আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সানশাইনঃ সূর্যস্নানের মানবিক ছবি

চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)

ধরা যাক, আমরা একটি সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র বানাতে যাচ্ছি। ছবিটির কাহিনী অনেকটা সময় পরের পৃথিবীর পটভূমিতে। এমন একটা সময়ে যখন সূর্যের আয়ুষ্কাল শেষের পথে। তারকা হিসেবে সূর্যের দীপ্তি কমে আসছে, ধীরে ধীরে সে নিভে যাচ্ছে। সূর্য নিভে গেলে প্রাণের উদ্ভব হওয়া গ্রহটিতে সকল প্রাণ বিলুপ্ত হবে।

মানুষ হিসেবে তখন সবচেয়ে জরুরি কাজই হবে সূর্যকে টিকিয়ে রাখা। মানব সভ্যতার এরকম একটা ক্রান্তি সময়ে একদল নভোচারীকে পাঠানো হলো সূর্যরক্ষা মিশনে। পৃথিবীর সকল খনিজ ও নিউক্লিও রসদ ঘেঁটে বানানো হলো অতি শক্তিশালী বোমা। ফিউশন বিক্রিয়ার চক্রতে সেটা কাজ করবে অনন্তকাল। এই বোমাটিকে সূর্যের ভেতরে ফেলে আসলে মিশন সম্পন্ন হবে।

“উই হ্যাভ টু ক্রিয়েট এ স্টার উইদিন এ স্টার!” এরকম একটা সায়েন্স ফিকশন বানাতে ঠিক কতো টাকা খরচ হতে পারে? হলিউডের হিসেবে বলি, পরিচালক ড্যানি বয়েল পুরোপুরি নভোযানভিত্তিক এই ছবিটি বানিয়েছেন মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। ছবিটির নাম “সানশাইন“। তিন বছর আগে আমি ম্যুভিটার ট্রেইলার দেখেছিলাম, তখন থেকেই আমার কাছে এই ছবিটি বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। গত পরশু ম্যুভিটা দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে কেন আরো আগেই দেখি নি! দর্শক হিসেবে, সাধারণ একটি সায়েন্স ফিকশনে আমার কাছে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় সেটা হলো গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গল্প বলার (স্টোরিটেলিং) মুন্সিয়ানা। কারণ এখনকার স্পেশাল ইফেক্ট আর কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কল্যাণে যে কোন কিছুই দেখানো সম্ভব সেলুলয়েডের পাতায়।

বিশাল অতিকায় কিংকং এখন ডাইনোসরের সাথে যুদ্ধ করতে পারে, মানুষ অভিনীত চরিত্রকে রূপকথার ‘গলাম‘ বানিয়ে ফেলা নস্যি, ছোট একটা পুকুরেই টাইটানিক জাহাজের গল্প বলে ফেলা যায়! সেখানে পরিচালকের আলাদা স্বাক্ষর না থাকলে সায়েন্স ফিকশন কেবল অর্থহীন সময়ক্ষেপণ হয়ে পড়ে। সানশাইনের শুরুতেই পটভূমিতে একটি কণ্ঠ পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে দেয়। সূর্যের উদ্দেশ্যে সাত বছর আগে পাঠানো হয়েছে নভোযান ইকারুস ১। ছয়মাস পৃথিবীতে বেস স্টেশনের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। তারপর থেকে আর কোন খবর পাওয়া যায় নি নভোযানটির।

এজন্যেই ষোলো মাস আগে যাত্রা করেছে ইকারুস ২। আটজন মহাকাশচারী আর স্টেলার বোমার পে-লোড নিয়ে সূর্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটি। মীথোলজিতে আকৃষ্ট আমি ইকারুসের নাম শুনেই দারুণ মজে গেলাম। দুরন্ত স্পর্ধায় পাখা বেঁধে সূর্যের দিকে রওনা দিয়েছিলো ইকারুস, তারপরে তাপে পাখার মোম গলে যাবার পরে তার মৃত্যু ঘটেছিলো। ইকারুস ২ এর যাত্রীদের মাঝেও ছোট একটা আশংকা কাজ করতে থাকে শুরু থেকেই।

এরপরে যেটা নজরে পড়লো সেটা হলো আটজন মানুষের মাঝে টানাপোড়েনের অংশটি। একটা বদ্ধ অবস্থায় ষোলোমাস কাটানোর সময়ে এরকম পরিস্থিতি হতেই পারে। গোষ্ঠী হিসেবে মানুষের ইতিহাস আধিপত্য বিস্তারের লোভ ও কাঙ্ক্ষায় ভরপুর। সেরকম একটা মাইক্রো-সমাজ এখানেও গড়ে উঠেছে। দলনেতা ও সহ-দলনেতা ছাড়া বাকি ছয়জন নানা বিদ্যায় পারদর্শী- পদার্থবিদ, গণিতবিদ, প্রকৌশলী, বোটানিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট আর অপারেটর।

একটা চারকোণা টেবিলের চারপাশে বসে থাকা আটজনের আলোচনা, বাদানুবাদের দৃশ্যটিতে অনেকগুলো পরিচিত ঘটনা পেলাম। ক্যামেরা সেসময়ে দ্রুত এক একজনের মুখের ওপরে পড়ছে, তাদের অভিব্যক্তির মাঝেই অনেক না-বলা সংলাপ ঘুরছে। এখানেও প্রাগৈতিহাসিক সমাজের মতোন ব্যবস্থাঃ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত থাকছে কেবলই সেই বিষয়ে এক্সপার্ট নভোচারী। বাকিদের উপস্থিতি সেখানে সাধারণ নাগরিক/প্রজার মতোই।

