আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যশের সেরা যশোর

আমি একজন প্রতিভা শূণ্য মানুষ প্রাচীনতম জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম বংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জেলা হলেও দক্ষিন বঙ্গের অনেকের মতে যশোর, বাংলাদেশের সবচাইতে প্রাচীন শহর বা সর্বপ্রথম শহর। তদুপরি বাংলাদেশের রাজধানী, বিভাগীয় শহর, সিটি কর্পোরেশন বাদে যে জেলার নাম প্রথমেই স্মরন করতে হয়, সেটাই যশোর। মফঃস্বল শহর হিসেবে এর সবগুলো থানাই উন্নত ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধে সবার প্রথম থেকেই বীরত্বের সাথে সেতাবগঞ্জকে সাথে নিয়ে সবার আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে এই জেলাটি। সেই ছয়ই ডিসেম্বর।

এমনকি ইংরেজ শাসনামলেও যশোরের ব্যারাকপুর থেকেই প্রথম সসস্ত্র ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর যশোহরের মুজিবনগরই ছিল বাংলাদেশের রাজধানী। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যশোর সেক্টর অনেক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে এই সেক্টরের সকল সফল অপারেশন ও স্বাধীনতার সংবাদ সকল সেক্টরের স্বাধীনতার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। সাতজনের দুইজন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ও সিপাহী হামিদুর রহমান যশোরেরই সন্তান। যদিও হিন্দু আধিপত্য ছিল তবুও বিধবা বিবাহ আইন পরিশোধিত নিয়মে এই অঞ্চলটি অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিল।

আঠারোশো চুরাশী সালে মহামতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যশোহরকে উল্লেখ করে দুটি বই প্রকাশ করেছিলেন। যার নাম যথাক্রমে, কস্যচিৎ তত্ত্বন্বেষনঃ নামে রচিত বিধবা বিবাহ ও যশোর হিন্দু ধর্ম রক্ষিনী সভা ও কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য নামে রচিত ব্রজ বিলাস। সতেরোশো ছিয়ানব্বই সালে ইংরেজদের হাতে জমিদার কালীশংকর রায়ের বন্দীত্বের পর কৃষক সংগ্রাম চুড়ান্ত আকার ধারন করে। দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নীল দর্পন নাটকেও এখানকার নীল বিদ্রহের কথা উল্লেখ আছে। নীলবিদ্রোহের অন্যতম নেতা দিগম্বর বিশ্বাসের এর জন্ম ছিল চৌগাছাতে।

আঠারোশো সাতান্ন সালে ইংরেজ বিরোধীদের তালিকায় ছিলেন যশোরের পরাগ ধাবী। সাংবাদিক শিশির কুমার ঘোষ তৎকালীন শিক্ষিতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তার ছোটভাই মতিলাল ঘোষ আঠারোশো সাতচল্লিশ সালে ঝিকরগাছার অমৃতবাজারে জন্মেছিলেন বড় ভাই ও নিজ গুনে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের গন্য মান্য প্রধানদের মধ্যে একজন ছিলেন। নেতা, মন্ত্রী, শিল্পপতি, শিল্প ও সংস্কৃতি সবই আছে। বিভাগীয় শহরের বৈশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এই শহরটি বিভাগ হয়নি।

পুরোপুরি আর্মি বেষ্টিত সুরক্ষিত সুবিশাল এয়ারপোর্ট আর বৃহদাকার ক্যান্টনমেন্ট, বড় রেলওয়ে জংশন প্রভৃতি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এটি সিটি কর্পোরেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ শহরের সংসারে কপোতাক্ষ, ভৈরব ও মাতামুহুরী সহ বিভিন্ন নদনদী থাকতেও জলাভূমিতে এ শহরটি অচল। আঠারোশো চৌষট্টি সালের পৌরসভা, আঠারোশো চুয়ান্ন সালের পাবলিক লাইব্রেরী বাংলাদেশের এক প্রাচীনতম পাবলিক লাইব্রেরী, আলমগীর সিদ্দিকি হল, ঐতিহাসিক সুবিস্তৃত মুন্সী মেহেরুল্লাহ ময়দান, যশোহর ইনিস্টিটিউট, প্রতিদিন সারাদিন সেখানে লক্ষাধিক মানুষের আসা যাওয়া থাকা আর সময় কাটানো বিনোদন চলে। ইদানীং কালে এর মাঠটি এ অঞ্চলের সাধারন মানুষের উন্মুক্ত বিনোদন ও উন্মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র। কিশোরেরা এখানে আড্ডা মারে, সময় কাটায়, কেউবা খোলা মনে বন্ধুদের সাথে নিয়ে গানে গানে মেতে ওঠে।

তবে সাপ খেলা, ম্যাজিক প্রদর্শনী, কবিরাজী ঔষধ বিক্রি সহ বিভিন্ন ধান্দাবাজীর জন্যেও জায়গাটি প্রশিদ্ধ সেই বহুকাল থেকেই। হয়ত এগুলো কোন উপকারেই আসে না কিন্তু এখানে হাজারো পথহারা মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হয়। এখানে রয়েছে আলমগীর সিদ্দিকি হল, শুনতে অনেকটা জ্ঞান তরঙ্গিনী সভার মত, এখানে প্রশিদ্ধ ব্যক্তিত্বরা এসে সাধারন মানুষের সাআথে মিশে জম্পেশ আড্ডায় মুখরিত হয়। শীতের সময় ব্যাডমিন্টনের ঝড় ওঠে। এখানকার একপাশে সুপ্রাচীন, সুবৃহৎ ও সুবিস্তৃত গনগ্রন্থাগার।

