আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাচ শেখা এবং ...

www.cameraman-blog.com/

তখন ১৯৮৯ এর গ্রীষ্মকাল। আমি তখন সুইডেনের রাজধানী ষ্টকহোমে। থাকি বড়কাক্কার বাসায় আর কাজ করি পোষ্ট অফিসে। নিতান্তই শ্রমিকের জীবন। ঘড়িতে এলার্ম দেয়া থাকে ৪ টার।

ঝটপট গোসল সেরে ভাবীর আগের রাত্রে আমার জন্য বানানো নাশতা খেয়েই ছুটি বাসষ্টপে। বাড়ীর সব তখন ঘুমে। ফিরতে ফিরতে প্রায় ৩ টা বাজে। এরপর আর আমার তেমন কিছু করার থাকে না। এদিক সেদিক ঘুরি, এটা ওটা কিনি।

ঘোরার জায়গা খূব সীমিত। আমার প্রথম পছন্দ বিভিন্ন শপিং মল। উইন্ডো শপিং এর মাহাত্য তখন বুঝতে শিখেছি। আর কিছু না পেলে মানুষজন দেখি, গাড়ী দেখি কিংবা আবজাব খাই। আমি জাতিতে সর্বভূক, তাই কোন কিছু চেখে দেখার ব্যাপারে কোন সমস্যাই হয় না।

আর একটা কাজ করতাম। যেহেতু মান্থলি টিকেট কাটা থাকতো বাসে, ট্রেনে বা সাবওয়েতে আনলিমিটেড ঘোরাঘুরির সূযোগ ছিল। কেবল চড়ে বসার অপেক্ষা। মেরী আর বোয়ি মাঝে মধ্যে উইক এন্ডে কাজিনের সাথে বেড়াতে বের হতাম। ভদ্রলোক আমার থেকে ১৩/১৪ বছরের বড়।

এমনিতে মনে হয় খূব গম্ভীর, কিন্তু মিশলে বুঝা যেত আসলে কতোটা প্রাণখোলা। মাঝে মধ্যে এক আধটা মজার কান্ড করতেন। একবার এরকম ঘুরতে বেড়িয়ে আমার খূব পানি পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু কোন দোকান চোখে পড়ছে না যে একটা কোকাকোলা বা মিনারেল ওয়াটার কিনবো। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা বার, অমনি আমাকে টেনে নিয়ে ঢোকালেন বারে।

আমি তো ভয়ে অস্থির ভাইজানের সাথে আবার মদ্যপান করতে হয় কিনা এই চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত তিনি সহাস্যে অর্ডার দিলেন দুঃটো কোকাকোলার। বারের সুন্দরী ওয়েট্রেস কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিয়ে আসলো কোকাকোলা। সেটা শেষ করে বিল দেয়ার পালা। সুন্দরী হেসে জানালো ৪৮ ক্রাউন দিতে হবে।

২ টা কোকাকোলা ক্যানের দাম হলো বাইরে ৮ দু'গুনে ১৬ ক্রাউন আর বেজায়গায় বসে খেলাম বলে দিতে হলো ৪৮ ক্রাউন। বাইরে এসে কাজিনের মন্তব্য - মদ খেলেই তো ভাল হতো মনে হয়। যাই হোক। এরকম একদিন বের হয়েছি। বাসে উঠে কাজিন আমার হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে দিলেন।

সুইডিশ বুঝিনা, তারপরও দু'একটা শব্দ দিয়ে ভাবার্থ বের করে ফেলতে পারি অনেক সময়। লিফলেট থেকে বুঝলাম কোথাও একটা নুত্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা আছে, সপ্তাহে ২ দিন ক্লাস আর দিতে হবে মাসে ২৫০ ক্রাউন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কাজিনের দিকে তাকাতেই বললেন চলো তোমাকে ভর্তি করে দেই। আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। চলছে নাচের প্র্যাকটিস ... আমরা কিন্তু ঠিকই চলে এলাম জায়গা মতো।

বয়স তখন ২৪, মনের মাঝে তো কিছু ইটিশ-পিটিশ আছেই। সুইডিশ ছেলে-মেয়েরা তো যেখানে সেখানেই চুমোচুমি শুরু করে দেয়। এসব আর কাঁহাতক দেখা যায়। যেখানে গেলাম সেটা আসলে বাচ্চাদের একটা প্রি-স্কুল। ভিতরে বেশ কিছু ছেলে মেয়ে বিভিন্ন বয়সের ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

