আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যানুভূতি (খসড়া)

কোন একদিন.. এদেশের আকাশে... কালেমার পতাকা দুলবে, সেদিন সবাই ... খোদায়ী বিধান পেয়ে দু:খ বেদনা ভুলবে..

দৃশ্য এক (‌১৭ই অক্টোবর, বিকাল ৪ টা) রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। পিঠে ব্যাগ আর হাতে বালতি, বালতিতে একটা মগ। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে দুএকটা সি এন জি অটোরিক্সার দেখা মিললেও কোন এক অজানা কারনে একজনও আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে রাজী হচ্ছে না। বোধহয় বাসেই যেতে হবে। আরো ক্ষানিকটা হাটলাম।

বাস কাউন্টারে পৌছতে না পৌছতেই বাস হাজির। ভেবেছিলাম ভীড় হবে, না খালিই। হাতে বালতি, তাই অন্যদের বিরক্ত না করার ইচ্ছেতে একদম পিছনে গিয়ে বসলাম। দৃশ্য দুই (১৭ই অক্টোবর, বিকাল ৫টা ১৫মিনিট) শুরুতে বাসটা খালি থাকলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। ছোট্ট মিনিবাসে ছোটখাট একটা জনসমাবেশ।

কেউ বসে আছে আমার মত, কেউ সোজা দাঁড়িয়ে আছে। আবার কেউ ঈদের কাস্তে মার্কা চাঁদের মত করে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছে। হতভাগা কেউ কেউ গেটের রড ধরে ঝুলছে। আমার সামনে ছোটখাট একটা বিপদ। টেনশন ফ্রি থাকা স্বভাবের আমি আর টেনশন না করে পারলাম না।

কি করা যায়! এতগুলো মানুষকে গুতিয়ে বেরুব কি করে? বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। পিঠে ব্যাগ আর মাথায় বালতি, বালতির ভিতরে মগ, সামনে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করা মানুষের ছোট একটা জটলা। 'অপারেশন ঠেলা দিয়ে সামনে এগোনো' শুরু করলাম। লোকজনের বকাঝকা আর চোখ রাঙানী এড়িয়ে এগোতে থাকলাম। প্রতি মিনিটে একজনকে ক্রস করছিলাম।

দরজার কাছাকাছি এসে গতি আরো পড়ে গেল। সামনেও যেতে পারছিনা, পেছনেও না। বালতি উঁচিয়ে ধরা হাতখানিও আরেকজনের মাথার সাথে পেঁচিয়ে গেছে। কোনমতে ছাড়ালাম, ভদ্রতা দুরে রেখে ঠেলেঠুলে একটু জায়গা করে নিলাম। বালতিটা দরজার বাইরে চালান করে দিয়ে নিজের দেহটাকেও শুন্যে ছেড়ে দিলাম।

বাসটা আমার জন্য থামে নি। তবে গতি খুব বেশি ছিলনা, যার ফলে তাল সামলাতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি, ক্ষানিকটা দৌড়ুতে হল শুধু। দৃশ্য ৩ (১৭ই অক্টোবর, বিকাল ৫টা ৩০ মিনিট) শমরিতা হাসপাতালের লিফটে দাঁড়িয়ে আছি। খুব সুখে নেই, লিফট সাত তলায় এসে আঁটকে গেছে। বিদ্যুত সরবরাহ ঠিকই আছে, সাত তলাতেই আমার নামার কথা ছিল, দরজা খুলতে গিয়ে আটকে গেছে।

লিফটে কোন ইন্টারকম ফোন সেট নেই। জরুরি অবস্থার জন্য যে এলার্মটি রয়েছে তাও অনেক টিপেটুপে কাজ হলনা। লিফটে উঠলে আমার এমনিতেই কেমন কেমন করে, তারওপর অবস্থা বেগতিক। বুকের ধড়ফড় রীতিমত পুরো শরীর নাড়াচ্ছে। লিফটে উঠার সময়ই আমার কেমন শংকা লেগেছিল, কেন লেগেছিল জানিনা।

