আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য ও স্মরণ 'ইমন জুবায়ের: নগরে নির্জন ঋষি'

শরীরে আচড়ের দাগ, নষ্ট হল বুঝি আবার মানবতা! আজ ১৭ ফেব্রুয়ারী প্রিয় ব্লগার ইমন জুবায়ের এর ৪৬ তম জন্মদিন। আজকে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে চলমান আন্দোলনের ফাঁকেও বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে। কদিন আগেও আমাদের সাথে ব্লগ পোস্ট ও কমেন্টের মাধ্যমে কথা বলে যাওয়া লোকটি আজ আর নেই। ইমন জুবায়ের এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখাটি প্রকাশ করছি। আপনাদের সকলকে বলব, উনার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্য দোয়া করবেন।

বাংলা ব্লগজগত সম্পর্কে যারা অবগত তাদের কাছে ইমন জুবায়ের এক প্রিয় নাম। সব্যসাচী এই ব্লগার জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৯৬৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। বাবা আবদুল মালেক পাটোয়ারী ছিলেন একজন আইনজীবী, মা নুরুন্নেসা হামিদা বেগম। চার বোনের এক ভাই ইমন জুবায়েরের অনেক লেখায় তাঁর স্নেহময়ী মাতামহী আমেনা খাতুনের কথা এসেছে বারবার। স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকা উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে (১৯৮৪), এরপর ঢাকা সিটি কলেজে কলেজ জীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

তিনি ছিলেন জসিমউদ্দীন হলের অনাবাসিক ছাত্র। লেখালেখির প্রতি বিশ্বস্ত এই লেখক আগে থেকেই সাহিত্য চর্চা করে আসলেও নিজেকে প্রকাশের জন্যে বেছে নিয়েছেন পাঠকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ তথা মন্তব্য আদান প্রদানের সর্বাধুনিক মাধ্যম ব্লগকে। বাংলা ব্লগ যখন সামহয়্যারইনের হাত ধরে তার কুড়ি মেলছে সেরকম একটি সময়ে ২০০৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে ব্লগ নিজের লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি। বাংলা ব্লগে সাহিত্য ধারার ব্লগিংকে জনপ্রিয় করার পিছনে ইমন জুবায়েরের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ পোস্ট এবং তথ্যের আলোকচ্ছটায় ঋদ্ধ করেছেন সামহয়্যারইন ব্লগ।

স্বল্প সময়েই ব্লগপাতাটি বৈচিত্র্যপূর্ণ পোস্ট ও তথ্যের জন্য পাঠকের প্রিয় হয়ে ওঠে। এ যাবত তার ব্লগ পাতা প্রায় সাত লক্ষ বার পঠিত হয়েছে। বহুমাত্রিক এ ব্লগার সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত লিখেছেন নিরন্তর। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, চিত্রকলা, সঙ্গীত, বিশ্বসাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা, অনুবাদ, মৌলিক গল্প, কবিতা এবং লিরিক- ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তার রচিত প্রবন্ধ বিশেষত ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখাগুলো ছিল পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে।

বৌদ্ধ দর্শন ও তৎকালীন বাংলা অঞ্চলে এর প্রভাব, বিতর্কিত কালী সাধনা থেকে আদম ধর্মের গোঁড়ার কথা, বিতর্কিত সায়োন্টলজি থেকে ইল্যুমিনেটি ও তাদের গোপন বিষয় আসয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কেন্দ্রিক জাতিসত্তা বিষয় থেকে শুরু প্রাচীন এ্যাজটেক, জাপোটেক সভ্যতা, বাংলা বাউল দর্শন, সাংখ্য দর্শন, মরমি, সুফিবাদ-এমন নানাবিধ বিষয়ে তিনি লিখেছেন নিরন্তর। এসব লেখা এমন সব পাঠকদের জন্যে লিখেছেন যারা এসব বিষয় হয়ত কখনো ছুঁয়েও দেখেনি কোন বই এ। নেট পাতায় এগুলো পড়ে পরবর্তীতে এসব বিষয় বিস্তারিত জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে অনেকের মনেই। বিশেষ করে মিথোলজি বা পুরাণ নিয়ে তিনি এত লিখেছেন যে ব্লগাররা গ্রীক, চৈনিক, মায়া পুরাণ বিষয়ে মোটামুটি অনেকটাই শিখে ফেলেছে এগুলো পড়ে। এ জিনিসটি ইমন জুবায়ের এর একটি বিশেষ সাফল্য।