এর মাঝেই রয়েছে যশোরবাসীর প্রচেষ্টায় ও আমেরিকান সাহায্যার্থে নতুন গড়ে ওঠা আমেরিকান কর্নার। সাধারন- পত্রিকা পাঠক, শিশু- কিশোর ও চিন্তাশীল- গবেষকদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা থাকায় এটি জ্ঞান চর্চার এক অনন্য স্থান। দুঃখজনক হলো, এতো বড় জায়গায় নেই ভাল কোন নামাজের ব্যবস্থা, গুদামের মত একটা ঘর থাকলেও ইমাম নেই। ওযুর কোন ব্যবস্থাও নেই। অসংখ্য জানা অজানা বধ্যভূমি, স্মৃতিবিজড়িত সুবিশাল ঈদগাহ ময়দান ও সৌদি বাদশাহর নামে পুরাতন বাদশাহ ফয়সাল ইসলামী ইনিস্টিটিউট।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, আঠারোশো আটত্রিশ সালের জমিদার পত্নী ক্যাতারিনির যশোর জেলা স্কুল, মমিন গার্লস, বাংলাদেশ সেরা পুলিশ লাইন স্কুল, ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, শাহীন কলেজ, নির্মানাধীন শিক্ষাবোর্ড স্কুল এন্ড কলেজ, দক্ষিনবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়, সিটি কলেজ, মশিউর রহমান ল কলেজ, সরকারী মহিলা কলেজ, বরেন্য শিল্পি এস এম সুলতান ও তার প্রিয় পাত্র শামীম ভাইয়ের চারুপীঠ, উপশহর আর্ট কলেজ, পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট; সেখানে আছে নির্মানাধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রক্রিয়াধীন যশোর মেডিকেল কলেজ সর্বপরি যশোহর শিক্ষাবোর্ড। শিক্ষা, জমিজমা ও আইনী সেবা সুবিধার কারনে এখানকার শিক্ষাবোর্ড, কালেক্টরেট ও কোর্ট সমূহ পার্শ্ববর্তী ও দূরদুরান্তের মানুষের কাছে খুউবই দরকারী ছিল। বাংলাদেশের মাত্র কয়েকটি শিশু জেলখানার মধ্যে যশোরেরটাই অন্যতম আরো আছে এখানকার কেন্দ্রীয় কারাগার। কলকাতার বিখ্যাত যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম বেনাপোল বর্ডার বাংলাদেশের বৃহত্তম এক স্থলবন্দর। বৃহৎ জংশন আর সুবিশাল স্টেশন পৃথিবী বিখ্যাত যশোরের খেজুর রসের খেজুর রসা পৃথিবীতে অন্যতম সেরা চা, তাহের ভায়ের চা এর খোঁজ পাবেন ধর্মতলার মোড়ে।

এছাড়া আছে ইয়াকুব, দড়াটানার আবুল। এখানকার রাস্তাঘাটের চটপটি বাংলাদেশের সেরা। চিত্রা মোড়ের বারেকের চটপটি, পাবলিক লাইব্রেরী চত্ত্বরের সবুজের চটপটি উল্লেখযোগ্য। চার থাম্বার জনি ও বাদলের কাবাবেও সেরা যশোর। পৃথিবীতে একসময় নামকরা ছিল, যশোহরের তুলোতলা মার্কেট।

সর্বোচ্চ গরম ও সর্বনিন্ম ঠান্ডাতেও সেরা এই শহর। মাদকেও সেরা যশোহর। ভালতেও সেরা মন্দতেও সেরা। এখানে রয়েছে অনেক পুরাতন ধর্মীয় স্থাপত্য, রয়েছে ধর্মতলা, রয়েছে কারবালা, আবার রয়েছে অনেকের প্রিয় অনেকগুলো পতিতালয়। একটি আধুনিক শহরের পুরোপুরি বৈশিষ্টই এখানে আছে... বাংলাদেশের একমাত্র এই শহরেই সর্ব সাধারনের সামনেই যশোর ক্লাব, সুইমংপুল একাডেমি সহ নানা স্থানে জুয়ার আসর বসে সেই দীর্ঘ্যকাল ধরেই।

এখানকার সাধারন মানুষেরাও অনেক আধুনিক মনের। আর আবহাওয়ার দিক দিয়ে অবশ্যই ভাল আর আরামদায়ক। এ অঞ্চলের মাটিও অনেক উঁচু, তাই এখানকার উচ্চ অঞ্চলগুলোতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হারও নেই। এখানকার ঐতিহ্য ছিল চিরুনী শিল্প। এখানে আছে বিরাট ঐতিহ্যবাহী চিরুনীকল।

ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন থেকে তৎকালীন ইরাকের প্রেসিডেন্ট আরিফ, উপমহাদেশের খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল রায় সহ নানা বরেন্যরা এই চিরুনী ব্যবহার করতে যশোরে এসেছেন। এছাড়াও উনিশশো উনষাট সালে রাশিয়া, বাষট্টি সালে সুইডেন, ইরান, বৃটেন, সত্তর সালে ইতালী, ছিয়াত্তর সালে পোলান্ডের রাষ্ট্রদূতেরাও এ শিল্প পরিদর্শনে এসেছেন। এখানে এসেছেন জাপান শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বিশ্ব ব্যাঙ্কের উপদেষ্টা সহ নানা গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ। সেই আমলে সারা বিশ্বের ললনাদের কাছে যশোরের চিরুনীর কদরই ছিল আলাদা। আজো আছে সেই চিরুনী ফ্যাক্টরী কিন্তু সেই শিল্প আর নেই।

