আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যাপ্টেন্স ডায়েরি ২০০৬ - রিকি পন্টিং



দশম অধ্যায় - একের পর এক টেস্ট শুক্রবার, এপ্রিল ১৪ প্রথমেই এই ম্যাচ সম্পর্কে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ অসাধারণ ভালো খেলেছে। তারা জিতেও যেতে পারতো যদি কিছু জিনিস ভিন্নভাবে কাজ করতো। এটাও সত্য যে, আমরা মোটেও ভালো খেলতে পারিনি। যদিও পরে কোনভাবে ম্যানেজ করা গেছে। স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল প্রথম ইনিংসে ভালো বল করেছে, যা তাদের বিশাল রান সংগ্রহ করতে দেয়নি।

২য় দিনে মিডল অর্ডারে ধস নামার পর এডাম গিলক্রিস্ট অসাধারণ নৈপুণ্য দিয়ে গোটা টিমকে উদ্ধার করেছে। ২য় ইনিংসে আমাদের বিশাল সংগ্রহে আমারও গর্বিত অবদান রয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও এ সবই ছিল আমাদের সেরা খেলার চাইতে অনেক পিছিয়ে। ক্লান্তিকর সময়সূচী একটা অজুহাত হতে পারে। কিন্তু তা শুধু এই অর্থে যে, আমরা বুঝতে পারিনি এটা আমাদের কতটা গ্রাস করবে, যতক্ষণ না ম্যাচটা আমাদের হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল।

হয়তো আমরা কিছুটা আত্মপ্রাসাদে ভুগছিলাম। কিন্তু তা সত্বেও আমার উদ্বেগ ছিল প্রস্তুতি নিয়ে - মাঠে নেমে আমরা চেষ্টা করেছিলাম শতভাগ উজাড় করে দিতে। ম্যাচপূর্ব মিটিংয়ে আমি ছেলেদের বলেছিলাম, ট্রেনিংয়ের জন্য কিছুটা এনার্জি সেভ করে রাখতে, কারণ আমাদের তখন সবচেয়ে বেশী দরকার ছিল সতেজ হওয়া। আমি আমাদের কঠোর ট্রেনিং নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না, তাদেরকে বলেছিও। হয়তো আমরা একটু বেশী রিলাক্স করেছিলাম।

ফলে ম্যাচে নিজেদেরকে ফিরে পেতে অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দলে যথেষ্ট উদ্ধারকারী চরিত্র আছে। আমাদের কাজটা সহজ হতে পারতো যদি আমরা টসে জয়লাভ করতাম, সেক্ষেত্রে বোলাররা একদিন বা দুইদিন সময় পেত একটু জিরিয়ে নিতে। পরিবর্তে যা হলো, গনগনে গরমের মধ্যে আমাদের ফিল্ডিং করতে নামতে হলো, এমন এক দলের বিপক্ষে, যারা বহু আগে থেকেই আমাদের সাথে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক ২৫ ওভার পর দুপুরের লাঞ্চে, তাদের স্কোর ছিল ১-১৪৪, যার মধ্যে শাহরিয়ার নাফিস ৬০ রান নিয়ে খেলছিল।

অনেকদিন পর কেউ ওয়ার্নিকে এত ভালোভাবে খেললো। সেসময় শেনের বোলিং ফিগার ছিল - ৬ ওভারে ০-৩৮। ওদিকে বিঙ্গ-ও কঠিন মার খাচ্ছিল, ৮ ওভারে ৪৪ রান, যার মধ্যে ছিল ক্যাপ্টেন হাবিবুল বাশারের মারা বিশাল এক কভার ড্রাইভ, ঠিক লাঞ্চবিরতির আগের ওভারের শেষ বলটিতে। তাদের মার আমাদের সহ্য করতে হয়েছিল। প্রথম ইনিংসে আমাদের দুজন সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন, ম্যাকগিল ও জেসন গিলেস্পি, তারা কেউই সাম্প্রতিক সময়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলছিলেন না।

