আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিলেট বিভাগের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের রীতি

রঙ্গিলা বন্ধুরে....... i_mahmud2008@yahoo.com

ইসমাইল মাহমুদ লৌকিক আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস লোকজীবনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। সমাজ এগিয়ে চলে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানের পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে। বাঙ্গালীর জীবনের সঙ্গে এসব লৌকিক বিশ্বাস মিশে একাকার হয়ে। দেশের অন্যান্য স্থানের অপেক্ষা সিলেট অঞ্চলে এসব আচার-অনুষ্ঠানের সাড়া পাওয়া যায় বেশি। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় সিলেট অঞ্চলের বিবাহ রীতির কথা।

এখানকার হিন্দু ও মুসলিম স¤প্রদায়ের অনুসারীগণ বিবাহরীতি পালন করে অনেক ঝমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। হিন্দু স¤প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ঃ- হিন্দু বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথা- লৌকিক ও শাস্ত্রীয়। শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পুরোহিত দ্বারা সম্পাদিত এবং লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান সধবা মেয়েদের ও নাপিত দ্বারা সম্পাদিত হয়। এ আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলো পর্যায়ে রয়েছে।

যেমন মঙ্গলাচরণ, পানের খিলি, রুপসী পূজা, অধিবাস, দধিমন্ডল ইত্যাদি। মঙ্গলচরণ ঃ- এটি হচ্ছে বিবাহের প্রথম অনুষ্ঠান। ওই দিন শুভ দিনক্ষণ অনুযায়ী পাত্রে বাড়ি থেকে তত্ত্ব নিয়ে আসা হয় কনের বাড়িতে। কনের øান করিয়ে নতুন কাপর পড়িয়ে বসানো হয়। পাত্রের বাড়ি থেকে আগত কোনো এক গুরুজন কনেকে আশীর্বাদ করেন।

তখন কনের হাতে সিদুঁর ও শাঁখা পরানো হয়। তারপর পুরোহিতের মাধ্যমে বিবাহের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। পানের খিলিঃ- পানের খিলি অনুষ্ঠানে পাঁচজন সধবার প্রয়োজন হয়। পাঁচজনের বেশি হলে সমস্যা নেই কিন্তুু পাঁচজনের কম হলে অসুবিধা হয়। এতে কোনো পুরোহিত প্রয়োজন হয় না।

সধবা মেয়েরাই বিভিন্ন আচার সম্পন্ন করেন। অনেকগুলো পান দিয়ে পানের খিলি তৈরী করা হয় এবং খিলির মধ্যে বাঁশের কাঠি দিতে হয়। বাঁশের কাঠি ছাড়াও পানের খিলিতে সোনা ও রুপার কাঠি দিতে হয়। এই খিলি সধবারা একটি সদৃশ্য তালাতে সাজিয়ে মন্দিরে নিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে তারা বিভিন্ন ধরনের গীত করতে থাকেন।

রুপসী পূজা ঃ- রুপসী পূজাও সধবা মহিলারা করে থাকেন। কলাগাছের সাহায্যে একটি ছোট ঘর তৈরী করা হয় এবং এতে সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হয়। দুধ, ধান, দূর্বা, দই, ঘি, ডিম, সিঁদূর ইত্যাদি সহ রুপসী গাছের তলায় যাওয়া হয়। তারপর এ ছোট ঘরটিকে ধান দূর্বার মাধ্যমে আর্শিবাদ করা হয় এবং দুধ দিয়ে গাছের শিকড় ধুয়ে দিতে হয়। সধবারা ওই দিন উপবাস থাকেন।

সিদুর ও দই গাছের শিকড়ে দিয়ে চলে আসতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন ফল ও সন্দেশ রুপসী দেবতার নামে সমর্পণ করে চলে আসতে হয়। অধিবাস ঃ- বিয়ের আগের দিন এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এটি সন্ধ্যায় ও রাতে অনুষ্ঠিত হয়। কনেকে হলুদ-তেল সহ øান করানো হয়।

কনের মা সাতটি ছোট ঘটে পুকুর থেকে জল নিয়ে আসেন। সেই জল দিয়ে কনেকে øান করানো হয়, কনেকে একটি চৌকিতে বসানো এবং এর চারদিকে বসানো হয় জলের ঘটি (পাত্র) এবং চারদিকে আল্পনা দেওয়া তাকে। মা কনের মাথার উপর দিয়ে তিনবার ছুরি ঘুরিয়ে আনেন এবং এর মধ্যে দিয়ে মা সকল শত্র“র হাত থেকে মেয়েকে রক্ষার করার জন্য আশীর্বাদ করেন। অন্য সধবারা হলুদ মাখিয়ে দেন কনেকে। গ্রামের মহিলারা গীত ও ধামাইল নৃত্য করতে থাকেন।

সারারাত এই নৃত্য মহিলারা করে থাকেন। বরের বাড়িতে ও ঠিক একই রকম অধিবাসের অনুষ্ঠান করা হয়। ওই দিন থেকে বর ও কনের হাতে তর্পণ রাখতে হয়। বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত রাখতে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান ঃ- বর কনের বাড়িতে আসার পর শালক-শালিকারা ঠাট্টা-তামাশা করেন।

সধবারা উলুধ্বনি মাধ্যমে শংখ বাজিয়ে বরকে বরণ করে নিয়ে আসেন। বিবাহ লগ্নে কিছু আগে কনের মাতা বরকে আশীর্বাদ করেন। একে দধিমঙ্গল বলা হয়। কনের মাতা আর্শীবাদ করে একটি আংটি বরের হাতে পরিয়ে দেন। তারপর বরকে বিবাহের কুঞ্জে নিয়ে আসা হয়।

