আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমর স্থাপত্য তাজমহলে

পঙ্খিরাজে চাদেঁর দেশে

‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ কি তার প্রাণ ভিতরে তার মমতাজ নারী, বাহিরে শাহজাহান। ’ কবি নজরুলের বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতার এই লাইন দু’টি যখন পড়ি, আমার তাজমহল দেখার সাধ জাগে! এই সাধ যত পড়ি তত জাগত! দীর্ঘদিন থেকে নিজের বেডরুমে তাজমহলের একটি পেইন্টিং। অবশেষে ৩ এপ্রিল ২০০৪ সালে তাজমহলে যাওয়ার সুযোগ আসে। আমার আব্বার চিকিৎসার জন্য প্রায় মাসখানিক নিউ দিল্লি অবস্থান করি। খালাত ভাই প্রভাষক আব্দুস শহিদ (শাহিন) সাথে ছিলেন ।

আমরা দেশে আসার দু’দিন পূর্বে সোমবারে ভোরে নিউদিল্লি থেকে আগ্রার তাজমহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। প্রায় দুইশত মাইল দুরত্ব। আমরা ড্রাইভার সহ পাঁচজন। আমাদের গাইড হিসেবে ড্রাইভার কাজ করবেন। এসব স্থানে গাইড ছাড়া তেমন কিছু জানা যায় না।

কেউই ব্যস্থতার জন্য পরিকল্পিত ভাবে বের হতে পারেননি। এমনকি কেউ ভোরে পানিও মুখে দিয়ে বের হননি। ঘন্টা দুয়েক যাত্রার পরেই ক্ষুধার তীব্রতায় সবাই ভোগেন। রাজস্থান মোটেল পর্যটন হোটেলে ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করেন। সেখানে আমরা চা স্যানডুইস্ খাই এবং কয়েকটি ফটো তুলি।

অবশ্যি অনেক টুরিস্ট বাসও সেখানে বিরতী নেয়। নাশতা ও কেনাকাটা করে আবার যাত্রা শুরু করে। তাজমহলে যাওয়ার ৭ কি:মি: পূর্বে আমরা সিকান্দারায় যাই। এটি সিকান্দার লুদির রাজধানী ছিল। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) কবর দেখতে।

তিনি ঐ স্থানকে তার কবরের জন্য নির্ধারিত করে ১৬০২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু জীবিত অবস্থায় সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ১৬১৩ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৫ লাখ রুপি ব্যয় করে কাজ সম্পূর্ণ করেন। এই জাঁকাল সমাধি ১৫০ একরের একটি বড় বাগানের মধ্যে অবস্থিত। চর্তুদিকে ২৫ ফুট উঁচু দেয়ালে বেষ্টিত।

চারটি গেইট চারদিকে রয়েছে। একটি গেইট ব্যতীত সবগুলো বর্তমানে বন্ধ। সিকান্দারার মূল গেইট উত্তর দিকে অবস্থিত। এটি লাল পাথরে তৈরী এবং চন্দন কাঠের দরজা। মূল গেইট পেরিয়ে লাল পাথরের শান বাধাঁনো পথ মাড়িয়ে এ ভবন।

প্রায় ১০০ ফুট উচুঁ চারতলা বিশিষ্ট চর্তুধার সমান আকৃতির প্রথম তিন তলা লাল পাথরের তৈরী সম্রাট আকবর কর্তৃক এবং চতুর্থতলা সম্রাট জাহাঙ্গীর সাদা পাথরে নির্মাণ করেন। সেখানে পৌঁছে কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করি। জনপ্রতি ১১০ রুপি বিদেশীদের জন্য। ভারতীয়দের জন্য মাত্র ১০ রুপি। মূল ভবনের মধ্যখানে সম্রাট আকবরের সমাধি।

সেখানে যেতে প্রথমে নিচু, পরে আবার সমতল পথ। এটা সম্রাটের পরিকল্পনা। তিনি জীবিত থাকতে সবাই তার দরবারে মাথা নিচু করে প্রবেশ করতে হত। তাই কবরে যেতেও প্রথমে নিচুগামী রাস্তা করেন। কবরের পাশে আওয়াজ করলে ৭ সেকেন্ড প্রতিধ্বনি করে।

