আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্যাসোলিনে পোড় খাওয়া স্মৃতি কিংবা নিকোটিনে ধূমায়িত প্রতিশোধ

.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো আশীষ কুমার স্কুল-কলেজে ব্যাক বেঞ্চারই ছিল। ছাত্র হিসেবে অনেকটাই গণনার বাইরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সাইন্সে চান্স পেলেও খুব ভাল, মেধাবী, সম্ভাবনাময় ছাত্র হিসেবে কেউ পাত্তা দিতনা। অনেকটাই ফটকা গোছের এই ছেলে এলাকার একটু নামী উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের এক মেয়ে চন্দ্রিমা দেবীর প্রেমে পড়ে গেল। মেয়ের পিছনে অনেক ঘুরাঘুরি করে কলঙ্ক রটানো ছাড়া বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারলনা।

বন্ধু হিসেবে সম্পর্কে সহায়তা করার ব্যাপারে অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল আমাকে। কিন্তু তখনও যে বাপের হোটেলে খাই, তার উপর ব্যর্থ হলে কলঙ্ক-অপমানের দায়ভার আমার ঘাড়েও এসে পড়বে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেদিন সে চিৎকার করে বলেছিল, আমার কী নেই? কী চায় সে? আমি নামী বিজ্ঞানী হয়ে দেখিয়ে দিব! বহু বছর পরে শুনি মার্কিন প্রবাসী এক ছেলের হাত ধরে চন্দ্রিমা পালিয়ে যায় দেশ ছেড়ে, কাউকে কিছু না বলে। দিপংকরের বাবার বেশ সম্পত্তি, ছেলেকে তাই বিদেশে রেখে পড়াচ্ছেন। কিন্তু ছেলে দেশে বেড়াতে আসার নাম করে অনলাইন প্রেমিকা চন্দ্রিমাকে বিয়ে করে নিয়ে পালিয়ে যাবে, এটার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেননা।

বাবা রাগ করেই ছেলের পড়া লেখার খরচ বন্ধ করে দেন। চন্দ্রিমা একটা দোকানে কাজ নেয়, দিপংকর লেখা পড়ার পাশাপাশি গ্যাস স্টেশনে কাজ করে দিন চালায়। দিপংকর আমাদের এলাকারই এবং আশীষকে যদিও বা চেহারায় চিনত। বিয়ে করে পালিয়ে যাবার কথা পর্যন্ত সবাই জানত। ভীষণ কাকতালীয়ভাবে দিপংকর-চন্দ্রিমা পরিবারের বাস আমার এলাকা থেকে ১ ঘন্টার ড্রাইভ।

ঘটনা চক্রে আমার এলাকায় কনফারেন্সের সুবাদে আশীষের আগমনের বার্তা পেলাম। দামী গাড়ি আর বিশাল বাড়ি ভাড়া করে একা থাকে প্রবাসী বন্ধুটি। বহুকাল পরে দেখা হবে ভেবে একটু তোড় জোড় করে ভাল মন্দ রান্না করলাম, নিজের গাড়ি শত শত মাইল ড্রাইভ করে চলে আসল । এক সপ্তাহের জন্য হোটেলে রুম বুকিং দেয়া ছিল, তাই রাতের বেলায় আর থেকে যেতে চাইলনা। বন্ধু দেখি প্রবাসে এসে বিড়ি খাওয়া শিখেছে, বাইরে বেরিয়ে দু'জন একটা বিড়ি ভাগাভাড়ি করে টানলাম।

মাঝেই পাড়লাম কথাটা, -জানিস চন্দ্রিমা যে আমার এলাকার মাঝেই থাকে? ভীষণভাবে তড়িতাহত মনে হল তাকে। -দেখা করবি? দিপংকরকে তুই চিনতি নিশ্চয়ই? মুখ দিয়ে কথা আসছেনা, চোখের পাতা নড়ছেনা দেখে সিগারেটের ধোয়াটা ছেড়ে আশীষের দিকে এগিয়ে দিলাম। তার মনের জ্বলুনি দেখে একটু শব্দ করে বললাম, -দেখা করবি? দাওয়াত দিই একদিন ওদের! পরের দিন আশীষের সৌজন্যে দিপংকর পরিবারকে নেমন্ত্রণ করলাম। ফোনালাপে আরে আশীষদা কেমন আছেন!, বেশ খোশ মেজাজ দেখা গেল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিপংকরের জানা ছিলনা চন্দ্রিমার ব্যাপারে আশীষের এক কালের অন্ধ এক পেশে প্রেমের গল্পগুলো।