একবার আমার সাথে ব্যক্তিগত বার্তায়, এ সব গবেষনাধর্মী প্রবন্ধ নিয়ে বই প্রকাশের ইচ্ছা আছে কিনা প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেছিলেন, তিনি চান এই বিষয়গুলো পাঠক বিনামূল্যে পড়ুক, তার ধারণ করা জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক। বই করার কথা তিনি তখনো ভাবছিলেন না এগুলো নিয়ে। এ থেকেই তার নির্মোহ চরিত্রের ধারনা মেলে। সৃজনশীল ও মননশীল উভয়-শ্রেণীর সাহিত্য কর্মেই তার প্রতিভার পরিচয় মেলে। বাংলা ব্লগে তার লেখা গল্পের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক, যা এযাবৎ একজন ব্লগারের পক্ষে সর্বাধিক।

তার লেখা গল্পের ভিতরে ইতিহাস আশ্রয়ী একদিন সিরিজটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সিরিজে নির্দিষ্ট একটি প্লটের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা: ), যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ, সম্রাট অশোক, লালন, হাসন রাজা, কনফুসিয়াস, রবিঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় মনিষীদের জীবনী ভিত্তিক গল্প। তিনি কবিতাও লিখেছেন অনেক। তবে কাব্য চর্চায় তার পারদর্শিতা বেশি ফুটে উঠেছে গীতি কবিতা তথা লিরিক লেখায়। উল্লেখ্য তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড এর নিয়মিত গীতিকার।

বাংলা কাব্যজগতের দুই প্রবাদ পুরুষ জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার লেখালেখির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রচুর লিখেছেন এই দুই মহান কবিকে নিয়ে। তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা, স্মৃতিকথা এসব লিখেছেন প্রায়শই। নির্মোহ স্বভাবের এই ব্লগার নির্বিবাদী চরিত্রের জন্যে সব শ্রেণীর ব্লগারদের কাছেই প্রিয় ছিলেন। তার লেখার বৈচিত্র্য থেকেই বিচিত্র বিষয়ে তার বিপুল পাঠাভ্যাসের খবর পাওয়া যায়।

তিনি ভালবাসতেন বই পড়তে। বহু দুর্লভ বই তার সংগ্রহে ছিল। তিনি আরো ভালবাসতেন গান শুনত, গিটার বাজাতে। বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদারের কাছে তিনি সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষা লাভ করেন, যদিও কখনো জনসম্মুখে গান গাওয়ার ব্যাপারে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ইমন জুবায়ের এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তিনি ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী।

বন্ধু বান্ধব, হই হুল্লোড় খুব একটা পছন্দ করতেন না। লেখা পড়া শেষ করেও তিনি চাকরি বাকরির দিকে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। নিজের সম্পর্কে তার খুব বেশি বক্তব্য পাওয়া যায় না, তথাপি সম্প্রতি তিনি তার এক বন্ধুর কি করেন প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘কিছু না। চাকরি/বাকরি না। খুঁজিও নাই।

আমার সময় কাটে বই পড়ে, গিটার বাজিয়েÑ ইন্ডিয়ান রাগ বাজাই, বোনের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে আর গান লিখে... ব্ল্যাকের জন্য (নাম শোনার কথা) ...২০০৮ সাল থেকে ব্লগিং করি। এতেও সময় কাটে। এই ...মনে মনে রোমান্টিক হলেও বিয়েটিয়ে করি নাই। স্বাধীন থাকতে চাই। এই ...আমার ডায়াবেটিস আছে ...মেয়েদের এড়িয়ে চলি ...তারা ছেলেদের বদলাতে চায় ...আমি বদলাতে চাই না ...এই...’ বাংলা ব্লগে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ইমন জুবায়েরকে বিগত ২০১১ সালে সামহয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ সেরা ব্লগার হিসেবে পুরস্কৃত করে।

এ ছাড়াও একই বছরে জার্মানির ডয়চে ভেলে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ব্লগীয় প্রতিযোগিতায় মনোনীত হয়েছিলেন, তথাপি ওই প্রতিযোগিতায় অনিয়মের প্রেক্ষাপটে তিনি ওখান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। চিরকুমার এবং লেখালেখির প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত এই কলম সৈনিক বিগত ৩ জানুয়ারি দিবাগত রাতে আনুমানিক ২.৩০ এ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। বাংলা ব্লগের এই নির্জনতা প্রিয় এবং নগরঋষি অভিধায় খ্যাত এই লেখক ও ব্লগারের স্মৃতির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। ইমন জুবায়ের এর মেধা ও তার সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মূল্যায়ন তার জীবদ্দশায় সম্ভব হয় নি, তথাপি আমরা আশা করব আগামীতে তার সাহিত্য কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।