রানজিট ক্যামনে কচায় কচায় এইখানে ঢুকছে। এইগুলা সবই নাকি আবার comprehensive framework of cooperation for development between the two countries, অর্থাৎ দুই দেশের সামগ্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বা চিহ্নিত জায়গা হলো এইগুলা এবং দুই প্রধানমন্ত্রী একমত হইয়া এটাকে vision for the future বইলা হাসিনা একে গলায় লটাকায়ে লইছে। কেবল ট্রান্সপোর্টেশন ও কানেকটিভিটির ক্ষেত্রেই নয় সামগ্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র ঐ ছয়টা প্রত্যেকটাতে ভারতীয়দের বুঝ, তাদের করা অর্থ আমাদের চেয়ে ভিন্ন। তবু এটা নাকি mutually shared vision for the future, ওটা আমাদেরও স্বার্থ।

যেমন water resources এর ভারতীয় মানে হলো, ফারাক্কা বা তিস্তা ইস্যুতে আগেই অনেকবার বলেছি, ওদের পানির অসীম প্রয়োজন মিটবার পর যদি থাকে তবে বাংলাদেশ পাইতে পারে, নইলে হয়ত আল্লাহ দায়ী পানি কেন কম দিছে; এছাড়া টিপাইমুখ, ওখানে water resources এর ব্যবহারে ফারাক্কা বা তিস্তার মত অসীম প্রয়োজন মিটবার পর আর একটা বিশেষ দিক আছে, পানিবিদ্যুত। এভাবে ভারতের সব প্রয়োজন মিটানোর পর বাংলাদেশের জন্য কী হয় দেখা যাবে। হাসিনা বলেছেন, যা নাই অর্থাৎ টিপাইমুখ বাঁধ এখন নাই - তা নিয়ে এত কথা বলার কি আছে। এর আগে ভারতের কথা বিশ্বাস করা ছাড়া পথ কী। অর্থাৎ হোক আগে, ফারাক্কার মত সারা সিলেট ও নীচের এলাকা শুকায়ে মরুক এরপর ফারাক্কার মত কান্নাকাটি কিছু একটা করা যাবে।

উনার সংসদ সদস্যরা ভারতীয় হেলিকপ্টারে বসে আকাশ থেকে দেখে আইছে ওখানে ক্ষতির কিছু নাই, বরং লাভ হইব। ফলে সামগ্রিক সহযোগিতাই তো হইতেছে। এই হলো, water resources নিয়ে ভারতের এবং হাসিনারও সামগ্রিক সহযোগিতা চিত্র। এরপরের সামগ্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র হলো, power, মানে বিদ্যুৎ। এর ভারতীয় মানে হলো, এখন সাতবোন রাজ্য এলাকায় চাহিদার চেয়ে চারগুণ বেশি উৎপাদন ক্ষমতা আছে, এটা আরও বাড়বে।

এটাকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বাংলাদেশের গ্রীড ব্যবহার করে ভারতের অপর পারে নিতে হবে। এই সুযোগে বাংলাদেশের গ্রীড একেবার ভারতের দুই অংশের সাথে সংযুক্ত করে ফেলতে, শুরুতে না হয় বলল এর থেকে মাত্র ২৫০ মেগা বাংলাদেশকে দিবে। ভারতের দিবে বললে তো কোন অসুবিধা নাই, কারণ এমন দাম ধরবে যে বাংলাদেশ বলবে না দরকার নাই। এখনই শোনা যাচ্ছে ওর ইউনিট প্রতি দাম রাখবে আড়াই রুপী অর্থাৎ পোনে চার টাকা; ফলে ভারত বাংলাদেশকে বলতে পারে দেখেন পোষাইলে নিবেন নাইলে যান গা। গ্রীড ভাড়া নিয়ে খুশি থাকেন।

