আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলহত্যাকাণ্ডঃ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কাণ্ডারী তাজউদ্দিন আহমেদ

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত’_তাজউদ্দিন আহমেদ। তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম হয় ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই।

ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদিয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা মৌলবী ইয়াসিন খান, মা মেহেরুন্নেসা খানম। ৪ ভাই ও ৬ বোনের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ৪র্থ । পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। ভূলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

এই বিদ্যালয় থেকে ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন। কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুলে ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। এসময় তিনি স্কাউট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এর ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সিভিল ডিফেন্স-এ ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

এম.ই স্কলারশিপ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলায় দ্বাদশ স্থান অর্জন করেন। এসময়ই তিনি যুক্ত হন মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে। সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য ওই বছর নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন। এক পর্যায়ে মুসলিম লীগের গণবিচ্ছিন্ন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে তিনি পরবর্তীতে ওই দলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ঢাকা বোর্ডে ৪র্থ স্থান অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি যুক্ত হন সক্রিয় রাজনীতিতে। যদিও তার চিন্তাধারায় দেশপ্রেম ও রাজনীতির মন্ত্র ঢুকেছিল জন্মভূমি কাপাসিয়াতে থাকা অবস্থায়। ওই সময় কাপাসিয়াতেই নির্বাসিত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তিন বিপ্লবী রাজেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, বিরেশ্বর বন্দ্যাপাধ্যায় ও মনীন্দ্র শ্রীমানী। তাজউদ্দিন আহমেদ তখন কাপাসিয়া মাইনর স্কুলের ছাত্র।

তাঁর প্রখর মেধার পরিচয় পান এই বিপ্লবীরা। তাঁকে ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মনীষীদের জীবনী সম্পর্কে জানতে-পড়তে সাহায্য করেন তাঁরা ৷ তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ফেলেন প্রায় ৫০/৬০ খানা বই। বিপ্লবীরা তাঁর চেতনার নির্মাণ করেন শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ ভাবনা। ১৯৪৮ এ প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদেরও একজন তিনি।

ভাষা আন্দোলনেও তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম লড়াকু সৈনিক। ১৯৪৮সালের ১১ ও ১৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ধর্মঘট-কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ দলের কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দটি থেকে বাদ দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ এ সময়ই আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ওই বছরই তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

সাংগঠনিক কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হন এবং জয় লাভ করেন তিনি । তখন তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর। ওই নির্বাচনি প্রচারণায় তাঁর জন্য ভোট সংগ্রহ করেছেন জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলিকে সহধর্মিনী করেন।

তিনি সারা জীবন তাজউদ্দিন আহমেদকে রাজনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) আওয়ামী লীগের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এদলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেফতার করে আইয়ুব সরকার। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬ দফা আন্দোলনের কারণে দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৬ সালের ৮ মে পুনরায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

জেল থেকে মুক্ত হন ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনায় তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। যিনি মানুষের অধিকার ও দাবির ব্যাপারে ছিলেন অনড়। ইয়াহিয়া খান তাজউদ্দীনকে ভয় করতেন তাঁর সততা ও কঠোরতার কারণে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ।

মধ্য রাত। নিরাপরাধ বাঙালি জাতির ওপর জাপিয়ে পড়লো পাকিস্তানি হায়নার দল। হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠলো ওই পশুরা। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্থানে নিয়ে গেল । তাজউদ্দীন তাঁর সহযাত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

মুহম্মদ আলী ছদ্মনাম নিয়ে, গ্রেফতার এড়িয়ে, শত্রু সেনার চোখ এড়িয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভারতে পৌছেন। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে প্রবেশ করে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে এবং দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেন। ভারত সহযোগিতা করার আশ্বাস দিল। জরুরি হয়ে পড়ে একটি সরকার গঠন। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, ৫ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্ঠা পরিষদ আর নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করলেন।

