আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে দেশ

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ও নিচু বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমুদ্রের নিচে তালিয়ে যাবে বলে দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় সম্প্রতি যে আলোচনা চলছে, তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ড. এম এইচ খান। তিনি বলেন, পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা খুবই সম্ভব। গতকাল এক লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের সম্ভাব্য উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ নিয়ে নানা মত রয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য চিত্রের (সিনারিও) আলোকে, বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে এর কী প্রভাব পড়বে, তা বিশ্লেষণ করছেন। তাদের বক্তব্যের সারকথা, এসব দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরে তলিয়ে যাবে।

তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের ওপর একই ধরনের প্রভাব পড়বে বলে যারা মনে করেন, তারা বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরলীকরণের চেষ্টা করছেন। বাস্তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে, মালদ্বীপের ওই পরিমাণ উঁচু ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কিছু না-ও ঘটতে পারে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. খান লিখেছেন, মালদ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১২ শ’ ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে, যেগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার ফুটেরও কম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে তা মোকাবেলায় এসব দ্বীপে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে, তলিয়ে যাওয়াই হতে পারে এর অবধারিত পরিণতি।

অন্য দিকে বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। হিমালয় পর্বতমালা থেকে সৃষ্ট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিলনস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ। এ দেশের নব্বই ভাগ ভূমি সৃষ্টি হয়েছে প্রমত্তা এই নদীগুলোর বয়ে আনা পলি দ্বারা। এ কারণেই উপকূলবর্তী এলাকায় ভূমির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি। এশিয়ার বৃহত্তম এই নদীগুলো প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পলি বয়ে নেয় সাগরে, যার কিছু অংশ প্লাবনের সময় ভূপৃষ্ঠের ওপর জমা পড়ে।

এ প্রক্রিয়ায় এক দিকে অতি ধীরে ধীরে বাড়ছে ভূমির উচ্চতা, অন্য দিকে সাগরের তলদেশে রচিত হচ্ছে নতুন ভূখণ্ডের ভিত। প্রাকৃতিকভাবে এখানে ভূমি গঠনের এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা এখনো ক্রিয়াশীল। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে, এ প্রক্রিয়ায়ই তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও তা ঘটবে অতি ধীরে, বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার হারে। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা তিনটি সম্ভাব্য চিত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন ড. খান।

তার মতে ভূমি রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না নিলেঃ এ পরিস্থিতিতে হাইড্রো-জিওলোজিক প্রক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবে কার্যকর থাকবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বর্ষা মৌসুমে প্লাবনের মাত্রা ও সংখ্যা উভয়ই বেড়ে যাবে। এতে পলি জমে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির হার বাড়বে। অর্থাৎ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভূমির উচ্চতাও বাড়তে থাকবে। ফলে, ভূমি তলিয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা, তা না-ও ঘটতে পারে। সমস্যা যা হবে তা হলো, ঘন ঘন বন্যায় সম্পদ ও কৃষির ক্ষয়ক্ষতিসহ সাধারণ ভোগান্তি বেড়ে যাবে।

সাগরকে রুখতে উপকূলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেঃ হাইড্রো-জিওলোজির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর যেকোনো অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে থাকে। অতীতে এভাবেই অনেক অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। উল্লেখ্য, সাগর থেকে পানি এসে নয় বরং নিষ্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায়, বৃষ্টি বা নদীর পানি জমেই সৃষ্টি হয়েছে এসব জলাবদ্ধতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতা আরো বাড়িয়ে দেবে। ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ব্যবস্থা নিলেঃ পরিকল্পিতভাবে ভূমি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় ভূমির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

এ ধরনের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হবে, নদীগুলো যে পলি সাগরে বয়ে নেয়, তার আরো বেশি অংশ ভূমিতে নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ছোট ছোট নদী, খাল ইত্যাদির সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো নদীর পলিসমৃদ্ধ পানি স্থলভাগে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পানির স্বাভাবিক নিষ্কাশনের নিশ্চয়তাসহ এটি হবে অনেকটা বন্যাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার মতো ব্যবস্থা। এভাবে বন্যা শেষে জমাকৃত পলি ভূমির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। উপকূল এলাকাকে অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত করে, সুবিধামতো এক বা একাধিক অংশে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারে।

কয়েক বছরের মধ্যে এটি উন্নত হলে, অন্য এলাকা এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। তার মতে, দু’টি বিষয় এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা দেবেঃ (ক) বাঁধ নির্মাণ ও নদী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। (খ) নিয়ন্ত্রিতভাবে ভূমি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি। ড. খান লিখেছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে, বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে কি যাবে না, সেটা নির্ভর করবে এ দেশের মানুষ তার ভূমি সম্পদ সংরক্ষণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তার ওপর। কিছুই না করা হলে, প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্ট ভূখণ্ডকে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নেবে।

সাগরকে ঠেকিয়ে রাখতে ভুল পদ্ধতিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে, তা ভূমির তলিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। ‘ভূমি-নদী-পানির সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গড়ে তুললে, ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।