আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিপজল এবং বাংলা সিনেমার (আংশিক রঙিন) ইউ-টার্ন (২য় কিস্তি)

স্বপ্ন, সংবাদ, সিনেমা নিয়ে হ-য-ব-র-ল

(২য় কিস্তি) ১ম কিস্তির লিঙ্ক: Click This Link কাজের মানুষ: কাহিনী সংক্ষেপ সাধু সওদাগর নামের এক চেয়ারম্যানকে হত্যার মামলা পরিচালনার দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শুরু হয়। মামলায় অভিযুক্ত আসামী অনুপস্থিত ইসমাইল দরবারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন জজ সাহেব (রাজ্জাক)। তবে আদর্শ বিচারকের মত, শাস্তি প্রদান করে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। প্রতিটা রায়ের পর যেমন মনে হয়, তেমনি এই রায়ের পরও ইনসাফ করতে পেরেছেন কিনা এই ভেবে তিনি চিন্তিত। ওদিকে জজ সাহেবের অগোচরে নিজ ঘরেই তার ভাতিজি সুমি (রেসী) পরিবারের অন্য সদস্যের দ্বারা চরম বেইনসাফির স্বীকার।

ফুপু, বড় ভাই-ভাবী, ছোট ভাই-ভাবী, ছোট ভাইয়ের শ্যালক-- সবার নির্যাতন-নিপীড়নের নীরব ভোক্তা সে। নিপীড়ন চরমে উঠে গেলে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মহত্যার জন্য সুমি ব্রিজের উপর থেকে ভরা-নদীতে ঝাঁপ দেয়। উদ্ধারকর্তা হিসেবে এরপর অবশ্যই হাজির হবে ছবির নায়ক-- একথা আমাদের সবার জানা। আমাদের জ্ঞানের সীমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না দিয়ে সত্যি সত্যি আবির্ভূত হন ছবির নায়ক ডিপজল।

এরপর সুমিকে বাঁচাতে তার কোন বেগ পেতে হয় না। সুমি তার আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ প্রকাশ করে। ডিপজল কাজের মানুষ, ‘কাজু ভাই’। কারো দুঃখ দেখলে এগিয়ে যায়। সুমির দুঃখ দেখেও সে পালায় না।

সুমিকে পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে ‘কাজের মানুষ’ হিসেবে প্রবেশ করে জজ বাড়িতে। কাজু জজবাড়িতে ঢোকার পর অতি দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। কোন না জানা জাদুর বশে একই টেবিলে বসে হাসিমুখে খাবার খায় সবাই। এরপর জজ-আব্বার পরিবারে চলমান নানা সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে থাকে একের পর এক। ফুপুর সমস্যা তিনি মিথ্যা না বলে থাকতে পারেন না, বাড়ির কোন কাজেকর্মে হাত লাগান না।

হস্তরেখা পাঠের অভিনয় করে কাজু এই সমস্যার তাক লাগানো সমাধান দেয়। ওদিকে বড় ভাইয়ের একটি প্লট দখলদারের কব্জায়। প্লট না ছুটালে ব্যবসার পার্টনারশিপ ছুটে যায় আর কি। বিষয়টি জানতে পেরে কাজু একাই হাজির হয় অকুস্থলে। সুপার হিরোর মত গামছার খেল দেখিয়ে একাই পরাজিত করে গোটা দশেক দখলদার সন্ত্রাসী।

এখানেই শেষ নয়, আরো আছে। ছোট ভাইয়ের ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে দালালির চাকরি। চাকরি হারানোর মুহূর্তে কাজু নিজেকে কাজে লাগায়। পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে একটি কোম্পানির মালিককে বলে একদিনে ৫০০ ইন্সুরেন্স করিয়ে দেয় সে। প্রেমের ক্ষেত্রেও কাজু কাজের মানুষ।

যেই পুলিশ ইন্সপেক্টরকে জজসাহেব দুচোখে দেখতে পারেন না, তার সাথেই একমাত্র মেয়ের (জিনিয়া) বিয়েতে রাজি হয়ে যান কাজুর কারসাজিতে। সুমির দুঃখও ঘুচে যায় কাজুর এসব কাজের কারণে। অতঃপর তাহারা, মানে জজবাড়ির লোকেরা, সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। কিন্তু তখনো সিনেমার 'ইন্টারভেল বেল' বাজেনি। তার মানে কাহিনীর এখনো ঢের বাকি।

বিরতির আগেই ক্লাইম্যাক্স! জজবাড়িতে নিজ কাজ সম্পন্ন করতে না করতেই পুলিশের কাছে খবর চলে গেছে: এই কাজু আসলে দরকার আলি ওরফে ইসমাইল দরবার। জিনিয়ার প্রেমিক ইন্সপেক্টর এসে ইসমাইল দরবারকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ইন্সপেক্টরের অভিযোগ জজবাড়ির কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। কাজুও ঐ বাড়ির ‘কাজের মানুষ’ বলে তেমন কিছু বলতে চায় না। থানায় জজ চাচাসহ সবার সামনে সুমির সরল স্বীকারোক্তি -- "তুমি 'কাজের মানুষ' না, তুমি আমার ভালবাসার মানুষ" -- কাজুকে নরম করে দেয়, সে বলতে শুরু করে তার অতীত জীবনের না বলা কাহিনী, চলতে থাকে ফ্লাশব্যাকে ইসমাইল দরবারের জীবনকাহিনী।

