আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আন্তর্জালে জামাত-শিবির : স্বাধীনতাবিরোধী প্রচার ও প্রতিরোধের চার বছর

অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি

ক. খুব সহজ একটা পরীক্ষা দিয়ে ব্যাপারটা যাচাই করে নিতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি পোস্ট লিখুন। কিংবা সেটাও ঝামেলার মনে হলে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি পোস্টে ঢু মারুন। পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় অবধারিত মন্তব্য দেখবেন শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা কিংবা ছাত্রলীগের সমালোচনায়, নিদেনপক্ষে ভারতের। লেখককে নিশ্চিতভাবেই পোস্টের সঙ্গে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক অনেক বাকোয়াজি সইতে হবে।

সেখানে পাল্টা কিছু বলার পর আপনি আওয়ামী লীগ সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হবেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা দলটির মতো আপনারও পৈত্রিক সম্পত্তি বলে মশকরা চলবে। খুব খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারবেন এসব মন্তব্যের গোপন বার্তাটা- মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষ মাত্র। এর সঙ্গে জড়িতরা কেউই সৎ নন। ভারতের সমর্থনে পাকিস্তান ভাঙ্গার সফল চক্রান্তটি সেরে, বাকশালের ব্যানার টানিয়ে দেশটা লুটেপুটে খেয়েছে তারা।

বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তারা এসব বলে যা অন্য পাঠকদের মননে সূক্ষভাবে বিভ্রান্তি ঢোকানোর অপপ্রয়াসমাত্র। এই স্লো পয়জনিংটা পরিকল্পিত এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্যরা করে আসছে। দলটির নাম জামাতে ইসলামী। এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মীরাই মূলত বেশী একটিভ। তা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির চরিত্রহানী করে তাদের কি লাভ? স্রেফ নিজেদের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিন্হিত হয়ে যাওয়ার প্রতিষেধ হিসেবে, কবচ হিসেবে ব্যবহার।

ওই খারাপ লোকগুলো স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধীতার জন্য তাদের নুরানী চেহারার মুমিন নেতাদের মিছেমিছি রাজাকার বলে গালি দেয়- এই তত্বটা জায়েজ করা। খ. বছর চারেক আগে পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ ছিলো। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি কারণ এই নোংরামীর এই জঘন্য কীর্তিকলাপের স্বাক্ষীদের অন্যতম আমি। বাংলা কম্যুনিটি ব্লগের যাত্রাশুরুর সঙ্গে সঙ্গেই যেমন ইচ্ছে যা খুশী বলার মঞ্চটা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে নামে জামাতিরা। কাব্য চর্চার জন্য বেছে নিয়েছিলাম ব্লগকে, প্রথম পোস্টের পরই ঘাট মানতে হলো।

মুক্তিযোদ্ধারা খারাপ, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কেনো রবীন্দ্রনাথ লিখবে, বদলানো দরকার, একুশে ফেব্রুয়ারী-ষোলই ডিসেম্বর শহীদ মিনার আর স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া বেদাতি কাজ- হিন্দুয়ানি। মাথাটা স্রেফ খারাপ হয়ে গেলো। কবিতা শিকেয় রেখে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পোস্ট নামাতে শুরু করলাম। কিন্তু সবকিছুর জন্যই এদের হাস্যকর জবাব তৈরি থাকে। মতিউর রহমান রেন্টু, মেজর ডালিম, মেজর জলিলের বই থেকে উদ্ধৃতি।