গার্ডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এ লিফটে সাত তলায় উঠা যায়তো?” সেও বাঁকা করে জবাব দিল, “লিফটেই তো মানুষ সাত তলায় যায়, নাকি!” সন্দেহ নিয়েই লিফটে চড়লাম আর এই ফ্যাসাদে পড়লাম। ভাগ্য ক্ষানিকটা ভালর দিকে এগোল। দরজার সামান্য ফুটো দিয়ে সাততলার একজন ওয়ার্ডবয়ের সাথে যোগাযোগ করা গেল। সে লিফটে কন্ট্রোলরুমের সাথে যোগাযোগ করল। কন্ট্রোলরুম থেকে লিফটের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দিল।

আবার বিদ্যুত দেয়া হল, লিফট অযথাই উপরে নিচে উঠা নামা করল কিছুক্ষন এরপর আবার সাততলায় এসে আটকে গেল লিফট। আবার কন্ট্রোলরুম, বিদ্যুত বন্ধ, বিদ্যুত এল, লিফট উপরে উঠল, নিচে নামল। এবার তাড়াহুড়ো করে পাঁচতলার সুইচ টিপে দিলাম। পাঁচতলায় সহিহ সালামতে নেমে এলাম। হেঁটেই বাকি দুতলা পাড়ি দিলাম।

দৃশ্য চার (১৭ই অক্টোবর, বিকাল ৬টা) শমরিতা হাসপাতালের সাততলার মহিলা ওয়ার্ডের দরজার পাশের একটা বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। পাশে ছোট মামা আর মেজ মামা। সামনে নানু শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। গলা পর্যন্ত শাদা চাদরে ঢাকা শরীর।

নানুর নাকে অক্সিজেনের পাইপ লাগানো। উনার নি:শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমার পাশেই নানুর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছোট মামা আর মেজ মামা। সিটি স্ক্যানের রিপোর্টটায় চোখ বুলালাম, দেখে কিছু বুঝলামনা। বুঝার কথাওনা।

আশা করলাম দ্রুত রোগমুক্তি ঘটবে। দৃশ্য পাঁচ (১৮ই অক্টোবর, ভোর ৬টা ৩০ মিনিট) ফজরের নামাজ পড়ে বেরুলাম। ঘরে পড়ার টেবিলের দিকে ছোটার পরিবর্তে ছুটছি এক বন্ধুর বাসার দিকে। আজ সকালে টেলিকমিউনিকেশন পরীক্ষা। আমার নোট ঐ বন্ধুর কাছে।

গতকাল পাওয়ার কথা থাকলেও পাইনি। তাইই সকালের এই সফর। ওর বাসায় গেলাম, ও গেছে মসজিদে। মসজিদে গেলাম, গিয়ে দেখি ও সেখানেও নেই। ফোন এল ওর, ও এখন ওর বাসায়।

গেলাম আবার সেখানে। ওর পড়ার টেবিলে বসলাম ওকে সাহায্য করার জন্যে, ওর প্রস্তুতি নাকি ভাল ছিলনা। কিছুক্ষন পর ও রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘুমাতে গেল। আমিও বাসার দিকে ছুট দিলাম। বাসার অবস্থা অন্যরকম।

মা সহ সবাইই খুব সকালেই হাসপাতালে চলে গেছে নানুকে দেখতে। স্বভাবতই সকালের নাস্তাটা জমলনা। দৃশ্য ছয় (১৮ই অক্টোবর, সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট) পরীক্ষার হলে ঢুকেছি নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পরে। দেরী হওয়ার বিশেষ একটা কারন আছে। আসার আগে পরীক্ষা দিতে আসার প্রস্তুতির সাথে সাথে গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছি।

মা ও আর সবাই নানুকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। রিকশা পাইনি, দৌড়ে এসেছি পরীক্ষা দিতে, সারা দেহ ঘর্মাক্ত। মুখভাবে কোন নতুনত্ব নেই। জামাকাপড় সব সময়কার মতই উস্কোখুস্কো। পরীক্ষার খাতা নিলাম, কলম বের করে লেখা শুরু করলাম।