গৌঢ় বঙ্গের একটি ঐতিহাসিক টাকশাল ছিল মুহম্মদাবাদে। সেটাও আর নেই। কেশবপুর, ঝিকরগাছা, চৌগাছা, কোটচাঁদপুর ও নারিকেলবাড়িয়াতে চিনি উৎপাদনের কারখানা ছিল। বিশেষত পর্যাপ্ত পরিমান কাঁচামাল না পাওয়া ও যোগাযোগের অব্যবস্থার ফলেই এসব শিল্প নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সেই সব কারখানার মধ্যে মোবারকগঞ্জ চিনিকলটিই নিয়মিত উৎপাদন করে যাচ্ছে।

খেজুরের গুড়ের কারখানা ছিল ঘরে ঘরে। এখনো গ্রামের দিকে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গৃহস্থ বাড়ির মহিলাদের তত্ত্বাবধায়নে খেজুর, তালের গুড়, হাতে গড়া চিনি ছাড়া যশোরে বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি সর্বব্যাপী। লোহাগড়ার বড়দিয়া ছিল পাট ব্যবসায়ীদের অন্যতম কেন্দ্র। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ঘরে ঘরে চরকা ছিল।

বাড়িতে মা বোনেরা সকলেই চরকা দিয়ে সূতা কেটে কাপড় বুনত। তাঁতীরা ঘরে ঘরে তাঁত শিল্পের উন্নতি সাধন করেছিল। যার প্রমান হিসেবে নীলগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট তাঁতীপাড়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। এশাশাদের বাড়ির পাশে নীলগঞ্জের ভৈরব নদীর তীরে হাট বিরাট হাট বসত। আজ সে তাঁতীও নেই, তাঁত শিল্পও নেই।

তবে যশোরের হস্তশিল্পের সুনাম এখনো আছে। নকশীকাঁথা সহ নানান প্রকার সেলাই ও হস্ত শিল্পে এই শহর এখনো সেরা অবস্থানেই রয়েছে। এছাড়াও শামুক শিল্প তথা আমরা মুরুব্বিরা পানের সাথে যে চুন খাই, অনেক অল্প বয়সীরা গাল কে লাল করতে যে চুন ব্যবহার করে, এই চুন তৈরিতে কাজ করে যশোরের নিন্মাঞ্চলের মানুষেরা। এখানকার হাওড় বাওড় বিলাঞ্চলে প্রচুর শামুক পাওয়া যায়, স্থানীয়েরা শামুক পুড়িয়ে প্রক্রিয়াজাতকরনের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌছে দেয় চুন। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন পন্য বিশেষত শুটকি, চিংড়ি সহ বিভিন্ন মাছ পরিবহনে যশোরের বিমান ব্যবস্থা অনেক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।

রেলওয়ে জংশনের ভূমিকাও অনেক। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও যশোর বাংলাদেশের বিরাট একটা কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের এই জেলার থানাও বেশী আর প্রতিটা থানা, ইউনিয়ন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। যশোরের নওয়াপাড়া নানাবিধ ব্যবসায়িকদের লক্ষ্যকেন্দ্র। একই সাথে তিন পথ নৌপথ, রেল পথ ও সড়ক পথের সুবিধার কারনে অনেক সফল একটা ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সার, সিমেন্ট সহ নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পের যোগান দেয় যশোরের নওয়াপাড়া। লক্ষ্য করবেন, দক্ষিনবঙ্গের বৃহৎ মোটরপার্টস মার্কেট, বাস, ট্রাক, ট্রাঙ্ক ও লরী সহ যত মটরস আমাদের বাংলাদেশকে নিয়মিত সচল করে রেখেছে, তা যশোরের মানুষেরই অবদান। রবীন্দ্রনাথ সড়ক বা আর এন রোড কেবল মোটর্স পার্টসই নয়, সকল প্রকার কৃষিজ মেশিনারীজের আমদানী, সেটিংস, বিক্রয় ও বিপনন, প্রস্তুতকরন, সার্ভিসিং সহ সব কাজে যশোরই অধিক উন্নত। উল্লেখ্য যে, যশোরের বিশ্যবিখ্যাত মনিহার সিনেমাহলের পাশেই যে মনিরুদ্দীন পেট্রল পাম্প সেটাও বিখ্যাত। সাতক্ষীরা, নড়াইল, মাগুরা সহ আশেপাশের জেলা থেকেও লোকজন ঐ পাম্পের তেল নিতে আসে।

বিশ্বস্ততা বিশুদ্ধতাই মূল কারন। বলা যায়, পুরো যশোর হলো দ্বিচক্রযানের শহর। বাইপাস এয়ারপোর্ট সড়কে এফ যেড, আর ওয়ান ফাইভ সহ নানাবিধ নিত্য নতুন মোটর সাইকেল সহ পালছার, ডিসকভার বিশেষ করে সি ডি আই ও ভ্যাসপা চলে খুউব তবে যে বিষয়টি চোখে পড়ার মত, তা হলো- সারা দেশের সর্বোচ্চ বাই সাইকেলের শহর যশোর। কিন্তু রাস্তাঘাট চিরকালই খাড়াপ। টি ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো, খান টিপু সুলতান, মুফতি ওয়াক্কাস, ইকবাল কবির জাহিদ, টুটুল ভাই, বেনজির খান, শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক, অ্যাডভকেট আব্দুল গফুর আহমেদ, শুনতে ভুল করবেন না বাঘারপাড়ার টি এস আইউব, রেজাউদ্দিন স্টালিনের মত এরকম দেশবরেন্য নেতা, এত জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবাস যশোরে।

এতদ্বসত্ত্বেও রাস্তাঘাট, রেলওয়ে স্টেশনের নেই উন্নয়ন। বিভিন্ন ব্যবসার উপযুক্ত সুযোগ ও পরিবেশের কারনে অন্যান্য শহরের তুলনায় শহরটির উপর জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশী। যা একদিকে যেমন শহরটিকে প্রানোচ্ছল করেছে অন্যদিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একানকার রাস্তায় চলতে গেলে কান্না পায়। রিকশায় উঠলে রিকশাওয়ালার জন্য কষ্ট লাগে।