আমি মনে করি এটা কোন কাকতালীয় না। প্রথমবারের মতো ম্যাগিলা * টেস্টে আট উইকেট নিলো, যার মধ্যে ২০০ তম টেস্ট উইকেটও ছিল (তার মতো খেলোয়াড়ের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন, যোগ্যতা থাকা সত্বেও তিনি বেশী ম্যাচ খেলতে পারেননি,)। আর ডিজি^ টাইট লাইন লেংন্থে বল করেছে, এমন এক উইকেটে যেখান থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই। আসলে আমরা ভালো করেছি - প্রথমদিন শেষে ৩৫১-৪ থেকে ৪২৭ এ তাদের বেঁধে ফেলেছি। কিন্তু পরে আমরা আবার আমাদের সব অর্জনকে ব্যর্থতায় পর্যবেসিত করেছি, দ্বীতিয় দিন ৬-৯৩ তে খেলা শেষ করে।

মনে হচ্ছিলো আমরা ফলো অন করতে যাচ্ছি। যার কারণে এটা হয়নি, সে হলো গিলিΩ, ৬১ রানে চতুর্থ উইকেট পতনের পর সে ব্যাট করতে নামে এবং শেষ ব্যাট্সম্যান হিসেবে আউট হয় ১৪৪ রানে, ২১২ বল খেলে (তার স্ট্যান্ডর্ড হিসেবে ততটা দ্রুত নয় এটা), দলীয় স্কোর ছিল তখন ২৬৯। তার মানে, সে ক্রিজে নামার পর যত রান হয়েছে, ৭০% রান এসেছে তার ব্যাট থেকে, এর মধ্যে মাত্র ১৮% রান এসেছে যখন তার সঙ্গে একজন স্পেশালাইজড ব্যাট্সম্যান পাপπ খেলছিল। গিলি কি কোন প্রতিষ্ঠিত দলের সাথে এরকম খেলা খেলেছে ? আমি নিশ্চিত, এটা সর্বকালের অন্যতম সেরা টেস্ট ইনিংস হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো, কিন্তু দলটি যেহেতু বাংলাদেশ, আমি বাজি ধরতে পারি এটাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে না, যেটা আনফেয়ার। কারণ এটা তাদের মাঠ, তারা সিরিয়াস ছিল, আমরা ছিলাম ডেসপারেট।

সে দলের প্রয়োজনে আবারো এগিয়ে এসেছে। ১৫৮ রানে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ দ্বীতিয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামে, কিন্তু এবার আমাদের বোলাররা ছিল অসাধারণ। ওয়ার্নি প্রথমদিন কাঁঠে আঘাত পেয়েছিল এবং এক সময় মনে হচ্ছিল সে দ্বীতিয় ইনিংসে বল করতে পারবে না। কিন্তু পরিবর্তে সে শক্ত হাতে সামাল দেয় তৃতীয়দিন বিকেলে এবং চতুর্থ সকালে প্রতিপক্ষের লেজ মুছে ফেলে। ডিজিও ছিল অসাধারণ, স্থানীয় ব্যাট্সম্যানদের মনে ভীতি সঞ্চার করেছিল, মনে হচ্ছিল ঐতিহাসিক জয় সন্নিকটে।

চুতর্থ দিন শেষে মনে হয় আমরা আমাদের নাক যথাস্থানে ফেরত পাই, জয়ের জন্য তখন দরকার ছিল ৯৫ রান, ৬ উইকেট হাতে। সে রাতে ৭২ রানে অপরাজিত থেকে আমি ঘুমাতে যাই, পরদিন শেষপর্যন্ত খেলার ব্যাক্তিগত মিশন নিয়ে। আমরা হারতে পারি - শেষদিন এই কথাটা শুধু একবারই মনে হয়েছিল, যখন আমাদের সপ্তম উইকেটের পতন হয়, জয় থেকে ২৪ রান দূরে থেকে, আমি তখন ৯৭ রানে ব্যাট করছিলাম। শাহাদাত হোসেন একটা শর্ট ডেলিভারি দিয়েছিল, যেটাকে আমি পুল করি, কিন্তু টপ এজ্ড। এক মূহুর্তের জন্য সময় থমকে দাড়িয়েছিল।