বোঝা যায়, খুন করে ভোল পাল্টে কাজু নাম নিলেও আগে থেকেই ‘কাজের মানুষ’ ছিল ইসমাইল দরবার। তখন সে গ্রামে থাকে। গ্রামের প্রতিটা সাধারণ মানুষের দরকারে অদরকারে সবার আগে নিজ থেকেই হাজির ইসমাইল দরবার। তাই গ্রামের মানুষের কাছে সে ‘দরকার আলি’, ‘দরকার ভাই’। দরকার আলি উপকারী, কাজে-কর্মে দক্ষ, প্রতিবাদী।

তখন তার সুখের সংসার-- সে, মা আর বোন। ময়না নামের এক তরুণীর সাথে তার প্রেমও রমরমা। এই পর্যায়ের জীবনেও দরবার কিভাবে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের দরকারে নিজেকে উজার করে দিয়েছে তারই আরেক প্রস্ত বর্ণনা দেখা যায়। গ্রামে বাঁধ দেওয়ার কাজ করা শ্রমিকদের পাওনা গম নিজ দায়িত্বে এনে দেওয়াকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান সাধু সওদাগরের সাথে তার বিরোধ বাধে। পরবর্তীতে চেয়ারম্যানের সিন্দুক থেকে গ্রামবাসীকে দেওয়া ঋণের চুক্তিপত্র নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয় সে।

এতে চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে চেয়ারম্যানের লোকেরা দরবারের বাড়িতে আগুন দিলে তার মা বোন পুড়ে মারা যায়। মা বোনের লাশ হাতে নিয়েই ঠোঁট নাড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে দরবার: কাঁদে রে এক এতিম ছেলে মা গো মা, একবার দেখ না দু চোখ মেলে... মা বোনকে কবর দেওয়ার পরই কবরের একপাশ থেকে বাঁশের খুঁটি উপরে নিয়ে তা দিয়ে চেয়ারম্যান সাধু সওদাগরকে হত্যা করে সে। ঘটনা শোনার পর জজ-আব্বার ইচ্ছায় ইসমাইল দরবারের মামলা আবার আদালতে ওঠে। তারপর কী ঘটেছে, ছবিটি না দেখেই বাংলা সিনেমার যেকোন দর্শক বলে দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

সম্মানিত আদালত রায়ে বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ইসমাইল দরবার অপরাধ করেছে। কিন্তু 'বিশেষ বিবেচনায়' তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলে সিনেমা আর কাজুর সুখী সমাপ্তি ঘটে। সিনেমার শেষদিকে এসে নায়কের জন্য বিচারকদের এমন 'বিশেষ বিবেচনা' বাংলা সিনেমায় অশেষ-- খুবই কাঙ্ক্ষিত ও সাধারণ বিষয়। অবশ্য শেষ ভরসা রাষ্ট্রপতি তো ছিলেনই-- অল্পদিনের ব্যবধানেই কত কত চোর বাটপার আর খুনিকেই তো রাষ্ট্রপতিরা পার করে দিলেন। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম।

অবশ্য দরকার আলি তো নিতান্ত সৎ, ভাল আর উপকারী লোক। তাকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতেন কিনা তাতে অবশ্য দুর্জনেরা সন্দেহ করতেই পারে। সেই সন্দেহ প্রমাণের সুযোগ না দিয়ে চিত্রনাট্যকার এই ছবিতেও পুরানো চেনাপথেই হাঁটলেন। (ডিপজল এবং বাংলা সিনেমার (আংশিক রঙিন) ইউ-টার্ন কিভাবে সত্য তা জানতে পড়ুন আগামীকাল প্রকাশিত ৩য় কিস্তি) ........... লেখাটি পাঠের সুবিধার্থে সামুতে তিন কিস্তিতে দেওয়া হবে। পুরো লেখার একটি সংক্ষিপ্তরূপ 'ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলা সিনেমা' শিরোনামে মিডিয়াওয়াচ পত্রিকায় (নতুন রূপে ও নবতর মেজাজে, বর্ষ ১, সংখ্যা ৪) প্রকাশিত হয়।

(Click This Link) ঐ সংস্করণে শিরোনামসহ অন্যত্র 'ডিপজল-স্তুতি'র বেশির ভাগ অংশ সযতনে ছেঁটে দিয়ে বাধিত করা হয়। এখানে ঐ অংশ উদ্ধার করলাম। সাথে সামান্য পরিমার্জনাও করা হল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।