বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
রোমের এক অভিজাত পরিবারে রোমান দার্শনিক বোথিয়াস (খ্রিস্টাব্দ ৪৮০-৫২৪) এর
জন্ম। তাঁর পুরো নাম আনিসিউস ম্যানলিউস সেভেরিনাস বোথিয়াস। সেই সময়টায় পুব দিক থেকে বর্বর হুনরা বারংবার হুঙ্কার দিচ্ছিল, টলিয়ে দিচ্ছিল রোমান সাম্রাজ্যের ভিত ।
তখনকার দিনের কনসাল এর ক্ষমতা অনেকটা এখনকার দিনের ম্যাজিস্ট্রেটের মতো। বোথিয়াসের বাবা ছিলেন একজন রোমান কনসাল। অসট্রোগথরা ছিল (পূর্ব ) জার্মানিক ট্রাইব। হুনদের তাড়া খেয়ে তারা রোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করে রোমান সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়। বোথিয়াস কে অসট্রোগথদের কনসাল নিযুক্ত করা হয়েছিল।
রোমান সম্রাট সে সময় থিওডোরিক। তো, সম্রাট বোথিয়াসকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন! কেন? কনসাল বোথিয়াস নাকি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে অর্থাৎ বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন! বোথিয়াস নাকি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। অতএব তাকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করাই যায়, অতএব তাকে হত্যা করাই যায়!
আসলে, অনুমান করি, বোথিয়াস প্রশাসক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অসট্রোগথ-প্রজারা তাঁকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। সম্রাটের কানে সেসব কথা গিয়েছিল।
হয়তো প্রশাসক হিসেবে বোথিয়াসের গৃহিত নীতিমালা ছিল বহুসংখ্যক মানুষের জন্য কল্যাণকর! হয়তো ...
মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার আগে বোথিয়াস রোমে গৃহবন্দি ছিলেন। ভীষণ মানসিক অস্থিরতা। মন শান্ত করার লিখবেন ভাবলেন। লিখলেন। পরে ইংরেজিতে সে বইয়ের নাম দেওয়া হল: “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” এর বাংলা করলে দাঁড়ায়: দর্শনের সান্ত্বনা বা দর্শনের প্রবোধ।
রেনেসাঁ পর্যন্ত সমগ্র খ্রিস্টানবিশ্বের এরকম প্রভাবশালী গ্রন্থ খুব কমই ছিল। বোথিয়াস একনিষ্ট খ্রিস্টান হলেও অন্ধবিশ্বাসের বদলে মানবীয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেছেন।
“দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বইটির রচনারীতি, মানে, ভাষা প্রয়োগ অশ্র“তপূর্ব। একই রচনায় গদ্যে ও পদ্যের মিশ্রন! বইটি আসলে দু-পক্ষের সংলাপ। একজন বোথিয়াস নিজে, অপর পক্ষ হলেন স্বয়ং দর্শন এবং দর্শনকে নারী কল্পনা করেছেন বোথিয়াস! এমনই সৃজনশীল মানুষ ছিলেন বোথিয়াস।
তখন একবার আমি বলেছি, বোথিয়াস প্রশাসক হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সৃজনশীল বলেই বোথিয়াস মানবিক আর মানবিক বলেই বোথিয়াসের গৃহিত নীতিমালা ছিল বহুসংখ্যক মানুষের জন্য মঙ্গলময়! এবং আরও বিস্ময়কর এই যে ... “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বইতে বোথিয়াস তাঁর বক্তব্য রেখেছেন গদ্যে, পক্ষান্তরে, দর্শন (নারী) তাঁর বক্তব্য রেখেছেন পদ্যে!
সেই খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের এই সৃজনশীলতা!