এমন কি একই শব্দ ৭ বার প্রকম্পিত হয়। উত্তরকোণে খোদাই করে লেখা ‘আল্লাহু আকবার’ এবং দক্ষিণ কোণে ‘জাত-ই-জালালুহু’। আর চর্তুদিকে আল্লাহর নিরান্নব্বইটি সিফাতি নাম সফেদ পাথরের গায়ে খচিত আছে। ভিতর থেকে বাহিরে আসি দেয়ালের কোণে মুখ লাগিয়ে কথা বললে, অন্য দেয়ালে কান লাগিযে শুনা যায়। মরিয়ম টম সম্রাট আকবরের কবরের পশ্চিমে অবস্থিত।

এটি ও অত্যন্ত সুন্দর ভবন। সম্রাট আকবরের স্ত্রী মরিয়ম জামানির কবরস্থান। সাদা মার্বেল পাথরে সাজানো। জাহাঙ্গীর তার মায়ের স্মৃতিস্বরূপ তৈরী করেন। চারদিকে ঘুরে দেখি সিকান্দারা।

এক পাশে কিছূ হরিণ ঘাস খাচ্ছে এবং বানর বাচ্ছাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাজমহলে যাওয়ার সময় কথা প্রসঙ্গে ড্রাইবার বলেন, মোঘল সম্রাটদের বংশধররা এখন কলকাতায় রাস্তায় রাস্তায় থাকে। ড্রাইভারের কথা তখন বিশ্বাস হয়নি। আমি ভেবেছি হিন্দু ড্রাইবার হয়তো ঈর্ষান্বিত হয়ে বলছেন ! ইচ্ছে থাকা সত্বেও এব্যাপারে তার সাথে কথা বলিনি। পরবর্তীতে একটি পত্রিকায় পড়ে ড্রাইবারের কথার সত্যতা পাই।

ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর ১৮৫৭ সালে বৃটিশ বিরোধী সিপাহি-জনতা বিদ্রোহে পরাজিত হন। বৃটিশ তাকে ইয়াঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। ভারতবাসী তবু তাকে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধার আসনে রেখেছে। কিন্তু তার প্রপৌত্রী মাধু কলকাতার হাওড়ায় একটি বস্তিতে থাকতেন।

মা সুলতানা বেগমের সাথে চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের দুর্দশার চিত্র একজন সমাজকর্মী প্রকাশ করেন। ফলে রাষ্ট্র পরিচালিত কো¤পানি কোল ইন্ডিয়ায় চাকরি দেয়া হয়েছে। একজন শিল্পপতি তাকে একটি বাড়ি ও স্কুলে চাকুরি দেয়ার অঙ্গিকার করেছেন। যখন তাজমহলের টাওয়ার দেখা যায়, আমরা আগ্রা ফোর্টেন নিকট আসি।

এখানে প্রথম মোঘল সম্রাট বাবার থেকে শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের রাজপ্রাসাদ ছিল। এটি মূলত তৈরী করেছেন সম্রাট আকবর। একটি একত্রমিশ্রিত রাজপ্রসাদ। যা আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, এমন কি আওরঙ্গজেব ও তৈরী করেছেন। আগ্রা শহর থেকে এই ফোর্ট পূর্বে এবং যমুনা নদীর ডান তীরে অবস্থিত।

বিস্তৃত এবং শক্ত দেয়াল লাল পাথরে তৈরী। চর্তুদিক ৪০ ফুট উঁচু ও প্রশস্থ দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টত। এগুলোর মধ্যখানে ভয়ানক কুমির ও কচ্ছপে ভরপুর ছিল। ফলে শক্ররা ফোর্টে ঢুকতে সাহস করতে পারত না এবং কেউ অনুমতি ব্যতীত যেতেও পারতনা। এই ব্যয়বহুল পরিবেষ্টনীর কাজ সম্পন্ন হয় আকবরের প্রধান সেনাপতি কাসিম খানের তত্ত্বাবধানে।

১৫৬৫ সালে নির্মাণ কাজ শুরু এবং ৩৫ লাখ রুপি খরচ হয়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে আগ্রা ফোর্টে প্রায় ৫০০ টি ভবন ছিল। কিন্তু র্দূভাগ্যক্রমে কিছু সংখ্যক ভবন বর্তমানে বিদ্যমান। মোঘল সম্রাজ্যের পতনের পর সর্বপ্রথম নাদির শাহ্ বাহির হতে আক্রমন করে অনেকগুলো ভবন ধ্বংস করেন। এরপর দুর্ধষ মারাঠারা ও আক্রমণ করে।

