আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধ ও ট্রাইব্যুনাল : নানকিং মাসাকার ও টোকিও ট্রায়াল

সব বিষয়ে জানতে ও শিখতে আগ্রহী একজন উদার মনের মানুষ।
যুদ্ধাপরাধ ও ট্রাইব্যুনাল - ২য় পর্ব জাপানী সেনাবাহিনী চীন আগ্রাসনের প্রাক্কালে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের তৎকালীন রাজধানী নানকিং শহর দখলের পর ২ থেকে ৩ লক্ষ লোককে হত্যা, ২০ থেকে ৩০ হাজার মেয়েলোককে ধর্ষণ এবং সারা শহরে লুটতরাজ ও ধ্বংসের এক তান্ডবলীলা চালিয়েছিল। এই কুখ্যাত গণহত্যা, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও অমানবিক নির্যাতন ইতিহাসে Nanking Massacre বা Nanjing Massacre বা Rape of Nanking এবং এই যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য পরবর্তীতে যে ট্রাইব্যুনাল হয়েছিল তা International Military Tribunal for the Far East বা Tokyo Trials বা Tokyo War Crimes Tribunal নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালে চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার রাজধানী পিকিং থেকে নানকিং-এ স্থানান্তরিত করে। চীনে কিউমিনটাং ও কম্যুনিষ্টদের (Nationalist-Communist Civil War) মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৯৩১ সালে মঞ্চুরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে জাপান চীন আগ্রাসন শুরু করে। পরপর আরো কয়েকটি শহর দখল করার পর চীনের টনক নড়ে। ১৯৩৭ সালে চীনের কম্যুনিষ্ট ও জাতীয়তাবাদীরা একত্রিত হয়ে জাপানের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য একটি যুক্ত বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী ছিল খুবই দুর্বল। তাদের ছিল না উপযুক্ত কোন ট্রেনিং বা আধুনিক কোন অস্ত্র।

জেনারেল টাং শেনজির নেতৃত্বে সামরিক-আধাসামরিক মিলে ১ লক্ষ সৈন্য নানকিং রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হল। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দীর্ঘ যুদ্ধ ও ব্যাপক হতাহতের মধ্য দিয়ে জপান সাংহাই দখল করে। জাপানের দখলকৃত শহরগুলো থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু এসে আশ্রয় নিল নানকিং শহরে। নানকিং শহরের লোকসংখ্যা ২৫০০০০ থেকে বেড়ে হয়ে গেল প্রায় ১০ লক্ষ। এসময় জাপানের সম্রাট হিরোহিতুর পুত্র প্রিন্স অশোকা ছিলেন জাপানের রাজকীয় বাহিনীর কমান্ডার।

সাংহাই দখলের পর জাপানীরা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে নানকিং দখলের অভিপ্রায়ে জেনারেল মাটসুইয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে আসতে লাগল। জেনারেল টাং শেনজির আদেশে শহরের চারপাশের রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দেওয়া হল যাতে লোকজন পালাতে না পারে ও জাপানীরা সহজে শহরে ঢুকতে না পারে। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ৯ ডিসেম্বর জাপানীরা নানকিং-এর দ্বার প্রান্তে চলে আসল। নানকিং-এর পতন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। জাপানী জেনারেল মাটসুই চীনের সেনাবাহিনীর কাছে হুকুম পাঠাল, ২৪ ঘন্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের জন্য, অন্যথায় তাদেরকে সম্পুর্ণভাবে ধ্বংস করা হবে।

চীনা জেনারেল টাং International Comittee for the Nanking Safety Zone -এর সদস্যদের মাধ্যমে Hankow শহরে অবস্থানরত চিয়াং কাইশেকের সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি শেষ সৈন্যের জীবন থাকা পর্যন্ত নানকিং রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। কয়েকদিন ব্যাপক যুদ্ধের পর ১৩ ডিসেম্বর জাপানীরা নানকিং দখল করে নিল। এ যুদ্ধে চীনের অনেক সৈন্য প্রাণ হারাল। আর যারা বেঁচে ছিল তারা বিভিন্ন দিকে পালিয়ে গেল, অনেকেই পোশাক পরিবর্তন করে সাধারণ জনতার ভীড়ে মিশে গেল।

