আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশবিদেশের উপকথা-কেনিয়া(আফ্রিকা)

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

এই গল্প ও আফ্রিকার, কেনিয়াতে প্রচলিত উপকথা। এক সিংহ, নাম তার সিম্বা, সে একা একা থাকতো তার গুহায়। সতেজ সবল শক্তিশালী তরুণ সিংহ, দুনিয়ার কোনোকিছুকে সে পরোয়া করতো না। খিদে পেলে বের হয়ে অনায়াসে শিকার ধরে খেতো, খিদে মিটে গেলে বাকী খাবার ফেলে রেখে যেতো হায়েনা নেকড়ে শিয়াল এদের জন্য। সিম্বার প্রসাদলাভের জন্য চাটুকারের মতন আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতো এইসব হায়েনা নেকড়েরা, গদগদ বন্ধুত্বের কথা বলতো।

একদিন শিকার করতে গিয়ে আহত হলো সিম্বা, পায়ে এত আঘাত লাগলো যে কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গুহায় ফিরে এলো সে। শুয়ে পড়লো। তারপরে তার হলো জ্বর, ওঠার ক্ষমতাও রইলো না। হায়েনা নেকড়েরা-এতকাল যারা প্রসাদলোভে বন্ধুত্বের গদগদ ভাব দেখাতো, তারা উঁকি দিয়ে দেখেই ব্যাপার বুঝে ফেলে সরে গেল। দু:সময়ে সিম্বাকে সাহায্য করতে কেউ এলো না।

একলা গুহায় শুয়ে শুয়ে সিম্বা নিজের কপালকে দুষলো, একজনও প্রকৃত বন্ধু তার নেই বলে। সুঙ্গুরু যাচ্ছিলো সিম্বার গুহার কাছ দিয়ে, এমনিতে সে খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করে সেই জায়গায়, বলা তো যায় না, সে ছোটো প্রাণী, সিম্বামহারাজের মতন উচ্চদরের প্রাণীর সঙ্গে দূরত্ব রাখাই তার ভালো। বলা তো যায় না, কখন কী থেকে কী হয়ে যায়। সে যাক গে, কিন্তু সিম্বা ওভাবে শুয়ে আছে কেন? অসুখ করলো নাকি? আহা, কেমন কুঁকড়েমুকড়ে শুয়ে আছে! সে যাবে নাকি একবার ভিতরে? সে অনেকরকম ওষুধ জানে, যদি কোনো উপকার হয়! সুঙ্গুরু জল নিয়ে ভীরু ভীরু পায়ে ভিতরে গেল, তৃষ্ণার্ত সিম্বাকে জল খাওয়ালো। সিংহের পায়ের ক্ষততে পাতালতার রস থেকে বানানো ওষুধ লাগিয়ে পাতা দিয়ে ঢেকে ভালো করে বেঁধে দিলো তন্তু জড়িয়ে জড়িয়ে।

সিম্বাকে খেতে দেবার সামর্থ তার ছিলো না, সিম্বা যা খায় সে তা কোথায় পাবে? সে কেবল তাকে পরিচর্যা করলো সাধ্যমত। সিম্বার আধা-আধা ঘুম আধা-আধা জাগা অবস্থা, সেই অবস্থাতেই সে অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালো সুঙ্গুরুকে। সুঙ্গুরু সিম্বার ঘাড়ে, মাথায়, কেশরের ভিতর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সে আস্তে আস্তে খালি বললো, "আপনি কথা বলবেন না সিম্বা, আপনি খালি চুপ করে ঘুমান। দেখবেন, কালকে অনেক ভালো লাগবে। " পরদিন সকালে সিম্বার জ্বর সেরে গেল, পায়ের ব্যথা কিছুটা কমলো, সে উঠতে পারলো।