ফোর্টে প্রবেশের জন্য আমর সিং গেইট’ জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। এই গেইট শাহ্জাহান বিখ্যাত রাজপুত যোদ্ধা আমর সিং এর নাম করণে করেছেন। এখানে প্রবেশের জন্য টিকেট সংগ্রহ করি। জনপ্রতি ২৫০ রুপি। বিদেশীদের জন্য ভারতীয়দের জন্য ২০ রুপি মাত্র।

এই গেইট অতিক্রম করে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি সুন্দর ভবন। এটি ‘জাহাঙ্গীর প্যালেস’। দেয়াল ও ছাদ সোনালী রং সহ উজ্জ্বল রংয়ের। এটি লাল বালুপাথরের দ্বিতলা বিশিষ্ট। এই ভবন চারটি ভাগে বিভক্ত।

পশ্চিমাংশে ব্যক্তিগত উপাসনালয়, উত্তর দিকে হল রুম। দক্ষিণ কোণে ড্রয়িরুম। ‘খাসমহল’ সাদা পাথরে গঠিত। এটি রাজ পরিবারের মহিলাদের ব্যবহারের জন্য। একে আরাম গা ও বলা হত।

এটি শাহজাহান বিশ্রাম ও শয়ন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। দক্ষিণাংশে বৃহৎ ও আরামপ্রদ ভবনে সম্রাট শাহ্জাহানের বড় ও প্রিয় মেয়ে জাহান আরা থাকতেন। উত্তরাংশের রুমে শাহ্জাহানের অন্যমেয়ে রওশন আরা বেগম থাকতেন। উভয় রুমের সৌন্দয্য এখনো বিনষ্ট হয়নি। দিওয়ান-ই খাস ছিল রাজদরবার।

সেখানে মোঘল সম্রাটগণ শুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বস্থ বিষয়ে মন্ত্রী ও রাজ প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতেন। এখানে শাহ্জাহানের ময়ূর সিংহাসন ছিল। আওরঙ্গজেব পরে দিল্লিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে সেটি বহিরাক্রমনকারীরা নিয়ে যায়। বর্তমানে তেহরানে আছে।

‘শীষ মহল’ রাজ পরিবারের মহিলাদের ড্রেসিংরুম ছিল। এটি খাস মহলের উত্তরে অবস্থিত। ছোট ছোট সুন্দর আয়না দ্বারা দেয়াল ঢাকা ছিল। এটি শাহজাহান কর্তৃক ১৬৩০ সালে নির্মিত হয়। গোসলের জন্য টারকি বাথ, গরম ও ঠান্ডা পানির দু’টি ট্রাংক ছিল।

এই স্থান ছিল পৃথিবীর বেহেস্ত। জেসমিন টাওয়ার এবং সাম্মন বুরজ একই ভবনে। এটি প্রথমে জাহাঙ্গীর তার রানী নূরজাহানের জন্য তৈরী করেন। পরবর্তীতে শাহ্জাহান মমতাজের জন্য আধুনিকায়ন করেন। এটি মার্বেলের অলৌকিক কাজ এবং মূল্যবান রঙ্গিন পাথরে সাজানো।

এখানে শাহ্জাহান তার ছেলে আওরঙ্গজেব কর্তৃক বন্দী ছিলেন। তিনি তার প্রিয় মেয়ে জাহান আরার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস নেন। এখান থেকে তিনি জানালা দিয়ে তাজমহল অত্যন্ত পরিস্কার ভাবে দেখতেন। নাগিনা মসজিদ ১৬৬৮ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব অন্দর মহলের মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য নির্মাণ করেন। এটি আয়তনে ছোট কিন্তু অত্যন্ত চমৎকার।

মিনা মসজিদও তিনি শাহজাহানের জন্য নির্মাণ করেন। যখন তিনি আগ্রা ফোর্টে বন্দী ছিলেন, সেখানে নামাজ পড়তেন। ‘মিনা বাজার’ সম্রাট আকবর অন্দর মহলের সুন্দরী মহিলাদের জন্য তৈরী করেন। এখানে মন্ত্রী-সভাবর্গ গণের স্ত্রী, কন্যারা ক্রয়-বিক্রয় করত। সেখানে সম্রাট আকবর ব্যতীত কোন পুরুষের যাওয়ার অনুমতি ছিলনা।