ছোট ছোট ডেস্ক আর চেয়ারগুলি একপাশে জড়ো করা। আমাদের ঢুকতে দেখে লাল ড্রেস পড়া একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। কাজিন সেই লিফলেট টা বের করে দেখাতেই মেয়েটা হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বয়স জিজ্ঞাসা করলো। বললাম, বলতেই আমাকে বললো তোমাকে এনরোল করা যাবে, কিন্তু একে না - বলে আমার কাজিন কে দেখালো। আমার কাজিন হেসে বললো সে এমনি এসেছে দেখতে।

জানলাম মেয়েটার নাম মেরী, আমার থেকে কিছু বড়। সেই মূল ইন্সষ্ট্রাকটর, আরেকজন আছে ছেলে, নাম বোয়ি। বোয়ি জানাল সে ইংরেজী পারে না। ঠিক হলো ভাষাগত ব্যাপারে মেরী আমাকে হেল্প করবে। চলছে নাচের প‌্য্যাকটিস ... আরো কিছু ছেলে মেয়ে আসার পর শুরু হলো নাচ শেখানোর পালা।

বলা হলো ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা হয়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম এর মাজেজা। ছেলেদের যা ষ্টেপ, মেয়েদের ষ্টেপগুলি ঠিক তার বিপরীত। ভাষা না বুঝলেও নাচের ষ্টেপ বুঝতে তেমন অসুবিধা হলো না। প্রায় আধ ঘন্টা একা একা ষ্টেপ প্র্যাকটিশ করার পর মিনিট দশেকের একটা ব্রেক দেয়া হলো।

এরমধ্যে আমার কাজিন কখন জানি বাইরে যেয়ে দু"টো কোকাকোলার ক্যান নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে আরো কিছু লোক কিছু মিউজিক্যাল ইন্সষ্ট্রুমেন্ট নিয়ে চলে এসেছে। এই যেমন গিটার, একোর্ডিয়ান, বাশির মতো কি জানি একটা, ছোট একটা কিবোর্ড ইত্যাদি। এরপর শুরু হলো ২য় পর্ব। বলা হলো পছন্দ মতো সঙ্গী বা সঙ্গীনি বেছে নিতে।

এইবার একটু মুশকিলেই পরলাম। কাকে যে বলি। মেরী আমার এই অবস্থা দেখে জোরেই বললো - আস্ক সামওয়ান। এতে মনে হলো আমার শিকড় গজিয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে দু'হাত বাড়িয়ে সুইডিশে কি যেন বলছে আমাকে।

দু'হাত বাড়ানো দেখে বুঝলাম আমাকেই ... । আমিও একগাল হেসে দু'হাত বাড়িয়ে বললাম আমি কিন্তু সুইডিশ বুঝিনা। মেয়েটা তখন ঝরঝরে ইংরেজীতে বললো শ্যাল উই ডান্স ? মেয়েটা বেজায় মোটা, তার উপর খাট। কিন্তু চেহারাটা খূব মিষ্টি আর হাসলে গালে টোল পড়ে। এরাই মিউজিশিয়ান এবার পজিশন নিয়ে দাড়ানোর পর ইন্সষ্ট্রাকটররা দেখিয়ে দিলো কিভাবে পার্টনারকে ধরতে হবে।

আহারে !!! এরপর বলা হলো এরআগে যেভাবে ষ্টেপগুলি প্র্যাকটিস করেছি ঠিক সেভাবেই করতে, তবে ধীরে। এইবার অনেকেই টুকটাক ভূল করছিলো। কেই ষ্টেপ ভুল করলেই অনেকটা প্যাঁচ খাওয়ার মতো অবস্থা হয়। কিছুক্ষণ এরকম করার পর বলা হলো গতিটা বাড়াতে। এইবার মনে হলো কঠিন অবস্থা।

ঘোরার সময় ব্যালেন্স রাখাটা কঠিনই মনে হলো। তার উপর আমার পার্টনার বেজায় মোটা বলে আমি বেশ হিমশিম খাচ্ছিলাম। ১৫/২০ মিনিট এরকম করার পর দেখি ঘাম বেড়িয়ে গেছে। এবার দেয়া হলো পাঁচ মিনিটের ব্রেক। ব্রেকের সময় কথা হলো মেয়েটার সাথে।

ওর নাম সোনিয়া, পড়ে ষ্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে ল'এ। জানাল সে আর তার বয়ফ্রেন্ড এসেছে নাচ শিখতে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম তাহলে আমার সাথে জুটি বাধলে কেন ? ও হেসেই জবাব দিল তোমার করুন অবস্থা দেখে মায়া হলো, তাই। এবার দু'জনে মিলেই হাসলাম। আরো কিছু টুকটাক কথা হলো।