সেই সধবারা বরণ ডালা, ধুতুরা প্রদীপ ও মালা নিয়ে কুঞ্জে প্রবেশ করেন। তরপর সাতপাক শুরু হয়। বিবাহ অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে বাদ্য-বাজনা উলুধ্বনি দেওয়া হয়। যখন ছয় পাক শেষ হয় তখন কনের তর্পণ থেকে একটি ডাব বরের তর্পনে এবং বরের তর্পন থেকে একটি ডাব কনের তর্পনে বদল করা হয়। সাতপাক শেষ হওয়ার পর প্রদীপের মাধ্যমে বর ও কনের শুভ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়।

এরপর মালা বদল হয়। উলুধ্বনি মাধ্যমে বর কনে কুঞ্জ ত্যাগ করেন। তারপর বর-কনেকে পুনরায় বিবাহ কুঞ্জে নিয়ে আসা হয়। সেখানে স¤প্রাদানের জন্য পুরোহিত কর্তৃক বেদমন্ত্র পাঠ, হোমাদি ও বসুধারা ক্রিয়া হয়। কনের পিতা অথবা জ্যৈষ্ট ভ্রাতা সম্প্রাদান করে থাকেন।

সম্প্রাদানের মাধ্যমে কনের একুশটি কড়ি ও ১টি আংটি দরকার হয়। পাশা খেলা নবদম্পতির মধ্যে অপরিচয়ের সংকোট ও জড়তা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। মুসলিম বিবাহরীতি ইসলাম ধর্মে সর্বাধিক চারজন স্ত্রী গ্রহনের অনুমোদনের হয়েছে। তবে স্ত্রী মতামত না নিয়ে কেউ পুনরায় স্ত্রী গ্রহন করতে পারে না। মুসলিম বিবাহের বিচ্ছেদ আছে ।

কিন্তুু হিন্দু বিবাহে অবিচ্ছেদ্য। মুসলিম বিবাহের অনুষ্ঠানগুলো ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করা হলো। পান চিনিঃ- বিবাহের পাত্রপাত্রী পছন্দ হলে আসে পান চিনি বা পাকা কথার পালা। অঞ্চলভেদে এর বিভিন্ন নামকরণ হচ্ছে। সাধারণত কন্যার পিতৃগৃহে এই অনুষ্ঠান হয়।

এই অনুষ্ঠানে কনকে আংটি বা টাকা দেওয়া হয়। কাবিনের টাকা দেনাপাওনা নিয়ে আলোচনা করা হয় এই অনুষ্ঠানে। গায়ে হলুদ ঃ- এই অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনরা সবাই বর বা কনের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে যান। এ সময় তাদের মিষ্টিমুখও করান। গায়ে হলুদে বর ও কনের রক্ষাকবচ হিসাবে রাখী বেঁধে বরের ডান হাতে কনের বাম হাতে পরিয়ে দেওয়া হয়।

ইদানিং বর পক্ষ ও কন্যা পক্ষ উভয় যৌতুকের জন্য একে ওপরকে চাপ সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের কারণে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। যা মুসলমানদের ইসলামিক নিয়ম বর্হিভূত। এসব বেশির ভাগ দেখা যায় লন্ডনি কন্যা ও ছেলের মধ্যে ঘটে থাকে। দধিমঙ্গলঃ- দুলাই সাজানো হয়ে গেলে মা দুধ ভাত দিয়ে তাকে আড়াই লোকমা ভাত খাওয়ান।

অবশিষ্ট ভাত পুকুরে ফেলে দেন। এক পাতিল ভাত গামলায় ডেলে তাতে দই মাখিয়ে দিয়ে বর তিন লোমকা দইভাত খায়। এর পরই বর সজ্জা করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিবাহ করতে যান। আকদঃ- এই অনুষ্ঠাই মুসলমান বিবাহের মূল অনুষ্ঠান। এতে উভয় পক্ষের দুজন স্বাক্ষী থাকতে হয়।

এবং একজন উকিলের দরকার হয়। বিয়ের কাবিন ঠিক করা হয়। ছেলে পক্ষের লোকজন এবং অন্যদের সামনে বর আগে কবুল করেন। বর কবুল করার পর কনে কবুল করেন। কাবিন নামায় উভয়ের সই অথবা স্বাক্ষর নিতে হয়।

এর পর বর-কনের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর নিকট মোনাজাত করা হয়। আকদের উপাদান সমুহ বরের বাড়ি থেকে আসে। আকদের অনুষ্ঠান বিয়ের আগেও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আকদ ও বিয়ে একই দিন করা হয়। বিয়েতে আর ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান করা হয় না।

বিয়ের দিন ভোজনের আয়োজন করা হয়। বৌ-ভাতঃ- সাধারণত বরের বাড়িতে বিবাহের তৃতীয় দিনে ওয়ালিমা হয়। একেই অন্যান অঞ্চলের বৌ-ভাত বলা হয়। বরের বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে সবাইকে আপ্যায়ন করার জন্য এই অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। ওয়ালিমার মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হয়।

সিলেট অঞ্চলের যতটুকু পারা যায় পূর্বের আচার নিয়মনীতি মেনে চলা হয়। তাই এ অঞ্চলের বিয়েতে বিবাহ অনুষ্ঠানের পরিপুর্ন আনন্দ উপভোগ করা যায়। তা ছাড়া সবার উপস্থিতিতে বিবাহ অনুষ্ঠানগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। আজকাল বাসা-বাড়ীতে বিয়ে অনুষ্ঠান না করে কমিউনিটি সেন্টারে হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হয়। এটা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।

০১৭১৫১৭১৯৫০ ০১১৯৬১২৮৫১৩ ০১৬৭০৫৮৪২৭৫

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.