‘মতি মসজিদ’ দেওয়ান-ই-আম এর উত্তরে অবস্থিত। এটি সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী। সম্রাট শাহ্জাহান ৩ লাখ রুপি ব্যয় করে ১৬৪৭-১৬৫৪ সালে কাজ শেষ করেন। মসজিদের তিনটি গেইট দু’টি মহিলাদের জন্য ও একটি সাধারণ জনগনের ব্যবহারের জন্য। মসজিদের উপর তিনটি বড় গুম্বুজ।

তাছাড়া জামে মসজিদ, ওয়াটার গেইট, দিল্লি গেইট প্রভূতি সেখানে দেখা যায়। আমরা সেখান থেকে তাজমহলে যাই। গাড়ী থেকে নেমে ঘোড়ায় গাড়ীতে উঠি। মিনিট দশেক চড়ে গন্তব্যে পৌঁিঁছ। টিকেট সংগ্রহের পালা।

বিদেশীদের জন্য ৭৫০ রুপি। ভারতীয়দের জন্য মাত্র ২০ রুপি। আমরা কৌশলে ক্ষণিকের জন্য ইন্ডিয়ান হয়ে গেলাম। কলকাতার একটি এড্রেস এবং মুখ্যন্ত্রীল নামটি সবাই জেনে নিলাম। এভাবে প্রবেশ করি স্বপ্ন সাধের কবির উপমার তাজমহলে।

সে কি আনন্দ! সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় না তাজমহল দেখছি! মনে হয় এখনো কল্পায় আছি। এখনো কবিতার উপমায় আছি। এখনো স্বপ্নে বিলাসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস্তবতায় ফিরে আসি। ক্যামেরা ম্যানের কথায় মাথাটা আরেকটু তুলুন।

যমুনা নদীর ডান তীরে তাজমহল অবস্থিত। আগ্রা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী তাজমহল পৃথিবীর মধ্যে সবচে’ সুন্দর স্থাপত্য শিল্প। সম্রাজ্ঞী মমতাজের প্রতি অপূর্ব ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ। তার আসল নাম আরজুমান বানু বেগম।

১৫৯৩ সালে ৬ এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম কওয়াজা আবুল হাছান। উপাধি ছিল ইয়াসিন-উদ-দৌলা আসাফ খান। তিনি নুরজাহানের আপন ভাই এবং জাহাঙ্গীরের কোর্টের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। মমতাজ ছোটবেলা থেকেই খুব সুন্দরী।

পিতা তার গৃহে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজের গুণ ও যোগ্যতায় উন্নতি লাভ করেন। তিনি যুবতি অবস্থায় রাজকুমার খুররমের আক্রমনের শিকার হন। অবশেষে তারা একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করেন এবং বিয়ে হয়। পরবর্তীতে সম্রাট শাহ্জাহানের সাথে তার বিয়ে হয়।

তখন ১৯ বছর বয়স ছিল। তিনি বিয়ের পর ১৮ বছর জীবিত ছিলেন। এই সময়ে তার উপস্থিত জ্ঞান দিয়ে অনেক রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান এবং কোষাগারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি সমাজকল্যাণ মূলক কাজের জন্য অত্যান্ত জনপ্রিয় ছিলেন। শাহ্জাহান ও তার ভালোবাসা ছিল অবিচ্ছেদ্য।

যখন শাহজাহান বিদ্রোহী খান-ই জাহান লোদী কে দমনে বুরহান পুরে তখন তিনি ও সেখানে ছিলেন। এসময় তার ১৪তম সন্তান গাউহার আরা বেগম জন্মগ্রহন করেন। মমতাজ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। বলা হয় এসময় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। মমতাজ তার শেষ ইচ্ছা শাহ্জাহানকে বলেন।