মওদুদীর পর এসবই যেনো সহীহ মুক্তিযুদ্ধনামা। মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলো স্বাধীনতা না, তাই আত্মসমর্পণ করেছে; স্বাধীনতার আসল স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা ভাসানী, তাকে ভারতে বন্দী করে রেখেছিলো আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী নেতাদের ফুর্তির ফুটেজ দিয়ে জহির রায়হান স্টপ জেনোসাইড বানিয়েছিলেন, তাই তাকে মেরে ফেলে র, হুমায়ুন আহমদের উপন্যাসের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ মুজিব ৭ মার্চ জিয়ে পাকিস্তান বলেছেন- এলাহী সব আবিষ্কার। পাকিস্তানীরা কেনো ওসমানীর কাছে সারেন্ডার করলো না- প্রশ্নের শেষ নেই। শুধু মুক্তিযুদ্ধ? এরপর স্বাধীন দেশে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন, ডালিমের বউকে রেপ করেছেন, সুলতানা কামালকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছেন, দেশে দুর্ভিক্ষ আর মুজিবের ছেলেরা সোনার মুকুট পরে বিয়ে করে, সিরাজ শিকদারকে মারার পর সংসদে দাড়িয়ে মুজিব দম্ভোক্তি করে- কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। গ. প্রত্যেকটি অপপ্রচারের জবাব দেওয়া হয়েছে।

প্রতিটির। তাতে কি ভবি ভোলে! আরে ফিরোজ কামাল যে ইতিহাস লিখে গেছেন তার কাছে অমি রহমান পিয়ালের পোস্ট তো নস্যি। রেন্টু জানেন আওয়ামী লীগের হেসেলের খবর, সেটা আমরা কিভাবে জানবো! কিন্তু জামাতিরা থামে না। তবে গতি কমে, থমকায়। প্রতিরোধে যোদ্ধা বাড়ে।

জন্ম নেয় এ-টিমের মতো কালজয়ী যোদ্ধাদল। ব্লগে ব্লগে নীতিমালা আসে, স্বাধীনতা বিরোধী পোস্ট করা যাবে না। সরাসরি হাবিজাবি লেখা তাই বন্ধ। তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসে। অন্যভাবে, সূক্ষ কৌশলে।

এবং ইতিহাস হাতড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করি- এই সব ইংরেজিতে আরো আগে থেকেই চালাচ্ছিলো তারা। ইসা খা, তাজ হাশমী এবং মুফাখ্খারুল ইসলাম ইত্যাদি পোষা বুদ্ধিজীবিদের ব্যবহার করে। ফিরোজ কামালরা অনুবাদক মাত্র। আর সেগুলোই চলে কপি পেস্ট। দায়িত্ব নিয়েই বললাম কপি পেস্ট।

না হলেও ১০টি পোস্ট দেখেছি আমি শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে। ১৯৭৬ সালের টাইপোটা আর সংশোধন হয় না। সেইসব লেখনীরও প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু প্রচারে আসেনি। বাংলায় হিসেবেটা পুরোপুরি উল্টো, উল্টে গেছে পাশার দান। জামাতি প্রচারণা হালে পানি পায় না তুমুল প্রতিরোধে।

শুরুতে ধীর গতিতে হলেও এখন সরাসরি-উদ্দাম-গদাম। প্রমাণ তারা হাড়ে হাড়ে পেয়েছে গত নির্বাচনে। তারুণ্য তাদের বিচার দাবি করেছে ব্যালটে। এই মনোভাবে আন্তর্জলে জামাতি নেতাদের মুখোশ খোলা কার্যক্রমের অবদান মোটেও কম নয়, হেলাফেলার নয়। ঘ. এর প্রেক্ষিতটা যাচাই করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম আসলে প্রোপোগান্ডাটুকু একদম শুরু থেকেই চালিয়ে যাচ্ছে জামাতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো।

শুরুতে নিজেদের পিঠ বাচাতে, সেনা শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় পায়ের নীচে জমিন পেতে ও তা শক্ত করতে এবং এরপর ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষ নিয়ে। জবান বদলায়নি- এতই শক্ত ঈমান এসব বেঈমানের। এখন সেই একই সর্বরোগহরা মহৌষধীর প্রয়োগ যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে। আওয়ামী লীগ জামাতকে নির্মূল করতেই নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওয়াজ তুলেছে- এটা একটা রাজনৈতিক চাল মাত্র। সব দলেই যুদ্ধাপরাধী আছে, শেখ হাসিনার বেয়াইও রাজাকার- বোলের শেষ নেই।