বোথিয়াস-এঁরাই তৈরি করেছেন বিস্ময়কর ইউরোপীয় মনচেতনা-যে মনচেতনা নিয়ে আমাদের বিস্ময় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সন্দেহ কি- আমাদের ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে আমরা ওদের সমকক্ষ হতে চাই ,ক্ষুধা ও দারিদ্রকে দূর করতে চাই, বিশ্বকে নিতে চাই হাতের মুঠোয়, কক্ষপথে পাঠাতে চাই স্যাটেলাইট, অথচ, ইউরোপীয় মনচেতনার ভিতটি যে ঠিক কোথায়- সে বিষয়ে অনুসন্ধানের তাগিদ আমরা একেবারেই বোধ করি না। এই এক প্যরাডক্স! এই এক প্যরাডক্স যে - ধ্রুপদি দর্শনগ্রন্থাবলীর সঙ্গে পরিচিত না-হয়েই আমরা কেবলি ভুরি ভুরি বৈজ্ঞানিক পয়দা করতে চাই! যেন-দার্শনিক মতবাদসমূহ বিজ্ঞানের পথকে কখনোই সুগম করে তোলেনি ...যেন বৈজ্ঞানিক নিউটনের নাম জানলেই যথেষ্ট ...দার্শনিক ডেভিড হিউম বাস্তবতা (রিয়েলিটি) সম্বন্ধে কি বিশ্বাস করতেন, তার আগে রেনে দেকার্ত চিন্তন (থিংকিং) সম্বন্ধে কী বললেন সেসব সম্বন্ধে জানার কোনওই দরকার নেই ... বাংলাদেশের বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তর থেকে পাঠসূচিতে দর্শনের ইতিহাস অর্ন্তভূক্ত করার দাবী করছি। দেশের মানুষকে অন্ধ করে রাখার শাসকশ্রেণির কোনও অধিকার নেই!
যাক।
তো, বোথিয়াস তাঁর বইতে কি লিখেছেন? যা লিখেছেন তেমনটা লেখাই তাঁর পক্ষে ছিল স্বাভাবিক। তখন আমি বলেছি যে বোথিয়াস ছিলেন একজন খ্রিস্টান দার্শনিক- যে কারণে অকপটে লিখেছেন, ‘জগতে নানাবিধ অন্যায় ও অসাম্য পরিলক্ষিত হলেও জগতে এক মহান স্বর্গীয় শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। সেই মহান স্বর্গীয় শক্তির তুলনায় ‘এভরিথিং এলস ইজ সেকেন্ডারি। ’ মানে সেই মহান স্বর্গীয় শক্তির তুলনায় যা কিছু রয়েছে তা সবই তুচ্ছ। ’এ ছাড়াও জগতে অশুভের উপস্থিতি, নিয়তিবাদ, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও বিচারের প্রকৃতি (দি নেচার অভ জাস্টিস) এবং পুন্য বিষয়ক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বোথিয়াস ।
বোথিয়াস মন ও মনন প্লেটো দ্বারা প্রভাবিত। তার কারণ আছে। ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড মনে করেন: পাশ্চাত্য দর্শন আসলে প্লেটোর রচনার ধারাবাহিক ফুটনোটস বা পাদটীকা! কাজেই বোথিয়াস এই প্লেটোনিক
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,“ঐশ্বরিক উপাদান মঙ্গলময়। ” অন্যকথায় ঈশ্বর ও শুভবোধ অভিন্ন। সিদ্ধান্তটি সরল ও নিরীহ মনে হলেও পরবর্তীকালে দর্শনজগতে এই সিদ্ধান্তের অপরিসীম প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
বোথিয়াস আরও বললেন, যারা ঐশি ক্ষমতা অর্জন করেছেন তারাই ঈশ্বর। পরবর্তীকালে এ কথার মানে দাঁড়াল: মানুষ হিসেবে যে ভালো সেইই ঈশ্বর!
কুষ্ঠিয়ার ছেঁউরিয়ায় বাউলদের মাঝে এমন ধারণা বিদ্যমান। আবদেল মাননান কর্তৃক লালনসমগ্রর প্রথম সঙ্কলনের ভূমিকা দেখুন। লালনকে স্বয়ং ঈশ্বর সাব্যস্ত করেছেন ঐ বিদগ্ধ লালন গবেষক। লালন অবশ্য বিশ্বাস করতেন মহাকালের কর্তা বা সাঁই মানুষের ভিতর বাড়িতে বাস করেন।
একটা গান হয়ে যাক ...
যেখানে সাঁই বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে
দেখতে যেন ভুজঙ্গনা ...
ভুজঙ্গ মানে সাপ। হঠাৎ সাপ দেখলে লোকে যেন চমকে ওঠে। তেমনি লোকে চমকে ওঠে যখন শোনে যে মহাকালের কর্তা বা সাঁই তার ভিতর বাড়িতে বাস করেন। বোথিয়াস লিখেছেন: দে হু অবটেইন ডিভিনিটি বিকাম গডস। অর্থাৎ স্বর্গীয় গুণ অর্জন করে ঈশ্বর হওয়া যায়।
বোথিয়াস আরও বললেন: অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা সুখি তারাই ঈশ্বর। রবীন্দ্রনাথের মূল বক্তব্যও কি তাই নয়? একটা গান হয়ে যাক ...