তিনি যেন তার সমাধির উপর সুন্দর ও অতুলনীয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। যা তাদের পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার নির্দশন। তিনি তার মেয়ে জাহান আরা কে শাহ্জাহানের সেবা-যতেœর দায়িত্ব দেন। তখন তিনি মমতাজের পাশে ছিলেন। তিনি তাকে বলেন কিভাবে তোমাকে বিশ্বাস করাব, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তখন মমতাজ বলেন, আপনি আবার বিয়ে করবেন না এবং সন্তানদের দেখা শুনা করবেন। তিনি ১৭ই জুন ১৬৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ‘দ্যা লেডি অব দ্যা তাজ’ মমতাজের মুত্যুর পর শাহ্জাহান প্রিয়তমা স্ত্রী বিয়োগের ট্রাজেডী সহ্য করতে পারেননি। তিনি নিজে পুরো দু’বছর সর্বপ্রকার অভিলাষ ও অনুষ্ঠানাদি থেকে বিরত থেকেছেন। প্রতি শুক্রবারে সাদা জামা পরিধান করে তিনি কবরে গিয়ে ফাতিহা পাঠ করতেন।

মমতাজকে বুরহানপুরের বিপরীতে জাইনাবাদের একটি বাগানে জুন মাসে ১৬৩১ সালে অস্থায়ী কবর দেয়া হয়। ঐ বছর ডিসেম্বরের ১লা তারিখ মৃত দেহ আগ্রায় পাঠানো হয় এবং ২৯ ডিসেম্বর এসে পৌছে । সেখানে আবার যমুনা নদীর তীরে কবর দেয়া হয়। শাহ্জাহান স্ত্রীর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা করেন। তিনি বিশ্বের বিখ্যাত আর্কিটেকদের কাছে নকঁশা আবেদন করেন।

অনেক ডিজাইন জমা পড়ে। কিন্তু উস্তাদ ঈসা আফ্রানদির তরপির ডিজাইন মনোনিত করে কার্যক্রম শুরু করেন। মূল ভবনের উন্নতমানের সাদা মার্বেল রাজস্থান থেকে ক্রয় করেন। অন্য সাজ সরঞ্জাম লাল পাথর দলপুর ও ফতেহপুর সিকরি থেকে ক্রয় করেন। নারবাদ ও চারকন থেকে হলুদ ও কালো পাথর ক্রয় করেন।

বিভিন্ন রাজা এবং বিদেশ থেকে কিছু মূল্যবান পাথর ও সোনা-রুপা গ্রহন করেন। ১৬৩১ সালে ডিসেম্বর মাসে তাজমহলের কাজ শুরু হয়ে ১৬৪৮ সালে শেষ হয়। কিন্তু ফ্রেন্স টেইলর জিম স্বাক্ষী হিসেবে তাজমহলের শুরু এবং শেষ সম্পর্কে মন্তব্য করেন: বিশ হাজার শ্রমিকে বাইশ বছর কাজ করেছে। আবার শাহ্জাহানের দরবারের ইতিহাসবেত্তা আব্দুল হামিদ লাহরি এবং মোঃ ছালিম কামবু বর্ণনা করেন, মূল ভবন ও সহযোগী ভবন গুলো ১৬৪৩ সালে ফ্রেব্র“য়ারী মাসে কাজ শেষ হয়। ফলে ১২ বছর লেগেছে কাজ শেষ হতে।

তাজমহলের চর্তুদিকে ভবন, তাজ গার্ডেন এবং তিনতলা বিশিষ্ট গেইট নির্মানে পাঁচ বছর লেগেছে। পাশের মসজিদ, গেষ্ট হাউস এবং অন্যান্য ছোট ভবন গুলো নির্মানে আরো লেগেছে পাঁচ বছর। ফলে সর্বমোট বাইশ বছর লেগেছে। বলা হয় মূল প্রবেশদ্বারের ছোট ছোট বাইশটি গুম্বুজ দ্বারা বাইশ বছরের কার্যক্রমের স্মৃতিস্তম্ভ। তাজমহলের গেইট অতিক্রম করে দর্শনার্থীরা কয়েক পা অগ্রসর হলে তাজ গার্ডেন দৃষ্টিগোচর হয়।

মহলে প্রবেশ করেই মূল গুম্বুজের নিচে মমতাজ ও শাহ্জাহানের কবর অবস্থিত। কবরের গায়ে লেখা আরজুমান বানু বেগমের কবর। তাকে ডাকা হয় মমতাজ মহল। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি পশ্চিম দিকে শাহ্জাহানের কবর। দৈর্ঘ ১১.৫ ফুট, প্রস্থ ৭.৫ ফুট এবং উঁচু ২ ফুট।

