আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের বড় দুই দূর্বলতা

অনু পরিমাণ খবরকে নিয়ে আসব সবার গোচরে

আমার পড়া সেরা লেখা আবুল কাসেম ফজলুল হক জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দুটি মারাত্মক দুর্বলতা নিয়ে এগোচ্ছেÑ এক. অন্তর্গত দুর্বলতা, দুই. পারিপার্শ্বিক দুর্বলতা। এ দুটি দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে ও উন্নতি করতে হলে পর্যায়ক্রমে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে এবং মহান সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। এর জন্য জাতির জীবনে ইচ্ছা, সঙ্কল্প ও কাজ দরকার। বাস্তবে সে ধারার কাজ, সঙ্কল্প ও ইচ্ছা কোনোটাই নেই।

বাংলাদেশ চলছে সম্পূর্ণ ভোগবাদী দাস-মনোবৃত্তি নিয়ে পরাধীনতার পথ ধরে। আত্মপরিচালনার দায়িত্ব সে নিতে চায় না; বিদেশি প্রভুদের পদে আশ্রয় নিয়ে প্রভুসেবার মাধ্যমে পরাধীনতার সুখ সে ভোগ করতে চায়। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর লোকদের আচরণ, কথাবার্তা ও চিন্তা-চেতনা লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়। হীনচেতা শাসক শ্রেণীর নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে, জাতীয় হীনমন্যতাবোধ নিয়ে নিদারুণ অদৃষ্টবাদী জীবনযাপন করছে। প্রবৃত্তির দাস সবাইÑ কোনো উচ্চ আদর্শ নেই।

এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিবেকবান চিন্তাশীল লোকদের এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। অবস্থা এখন এমন করে ফেলা হয়েছে যে, জনগণ শ্রদ্ধা করতে পারে, ভালোবাসতে পারে, আস্থা স্থাপন করতে পারে এমন নেতা, এমন চিন্তক দেশে নেই। অত্যুন্নত প্রযুক্তির এই কালে প্রচার মাধ্যম তুচ্ছকে উচ্চ করে এবং উচ্চকে তুচ্ছ করে সমাজে মহত্ত্বের মর্যাদা ক্ষুণœ করে চলছে। মহত্ত্বের প্রয়াস সমাজে আছে।

বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব আছেন। প্রচার মাধ্যম তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। মহত্ত্ব প্রয়াসীদের স্বতন্ত্র কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। যে কোনো জাতির রেনেসাঁসের মনীষীরা সত্যসন্ধ মন নিয়ে সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে সত্য সন্ধানে ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যেভাবে কাজ করেছেন, বাংলাদেশের বিবেকবান-চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আজ তেমনিভাবে সত্যসন্ধ মন ও সত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নিয়ে কাজ করা দরকার। রেনেসাঁস হলো বৌদ্ধিক জাগরণÑ চিন্তার জাগরণ।

রেনেসাঁসের জন্য বৌদ্ধিক কর্মকা-ের সঙ্গে চরিত্রবল দরকার। চরিত্রবল অর্জনের জন্য সত্যসন্ধিৎসা, সত্যোপলব্ধি এবং সব কাজে সত্যনিষ্ঠা অপরিহার্য। সত্য হলো পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের আধার। তথ্য অবলম্বন (ভধপঃং) করেই সত্য ((ঃৎঁঃয) নির্ণয় করতে হয়। সত্যোপলব্ধির জন্য জ্ঞানই যথেষ্ট নয়Ñ প্রজ্ঞাও দরকার হয়।

সাধারণ মানুষ প্রজ্ঞাবানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে তাদের অনুসরণ করে প্রজ্ঞার অংশীদার হয়। ব্যক্তিগত ও যৌথ জীবনে সত্যের অবলম্বন অপরিহার্য। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। কিংবা ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষÑ এই প্রত্যয় ছাড়া মানবজাতি কতোকাল চলতে পারবে? বাংলাদেশকে উঠতে হলে এ রাষ্ট্রের জনসাধারণকে এই প্রত্যয় অবলম্বন করে চলতে হবে। প্রত্যেকের মধ্যে যে সত্যবোধ আছে, তার সম্মিলিত রূপ উদ্ভাবন করতে হবে এবং তা-ই হবে পরম সত্য।