কাছাকাছি থেকে কিছু ছোটোখাটো শিকার করে এনে সিম্বা নিজে খেলো আর সুঙ্গুরুকে দিলো। সুঙ্গুরুর এখন একেবারে ভয় কেটে গেছে, সে বুঝতে পেরেছে সিম্বাকে সে দূর থেকে যেমন মনে করতো সে মোটেই সেরকম ভয়ানক নয়, খুবই কোমলহৃদয়। খুব ভদ্রও। ক'দিন গেল, দিন দিন সিম্বার ক্ষতের অবস্থা ভালো হওয়ার দিকে যাচ্ছে। আর কয়দিন ওষুধ লাগালেই একেবারে শুকিয়ে যাবে।

সুঙ্গুরু রোজ নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেয়। সেদিন বিকালে খাওয়াদাওয়া সেরে গল্প করছিলো তারা দু'জনে। এমন সময় হায়েনা নিয়াঙ্গাউ খাবারের গন্ধ পেয়ে এসে হাজির। গুহার দুয়ারে এসে গলাখাঁকাড়ি দিয়ে জানান দিলো চাটুকার হায়েনা। সিম্বা উঠে এসে বললো, "আরে! নিয়াঙ্গাউ যে! তা এতদিন পরে কী মনে করে?" নিয়াঙ্গাউ তো বিনয়ে একেবারে যেন গলে যাবে এমন ভাব করে বলে," সিম্বা, তোমাকে এতদিন না দেখে সবাই যে কি চিন্তিত কি বলবো! আমি তো তাই তড়িঘড়ি খোঁজ নিতে এলাম কেমন আছো।

তুমি সুস্থ হয়ে বনে ফিরবে এই আশায় সবাই দিন গুনছি। তুমি বিনা অরণ্য আঁধার। " সিম্বা তো নিয়াঙ্গাউয়ের ভন্ডামি দেখে স্তম্ভিত। এতখানি শঠ ও হয় কেউ! খানিকক্ষণ সে থমকে থেকে তারপরে গর্জন করে বললো,"চুপ কর‌্‌‌ চাটুকার! এতদিন পরে সুবিধা খুঁজতে এসেছে ব্যাটা সুবিধাবাদী। আমার দু:সময়ে তো উঁকি মেরে পালিয়েছিলি, একটু সাহায্যও করিস নি।

এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাবি, নইলে তোর কপালে দুর্ভোগ আছে। " সিম্বার কথা শুনে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় কাপুরুষ হায়েনাটা। যেতে যেতে সুঙ্গুরুর ব্যঙ্গহাসি কানে বেঁধে তার। এর পরেও নির্লজ্জ নিয়াঙ্গাউ হাল ছাড়ে না, সে আবার একদিন এসে হাজির। সুঙ্গুরু তখন জল আনতে নদীতে গেছে, সিম্বা গুহায় একা।

খুব বিনয়াবনত আর বিষন্ন ভঙ্গী করে নিয়াঙ্গাউ বলে, "আমি অতি দুর্ভাগা। তোমাকে নিজের বন্ধু ভাবি বলেই খোঁজ নিতে আসি, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পারো না। " সামনের থাবা তুলে সে চোখের জল মোছার অভিনয় করতে থাকে। সরলসোজা সিম্বা এত ছলচাতুরি বোঝে না, সে একটু দু:খিত হয়। সেদিন ওরকম গালাগাল দিয়ে তার মন এমনিতেও খারাপ ছিলো।

সে বললো, " আরে কাঁদছো কেন? সেদিন রাগের মাথায় কী বলতে কী বললাম! মনে কিছু দু:খ রেখো না। এই নাও, এটা খাও। " তার খাবারের অবশিষ্ট থেকে একটুকরো মাংস সে হায়েনাকে দেয়। মাংস পেয়ে হায়েনা খুব ধন্যবাদ দিয়ে মাংসটুকু খেতে খেতে বলে, " সিম্বা, তোমার পায়ের ক্ষতটার কি অবস্থা?" সিম্বা বলে, "শুকিয়ে এসেছে প্রায়। আর কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