শাহ্জাহানের স্মৃতিস্তম্ভ মমতাজের চেয়ে কিছুটা উঁচু। আসল কবরস্থানে যাওয়ার পথ বন্ধ। আমরা যেখান থেকে দেখেছি ঠিক ছয়/ সাত ফুট নিচে মূল কবরে স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে যেতে হয়। কর্তৃপক্ষ সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

কবরের সোজা উপরে দর্শনার্থীর জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। অবশ্য ফ্লোরে এসে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে তাকালে মূল কবর দেখা যায়। উভয় কবরের চারদিকে সুদৃশ্য পাথরের দেয়াল। ফাঁক দিয়ে কবর দেখা যায়। সামনের দিকে একটি খোলা গেইট দিয়ে উভয় কবর দেখা যায়।

এক সময় তাজমহলের ভিতর দিয়ে আবার বাহিরে আসি। একেক করে চারটি টাওয়ারের কাছে যাই। সবাই মিলে কয়েকটি ফটো তুলি। সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে আমরা খুবই তৃঞ্চার্ত হই। অনেকটা ক্লান্তি ও আসে।

যমুনা নদীর দৈন্যদশা দেখে আরো তৃঞ্চার্ত হই। যমুনার বুকে বালুতে ভরাট হয়েছে। খানিক জলে কয়েকটি বলাকা দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে হাতি-ঘোড়ার ঠাঁই ছিলনা। সেখানে আজ বকের হাঁটু পানি।

কয়েক বছর আগে ও যারা তাজমহল দেখেছেন, তারা বলেছেন নদীকে হাওরের মত মনে হয়েছে। এখন বকের হাঁটু পানি। মরুভূমির মত ধু-ধু বালুকা। যমুনা নদীর এই দৃশ্য দেখে যে কোন পর্যটক বিস্মিত হন। তাজমহলের শিল্প স্থাপত্য দেখে যেভাবে আনন্দিত হয়েছি, সেভাবে যমুনার মরু প্রান্তর দেখে শুন্যতা অনুভব করেছি।

এসব দেখতে দেখতে তৃঞ্চার্ত ও ক্লান্ত হয়ে তাজমহলের ছায়ায় খোলা আকাশের নিচে বসি। সেখানে সাদা পাথরের টাইলস্ বিছানো। দীর্ঘদিন পরেও সৌন্দর্য কমেনি। সবাই তাজমহলের ছায়ায় বসে তপ্ত প্রাণ সিক্ত করে। আমি তাজমহলের সৌন্দর্য সলিলে অবগাহন করে মনের জমানো কথাগুলো সাজাতে থাকি।

তাজমহল মানুষের হাতের অতি অনাবিল, অত্যন্ত উজ্জ্বল দ্বীপ্তশীল কাজ। এ যেন মার্বেল পাথরের একটি কবিতা। তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং দর্শনাথীরা অনেক মন্তব্য করেছেন। মাজ জেন স্লিম্যান তার বইয়ে লেখেছেন, ‘যখন সেখানে (তাজমহলে) আমার স্ত্রী গেলেন আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি এই মহল সম্পর্কে কি চিন্তা করছ? তিনি বলেন, আমি বলতে পারব না। আমি জানি এটি একটি সমালোচনা এই ভবনের।

তবুও আমি বলতে পারি আমার অনুভূতি। আমি চাই আগামীকাল মরে যাই এবং আমার (কবরের) উপর অনুরুপ আরেকটি (তাজমহল) হবে। লর্ড রবার্ট ‘তাজমহলের প্রশংসা করে এভাবে বলেন, আমি প্রলুদ্ধ নয়, অবর্ণনীয়কে বর্ণনা করতে। যারা এখনো এটি দেখেননি, আমি তাদের বলি ভারতে যাও! তাজমহল-ই ভ্রমণের জন্য একামাত্র গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেখান থেকে উঠে আরো ঘন্টা খানিক দেখি।

আসার আগে বারবার ছুঁই তাজমহলের পাথর। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আবার ছুঁই, আবার দেখি। তবুও যেন বিদায় নিতে ইচ্ছে হয় না। আবার দেখার ইচ্ছে জাগে।

ছোঁয়ার ইচ্ছে জাগে। বার বার দেখেও যেন দেখার হলনা শেষ। বারবার ছুঁয়ে যেন ছোঁয়ার সাধ মিটলনা। এই অতৃপ্তি মনে নিয়ে তাজমহল থেকে ফিরে আসি!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।