কমনসেন্স বলে স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী দল মুক্তিযুদ্ধে মাত্র চারটি। মুসলিম লিগ, জামাতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী ও পিডিপি। এর মধ্যে বাকিগুলোর অস্তিত্বমাত্র নাই জামাত ছাড়া। অন্যগুলো বিলীন এখানে ওখানে, শুধু মাত্র জামাত মুক্তিযুদ্ধ সময়কার বুদ্ধিজীবি হত্যাকারী আলবদর হাইকমান্ডের পুরোটার নেতৃত্বে এবং বিশ্বাসঘাতক শিরোমনি গোলাম আযমের পিরানীতে এককভাবে সক্রিয়। তো এদের লাইন ধরে বিচার করা হলে যদি জামাতের বারোটা বাজে, সেটার দায় কার? তাদের প্রতিটি মিথ্যার স্বরূপ উম্মোচিত হচ্ছে, মানুষ জানছে সত্যিটা।

বিভ্রান্তি কেটে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মে। এজন্য অন্তর থেকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন সেইসব লড়াকু যোদ্ধাদের- যারা ভার্চুয়াল জগতে জামাত ঠেকানোকেই ধর্ম মেনেছেন। সমুন্নত রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা, লাল- সবুজের মান। ঙ. ব্লগার দেশীপোলার কাছে ঋণী ছিলাম। খুব ছোট্ট কিন্তু বাস্তবসম্মত একটা জিজ্ঞাসা ছিলো তার।

ইন্টারনেটে জামাতি প্রচারণা ও পরিকল্পনার বিষদ তুলে ধরে জানতে চেয়েছিলেন, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তর প্রজন্ম যারা এই রাজনীতিতে আছে তাদের সংশোধনের উপায় কি? শেকড় শক্ত করতে জামাতের দীর্ঘ যে বিনিয়োগ নানা খাতে সেগুলোরই বা গ্রহণযোগ্য মোকাবেলা কি? তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়া হয়নি, ভেবে পরে বলবো বলে চলে এসেছিলাম। আজ এই পোস্টটা লিখতে গিয়ে তার কথা স্মরণে এলো। উত্তরটাও। শাদ্দাদের বেহেশত নিয়ে একটি গল্প আছে ইসলামী গ্রন্থে যা অনেকটা এরকম : ধনের বলে ক্ষমতাবান এই বাদশাহ বিশাল এক সূরম্য প্রাসাদ বানিয়ে তাতে ভোগ বিলাসের সব হালনাগাদ উপকরণ জুগিয়ে তা বেহেশত বলে দাবি করেছিলো। সুবাদেই নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি তার।

ক্ষমতাবানদের অনুসারী জোটে, কিছু বিভ্রান্তও অনুগামী হয়। এক সময় ঐশীবলে ভেঙ্গে যায় সে প্রাসাদ, অনুসারীরাও বুঝে যায় এ আদতে এক ইউটোপিয়া ছিলো মাত্র। মোহ ভাঙ্গে তাদের। একইভাবে ধর্মের গন্ধম খাইয়ে জামাত যে বিশাল কর্মী সমর্থক গোষ্ঠীর অনুগামীতা পেয়েছে, তা একটা বড় ধাক্কা খাবে যদি এর মূল নেতৃত্ব এই দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধী বলে প্রমাণিত হয়। শাস্তি পায়।

ইতিহাসের এই ফাকা জায়গাটা চটজলদি পূরণ হয়ে গেলে আগামী প্রজন্মে এর সদস্যভুক্তি প্রজননভিত্তিকই হবে, অন্যভাবে নয়। আন্তর্জালে প্রতিরোধের সাফল্য তাই এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অনুদিত হোক। (লেখাটি আমার ব্লগেও প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।