একমাত্র রাস্তা খারাপ বলে কত সমস্যা লক্ষ করুন। কোটি কোটি পথচারীর দূর্ভোগ, লক্ষ লক্ষ চালকের কষ্ট, যানবাহন নষ্ট। এহাড়াও রয়েছে নানান সমস্যা। যশোর হলো বিশ্বখ্যাত দানবীর হাজী মুহম্মদ মোহসীনের শহর। বিশিষ্ট জ্ঞানী বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মায়ার শহর এটি।

জিলা স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তিনি খড়কীর খ্যাতনামা বুজুর্গ পীর শাহ আব্দুল করিমের নিকট মুরীদ হবার প্রচেষ্টা করেছিলেন। ছাতিয়ানতলা ছিল প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুন্সী মেহেরুল্লাহর জন্মভূমি। শোলখাদা গ্রামে বৈজ্ঞানিক ডাক্তার নীল রতন ধরের জন্মভূমি। হরিশংকর পুরে প্রখ্যাত গনিতজ্ঞ কে. পি বসুর জন্ম স্থান যশোরের কোট চাঁদপুর। ঝিনাইদহে বাঘা যতিন এর জন্মভূমি।

কম্পিউটর জগতের পিতৃ পুরুষ মান্যবর মোস্তফা মোনয়ার, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, অমর জ্ঞানের প্রদীপ ডঃ লুতফর রহমান প্রভৃতি জ্ঞানী গুনী জন এই বৃহৎ অঞ্চলের মানুষ। বৃহত্তর যশোহর হলো লালন শাহ, পাগলা কানাই এর দেশ। যশোরের আর এক গর্ব কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জন্ম নেন পরমানু বিজ্ঞানী ডঃ এম শমসের আলী, যার বাড়ি সদরের বসুন্দিয়াতে। যশোর জেলা স্কুলে তিনি পঞ্চম থেকে এস এস সি পর্যন্ত পড়েছেন। মাগুরা ডঃ লুতফর রহমানের বাড়ি পার হয়ে বগুড়ার খানিক আগে জন্ম নিয়েছিলেন আরেক বিজ্ঞানী দিদারুল আলম।

কুইক রেডিও আবিস্কার করে তিনি তাক লাগিয়ে চলে গেছেন বিদেশে। এশিয়া মহাদেশে নোভাকে নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন কালেক্টরেট যশোহর অফিসের কেরানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। বর্তমান হুশতলা বকচরের রোকন দারোগার বাড়িটাই ছিল তার বাড়ি। এখনে থেকে ছাপোষা কেরানীর চাকরি করে তিনি সারা বিশ্বের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের যশোরের দিকে। আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমন্দির, অ্যাভসো, আমেরিকান এ্যসোসিয়েশন অফ ভ্যালুয়েবল স্টার, লন্ডনের ব্রিটিস এ্যাস্ট্রনোমিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন, ফ্রান্সের লিও অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা রাধাগোবিন্দের লেখা পাওয়া ও পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতো।

এই অঞ্চলের রাজা রায় বাহাদুর ছিলেন এখানকার এককালকার মহোত্তম রাজা। যশোহরের নলডাঙ্গার রাজবাড়ির যে কুঠুরিগুলো এখনো অবশিষ্ট আছে, বহুকার পূর্বে পত্রিকায় এসেছিল, ধনে মানে কুলশীলে কাহার অপেক্ষা কোন অংশে নূন্য নহেন। দিগ্বিজয় প্রকাশ নামক গ্রন্থটিতে যশোর তথা দক্ষিণ বঙ্গকে কাননাবৃত্ত বলে উল্লেখ করা হয়। কেননা নদনদী বিধৌত এই শহরটির মাটি বৃক্ষরাজীর জন্য আদর্শ স্থান। কেউ বলে যশ বা খ্যাতির কারনে একে যশের শহর বা যশোহর বলা হত।

নাম নিয়ে বহুত মতপার্থক্য থাকলেও যেখানে কোন যুক্তিই শক্তিশালী নয়, সেখানে দূর্বল যুক্তিই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। কেউ বলে এক রাজা তৎকালীন পৃথিবীর যশ বলে খ্যাত ভারতীয় কর্নসূবর্ন হতে যশ হরন করে অর্থাৎ সম্পদ হরন করে এই শহরটি গড়ে তুলেছিল বলে প্রথমে যশ হরন পরে যশহর নাম হয়। কেউ বলে রাজা প্রতাপাদিত্যের বাবা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী যশেশ্বরীপুর থেকে এর নাম যশোর হয়েছে। কেউ বলে যশোর একটা দ্বীপের মত ছিল। সেতু পথে আসতে হত।

