আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্তহীন গন্তব্যে



রাহেলা মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, - এভাবে আর চলে না। আমাকে কি পেয়েছো তুমি? সংসার চালাতে পারো না তো বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন? ছয় সন্তানের জনক প্রৌঢ় রেজা সাহেব বইয়ের পাতা থেকে মুখ উঠিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান। তিরিক্ষি গলায় বলেন, -আমাকে কি করতে বলো? আমি তো যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। অফিসের পর বাড়তি পয়সার জন্য টিউশনিও করছি, যা আমার স্ট্যাটাসের লোকদের মানায় না। রাহেলার স্বর এবার সপ্তমে চড়ে, " ষ্টাটাস? স্ট্যাটাসের কি বুঝ তুমি? তোমার জুনিয়র আলম সাহেবকে দেখো।

দেখতে দেখতে ঢাকায় বাড়ি বানালেন, গাড়ী কিনলেন। ছেলেকে আমেরিকায় পাঠালেন পড়াশুনার জন্য। ষ্টাটাস বুঝেন উনি। " রেজা সাহেব একটু রসিকতা করার সুযোগ পান। গলা খাকারি দিয়ে হেসে বলেন, " যাও না, আলম সাহেবের ঘর করোগে"।

হঠাৎ রসিকতা ধরতে পারে না রাহেলা। ক্ষেপে গিয়ে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে-" আমি কি আমার নিজের সুখের জন্য বলি! ঈদ সামনে, ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। দু'বেলা দু"টো খাবার ছাড়া ওদেরকে কীই বা দিতে পেরেছো তুমি? বাপ হয়ে কি দায়িত্ব পালন করেছো শুনি? তোমাদের অফিসের অন্যান্যদের দেখো... - থাক্। এরা যে কি করে এসব করে সে তুমি ভাল করেই জান। শুধু বেতনের টাকায় চলতে হলে ওদেরও আমার মতো বারোটা বাজতো।

বুঝলে স্বাতীর মা, করাপসন, করাপসনে দেশটা ছেয়ে গেছে। - রাখো তোমার অনেষ্টি! এই নীতি নীতি করে সারা জীবন কি করলে তুমি? ভাড়া করা বাসা ছাড়া মাথা গোঁজার ঠাই নেই। এদিকে তোমার রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেল- এরপর যে কি দশা হবে! - কি আর হবে। আল্লাহ্ চালাবেন। এই বিবাগী উত্তরে রাহেলা আর সন্তুষ্ট হয় না, "হ্যা, আল্লাহ তো চালাচ্ছেন, কিন্তু কিভাবে যে চলছে সে তো আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

" বাদানুবাদ হয়তো চলতো আরো কিছুক্ষণ। কিন্তু বেলা পড়ে গেছে। এখন রান্না ঘরে না গেলেই নয়। রাহেলাকে তাই উঠতে হল। অপসৃয়মান রাহেলার দিকে তাকাতে তাকাতে বিয়ের প্রথম দিককার বেশ ক'টি বছরের কথা ভাবেন রেজা সাহেব।

রাহেলা কখনো এমনটি ছিল না। রেজা সাহেবের এ সততাকে রাহেলা তখন সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখতো-ওর বান্ধবীদের কাছে এ নিয়ে কত গর্ব করতো সে। অথচ সেই বয়সে মেয়েদের যে কত সাধ আহ্লাদ থাকে। রেজা সাহেব জানতেন তা, কিন্তু সাধ্যি হতো না কখনো। এ নিয়ে রাহেলা কোনদিন অনুযোগ করেনি, অভিযোগ করেনি।

বরং রেজা সাহেবই কোনদিন তার এ ব্যর্থতার কথা বললে রাহেলা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো, " আমি কিছু চাইনে গো, আমি শুধু তোমাকেই চাই-- তুমিই যে আমার সব। " নিজেকে তখন সবচেয়ে সুখী মনে হত রেজা সাহেবের। কিন্তু সংসারে নতুন আগুন্তুকগুলো আসার সাথে সাথে ছদ্মবেশী দিনগুলো মুখোশ খুলতে থাকে। সংসারের চাহিদা মেটাতে যেয়ে একেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। এ যুগের ছেলেমেয়েরা তো আর 'সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিং'-এ বিশ্বাসী নয়।

তাই হয়তো ছেলেমেয়েরাও তার এ সততাকে তীর্যক চোখে দেখে। সবচে' বেশী রাগ হয় বড় ছেলে রাহুলের উপর। ও'তো বেশ বড় হয়েছে, বিচার বুদ্ধিও কম নেই। কিন্তু ও কেমন নির্বিকার। বেকার, ইদানিং ভবঘুরে।