অত্যুন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অধিকারী হয়ে কার্যক্ষেত্রে প্রায় সব রকম মানবীয় গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে কেবল অর্থ ও ক্ষমতায় পূজা-পার্বণে বা এবাদত-বন্দেগিতে মজে গিয়ে বিশ্বব্যাপী মানবজাতি আজ আত্মঘাতী পথে চলছে। বৈষয়িক এই পথ ত্যাগ করে মানবজাতিকে উত্তীর্ণ হতে হবে সর্বসাধারণের জন্য পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ, পরম সুন্দরের পথেÑ এক কথায় সত্যের পথে। সর্বসাধারণের স্বার্থের মধ্যেই প্রত্যেককে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখতে হবেÑ সর্বসাধারণকে বঞ্চিত করে কোনো ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলীয় স্বার্থের স্বীকৃতি সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে থাকা উচিত নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার, শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি সব ব্যবস্থার অভ্যন্তরে চাই সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত সত্যনিষ্ঠা। রেনেসাঁসের স্পিরিট ও সত্যনিষ্ঠা নিয়ে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উদ্ধারের জন্য যারা কাজ করবেন তাদের প্রথমেই বাংলাদেশের দুর্বলতা ও দুর্গতি থেকে উদ্ধারের উপায় ও উন্নতির ভাবনাগুলো বুঝতে হবে।

এখানে অতি সংক্ষেপে সে বিষয়ে কিছু মন্তব্য করবো। বাংলাদেশ বর্তমানে যেভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিভক্ত হয়ে আছেÑ যেভাবে জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তিতে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে, তা অব্যাহত রেখে কস্মিনকালেও সত্যের পথে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। এ বিভক্তির মধ্যে সর্বজনীন কল্যাণের সম্ভাবনাকে বলি দেয়া হয়েছে। ফলে সরকার হয়ে পড়ে দলের জন্য সরকার, জনগণের জন্য সরকার নয়। বিভ্রান্তি দেখা দেবে আজকের বিরাজমান বাস্তবতায়Ñ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে, সুন্দর ও কুৎসিতের মধ্যে, সর্বজনীন কল্যাণ ও হীনস্বার্থ সন্ধানের মধ্যে।

মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং মিথ্যার সঙ্গে মিথ্যার তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। সত্য সামনে আসছে না। তাতে কখনো আওয়ামী লীগ জয়ী হচ্ছে, কখনো বিএনপি। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে, অতীতমুখী চিন্তা বাদ দিতে হবে এবং সত্যের পথ তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টি চাই।

প্রথমে অন্তর্গত দুর্বলতার কথা। অন্তর্গত মূল দুর্বলতা নেতৃত্বের দুর্বলতা। দুর্বল নেতৃত্ব নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। এখন সেই নেতৃত্ব আরো দুর্বল ও সম্পূর্ণ বিকারপ্রাপ্ত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

আন্দোলনের পর্যায়ে আওয়ামী লীগ যাতে স্বাধীনতার পথ থেকে সরে না যায়, তার জন্য তখনকার মার্কসবাদীদের প্রায় সব গ্রুপ তৎপর ছিল, ছাত্রলীগের একাংশও তৎপর ছিল। তাছাড়া মার্কসবাদীদের ছিল সমাজ বিপ্লবের স্লোগান। তাদের গণভিত্তি দুর্বল ছিল। মওলানা ভাসানীর জনপ্রিয়তা ছিল; কিন্তু তার সরকার উৎখাতের লক্ষ্য থাকলেও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্য ছিল না, রাষ্ট্রচিন্তাও ছিল না। মুসলিম লীগ প্রভৃতি ডানপন্থী দল ছিল গণধিক্কৃত।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই লাভ করেছিল জনসমর্থন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের নিয়ম-অনুশীলন ছিল না। অন্য কোনো দলের মধ্যেও তা ছিল না। গণতন্ত্রে ছিল একটা স্লোগানÑ একটা বিমূর্ত আবেগ মাত্র। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করার পর কীভাবে রাষ্ট্র গঠন করবে এবং রাষ্ট্র চালাবে, তা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনাই করেনি।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ছিল আওয়ামী লীগের চালকশক্তি। স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে যুক্তিসঙ্গত প্রস্তুতি ছিল না। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র সম্পৃক্ত না থাকলেÑ গভীর রাষ্ট্রচিন্তা না থাকলে- জাতি-রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলায় পড়ে। ১৯৭২ সালের প্রায় শুরু থেকে বাংলাদেশ সেই অবস্থায় পড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের প্রধান দুর্বলতা ছিল এই জায়গায় যে, তিনি যুদ্ধে যাননি, বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেননি এবং পরে পক্ষপাতমুক্ত অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতেও চাননি।