আরবীতে জসর অর্থ সেতু। আরবে জসর নামে একটা স্থানও আছে, যার সাথে বর্তমান যশোহরের কোন নাম সম্পর্ক পাওয়া যায় না। এই শহরের নাম নিয়ে যেখানে কোন সঠিক বা শক্তিশালী যুক্তি নির্ধারন করা যায় না, সেখানে যেকোন দূর্বল যুক্তিকেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তাই নাম নিয়ে বিতর্ক না করে আমরা আসলেই দেখি এটি সত্যিকারেরই যশের শহর। আমাদের মিডিয়ার অদ্বিতীয় গ্লামার মৌসুমি থেকে শাবনুর, শাহনুর, পৃথিবী বিখ্যাত নায়িকা ববিতা, সুচরিতা, সুচন্দা, রিয়াজ, চম্পা, পপি, শিমলা, শ্রদ্ধেয় আব্দুল হালীম স্যারের সবচে দুষ্টু ছাত্র আজীজুল হাকীম, সমু চৌধুরী, উদয় শংকর, রবি শংকর, মুন্সী রইস উদ্দিন, সন্ধ্যা রায়, কামরুজ্জামান কাজল, জন্মভূমি বা আর্কের হাসান, প্রনব ঘোষ, গ্রাম বাংলার মনির খান, মিনু রহমান, সুকন্ঠী ও অসাধারন বাস্তবমূখর অভিনেত্রী ও উপস্থাপিকা নওশীন, যশোহরের জামাই ফেরদৌস, মিডিয়ার নতুন আকর্ষন প্রচ্ছদ শিল্পি চারু পিন্টু, বিপ্লবী সাফী সমূদ্র, চিরকুমার পদ্মনাগ অধিকারী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, নাট্য ব্যক্তিত্ব নীলু মামা, কৌতুক সম্রাট কাজল, বিশেষ করে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব সালাউদ্দিন লাভলু ভাই সহ অনেক জানা অজানা অভিনয় ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর যশোহরের মায়ায় সিদ্ধ হলেও, যশোহরে হয়না কোন স্যুটিং।

নেই সাংস্কৃতিক আশানুরূপ উত্থান। সর্বোচ্চ কথাটি হলো যশোরের মানুষের ভাষা ও ব্যবহার অনন্য সুন্দর। কিন্তু রুচী ভালনা। এখানকার মানুষ দেশের সবচে খারাপ। আসলে এখানকার মানুষ খারাপ হয়ে উঠেছে কেবলই অযত্নে।

কি নেই এই শহরে! পৃথিবীর দধ্যে সর্বোচ্চ সুন্দর আর সুখময় দেশ যদি হয় বাংলাদেশ তাহলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সুখময়স্তথান যশোরই। শুধু নেই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেবার কোন জাতীয় নেতা, মানুষে মানুষে সার্বক্ষনিক মারামারি, দ্বন্দ, হিংসা। যদিও বেশ কিছু নেতৃত্ব পেয়েছিল কেউ কেউ কিন্তু অজ্ঞাত কারনেই তারা এ অঞ্চলের খুউব বেশী উন্নতি করতে পারেনি। এখানকার আর বাইরে থেকে আসা যশোরের প্রেমে পড়া মানুষগুলো শহরটির জন্য যা করেছে, সেটাই এখানকার মানুষেরা ভেঙ্গে চুরে খাচ্ছে। এতো পুরোনো শহর কিন্তু যশের যা কিছু ছিল, সেগুলোও নেই।

রাস্তাঘাট এতো খাড়াপ, গাড়িতে চললে কান্না আসে, রিকশায় উঠলে রিকশাওয়ালার জন্যেও কষ্ট হয়। এতো এতো ব্যবসা, শিল্প আর শিক্ষার নগরী, মানুষ নানান কর্মজীবি, এতো এতো টাকা আয় করছে, কোথায় রাখছে? কি শিখছে? নেতাদের দোষ দিয়ে কি হবে? এখানকার মানুষেরা নিজের শহরের উন্নয়ন নিজ্রাই করেনা। কি নেই যশের এই শহরে! নদ নদী দুটোই আছে যশোরে। তবু যেন কিচ্ছু নেই। প্রানকেন্দ্রে কত সুন্দর একটা নদী রয়েছে, যশোরের মানুষেরা ওটাকে মেরে ভুত করে ফেলেছে।

এখানকার মানুষের একটা বড় সমস্যা হলো, এরা প্রয়োজনে আপনাকে মাছ ধরে খাওয়াবে কিন্তু বিল দেখাবে না। এরা বাইন মাছের মত আচরন করে। কাদার মধ্যে থেকেও গায়ে কাদা লাগাতে চায় না। নিজেরাই নিজেদের উন্নয়নে সোচ্চার নয়। তবে অন্যদের উপকারে আত্মত্যাগ করতে পারে।

বন্ধু ও আত্মীয় হিসাবে এরা অনেক ভালোও বটে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত অঞ্চল যশোহরের মনিরামপুর থানা। আবার সারা বাংলাদেশের জেলখানায় যান মনিরামপুরের লোকই পাবেন ভরপুর। যৌতুক ও নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাই এদের বেশী ভোগায়। এখানকার মেয়েরা স্বামী নির্যাতনেও ওস্তাদ।

বাংলাদেশে যশোরের মেয়েরা তুলনামূলক ভাবে বেশী আধুনিক, যার মানে অত্যাধুনিক নয়, তবে সেরা; অধিকার আদায়ে সোচ্চার, মানে বাংলাদেশের সেরা নারী। মেধা ও মননে উন্নত মস্তিস্ক এখানকার সর্বস্তরের মানুষের। যশোরের মানুষেরা বন্ধুকে যেমন সহজে বরন করে নেয়, শত্রুতাতেও কারো সাথে সহজে পিছপা হয়না। সকল আন্দোলনে প্রথম জ্বলে ওঠাই তার প্রমান। উপমহাদেশের প্রথম বিদ্রোহী কবি মধুসূদনের দেশ যশোহরের মানুষের মস্তিস্কও অত্যন্ত প্রখর।

যারা এদের সাথে মিশেছেন তারাই জানেন। ভাষা ও আন্তরিকতা যেমন মধুর মত মিষ্ট, চিন্তা চেতনাতেও যশোহরের মানুষ মধুসূদনের মত আধুনিক। শিক্ষাবোর্ড, কেন্দ্রীয় কারাগার, প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী টিচার্স ট্রেনিং ব্যবস্থা, উন্নতমানের কৃষিজমি, যশোরকে করে তুলেছে আরো সমৃদ্ধ। সমূদ্র উপকূলের কাছাকাছি হলেও যশোরের বাতাস বিশুদ্ধ ও পানি অত্যন্ত সুপেয় ও গুনগত মানের। যেখানে সেখানে পানি খেলেও কোনই সমস্যা নেই।