হাত সামন্যতমও কাঁপল না। লেখার গতিও অন্যান্য সময়ের চেয়ে ক্ষানিকটা বেশি। কোন সমীকরনে সমস্যা হলনা। 'লাস্ট কল ক্লিয়ার্ড' এ প্রস্তুতি খুব ভাল ছিলনা, তবু কোথাও আটকালনা। সমীকরন মিলে গেল।

সবার আগে আমিই খাতা জমা দিলাম। দেড় ঘন্টার পরীক্ষা, ১৫ মিনিট আগেই বেরিয়ে গেলাম। দৃশ্য সাত (১৮ই অক্টোবর, দুপুর ১টা) তাড়াতাড়ি পৌছানোর জন্য একটু বেশি ভাড়া দিয়ে এসি গাড়িতে উঠেছি। বাসের ভেতরটা প্রচন্ড ঠান্ডা, আর বাসের ড্রাইভারের মাথাও। দামী গাড়ি বলেই হয়তো চালক একটু দেখেশুনে গাড়ি চালাচ্ছে।

আগেই পৌছানো তুহিন বারবার ফোন করে বলছে, “ভাইয়া, একটু তাড়াতাড়ি এস। ” আমার একটাই জবাব, “গাড়িতো ভাইয়া আমি ড্রাইভ করছিনা, কি করে একটু দ্রুত আসব!” ঢাকা থেকে বেরুতে গিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক যানজটে পড়তে হয়েছে এমনিতেই, তারওপর চালক সাহেব চলতিপথে গাড়িটা তিনবার থামিয়েছেন। দ্বিতীয়বারের ব্রেকে দুরাকাত জোহরের কসর নামাজ আদায় করলাম। নামাজের আগে অনেক সময় ধরে অযু করলাম। ক্ষানিকক্ষন বাসের পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

কিন্তু বাস ছাড়ার কোন ইংগিত নেই। আমার চেহারায়ও তাড়াহুড়োর ছাপ নেই, কিন্তু দেহের ভেতরের স্বত্ত্বা দেরী সহ্য না করে উড়ে গন্তব্যে চলে যেতে চাইছে। বাস চলতে শুরু করার পর কিছুক্ষনের মধ্যে গ্যাস নেয়ার জন্য তৃতীয়বারের মত থামল। আবার চলতে শুরু করার পর সামনে ট্রেনের সিগনাল দেখতে পাওয়া গেল। ট্রেন যাওয়ার পর আবার বাস আবার চলল, বাস চালক হয়তো আমার গ্রামে যাওয়ার কারন ফোনে কথা বলার শব্দ শুনে ইতিমধ্যে ধারনা করে নিয়েছে।

যার ফলে গাড়ির গতি একটু বাড়ল বলে মনে হল। মহীপাল নামক যায়গায় গাড়িটা থেমে আমাকে নামিয়ে দেবার কথা। গন্তব্যে পৌছুবার ক্ষানিক আগেই আমি দরজার পাশে এসে প্রস্তুত, গাড়ি পুরোপুরি থামার আগেই লাফ দিলাম, দৌড়ে গেলাম একটা সিএনজি অটোরিক্সার কাছে, ক্ষানিকটা বেশি ভাড়াতেই চড়ে বসলাম। দৃশ্য আট (১৮ই অক্টোবর, দুপুর ৪টা) গ্রামে পৌছলাম। নানুর কাছে গেলাম।

নানুর চেহারা কিংবা দেহ কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। তবে বুঝতে পারছিলাম যে, সামনেই নানু শুয়ে আছেন। দেহে একটা সদ্য কাদামাখানো শাদা চাদরের আগাগোড়া মোড়ানো। পাশে ছোট মামা, মেজ মামা, বড় মামা আর ছোট খালুজান নানুর দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছেন। উনারাও নানুকে দেখতে পাচ্ছেননা আর।

কিছুক্ষন আগেও অবশ্য তাঁরা তাঁকে দেখেছেন। অতি যত্নে মাটির বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। আর আমার পৌছানোর আগেই মাটি দিয়ে দেহটা ঢেকে দিয়েছেন। উঁচু মাটির উপর একটা প্লাস্টিকের চাদরও বসিয়ে দিয়েছেন। নানুর সবসময়কার নরম বিছানার পরিবর্তে এখন থেকে চিরদিনের জন্য তাঁর বিছানা নির্ধারিত হয়েছে মাটি।