আমি জানতাম বলটা আকাশে উড়ছে, কিন্তু কোথায় তা বুঝিনি। বলটা ডিপ ফাইন লেগ বরাবর ফিল্ডারের গলধঃকরণের জন্য ছুটে যাচ্ছিল। সৌভাগ্যবশত বলটা মাঝবরাবর গিয়ে থেমে পড়ে। এবং যদিও সীমানার ফিল্ডার মাশরাফি মুর্তোজা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন ক্যাচ ধরার, বলটা তার থেকে দূরে মাটিতে পড়ে এবং ডিজির সাথে আমি প্রান্ত বদল করে একটা সিঙ্গেল নেই। মনে হয় সেটা তাদের শেষ সুযোগ ছিল।

এরপর লাঞ্চের প্রায় ২০ মিনিট পর জয় আসে আর কোন উইকেট না হারিয়ে। এই ম্যাচে দুইটি জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি। এক. এই নিশ্চয়তা যে, আধুনিক টেস্ট ক্রিকেটে আপনার দল যত ভালো হোক না কেন, সেরা খেলাটা না খেললে আপনি অবশ্যই পরাজিত হবেন। ২০০৫ সালের এ্যশেজে তা প্রমাণিত হয়েছে। ইংল্যান্ড ভালো দল ছিল এবং তারা খুবই ভালো খেলেছে, যখন আমরা আমাদের সেরা খেলাটা খেলতে পারিনি, সুতরাং আমরা পরাজিত হয়েছি।

কথাটা সাদাসিধা শোনায়, কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, আপনাকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। এই খেলাটাতে, সর্বনিম্ন র‌্যাঙ্কধারী টেস্ট দলের বিপক্ষে, আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড থেকে বহুদূর নিচে নেমে গিয়েছিলাম, অন্তুত প্রথম দুইদিন, আমরা আমাদের এবিলিটির ৩০ থেকে ৪০ ভাগ প্রয়োগ করেছিলাম, স্পষ্টতই এজন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়েছিল। আমরা যদি কোন ভালো দলের বিপক্ষে এমন খেলতাম, তারা আমাদের ছুড়ে ফেলে দিত। যদিও আমরা গত কয়েক বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেটে আধিপত্য বিস্তার করছি, সা¤প্রতিক সময়ের ফলাফল এই ইঙ্গিত করে যে, আমাদের প্রতিদ্বন্দীদের সাথে আমাদের কোন বিশাল পার্থক্য নাই। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, যারা আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আমাদের প্রতিপক্ষের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের এসব ব্যাপার মনে রাখা উচিত।

জয় যদি এত সহজ হতো, তাহলে তো সবাই জিততো। দ্বীতিয় ব্যাপারটা হলো, এই ম্যাচে আমরা নিজেদের জন্য যে গর্ত খুড়েছি এবং শেষপর্যন্ত উদ্ধার পেয়েছি, সা¤প্রতিক সময়ে এটা ছিল অন্যতম সেরা রিকভারি। আমাদের দূর্বল প্রতিপক্ষকে বিবেচনা করে এটাকে হয়তো সেভাবে মূল্যায়ন করা হবে না। কিন্তু যেভাবে তৃতীয় দিন থেকে সীমিত সম্বল নিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত জিতেছি - এটা একটা বিরাট অর্জন। অনেক কিছু করতে হয়েছে এর মাঝে - তাদের ব্যাটিংয়ের সময় চাপে রাখতে হয়েছে, কঠিন টার্গেটকে তাড়া করতে গিয়ে ধৈর্য্য ধরতে হয়েছে, শেষ তিনদিন জয়ের আশা টিকিয়ে রাখতে হয়েছে এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে জয় - কথাটা স্বরণ রাখতে হয়েছে।

সেইসাথে বাংলাদেশীদের এক অথবা দুই পেগ নিচে নামানোর ব্যাপারটাও নিশ্চিত করতে হয়েছে। কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম তাদের দেমাগ বেড়ে গিয়েছে, প্রথমভাগে খেলা যখন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এমনকি চতুর্থ বিকেলে যখন কয়েকটা দ্রুত উইকেট পড়ে গিয়েছিল। নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু শিক্ষা পেয়েছি এই ম্যাচ থেকে, আমার বিশ্বাস তারাও পেয়েছে। * ম্যাগিলা - স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল ^ ডিজি - জেসন গিলেস্পি Ω গিলি - এডাম গিলক্রিস্ট π পাপ - মাইকেল ক্লার্ক


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।