তখন অন্যান্য দলের মধ্যেও, নবগঠিত জাসদেও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার-বিবেচনা ছিল না। মার্কসবাদীরাও কোনো সদর্থক গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়নি। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য জাতিভিত্তিক সর্বাঙ্গীন কোনো বক্তব্য এ দেশের মার্কসবাদীরা কখনো প্রচার করেনি। জাতি ও রাষ্ট্রের প্রশ্নে তারা সব সময় বিভ্রান্তির মধ্যে থেকেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের কোনো আকাক্সক্ষা যে তাদের ছিল বা আছে, এটাই লোকে মনে করে না।

জনসম্পৃক্ত হওয়ার মতো কোনো বক্তব্য নিয়ে কখনো তারা জনগণের মধ্যে যাননি। অথচ তাদের সামনে সুযোগ ছিল এবং আছে জনসম্পৃক্ত হয়ে জনগণের অভীষ্ট রাজনীতি নিয়ে জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার ও রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার। এরই মধ্যে নির্বাচিত সরকার, সামরিক সরকার, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, শাসনতন্ত্র বহির্ভূত জরুরি অবস্থার সরকার ইত্যাদির অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি। দুর্বল নেতৃত্বে গোটা সময়টাই গেছে চরম অপব্যবস্থার মধ্যে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের সবারই উত্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিদের হাত ধরে এবং পতন দুর্নীতির দায়ে।

কার্যত গত আটত্রিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ চলে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অধীনে। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে নেতৃত্বের দুর্বলতা কী ভীষণ মারাত্মক ব্যাপার। এরই মধ্যে নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে বংশানুক্রম ও পরিবারতন্ত্র। এখন হাল ছেড়ে দিয়ে থাকলে পরাধীনতার মধ্যে জাতির জীবনে ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর দুর্গতি দেখা দেবে। নেতৃত্বের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য চিন্তা ও চেষ্টা দরকার।

এর জন্য সাধারণ মানুষের দিকে তাকাতে হবে। ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণীর বাইরে বৃহত্তর জনগণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জনগণের ভেতর থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। নতুন নেতৃত্ব। দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, আদর্শের উপলব্ধি সবই হতে হবে নতুন।

রাষ্ট্রচিন্তা ও পার্টি গঠনেও দিতে হবে পরিপূর্ণ গুরুত্ব। জনসম্পৃক্ত পার্টির মাধ্যমেই সৃষ্টি করতে হয় নেতৃত্ব। বর্তমানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি দল ও দলের ভেতরে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী নীতি ও স্বৈরাচারী কর্মপদ্ধতি নিয়ে চলছে। বংশানুক্রম ও পরিবারতন্ত্র এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করেছে। শক্তের ভক্ত নরমের যমÑ এই হলো নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।

এ রকম নেতৃত্ব নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারবে না। এবার পারিপার্শ্বিক দুর্বলতার কথায় আসা যাক। দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি ইত্যাদি দুর্লঙ্ঘ্য বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টিত এক একটি বিশাল ভূভাগ এক একটি দেশ।

জমি, মাঠ, নদ-নদী, বনভূমি, মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, পাখি, আকাশ-বাতাস ইত্যাদি নিয়ে দেশ। পৃথিবীর দেশগুলোর দিকে তাকালে সব দেশকে এই শর্ত সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে দেখা যায় না। প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। সেই বৈচিত্র্যের পরিচয় পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যেও দেখা যায়। প্রাচীনকালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল ক্ষুদ্র এলাকায় সীমাবদ্ধ।