তাঁর বিছানা হতে মেটে পোকা বেরিয়ে আসতে দেখলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই আল্লাহর দরবারে হাত তুলে সাহায্য চাইলাম আমার অতি প্রিয় চিরদিনের জন্য শায়িত এই মানুষটির জন্য। কবরস্থান হতে বেরুলাম, কি ভেবে যেন একটু পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। দেখলাম নানা, আর নানুর কবরের মাঝে ও পাশে তাঁদের প্রিয় সন্তান সেলিম মামা আর টিপু মামা কবরে শুয়ে আছেন। মাটির নিচে আরেকটা পরিবার।

ধীরে ধীরে নিচের এই পরিবারের লোকসংখ্যা বাড়বে আর উপরে কমতে থাকবে, আর পাশাপাশি নতুনের কেতন উড়বে। এভাবেই নতুনেরা পুরাতন হবে আর পুরাতনেরা জায়গা নেবে মাটির নিচের দুনিয়ায়। নানু বাড়িতে এলাম। কই কোন কষ্ট লাগছেনা তো, আসছে কোন জোর কান্না। হয়তো দুএক ফোঁটা পানি চোখ থেকে এমনিতেই বেরিয়েছে।

ধমক দিয়ে মা-খালাদের কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। কেউ থামল, কেউ থামলনা। আমি যেন কেমন, একটুও কাঁদলামনা! কেন কাঁদব তাও বুঝতে পারছিনা। কেন যেন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি নানু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন। বেরিয়ে এসেই তাঁর মুরগী আর হাঁসগুলোর খবর নেবেন, খাবার দেবেন।

শুক্কুর আলীকে গরুগুলোর খাবার দেবার তাগিদ দেবেন। আমাদেরকে চা খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করবেন। আসলে তিনি কখনোই আর আমাদের ডাকবেননা। আর কখনোই আমাদেরকে রাতে ভাত বেড়ে খাওয়াবেননা। সকাল না হতেই রান্নাঘরের চুলোয় আগুন জ্বালাবেননা।

ছোটবেলায় নানাবাড়িই ছিল আমার সবচে পছন্দের স্থান। হয়তো এখন অনেক ব্যস্ত, কিন্তু প্রিয় স্থান ঐ নানা বাড়িই রয়ে গেছে। নানা মারা গেছেন প্রায় চার বছর হলো। নানুও চলে গেলেন। হয়তো আর নানাবাড়ি যাওয়া হবেনা।

এবারের রমজানের ঈদের পরের দিনও নানুকে দেখতে নানাবাড়ি গিয়েছিলাম। অল্প সময়ের জন্যে হলেও গিয়েছি। নানাবাড়ির এলাকায় ঐ কবরস্থানটার প্রতি ছিল আমার সবচে বেশি ভয়। বাঁশ ঝাড়ে ঘেরা ঐ জায়াগাটায় দিনের বেলায়ও আমি একলা যেতামনা, রাতেতো কথাই নেই। অথচ বাজার হতে নানাবাড়ি আসতে এখান দিয়েই আসতে হতো।

এখন এই জায়গাটা আর খুব বেশি ভয়ের নেই। কবরস্থানের ঐখানটাতে এখন চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন আমার সবচে প্রিয় মানুষ, আমার সেলিম মামা। তাঁকে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে সেখানে তার দাদা-দাদীর সাথে একদিন শুইয়ে দিয়ে এসেছিলাম। এরপর একে একে তাঁর পাশে শুইয়ে দিয়েছি আমার নানাকে, এরপর এবার আমার নানুকেও রেখে এলাম। এখন আর ওখানে আমার ভয় কিসের? মাঝে মাঝে ভাবি যেন, এখানেই আমারও চিরশয়নের ব্যবস্থা করা হয়।

তাহলে আমার সবচে প্রিয় গ্রামে আমি কেয়ামত পর্যন্ত থাকতে পারব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.