সাথে আমাদের এলাকার এক বড়দাকে দাওয়াত ও করা হল। দিপংকর আবার চন্দ্রিমাকে বিশেষ কিছু জানায়নি, এক বড়দার বাড়িতে কাল সন্ধ্যের পর আমাদের দুজনের দাওয়াত, ব্যাস এতটুকুই! আগমন ক্ষণে দরজায় বেল বাজতেই আশীষকে এগিয়ে দিলাম, আমি পিছে পিছে দাড়িয়ে। আশীষের উপর চোখ পড়তেই দিপংকরের পিছে দাড়িয়ে থাকা চন্দ্রিমার বিস্ফোরিত চাহুনি, সে এক ভীষণ দুর্লভ সিনেমার দৃশ্য। ঘরে ঢোকার পরে কারও সাথে কোন কথা বলতে পারেনি সে, হাসি মুখ দূরে থাক, এমন কি মুখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি তেমন একটা। রাধুনী হিসেবে নিজের হাত যশ লাগিয়ে করা বিভিন্ন পদ টেবিলে সাজিয়ে খেতে ডাকলাম তাদের।

সবাই খেতে বসলেও আশীষ পায়চারি করতে লাগল। আমি সুযোগ মত উষ্কে দিলাম, এভাবে আর কত দিন আশীষ? বিয়া থা কিছু একটা কর, বৌদির হাতের রান্না খাই আমরা! ব্যাচেলরের রান্না কী আর মুখে রুচে? ডাইনিং এর ওপাশে জানালার দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে বলে উঠল আশীষ- -জীবনে একজনকেই ভালবেসেছিলাম, সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে তাকে পেতে চেয়েছিলাম, তাকে কথা দিয়েছিলাম আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়ে মাথা তুলে দাড়াবো, আমার ক্যারিয়ার, উচ্চাশা সবই তোমার জন্য থাকবে, আমি বিনিময়ে শুধু তোমাকে পেতে চাই। সিনেমার নায়কের ঢংয়ে কথা বলতে দেখে দিপংকর ফিক করে হেসে দিল। আরে আশীষদা আমাদের বলবেন না, আমরা এলাকার ছোট ভাই থাকতে, কী যে বলেন আপনার মত ক্যালিবারের ছেলের জন্য দেশে এখন কত মেয়ের লাইন পড়বে। আমাদের দেখুন কেমন অড জব করে চালিয়ে নিচ্ছি।

ফাক তালে আমরা দু'জন লক্ষ্য করছিলাম চন্দ্রিমা কিছু মুখে নিতে পারছেনা। আশীষ সুযোগ নিয়ে বলে উঠল, -কী ব্যাপার চন্দ্রিমা, তুমি একদমই খাচ্ছনা দেখি! নাও নাও, খাও, অনেক শুকিয়ে গেছ এ কয়েক বছরে! খাওয়া দাওয়া- ঘুম হয় তো ঠিক মত! পুরো খাওয়া পর্বে আশীষ তার ভালবাসার একান্ত মানুষটির গল্প শুনিয়ে গেল। ভাল লাগার মানুষটি তাকে ছোট লোক থেকে শুরু করে আর্থিক অস্বচ্ছলতার খোটা দিতেও বাকি রাখেনি। আশীষ মুখ বুজে সহ্য করে আজ এতদূর কীভাবে উঠে এল তারই জীবন সংগ্রামের কাহিনী। কিন্তু এতটা সফল, স্বচ্ছল মানুষ ভালবাসার কাছে প্রত্যাখাত হবার কারণে আজ অসুখের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।

গল্প বলার পুরো ধাচটাই ছিল, চন্দ্রিমাকে লক্ষ্য করেই। খাওয়া বাদ দিয়ে আড়াল করে রাখা মুখ তুলে কিছু পর পর সে টিস্যু পেপার চাইছিল। তাদের বিদেয় দেবার পরে নিজের ঘোর কাটানোর সময় নিলাম। তারপর আশীষকে বললাম, -বন্ধু তুই আমার এক মাসের সিনেমার টিকেটের খরচ বাচিয়ে দিলি। জুনিয়রদের কাছে পাগলা আশুদা আর বিয়ে থা করেনি, চির কুমার থেকে যাবার দৃপ্ত শপথ নিয়ে বেঁচে আছে।

(সত্য কাহিনী অবলম্বনে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।