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥
কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো॥
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন
দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।
বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো॥
বাংলার মাঝির একটি ভাটিয়ালি গানে আছে:
দুঃখসুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল
সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল?
তাইতো বলি ওরে ও মন এ যে কঠিন ঠাঁই
কোন্ খানে পাঠায়া দিলা মওলা মালিক সাঁই রে ...
(এমন অন্তরঙ্গ নিবিড় কথা কি বোথিয়াসের কনসোলেশন এ আছে? থাকা সম্ভব? তাহলে?)
অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা হাসতে পারে তারাই ঈশ্বর। বাল্যকালে ইসলামের নবীর বাণী শুনেছি:“আল্লাহ মানুষের বিষন্ন মুখ অপছন্দ করেন।
” বোথিয়াস রচিত বইটির নাম আবারও মনে করি: “দি কনসোলেশন অভ ফিলোসফি ” বা দর্শনের সান্ত্বনা। অজস্র দুঃখকষ্টের মাঝে যারা সুখি তারাই ঈশ্বর। এই হল দর্শনের সান্ত্বনা বা দর্শনের প্রবোধ। জন্ম লয়ে মানুষেরে বাতাসের মতন ঘিরে ধরে দুঃখেরা। আমাদের হাসতে হবে।
আমাদের হাসতে হবে। বিশিষ্ট ভারতীয় যোগী রজনীশও ঐএকই কথা বলতেন। উপরোন্ত তিনি তাঁর অনুরাগীদের বলতেন নাচতে । কেন নাচতে বলতেন? কেননা মওলানা রুমি বলেছেন: Whosoever knoweth the power of the dance, dwelleth in God.
আহ্!
এবং এ ভাবেই জগতের মহাত্মাগন অভিন্ন।
বোথিয়াস মনে করতেন প্রকৃতগতভাবে ঈশ্বর অবশ্যি একজনই।
তবে গুনানুসারে বহু হতে পারে। এটি কিন্তু বহুঈশ্বরবাদ নয়!
প্রশ্নতো উঠবেই-ঈশ্বর যদি থাকেনই তাহলে সৃষ্টিজগতে এত অশুভ কেন?
এর উত্তরে অ্যারিষ্টটলের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে বোথিয়াস বললেন, দি ডিভাইন প্রোভাইডেন্স অ্যাজ রাদার লাইক আ স্পেটাটর অভ দ্য ইউনিভার্স রাদার দ্যান অ্যান ইন্টারভেইনিং এজেন্ট ...মানে স্বর্গীয় সত্ত্বা হলেন এমন একজন দর্শক যিনি সৃষ্টিকার্যে হস্তক্ষেপ করেন না। কাজেই বোথিয়াসের দর্শনে ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন! স্পেনের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদের ঈশ্বরের সরূপও এরূপ নির্বিকার।
বোথিয়াসের দর্শনে ভারতীয় দর্শনের উপাদান ছিল। কারমা।
যারা অন্যের ক্ষতি করে তারা দুর্ভোগ পোহাবে বেশি যদি তারা কৃতকর্মের জন্য এ জগতেই শাস্তি না পায়। এ বিষয়ে বোথিয়াসের যুক্তি অকপট, মরমী নয়। তাঁর মতে, যারা ইহজগতে শাস্তি এড়িয়ে যায়, তারা খারাপ হতেই থাকে এবং সুখের থেকে দূরে থাকে। বোথিয়াস আরও দাবী করলেন, পূন্যবান ব্যাক্তি শক্তিশালী, ভালোটা সবাই চায় কেবল পুন্যবানেরাই তা অর্জন করে।
কে জানে নিজের লেখা কতটুকু সান্ত্বনা দিতে পেরেছিল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান দার্শনিকটিকে।
সম্রাটের আশেপাশে ছিলেন বলেই বোথিয়াসকে অকালে মৃত্যু স্পর্শ করেছিল। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্ষমতার আশেপাশে ঘুরঘুর করে মৃত্যুর অদৃশ্য হাত আর যত্রতত্র নেমে আসে তার নির্মম খড়গ। সৃজনশীল মানুষেরা সাধারনত নির্জনতা প্রিয় হয়। বোথিয়াস দূরের কোনও নির্জন পাহাড়ে চলে গেলেই পারতেন।
তথ্যসূত্র:
১ ফিলিপ স্ট্রোকেস সম্পাদিত “হানড্রেড অ্যাসেনসিয়াল থিঙ্কারস”
২ অ্যান্থনি কেনি রচিত ‘ব্রিফ হিস্টি অভ ওয়েষ্টার্ন ফিলসফি’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।