কেবল পানি, গুড় বা চিনিই নয়, এখানে সেরা রয়েছে আরো অনেক কিছুই। দেশ সেরা এখানকার বাগাটের দৈ, যাদবের মিষ্টি আর ছাদেক গোল্লা বা জামতলার স্পঞ্জ রসগোল্লা সে তো পৃথিবী বিখ্যাত। যার অরিজিনালটা একবার পেয়েছিলাম ঢাকার শান্তিনগর এলাকার বেইলী রোডের সুইচে। মিষ্টি খেয়ে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রনের জন্যেও এখানে রয়েছে আহাদ সাহেবের স্মৃতিতে নির্মিত প্রায় ফ্রী চিকিৎসার আহাদ ডায়াবেটিক হসপিটাল। দক্ষিনবঙ্গের চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবেও যশোরের জুড়ি মেলা ভার।

প্রথমেই আছে সবার প্রিয়, সবার চেনা ফাতেমা হাসপাতাল, তরিকুল ইসলামের ওসিলায় যশোহর আড়াইশো বেড, আদ-দীন, শিশু সদন, শিশু মঙ্গল, ভৈরবের বুক জুড়ে কুইন্স হাসপাতাল কেবল চিকিৎসার কেন্দ্রই নয়, বলা যায় সেটা রোগীদের অবকাশ যাপনের কেন্দ্রস্থল। তাছাড়া সারা বাংলাদেশে চিকিৎসা অঙ্গনে যে দুটি বড় প্রতিষ্ঠান মানুষের সেবা দিতে দিতে আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে, তা হলো বৃহৎ ঔষধ কোম্পানী ইনসেফটা ও লাজ ফার্মা, যা যশোহরের মানুষেরই। ব্যবসা ও জনসেবায় কৃতিত্ত্বের দাবীদার আকিজ গ্রুপ। মিনা বাজার সহ বাংলাদেশের সকল বড় বড় জেলাগুলোতে ও গ্রাম গ্রামান্তরে সেবামূলক ও কর্মসংস্থানমূলক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে কাজী শাহেদও কোন অংশে পিছিয়ে নন। পুরনামলের চাকলাদার ফার্মেসির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিবহন সেবায় চাকলাদার রেখেছে অনন্য ভূমিকা।

ঈগল, দ্রুতি, সোহাগ সেই পুরোনো গৌরব নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। পট্টির শহর যশোর। কাপুড়িয়া পট্টি, চুড়ি পট্টি, কাঁসা পট্টি, কাঁসারি পট্টি, শাখারি পট্টি, কয়লা পট্টি, খাট পট্টি, বাঁশ পট্টি, মাছ পট্টি, মাগুর পট্টি, মাংস পট্টি, লোহা পট্টি, সোনা পট্টি, নটি পট্টি, বস্তা পট্টি, বিহারী পট্টি, রিফুজী পট্টি, চার থাম্বা কাবাব পট্টি, ঝালাই পট্টি, পাইপ পট্টি, ধোপা পট্টি, মাইক পট্টি, জুতো পট্টি, সকলেই চেনে। যশোরের মনিহার, উপমহাদেশের আলোচিত সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু তসবির মহল আরো অনেক কিছুতেই যশোর যুগ যুগ ধরেই সেরা। দক্ষিনবঙ্গের অঘোষিত রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও যশোর অবহেলিত।

যশোহর বলতে কেবল যশোর শহর মনে করলেও ভুল হবে। আসলে এই শহরটিই বাংলাদেশের একমাত্র শহর যার নামের শেষে শহর শব্দটি যুক্ত আছে, সেটা গুরুত্বপূর্ন কিছু না হলেও যশোহর কেবল যশোর নয় বরং রাজবাড়ী, ফরিদপুর, ঝিনাইদাহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, মুজিবনগর, দর্শনা, মাগুরা, খুলনা, কালীগঞ্জ, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ভারতের পশিমবঙ্গের অনেক এলাকা ইত্যাদি ইত্যাদি এলাকা সবই একদা ছিল যশোহরের পরিচয়ে পরিচিত। এখনো অনেকে যশোর পরিচয়ই দেয়। যুগে যুগে কালে কালে সবকিছু বিভক্ত হলেও আন্তরিক মিল রয়েই যায়। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদাহ পার হয়ে বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা।

সে যেন মায়ার শহর। সেখানে একবার গেলেই মায়ায় পড়ে যেতে হয়, তেমনি মায়ায় পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ন লেখার উপকরন পেয়েছেন বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতেই। কুষ্টিয়াতে মায়া খুঁজে পেয়েছিলেন লালন, সলেমান শাহ সহ অনেক নাম না জানা বাউল ফকির। খ্যাতনামা সাহিত্যিক বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, সঞ্চরনের রচয়িতা ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন সহ অনেক নামকরা কথা সাহিত্যিকের জন্মভূমি কুষ্টিয়া।

কুস্টিয়ার আর এক গর্ব রায়ান সাদি তিনি নিউ জার্সিতে থাকেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর নন্দলালপুর গ্রামের একজন মহাপুরুষ আলাউদ্দিন আহমেদ। ভেড়ামারার আরেক গর্ব কৃষিবিদ সুনীল কুমার দাশ। যাকে তেমন কেউ হয়ত চেনেন না, হয়ত তিনি বিখ্যাত কেউ নয় তবু তিনি বিরাট মনের বিশাল ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। কেবল বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রেই নয় সামাজিক উন্নয়নে, ক্যামেরার অন্তরালে বিশেষ করে সাধারন মানুষের উন্নয়নে তার সচেতন নাগরিকসুলভ আচরন আমাদেরকে সভ্য বাংলাদেশী হতে অনুপ্রানিত করে।