জনপদ, জনপদরাজ্য, সামন্তরাজ্য, সাম্রাজ্য ইত্যাদির ধারা অতিক্রম করে সত্যতার বিকাশের উচ্চস্তরে পৌঁছে মানুষ রাষ্ট্র গঠনের উপলব্ধি লাভ করে। জনপদ, জনপদরাজ্য, সামন্তরাজ্য, রাজ্য, সাম্রাজ্যÑ এগুলোও রাষ্ট্র, তবে আধুনিক যুগের রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। শিল্প বিপ্লবের ধারায় মানুষের জীবিকা প্রয়াস যাতায়াত, যোগাযোগ, জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি যখন এলাকাগত ক্ষুদ্র গ-ি অতিক্রম করে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়, তখন জাতীয় সংস্কৃতি রূপ পেতে থাকে। তখন জাতিগত ধারণার বিকাশ ঘটতে আরম্ভ করে। প্রত্যেক দেশের জনগণের মধ্যে এই চেতনা দেখা দেয় যে, আমরা এক জাতিÑ আমাদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার ও সম্প্রীতির ওপর আমাদের উন্নতি নির্ভর করে।

এই চেতনা থেকে বিকশিত হয় রাষ্ট্রচেতনা। ধারণা দেখা দেয় যে, আমাদের দেশে আমরা যদি আমাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারি, তাহলে সেই রাষ্ট্রে আমাদের জীবনের পূর্ণতা, সমৃদ্ধি ও সুখ-শান্তি সর্বাধিক সম্ভব হবে। এ থেকে দেখা দেয় নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা, গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ইউরোপের দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় সামন্ততন্ত্র, গির্জার কর্তৃত্ব ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার দেশগুলোর ছিল কয়েকটি শক্তিশালী ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অধীনÑ উপনিবেশ বা কলোনি।

উপনিবেশ দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে উপনিবেশকারী শক্তি ও তার দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। এসব দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বৃটিশশাসিত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখা দেয়। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একশ’ বছর সময়ের মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) থেকে মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭) পর্যন্ত একশ’ বছর ভারতের একটি একটি সুবা দখল করতে করতে আসমুদ্র হিমাচল সমগ্র ভারত দখল করেছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের চাপে এবং মুদ্রণযন্ত্র, স্টিম ইঞ্জিন, রেলপথ, জাহাজপথ, টেলিগ্রাফের ভার এবং নানা ধরনের ফ্যাক্টরি ও বহুব্যাপ্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগে ভারত ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

কিন্তু এর দ্বারা ভারতীয় জাতি গড়ে ওঠেনি। ভারতের জনগণ তখন ছিল এক মহাজাতি এবং মহাজাতির ভেতরে ছিল অনেক জাতি। সম্রাট আকবর ভারতবর্ষকে পনেরটি সুবায় বিভক্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনা করতেন। জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিচার করলে দেখা যাবে, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে আঠারটি কি বিশটি জাতি ছিল এবং এই জাতিগুলোর বাইরে ছিল বহু উপজাতি। ভারতবর্ষে তখন পনেরটির বেশি আঠারটি কি বিশটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র হতে পারতো এবং তাই হওয়া উচিত ছিল।

বাস্তবতার কারণে উপজাতিগুলোকে পার্শ্ববর্তী জাতির সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। সেভাবে জাতি-রাষ্ট্র গঠিত হলে ভারতীয় উপমহাদেশে জাতি সমস্যার সমাধান হতো। পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, শিখ-হিন্দু বিরোধ, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, ভারতের অভ্যন্তরে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ইত্যাদি রয়ে গেছে এবং সম্প্রতি ভারতের ওপরও যুক্তরাষ্ট্রের থাবা বিস্তৃত হতে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের মূল্য ভারতকে অবশ্যই দিতে হবে নিজেদের অস্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বৃটিশশাসিত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীদের জায়গায় জয়ী হয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ।