১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে এই সরকার। শত বাধা-বিপত্তির মাঝে তিনি প্রবাসী সরকারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। গঠন করেন প্রশাসনিক কাঠামো। এমনকি পাঁচ বছরের পরিকল্পনাও করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, একই সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

তাই যুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনাও করতে হচ্ছিল তাঁকে। যুদ্ধকালীন সময় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীকে, সাধারণ মানুষকে সাহস জোগাতে। শেখ মুজিবের ছিল নেতৃত্বের ক্যারিশমা আর তাজউদ্দীন আহমদের ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা। মূলত তাঁর সুনিপুণ দক্ষতার গুণেই যুদ্ধ সঠিক পথে এগোতে থাকে। যুদ্ধের সময় দলের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।

কিন্তু তিনি সকল বিষয়কে দক্ষতার সাথে মোকাবেলাও করেছেন। দূরদর্শিতা ছিল তাঁর অসামান্য গুণ। পকিস্তানিরা একটি সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী। তাদের সাথে লড়াই-সংগ্রাম করার জন্য দরকার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অস্ত্র, গোলা-বারুদ। এসব কিছুর ব্যবস্থা কর সহজ ছিল না।

কিন্তু তিনি সবকিছু মোকাবিলা করেছেন দক্ষতার সাথে। বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সমন্বয় সাধন এবং নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কূটনৈতিক তত্‍পরতাও চালিয়ে যান তিনি। যুদ্ধের সময়ে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিল বাহিনীর সাথে, কখনো শরণার্থী শিবিরে, কখনো ভারতীয় মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করে আবার কখনো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগ্রামী শিল্পীদের সাথে যুদ্ধের প্রতিটি দিন কাটতে হয় তাঁকে। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। প্রচণ্ড আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিন।

যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর সরকারের কতিপয় ষড়যন্ত্রী নেতা পাকিস্তানের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা কঠোর হস্তে দমন করেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তাজউদ্দীন এক টিভি ভাষণে বলেন- ৩০ লক্ষাধিক মানুষের আত্মাহুতির মাঝ দিয়ে আমরা হানাদার পশুশক্তির হাত থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঢাকার বুকে সোনালি রক্তিম বলয় খচিত পতাকা উত্তোলন করেছি৷ শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমেদ হন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী।

১৯৭৩ সালে ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এতদিন যিনি সংগ্রাম করেছেন দেশ স্বাধীনের জন্য এখন তিনি সংগ্রামে নামেন দেশ গঠনের। ১৯৭৪সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন তাজউদ্দীন আহমেদ। কোনোদিনই তাঁকে জড়িয়ে বিতর্কের সৃষ্টি না হোক এজন্য তিনি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একাত্তরের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতা মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় নিলেন স্বাধীনতা লাভের মাত্র ২ বছর ১০ মাসের মাথায়। সারাদেশে রাজনৈতিক তত্‍পরতায় ব্যস্ত আবার নানা বিষয়ে মুজিবকে সচেতন করতেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্ক্ষা সত্য হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করলো মোশতাক গংরা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সবাই তাজউদ্দীন আহমদকে আত্মগোপনে যাবার জন্য বলতে থাকেন দেশের বামপন্থী নেতারা। কিন্তু তিনি আত্মগোপন করতে অস্বীকৃতি জানান। ১৫ আগস্ট প্রথম গৃহবন্দী ও পরে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।

পরিবারের সদস্যদের প্রতি শুধু বলে গেলেন- ‘ধরে নাও আজীবনের জন্য’ যাচ্ছি৷ ৩ কন্যা, ১ পুত্রসহ স্ত্রীকে ছেড়ে যাবার সময় একটুও বিচলিত ছিলেন না। কারা অন্তরীণহলেন আরো ৩ জন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানার মধ্যে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ৪ নেতাকে। ১৫ আগস্টের পরে মোস্তাক গংরা ৩ নবেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড ঘটায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।