এছাড়াও এই ভূমি অনেক গুনীর জন্ম দিয়েছে, কেড়েও নিয়েছে অনেক চরমপন্থীর প্রান। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এই অঞ্চলের ভূমিকা অপরিশীম। তাছাড়া আনন্দের বিষয় হলো মায়ার এই ছোট্ট শহরে সারা বছরের প্রায় সবসময় কোন না কোন মেলা থাকে। সকলে মিলে মিশে আনন্দে এক অফুরন্ত মিলনমেলার শহর এটি। কেবল আধ্যাত্মিকতাতেই নয়, বাংলাদেশের প্রযুক্তি উন্নয়নে এই শহর অনেক অগ্রসর।

প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজে ও জনসচেতনতায় সুফি ফারুক ইবনে আবুবকরের অনন্য এক নিদর্শন প্রযুক্তিতে কুষ্টিয়া। দক্ষিনবঙ্গের রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বানিজ্য সহ সকল দিক দিয়ে মূল যশোহর হলো এসকল জেলার মধ্যমনি। এসব এলাকার সংবাদ নিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের সর্বপ্রথম ওয়েবসাইট যশোর ইনফো। যা যশোরকে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ডিজিটাল জেলায় রূপদান করেছে। আমার এ লেখা ও এসব তথ্য ছাড়াও সেখানে পাবেন এ জেলা ও বৃহত্তর যশোর বিষয়ে অনেক অজানা ও গুরুত্বপূর্ন তথ্য।

অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থান বলেও বাংলাদেশে এর অবস্থান প্রথম সারিতে। শেরশাহী আমলের বাংলাদেশের প্রাচীন সড়ক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে আর কালীগঞ্জ বেনাপোল সহ বিভিন্ন সড়কের বিশাল বিশাল প্রাচীন বৃক্ষগুলো মনে করিয়ে দেয় যশোহরের ঐতিহ্য। শেরশাহ নির্মিত রাস্তা দিয়ে সেই যুগেও ডাক চলাচলের প্রচলন ছিল। শেরশাহই প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন, একথা সত্য কিন্তু শেরশাহ বা তার আগে থেকেই এখানে ডাক চলাচল শুরু হয়। বেরইল গ্রামে নবগঙ্গার তীরে ছিল একটি ডাক চৌকির অফিস এটি বর্তমানে চৌকির ভূঁই নামে পরিচিত।

গাছের চারা তৈরি ও নার্সারী ব্যবসায় যশোরের সুনাম বহুদিনের। নার্সারী ব্যবসার জন্য যশোহরের হাজেরা নার্সারী বাংলাদেশের সেরা নার্সারী। কিন্তু এই নার্সারী মালিকেরা সুনাম ছাড়া সুবিধা পায়না। কোথাও সে সুবিধা নেই ভ্রাম্যমান অবস্থায় চারা উৎপাদন, সংরক্ষন ও বিপনন করে যাচ্ছে এখানকার শ্রমজীবি মানুষেরা। সকল নার্সারী মালিকদেরকে সরকারী জমি বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

সারা বাংলাদেশের চারা মাছের সর্বোচ্চ বাজার চাঁচড়া বাবলাতলা মৎসপল্লী। এই শহরে রয়েছে বিশালাকৃতির বুক ভরা বাওড়, রয়েছে লুকায়িত সাগর- ঝাপার দুটি বড় বড় বাওড়, রয়েছে সুবিশাল হরিনার বিল, যা আজ মরনাপন্ন। দেশের আশি ভাগ রেনু পোনা উৎপাদন ও বিপনন কেন্দ্র যশোর। কিন্তু সেখানে যাওয়ার ভাল রাস্তা নেই। ছোট্ট সড়কটি রেলওয়ে স্টেশন, যশোর পৌরসভা, রোডস এন্ড হাইওয়ে, খুলনা সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতায় হওয়ার কারনে কেউই গুরুত্ব দিয়ে এই রাস্তাটির কাজে এগিয়ে আসে না।

যশোহর রেলওয়ে জংশন থেকে বাবলাতলা যাবার কোন সুবিধা নেই বলে সারা দেশ আজ ক্ষতিগ্রস্থ বিশেষ করে ঐ এলাকার নিরুপায় মানুষগুলো। যশোরের গদখালী হলো ফুলের দেশ। সারা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ফুলের যোগান দেয় এই গদখালী। এনামুল বস বলেছিলেন, বানান ভুল করলে পুরটাই ভুল হয়ে যাবে। এই গদখালী থেকেই ফুলের সঠিকভাবে ব্যবসা ও চাষপদ্ধতি শিখে আজ বাংলাদেশের অনেক স্থানে ফুলের আবাদ করা শুরু হয়েছে ও অনেকের হয়েছে বৈপ্লবিক আত্মকর্মসংস্থান।