তারপর পাকিস্তানকালে আমরা জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ হই জাতীয়তাবাদের প্রেরণায়। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক দুর্বলতাটা এই জায়গায় যে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক ভিত্তি রাষ্ট্র হওয়ার মতো নয়। এ রাষ্ট্রের সীমানা প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। এই সীমানা নির্ধারিত হয়েছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতা যুদ্ধ (১৯৪৭) এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের (১৯৭১) মধ্য দিয়ে।

প্রকৃতির নয়, মানুষের তৈরি এই সীমানা বাংলাদেশের চারপাশ পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি ইত্যাদি দ্বারা পরিবেষ্টিত নয়। সমুদ্র যেটুকু আছে তার দক্ষিণে আন্দামান-নিকোবর সামুদ্রিক এলাকা ভারতের। স্থলভাগে বাংলাদেশের তিন দিকব্যাপী রয়েছে ভারতÑ মাত্র ২০-২৫ মাইল সীমানা মিয়ানমারের সঙ্গে। সমুদ্রও রয়েছে মিয়ানমারের এলাকায়। ১৯৪৭-এর আগে তৎকালীন বঙ্গপ্রদেশ ভারতেরই অন্তর্গত ছিল।

এ অবস্থায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও বাংলাদেশে সবসময় মনে করা হয়েছে ভারত বুঝি এই ভূভাগ (পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ) দখল করে নেবে! এই ভয় নিয়েই কি আমরা চলছি না? বাংলাদেশে মুজিব সরকারের পতনের পরে আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তি ভীষণভাবে ভারতের দিক দেখে বাংলাদেশের ভয়ের কথা প্রচার করতে থাকে। ভারতের বিরুদ্ধে এই প্রচার ধারা অব্যাহত রাখা হয়। পরে ভারতবিরোধী এই প্রচারের ধারাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে বিএনপি। তাজউদ্দীন সরকার যেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেনÑ মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপিÑ জিয়ার আমলে এগুলো রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করে। তখন হিন্দু-মুসলিম বিরোধকেও সামনে আনা হয়।

এর আগে মুজিব সরকার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যুদ্ধকালীন সহযোগীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা বা জেনারেল অ্যামনেস্টি ঘোষণা করেছিল। তার সুযোগে জিয়ার আমল থেকে কোলাবরেটাররাও সামনে আসে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ভারতবিরোধী প্রচারের তোড়ে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থীরাও ভেসে যায়। এর ফল এই হয় যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনকালে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়ে চলে যায় এবং স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে চলে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সীমানা না থাকা, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ নিতান্ত ক্ষুদ্র হওয়া, হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় ব্যবধান, বাংলাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের আশ্রয়ে চলে যাওয়া, এসবের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক দুর্বলতা।

বাংলাদেশকে উন্নতি করা হলে এ দুটি দুর্বলতা যথাসম্ভব কাটিয়ে উঠতে হবে। নেতৃত্বের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন রাজনীতি, নতুন চরিত্রের রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন, অনুশীলন চালাতে হবে এবং প্রথমে বৌদ্ধিক জাগরণ বা রেনেসাঁস ও পরে সার্বিক গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। আরো অনেক কিছু করতে হবে। বিবেকবান চিন্তাশীল লোকদের এ কাজ আরম্ভ করতে হবে। বর্তমান সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা, বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা যে ধারায় কাজ করছেন, তা দিয়ে ভালো কিছুই হবে না।

চিন্তা ও কাজের নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন প্রগতিশীল সত্তায় আত্মপ্রকাশ করার এবং শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করার জন্য বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী যে অসন্তোষ আছে, তার সুযোগ নিতে হবে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বাংলাদেশের গ্রহণ করতে হবে নিজের স্বাধীনতা রক্ষা করে জাতীয় ঐতিহ্য, সৃষ্টিশীলতা ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বিকশিত করার জন্য।

বাংলাদেশের ভূগোল, ইতিহাস ও জনজীবনের অভ্যন্তরে অনুসন্ধান করলে মহান সব সম্ভাবনার সন্ধান পাওয়া যাবে। আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্রচিন্তক ও সমাজ বিশ্লেষক। সূত্রঃ যায় যায় দিন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.