এই হলো, power বিষয়ে ভারতের সামগ্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্রের ভাবনা। এরপরের transportation and connectivity নিয়ে আলাদা পরের পোষ্টে কথা বলব। বাকি থাকল tourism and education, এর মধ্যে tourism আপাতত অলংকার মনে হচ্ছে কারণ যৌথ ঘোষণায় এনিয়ে কোন বিস্তারি পয়েন্ট নাই। তবে পরবর্তীতে, যদি না এর মানে হয় ভারতীয় ট্যুর অপারেটররা বাংলাদেশে অফিস খুলে বসবে; তাদের প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথের প্রাইভেট এয়ার ফ্লাইট কোম্পানীগুলোকে বাঁচাতে ভারত দর্শনের বিভিন্ন প্যাকেজ হাজির করবে। সবশেষে, education, এর ভারতীয় মানে যৌথ ঘোষণার ৪২ নম্বর পয়েন্টে আবছা করে পাওয়া যায়।

education বা স্কলারশীপ শুনলে অনেকের খুশি লাগতে পারে, কিন্তু বছরে ৩০০ স্কলারশীপের মুলাটা সরকারি কর্মচারিদের জন্য সীমাবদ্ধ। সরকারি কর্মচারিদের ট্রেইন করার জন্য আমাদের কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে, বা ফান্ড কনসট্রেইনে আছে এমন কথা আমরা শুনিনি। তবে বেছে কেবল সরকারি কর্মচারিদের পছন্দ করা নিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কী চলছে তা মনে করতে পারি। একটা গরীব রাজস্ব আয়ের দেশে রাষ্ট্রের গুরুত্ত্বপূর্ণ কর্মচারিদের বিদেশী ট্রেনিং ও স্কলারশীপের লোভ দেখানোর মানে কী হয় - এটা আমরা ভেবে দেখতে পারি। সাধারণভাবে বললে প্রাইভেট চাকরির তুলনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সরকারি কর্মচারিরা আন্ডারপেইড, স্বল্প বেতনের কর্মচারী।

আমি যোগ্যতার প্রসঙ্গে এখানে যাব না। প্রতিরক্ষাসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারিদের বেতন জোগাতে হয় সরকারি রাজস্ব আয় থেকে, তাও এই আয়ের ৭০ ভাগ ব্যয় হয়ে যায় শুধু বেতন যোগাতে। এবার বেতন বাদে প্রতিষ্ঠান চালানো, উন্নয়ন ইত্যাদির বাজেট আসে সংস্কার ইত্যাদির কথা বলে ডোনারদের টাকায়, ঋণ অথবা অনুদানে। কিন্তু সেনাবাহিনীর একটা গুলি কেনার খাতেও কোন ঋণ অথবা অনুদানে পাওয়া যায় না, ওটা সম্পূর্ণ চলতে হয় নিজের রাজস্ব আয় থেকে। এই পরিস্হিতিতে স্বল্প আয়ের সেনা কর্মচারীর পেশাগত ট্রেনিং, স্কলারশীপ কথা বলে পশ্চিম দেশে বিশেষত আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে।

এর নীট মানে হলো পুরা সেনাবাহিনীকে ভাবাদর্শের দিক থেকে এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যমে অনুগত বানিয়ে ফেলা। এর উপরে এখনকার শান্তি মিশনের চিৎকার আছে। সম্প্রতি ভারতের এক প্রাক্তন কুটনীতিবিদ আমাদের সেনাবাহিনীকে স্ব-রাষ্ট্রেস্বার্থের বুঝ থেকে দূরে রাখতে আরও বেশি বেশি করে শান্তি মিশনে তাদের এনগেজ রাখতে আর্টিকল লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলা বিবেচনায়, এককথায় বললে আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের রাষ্ট্রের কব্জায় নাই। অপহরণ ব্যবসায় স্কুলের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে যেমন বাচ্চার বাবাকে কব্জা করা হয়, একেবারে ঠিক সেভাবে, শান্তি মিশনের লোভকে কে কিডন্যাপ করে মিশন থেকে সেনাদের বাড়ি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবার জাল চিঠি তৈরি করে ১/১১ সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এভাবেই ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।

এটা নিশ্চয় আমাদের জানা আছে। কাজেই আমাদের গরীব দেশের রাজস্ব দশা, স্বল্প বেতনের রাজ-কর্মচারি - এসব বাস্তব পরিস্হিতিতে সরকারি কর্মচারিদের টার্গেট করে স্কলারশীপের মানে কী, আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের উপর এর প্রভাব কেমন হতে পারে আন্দাজ করতে চাইলে করা যেতে পারে। একাজে বছরে ভারতের দশ বিশ কোটি টাকা ইনভেষ্টমেন্ট, কিন্তু তা বিপুল রিটার্ন বয়ে আনবে বলাই বাহুল্য। আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.