ওর বয়সী কত ছেলে যে চাকরী-বাকরী করে সংসার চালাচ্ছে। অথচ চাকরী-বাকরীর ধারেকাছেও যাবে না ও। এইতো সেদিন কোন এক প্রাইভেট ফার্মে লোক নিয়োগের খবর নিয়ে এসেছিলেন রেজা সাহেবের বন্ধু আসগর আলী। ক্লারিকাল পোষ্ট- সর্বেসাকুল্যে বেতনও নেহায়েৎ কম নয়। প্রয়োজনে রাহুলের জন্য ব্যাকও করতে পারবেন জানালেন।

রাহুলকে বলতেই মুখ বেঁকিয়ে মুখের উপরই বলে দিয়েছে, ও স'ব ছোটখাটো চাকরী নাকি ওর পোষাবে না। ঢং! ছাল নাই কুত্তা বাঘা নাম। বাহাত্তরে এইচএসসি পাস ছেলের জন্য অফিসারের চাকরী যেন বসে রয়েছে! সুপারিশের সাহস নিয়ে এসেছেন যে আসগর আলী তা ওর বাপের ভাগ্য। না, এসব কথা মুখ খুলে ছেলেকে বলতে পারেননি তিনি। আসলে স্বাধীনতার পর থেকেই ছেলেকে তিনি একটু সমীহের চোখেই দেখেন, আগের মতোন আর শাসন করতে পারেন না।

ও' যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের ডামাডোল। রেজা সাহেব ছিলেন মুসলিম লীগের অন্ধ সমর্থক। ছেলে মুজীবের ভক্ত-ছাত্রলীগ্রে উঠতি নেতা। যুদ্ধ শুরু হলে রাহুল মুক্তিযুদ্ধে যায় বাবার অমতে। যুদ্ধকালীন সময়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে কাটান রেজা সাহেব।

যুদ্ধশেষে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসে রাহুল। এর সুবাদেই মুসলিম লীগার বাবার বিরুদ্ধে টু উচ্চারণ করতে পারে না কেউ। অবশ্য ততদিনে রেজা সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন। নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতা ভেবে মনে মনে গর্বও বোধ করেন। কিন্তু রাহুলের পরিচয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে ক্রমান্বয়ে রংবাজ মাস্তান হিসেবেই পরিচিতি পেতে থাকে।

এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পড়াশুনার পাটও চুকিয়ে দিয়েছে সে। সারাদিন কি সব নিয়ে মেতে থাকে -- বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে করেই খোঁজ রাখেন না রেজা সাহেব। পঁচাত্তর পর্য্যন্ত ধান্ধাবাজি করে কাঁচা টাকাও কামিয়েছেও বেষ। কিন্তু রেজা সাহেব এ টাকা স্পর্শ করেননি কোনদিন।

বাসায় তার নির্দেশ ছিল, রাহুলের এ পাপের টাকার এক আনাও যেন সংসারে খরচ করা না হয়। তবে রেজা সাহেবের আড়ালে রাহুল সংসারের জন্য দু'হাতে খরচ করেছে-- শুধু বাবার বেতনে চলতে হলে চুয়াত্তরের দূর্ভীক্ষ আর পাড়ি দিতে হত না। দিন সবার সমান যায় না। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর রাহুল কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে। প্রিয় নেতার নৃশংস মৃত্যুতে সে যেন আচমকা শক পায়।

নিজেকেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের একজন বলে মনে হতে থাকে তার। রাহুল তো আজকাল প্রায়ই বলে, ওরা যদি বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার সুযোগে অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত না হত তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত, স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেত না। আত্মগ্লানীতে রাহুলের মাস্তানী প্রতিভা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ফ্যা ফ্যা করে সে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় পথে পথে। আসলে রাহুল এখন ভীষল ফ্রাসটেডেড।

এবার রেজা সাহেববের ভাবনার মোড় পরিবর্তন হয়। মেয়েদের কথা ভাবেন। স্বাতী্ও মুন্নী দুজনেরই বয়স বাড়ছে-- শরীরেও ওরা বেশ বাড়ন্ত। ওদের সম্বন্ধ ঠিক করার কথা আজকাল প্রায়ই মনে করিয়ে দেয় স্বাতীর মা। কিন্তু সাহস হয় না।

সোনার বাজার হলেও অনেক চেষ্টা করে না হয় হাত দেয়া যায়। কিন্তু তা বলে পাত্রর বাজার! আর তা ছাড়া মেয়ে দু'টো দেখতেও আহামরি গোছের নয়। লেখাপড়ায় না হয় বেশ ভাল কিন্তু বিয়ের বাজারে মেধার বিচার করে কয়জনে! সবাই দেখে রূপ আর সেই সাথে যাচাই করে ভাবী শ্বশুরের কাছ থেকে ইপ্সিত দেনা-পাওনা। কি করবেন রেজা সাহেব! এক্সটেনসনের চাকুরীতে আছেন, মেয়াদ প্রায় শেষ। সতুন করে এক্সটেনসনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