একেবারে ধাতব নভোযানের ভেতর এমন দুর্দান্ত নমুনা সমাজের উদাহরণ দেখে আমি বেশ চমৎকৃত। ম্যুভিতে মূল টেনশনের শুরু হয় যখন বুধ গ্রহের পাশ দিয়ে ছিটকে চলে যাবার সময়ে একটা অজানা ট্রান্সমিশন পাওয়া যায়। রেডিও এনালিস্ট জানালো, সেটি ইকারুস ১- এর ডিসট্রেস সিগন্যাল, গত সাড়ে ছয় বছর ধরে ক্রমাগত পাঠিয়ে যাচ্ছে। বুধ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আর বুধের পৃষ্ঠের লোহার উপস্থিতি সেটিকে বাধা দিচ্ছিলো। এখন ইকারুস ২ কাছাকাছি আসায় সেটা ধরতে পেরেছে।

মূলত এই ঘটনাটাই নভোচারীদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। তাদের মূল মিশন সফল না হলে পৃথিবী তথা সমগ্র মানবজাতি বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা। আবার ইকারুস ১ এর সাথে একটা পে-লোড আছে, দুটাই নিয়ে যেতে পারলে সফল হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে! সব মিলিয়ে খুব কঠিন আর দুরূহ সিদ্ধান্ত! সেখানে পদার্থবিদের একটি সংলাপ এমন- “তুমি আমাকে বলছো এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে যেনো কয়েন ছুঁড়ে দিয়ে সেটি হেড আসবে না টেল আসবে তা বলতে হবে”। অনুমানের ভিত্তিতে এরকম বড়ো সিদ্ধান্ত নেয়া অনেক বড়ো ঝুঁকি। মনে পড়ে গেলো, এমন ইতিহাস বদলে ফেলা সিদ্ধান্ত থেকেই আমাদের এখনকার সভ্যতা এভাবে তৈরি হয়েছে!… সিনেমার বাকি অংশ এর পর থেকেই দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছে, অনেকটা ঐ নভোযানের মতোই।

সারাক্ষণই সূর্যের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, গনগনে উত্তপ্ত সূর্যের এতো কাছাকাছি মানুষ কখনই যায়নি। আর যায়নি বলেই অবজারভেশন ডেক-এ বসে সাইকিয়াট্রিস্ট মুগ্ধ হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনের অজান্তেই বলে বসেন, “ওহ গড! ইজ দিস হেভেন?” অথচ সে তখন মূল দীপ্তির মাত্র ২ শতাংশ দেখছিলো! এরকম ছোট ছোট বেশ অনেকগুলো দৃশ্য আর সংলাপের কারণে অধিকাংশ সময়েই আমার মনে হয় নি এটা কোন সায়েন্স ফিকশন। ধুম ধাড়াক্কা ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট নেই, আছে গভীর মনস্তত্ত্ব, মানুষের সাইকোলজিক্যাল আর সোশ্যাল ভ্যালুজের পরীক্ষা। আর আছে সেই প্রাচীন দ্বিধা, পুরো মানবজাতির চাইতেও কখনো কি একজন মানুষের জীবন বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে? চূড়ান্ত লজিক্যাল মানুষ কিসের মোহে, কিসের জাদুতে আবেগিক হয়ে ওঠে।

পৃথিবী থেকে মিলিয়ন মাইল দূরে, একটা নভোযানের ভেতরে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণের মাঝে থেকেও মানুষ কেন তার সহজাত প্রবৃত্তি আর আদিম আচরণ ভুলতে পারে না? এই প্রশ্নগুলো বার বার উস্কে দেয়ার জন্যে ড্যানি বয়েল আর অ্যালেক্স গার্ল্যান্ড (লেখক) কে সাধুবাদ। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও শেষমেশ মানবতারই গল্প! সূর্যস্নানের একটা চমৎকার উক্তি দিয়ে শেষ করছি। এই উক্তিটা সূর্যের আলোর ৩.১ শতাংশ ঔজ্জ্বল্য দেখার পরে সাইকিয়াট্রিস্ট ব্যাখ্যা করছেন: Searle: It’s invigorating. It’s like… taking a shower in light. You lose yourself in it. Corazon: Like a floatation tank? Searle: Actually, no. More like… In psych tests on deep space, I ran a number of sensory deprivation trials, tested in total darkness, on floatation tanks – and the point about darkness is, you float in it. You and the darkness are distinct from each other because darkness is an absence of something, it’s a vacuum. But total light envelops you. It becomes you. It’s very strange… I recommend it. *** সানশাইনের থিয়েট্রিক্যাল ট্রেইলারঃ যাদের নেট স্পিড কম, তারা এই ভিডিওটা দেখতে পারেনঃ মুভি ডাউনলোড লিঙ্কঃ ব্লু-রে টরেন্টঃ Click This Link ডিভিডিরিপ টরেন্টঃ Click This Link ডাইরেক্ট ডাউনলোডঃ http://stagevu.com/video/ktfykaklesjm

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।