জাপানী সৈন্যরা শহরে ঢুকে যাকে যেখানে পেল হত্যা করতে লাগল। নিরপরাধ জনসাধারণ থেকে শুরু করে আহত সৈনিক পর্যন্ত কেউ রক্ষা পেল না। জাপানীরা এখানে মানুষ হত্যার জন্য বর্বরতা ও নৃশংসতার সব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। এদের বিভৎস যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল নানকিং-এর ২০ থেকে ৩০ হাজার নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণধর্ষণের পর এদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করা হত।

জাপানী সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দিয়েছিল কে কার থেকে বেশি মানুষ হত্যা করতে পারবে। নিচের ছবিটি তৎকালীন জাপানী পত্রিকায় প্রকাশিত নানকিং যুদ্ধের একটি খবর। এ থেকেই অনুমান করা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদী জাপানীদের আগ্রাসনের নিষ্ঠুর কার্যকলাপের বিভৎসতা। সেই বিভৎসতার বর্ণনা দিয়ে লেখা দীর্ঘায়িত করলাম না। যাই হোক তখনকার দিনে মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তি আজকের মত এত শক্তিশালী ছিল না।

এছাড়া জাপানীদের নিষ্ঠুরতার ভয়ে কোন সাংবাদিক প্রকাশ্যে ছবি তুলতে পারে নি। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী, স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার-নার্চ ও উপসনালয়ের পাদ্রি-সন্ন্যাসিনীদের বর্ণনা এবং জাপানী কিছু সৈনিকের ডায়েরী থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হয় যে ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩৭ সালে নানকিং দখলের পর প্রথম ছয় সপ্তাহে জাপানীদের হাতে নিহত হয়েছিল কমপক্ষে দুই লক্ষ লোক ও ধর্ষিত হয়েছিল বিশ হাজার নারী। পরবর্তীতে জেনারেল মাটসুই তাঁর সৈন্যদের উল্লেখিত নিষ্ঠুর কার্যকলাপের কথা স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে জাপান ও চীনের collaborating government প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ও জাপান ২য় বিশ্ব্ব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে নানকিং-এর অবস্থা ধাপে ধাপে উন্নীত হতে থাকে। এসময় জেনারেল মাটসুই সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করলেও প্রিন্স অশোকা ২য় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত কমান্ডার ছিলেন।

এরমধ্যে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে নাৎসী জার্মানীদের হত্যা ও ধ্বংসের তান্ডবলীলার কারণে নানকিং মাসাকার সাময়িকভাবে চাপা পড়ে। জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর তা আবার যুদ্ধাপরাধের তালিকায় চলে আসে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের শারীরিক নির্যাতন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মায় নিরপরাধ মানুষ হত্যা এবং নানকিং মাসাকারের যুদ্ধাপরাধে জাপানের সামরিক অফিসার এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের উদ্দ্যেশ্যে বিভিন্ন দেশের ১১ জন বিচারকের সমন্বয়ে ১৯৪৬ সালের ৩ মে Tokyo War Crimes Tribunal গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, জাপানের সম্রাট পরিবারের কাউকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়নি- যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এই ট্রাইব্যুনাল জাপানের ২৮ জনের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অপরাধের অভিযোগ আনে: "Class A" (crimes against peace), "Class B" (war crimes), and "Class C" (crimes against humanity)।

বিচার সম্পন্ন হতে মোট সময় লাগে আড়াই বছর। বিচারের রায়ে জেনারেল মাটসুইসহ ৭ জনের মৃত্যুদন্ড, ১৬ জনের যাবৎজীবন এবং ২ জনের স্বল্প মেয়াদী কারাদন্ড হয়। বাকী ৩ জনের বিচারকালীন সময়ে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, কারাদন্ডে দন্ডিত সবাই মাত্র ৮ বছর পর প্যারলে মুক্তি লাভ করে। নানকিং মাসাকারের ভিডিও ক্লিপ: - চলবে - যুদ্ধাপরাধ ও ট্রাইব্যুনাল - ১ম পর্ব (ভূমিকা ও ইতিহাস) --------------------------------------------------------------- ছবি ও তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া Online Documentary ইন্টারনেট
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.