না, রাহেলার আশংকা অমূলক নয়। সত্যিই তো, রিটায়ারমেন্টের পর যাবেন কোথায় তারা! বাজান মারা যাওয়ার পর পৈত্রিক এক চিলতে ভিটার সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন। ছোট দুই ভাই থাকে সেখানে - বড়ভাইয়ের উদারতা নিয়ে তার অংশের অল্প-বিস্তর জমা-জমি ছেড়ে এসেছেন তাদের জন্য। তাছাড়া শহুরে জীবনে অভ্যস্ত তারা গ্রামে থাকবেনই বা কি করে! এতো বছর চাকুরী করে কিছুই করতে পারেননি তিনি। সবাই বলে কাষ্টমের কেরাণীও ইচ্ছে করলে টাকার ডিপো বানাতে পারে।

কাষ্টমসের একজন বড় অফিসার হয়েও সেই ইচ্ছেটাই করতে পারেননি তিনি। কাষ্টমসে থেকে কিভাবে যে তিনি নিজেকে সৎ ও নিষ্ঠাবান রেখেছেন তা ভেবে নিজেই অবাক হন রেজা সাহেব। অবশ্য লোভ যে কখনো হয়নি তা নয়। অনেক কষ্ট করে নিজেকে দমন করেছেন। লোভের মূহূর্তে বাজানের কথা মনে হত তার।

সেই ছেলেবেলায় বাজানের হাত ধরে পাঠশালায় যেতেন প্রতিদিন। বাজান ছিলেন পাঠশালার হেড মৌলভী। বিভিন্ন বিষয়ে তার পান্ডিত্য ছিল। সবচে' অবাক হতে হতো তার গল্পের ভান্ডারের বিস্তৃতি দেখে। পাঠশালায় যাওয়ার পথে নিত্যনতুন গল্প বলতেন তিনি।

প্রায়ই উপদেশমূলখ। বাজানের কাছেই তিনি প্রথম শুনেন যুধিষ্ঠিরের সততার কথা আর ঈষপের নীতিবিষয়ক কল্প-কাহিনী। অলৌকিক হলেও বাজানের বলার ভঙ্গীতে সেগুলো হয়ে ওঠতো অতিবাস্তব; তন্ময় হয়ে শুনে যেত সেদিনকার কিশোর রেজা। বাজানের মৃত্যৃদিনের কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে। বাবা তখন বৃদ্ধ, পাঠশালার চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন সেই কবে।

একদিন ছেলেদের কাছে ডেকে বলেন, "বাজানরা, আমার ডাক এসেছে। আল্লাহর হুকুম-- কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। শুক্রবার বাদজুমা আল্লাহ-পাক দরবারে মিলিত হব। সালেহা, সখিনা আর তোদের দুলাহ্ মিয়াদের খবর দে। " বাজানের কথায় ছেলেরা কেউ স্থির থাকতে পারে না - আসন্ন প্রিয় বিচ্ছেদের ছায়া ওদেরকে মাড়িয়ে যায়।

বাজানের নির্দেশমত আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেয়া হল। বাড়িতে যেন মহা উৎসব। অথচ সবার মুখেই বিষাদের নীল প্রলেপ। বৃহস্পতিবার রাতেই বাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুক্রবার সকালে খানিকটা সুস্থ হয়ে ছেলেদের সাথে কিছু বৈষয়িক কথাবার্তা বলেন।

শেষবারের মতোন আশীর্বাদ করেন, " বাজানরা, আমি সারা জীবন হালাল রুজীর দিকদারি করেছি-- হারাম পয়সার দিকে তোরাও কেউ নজর দিস না। বেশী লোভ করিস না। ইয়া মাবুদ, আমার বাজানদের তুমি দেখ। " বাজানের শেষ কথা সবসময়ই স্মরণ রেখেছেন রেজা সাহেব। কিন্তু এখন কি করবেন তিনি! বড় ছেলে বেকার, ঘরে বিবাহযোগ্যা দু'দুটো মেয়ে, ভাড়া বাড়ীতে বাস, চাকরীর মেয়াদও ফুরিয়ে এল।

ভাবতে ভাবতে রেজা সাহেবের মাথায় কি একটা শুরু হয়- বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে মাথা। চোখের সামনে তিনি দেখতে পান বাজানের শান্ত-সৌম্য মুখশ্রী। বাজান যেন প্রান্তরের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখে মোহন হাসি, চোখে আহ্বানের ইঙ্গিত। সম্মোহিত রেজা সাহেব এগুতে এগুতেই সহসা পিছু ফিরে তাকান। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নিত্যদেখা মুখগুলো দেখতে পান তিনি।

কি অসহায় করুণ দৃষ্টি ওদের! সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাহেলা। কিন্তু একি, তীব্র র্ভৎসনা ওর চোখে! হঠাৎ নিজেকে কাপুরুষ বলে মনে হয় রেজা সাহেবের। শিমুর মতোন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি, "বাজান, বাজানগো, কোথায় যাব বাজান .... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।