" নিয়াঙ্গাউ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে, " তোমাকে ওষুধ দেয় ঐ সুঙ্গুরু তো? বনের সবাই জানে ও কত চতুর! ও ইচ্ছে করে তোমাকে এমন ওষুধ দেয় যাতে ক্ষত সারতে সময় লাগে। নইলে এ তো কবে আরাম হয়ে যেত। ওরই জন্য দেরি হচ্ছে। তুমি সরল সোজা লোক, তাই ওকে বিশ্বাস করো। " সিম্বা অবাক হয়ে বলে, " সুঙ্গুরু ছিলো বলে বেঁচেছি আমি।

সে ওষুধ দিয়ে ক্ষত বেঁধে দিলো আর জ্বর কমালো বলে উঠে হেঁটে গিয়ে শিকার করতে পারলাম। নইলে না খেয়েই তো মরে যেতাম। তুমি কিনা বলছো সে ইচ্ছে করে আমার পুরোপুরি সেরে উঠতে দেরি করিয়ে দিচ্ছে! কিন্তু তাতে তার লাভ কী?" নিয়াঙ্গাউ মুখ বেঁকিয়ে একটা বিশ্রী ভঙ্গী করে বলে," লাভ কী বোঝোনা? যতদিন তুমি পুরোপুরি সেরে না ওঠো ততদিন তোমার কাছে সে থাকতে পারবে আর বিনা পরিশ্রমে ভালো ভালো খেতে পারবে। তুমি পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলে তো আর সেই সুবিধা থাকবে না। তখন তাকে নিজের খাবার নিজে কষ্ট করে যোগাড় করতে হবে।

" সুঙ্গুরু জল নিয়ে ফিরে এলো নদী থেকে। নিয়াঙ্গাউকে দেখে বললো, "আরে, তুমি! সেদিন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলে দেখে ভাবলাম আর বুঝি আসবেই না। তা এবারে কী মনে করে?" সিম্বা সুঙ্গুরুর দিকে ফিরে বলে, " জানো সুঙ্গুরু, এতক্ষণ তোমার বিষয়েই শুনছিলাম এই নিয়াঙ্গাউয়ের কাছে। তুমি তো গোটা বনে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক! তোমার মতন রোগ সারানোর ওস্তাদ আর নেই কেউ। এদিকে আমার পায়ের ক্ষত সারতে এত সময় লাগছে! অদ্ভুত! চাইলে তুমি অনেকদিন আগেই পুরোপুরি সারিয়ে ফেলতে পারতে, তাই না ?" সুঙ্গুরু এত অবাক আর আহত হয় যে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারে না।

সিম্বা কি তাকে সত্যিই সন্দেহ করে নাকি এই শঠ হায়েনাটা ওকে কিছু উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে? মনে মনে সে বলে, খুব সাবধানে এই পরিস্থিতি সামলাতে হবে, সামান্য এদিক ওদিক হলে বিপদ! সুঙ্গুরু বলে, " সিম্বা, কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। কোনো কোনো অসুখের ক্ষেত্রে খুব জটিল জিনিস দরকার হয় ওষুধ বানাতে, আমি সামান্য, ক্ষুদ্র প্রাণী, অনেকসময় যোগাড় করতে পারি না। এই যেমন আপনার ক্ষত তাড়াতাড়ি সারাতে এমন একটা জিনিস লাগবে--" সিম্বা উত্তেজিত হয়ে বলে, " কী জিনিস লাগবে?" সুঙ্গুরু বলে, "লাগবে একটা বড়সড় হায়েনার পিঠের চামড়া, মেরুদন্ডের উপরের চামড়া, একেবারে ঘাড়ের কাছ থেকে লেজের কাছ অবধি একটানে ছেঁড়া। " নিয়াঙ্গাউ পালাতে চেষ্টা করছিলো, পারলো না। সিম্বা বিদ্যুতের মতন লাফ দিয়ে পড়লো তার ঘাড়ে, একটানে ঘাড় থেকে লেজ অবধি ছিঁড়ে নিলো মেরুদন্ডের উপরের চামড়া।

সেই থেকে হায়েনাদের শিরদাঁড়া বরাবর পিঠের লোমগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ***

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।