এবার মেরী সবাইকে বললো নতুন পার্টনার নিতে। এবার চশমা পড়া হালকা পাতলা গড়নের একটা ছেলে এগিয়ে এলো সোনিয়ার দিকে। সোনিয়া আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল এটাই তার বয়ফ্রেন্ড। আমি তো পূরা টাশকি !!! এতো সোনিয়ার ওয়ান থার্ড। সামলায় যে কেমনে আল্লাহ মালুম ! মেরী আবারও তাড়া দিল আমাকে চুজ সামওয়ান।

তাকিয়ে দেখি সবাই প্রায় পার্টনার বেছে নিয়েছে। এক কোনায় গোটা তিনেক মেয়ে দাড়িয়ে আছে। ছেলে বাকি আছে একজন আর সেটা এই শর্মা। কিন্তু মেয়েগুলা একেবারেই পিচকি টাইপ। এই বড়জোর ১৩ - ১৫ এর মধ্যে বয়স।

মেরী আরেকবার তাড়া দেয়ার আগেই একটাকে গিয়ে বললাম মে আই ... । বলে হাত বাড়ালাম। মেয়ে হেসে এগিয়ে আসলো। বাকি দু'জনের কি করা যায় !!! ঠিক হলো বোয়ি পালা করে ওদের দু'জনের সাথে প্র্যাকটিস করবে। নাচের ফাঁকে ফাঁকে কথা বললাম।

ওর নাম এমা। স্কুলে কোন ক্লাসে যেন পড়ে। একটু লাজুক বা স্বল্পভাষি মনে হলো। চমৎকার ইংরেজী বলে। এরপর যতদিন নাচের ক্লাস করেছি এমাই ছিল আমার নাচের সঙ্গীনি।

আমাদের ৩/৪ রকমের নাচ শেখানো হয়েছিল। একটার নাম এই মূহুর্তে মনে পড়ছে ফক্সট্রট। তবে কোন নাচের ষ্টেপই আর মনে নেই। ২য় দিন থেকে মিউজিকের সাথে নাচতাম। মিউজিকগুলো ফোক টাইপ মিউজিক, অসাধারণ।

একেবারে শেষ দিন সবাইকে একটা ডান্স হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেখানে আমাদের মতো আরো দু'তিনটে গ্রুপ এসেছিল। এই সেই এমা ... তবে এই নাচ শেখা নিয়ে বাসায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। কাজিন বাসায় গিয়ে তার বইকে বলেছিল রঞ্জু নাচের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ভাবী গিয়ে বলেছে বড় আম্মা (বড় চাচী) কে।

তার কাছ থেকে শুনেছে বড়কাক্কা। এরমধ্যে কিন্তু পার হয়ে গেছে প্রায় দেড় মাস। আমি অবশ্য ঢাকায় এটা জানিয়েছিলাম চিঠিতে। আমার বাসা থেকে কোন প্রবলেম হয় নাই। ঘাপলাটা বাধালো বড়কাক্কা।

একদিন খাবার টেবিলে আমাকে কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি নাকি নাচের স্কুলে ভর্তি হয়েছো। বললাম জ্বি। এবার মনে হয় একটু রেগেই বললেন - তোমার আব্বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে, তার ছেলে হয়ে তুমি কিভাবে নাচ শিখতে গেলা। আমি সবিনয়ে জানালাম ঢাকায় সবাই জানে। কিভাবে ? বললাম আমিই জানিয়েছি।

কাক্কা এরপরও গজগজ করতে থাকলেন। বললেন তোমার আব্বা যদি আমাকে কিছু বলে তো আমি তাকে কি বলবো। আমি নিরব থাকাই ভাল মনে করলাম। কাক্কা উঠে গেলে বড় আম্মা আমাকে বললেন যে কাক্কা এটা পছন্দ করছে না, তুই আর যাস না। একবার মনে হলো কাজিনটাকে ফাঁসিয়ে দেই।

শেষে ঠিক করলাম, কিছুই বলবো না। আমি অবশ্য যাওয়া বন্ধ করি নাই। নাচের ক্লাস ছিল ২ দিন আর ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার ক্লাস ছিল ২ দিন। এরপর থেকে আমার ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার ক্লাস হয়ে গেল সপ্তাহে ৪ দিন। কি আর করা।

সেদিন কি একটা কাজে পুরান এলবামটা বের করতেই চোখে পড়লো এমার হাসি মূখটা। হিসেব করে দেখলাম ওর বয়স এখন ৩৩। কল্পনায় দেখার চেষ্টা করলাম ওর বর্তমান চেহারাটা। ঘুরে ফিরে চোখে ভাসছিলো কেবল সেই ১৩ বছরের স্বল্পভাষী এমার চেহারাটা। আহা !!! আমার নানা রং এর সেই দিনগুলি।

সেই আমলে আমি ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।