নানান রকমের গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, ঝাউ, জিপসি, ক্যালেন্ডলা, বেলী, জারবারা সহ হরেক রকম ফুলের চাষের সাথে কৃষিজ পন্য, উন্নতমানের ধান, গম বিশেষ করে সব্জির জন্য যশোর বিখ্যাত। যশোরের ইতিহাসের প্রাচীনতা প্রমান করে বারোবাজারের ভূতল থেকে উত্থিত বা খুঁড়ে বের করা বহু মসজিদ, নানা প্রত্নতত্ব নিদর্সন সহ গাজী, কালু, চম্পাবতীর কবর, সেখানেই সেই বিখ্যাত গান- সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো। সূর্য বংশীয় রাজাদের শাসন কেন্দ্র ছিল মহেশপুরে। যার অনেক নিদর্শন এখনো বর্তমান। উপমহাদেশের বৃহত্তম বটবৃক্ষ, মল্লিকপুরের সুঁইতলা; গজদন্ত পুকুর, যেখানে রাজার হাতীকে গোছল করানো হত এসব নিদর্শনের নমুনা পাওয়া যাবে এখানে।

বিজয়পুরে রাজা মুকুট রায়ের দিঘি, যা ঢোলপুকুর নামে পরিচিত। বিদ্যানন্দকাটি গ্রামে খানজাহান আলীর বিশাল এক দীঘি আছে। বাসুড়ী গ্রামেও রয়েছে তার খনিত একটি বিরাট এক দিঘী। কেশবপুরে বুড়িভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে প্রত্নতত্ব স্থল ভরত ভায়না। এখানে রয়েছে পাঁচ শতকের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ও আর কিছুদূর গেলেই ভরত রাজার দেউল।

যশোরে রয়েছে বিশ্বব্যাপী দানবীর খ্যাত হাজী মুহম্মদ মুহসীন নির্মিত মুহসিন ইমাম্বারা, মুড়লি মোড় থেকে কিছুদূর গেলেই রামনগরে আছে তিনশ বছরের পুরোনো মুড়লি ইমামবারা। সেখানে অনন্য স্থাপত্য শৈলীর দেখা মেলে, যা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলাদেশের ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও অনন্য এই শহরটি। পীর বোরহান শাহ, শাহ আব্দুল করিম, ভৈরবের পাড়ে শ্রদ্ধেয় গরীব শাহ (রহঃ) , ব্রিটিশ যুগের মুন্সী মেহেরুল্লাহ ময়দান, উপমহাদেশের মহাসম্মানিত আবুল হাসান যশোরীর কবর ও হাতে গড়া মাদ্রাসা রায়পাড়াতে, যা শহরটির ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক। শিক্ষাবোর্ডের সামনেই রয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বড় মারকাজ ও মসজিদ এবং দক্ষিনবঙ্গের বৃহৎ তাবলীগি সম্মেলন যশোরের মারকাজ মসজিদে হয়।

কারবালার সম্মানিত পীর এর শেষ চিহ্নসমেত বিশালাকার কবরস্থান, যা সমগ্র শহরবাসীর একাত্মতা রক্ষা করে চলছে আদিকাল থেকে। এছাড়াও রয়েছে খ্রীষ্টান মিশনারীজদের নানাবিধ প্রতিষ্ঠান, সুবিশাল কবরস্থান ও চার্চ। প্রাচীন কালে এ জেলায় দ্রাবিড়, মঙ্গল, আর্য ও আদিম অধিবাসীরা বাস করত। কিরাত, নিষাদও বাগদি জাতির বসবাসও ছিল এখানে। জেলাটিতে মুলত বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের আবাস ছিল।

হিন্দু রাজাদের সময়ে বৌদ্ধদেরকে জোরপূর্বক হিন্দুতে ধর্মান্তরিত করা হয়। ভড়ং,যোগী,কপালি, মাহিষ্য, তাঁতী, নমশূদ্র সহ নানা জাতির লোকেরা পূর্বে অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। এদেশে অনেক পূর্বকাল থেকে কায়েস্ত, বৈদ্য, ব্রাক্ষ্মন জাতির লোকেদের বসবাস ছিল। ই ইতিহাসের এই অংশগুলোর বিস্তারিত ও আরো অনেক তথ্য ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট যশোর ইনফো ডট কম ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাবে। নীলগঞ্জের বিরাট শ্মশ্মান, হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু পুরাতন রামকৃষ্ণ মিশন, বহু বহু পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির, বেজপাড়ার আর্য শিক্ষা ও চর্চা কেন্দ্র, বিশেষ করে চাঁচড়ার শিব মন্দির, মুড়লী মোড়ের জোড়া মন্দির, কতিপয় রাজবাড়ী, বিরামপুরের বিমলরায় চৌধুরীর ধ্বংশাবশেষ বাড়িটি ছাড়াও যশোরে রয়েছে নাম না জানা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক পুরাকির্তী।

কালিয়া বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈদ্য প্রধান স্থান। লোহাগড়া ও শালনগরে জোড় বাংলা মন্দির বিখ্যাত। খ্রীষ্টানদের অনেক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। সেই সাথে কেয়ার, জাগরনী চক্র, ব্রাক, বাঁচতে শেখা, আর আর এফ, আদ-দীন সহ অনেক প্রতিষ্ঠান যশোরকে তাদের কর্মের তীর্থস্থান করে নিয়েছে। আর এতেই এ অঞ্চলের সার্বজনীন ভাতৃত্ব বোঝা গেলেও এখানেও ভাইয়ে ভাইয়ে ঐক্য নেই।

আলোচনার ফাঁকে আমি এখানে একটা জেলার কিছু বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করলাম কিন্তু বাংলাদেশে সব শহরই উন্নয়নমূখী, ঐতিহাসিক ও আলাদা আলাদা বিশেষত্বে ভরপুর। যা তুলে ধরার দায়িত্ব স্ব স্ব এলাকার মানুষদের। সেই সাথে সমস্যা সমাধান ও সংস্কারেও মনযোগী হতে হবে সকলকে। জনসংখ্যা, কৃষিজমি, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জলাশয় ইত্যাদি তুলনা করে প্রত্যেক শহরের জন্য আলাদা আলাদা প্লান বা শহর পরিকল্।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।