আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোদীর তুলোখেতে নীরবে মরছে খুদে পিয়ারিরা



মোদীর তুলোখেতে নীরবে মরছে খুদে পিয়ারিরা খাদু রামের মনঃসংযোগ দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়! একমনে পাটের দড়ি পায়ে চেপে ধরে তাতে পাক লাগিয়ে চলেছেন বছর পঁয়তাল্লিশের খাদু। কিন্তু সেই পাকানো দড়ি যে আসলে নিজের গলারই ফাঁস, তা কী কেউ জানতেন! না, জানা সম্ভব নয়। এবং যখনই খাদু সেই দড়ি নিজের গলায় পরিয়ে জোরে টান দিতে গেলেন, তখনই কাছে বসে থাকা জনৈক প্রতিবেশীর ক্ষিপ্রতায় গেলো ভেস্তে। বেঁচে গলো একটা প্রাণ। খাদু রাম।

রাজস্থানের ভিল সম্প্রদায়ের এক হতদরিদ্রের নাম যারর কীনা ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কেন্দ্রীয় সরকারের রেগা প্রকল্পে নাম লিখিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও পরিবারকে দু’বেলা খাবার জুটাতে চরম ব্যর্থ এক মানুষের নাম খাদু রাম! ছেলেমেয়ে, বউ সমেত পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা সাত। পেটের ভাত যোগাতে নিজের ১৪ বছরের মেয়ে নিরুভাকে পাঠাতে হয়েছে গুজরাটে। শুরু হয়ে গেলো আরো একটা গল্প! দক্ষিণ রাজস্থান মজদুর ইউনিয়ন নামক একটি বে-সরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদন বললে ভুল হবে, বলা ভালো সেখানে একেবারে অঙ্ক মিলিয়ে বলা হয়েছে পেটের ভাত যোগাতে কীভাবে রাজস্থানের বানসোয়ারা, দুঙ্গারপুর এবং উদয়পুর জেলা থেকে প্রতি মাসে এই পিছড়ে বর্গের লোকজন চলে যায় গুজরাটে।

বছরশেষে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ (যার আবার একটা বড় অংশ কীনা শিশু শ্রমিক আর ১৪ বছরের নিচে সেই শিশু শ্রমিকের মাত্রা প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ)! এদের কাজ গুজরাটের তুলোর খেত এবং পাটের খেতে। এবার ফেরা যাক নিরুভা প্রসঙ্গে। ১৪ বছরের নিরুভার প্রতিদিনের কাজের রুটিন বড় দুর্বোধ্য। কোন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এভাবেও যে দিন গুজরান করা সম্ভব তা কল্পনাও করতে পারেন না অতি বড় বিজ্ঞের দল। সারাদিনে দশ থেকে বারো ঘন্টার কাজ।

দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটা থেকে। তুলোর ফল ছাড়িয়ে সেখান থেকে আঁশ বের করে তা রোদে শুকাতে দেওয়া। একটা ফুলও নষ্ট করা যাবে না, করলেই কাটা যাবে দিনের শেষে বেতন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে মজুরি দিনের শেষে ৬০ টাকা। ওই যে ‘মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট’ চালু হয়েছিলো স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরের বছরেই, সেটা এখনও মালিকপক্ষ মেনেই চলে! এমনই সব শিশু শ্রমিকদের থাকার জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের আস্তানা, সেখানেই আর বাকি সব শিশুশ্রমিকদের সঙ্গেই কোনক্রমে মাথা গুঁজে রাত কাটানো।

আর যদি এই অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে অসুস্থতার জন্ম হয়, তাহলে? না, কেউ সেভাবে দেখার নেই। নেই চিকিৎসার ন্যুনতম ব্যবস্থা এবং কোনক্রম কারোর যদি অকালমৃত্যুও ঘটে থাকে তবে ‘কোম্পানি দায়ী নহে’! নিরুভা অসুস্থ হয়েছিলো কিন্তু মৃত্যু হয়নি যা কীনা হয়েছে তারই ভাগ্নী পিয়ারির,যার বয়সও ছিলো চোদ্দ! এভাবে নিজের চোখে কি দেখা যায় চোদ্দ বছরের নিজের মেয়ের চরম, কঠিন যন্ত্রণার ছবি? তাই গলায় দড়ি পরে নিজেকে শেষ করে ফেলার নিস্ফল প্রচেষ্টার পর খাদু রামের স্বগতোক্তি,‘আমরা তো মানুষই নই। তাহলে আর বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে ফারাক কী রয়েছে!’ পিয়ারি কারাদি এই নিয়ে তৃতীয়বার গেছিলো গুজরাটে। এবং সেটাই শেষ যাত্রা! উদয়পুর জেলা থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে এক পাহাড়ী অঞ্চলে পিয়ারির বাবা কামজী কাদারি কাজ করেন কাঠের। পাহাড়ী অঞ্চলে কাঠের কাজ করে যে কতো পয়সা উপার্জন করা যায় তা বোধহয় না বললেও চলে।

কিন্তু পিয়ারির বছরশেষে উপার্জন করে আনা হাজার দুয়েক টাকাই যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে দিতো গোটা পরিবারে। পিয়ারি এবার বেশি কিন্তু রোজগার করতে পারেনি, উপরন্তু প্রচণ্ড জ্বর এবং পেটের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে গ্রামে ফিরেই ফেললো শেষ নিঃশ্বাস। বাবা-মা চেয়েছিলেন একটা ‘পোস্ট মর্টেম’ হোক, কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা। চিকিৎসক সাফ জানিয়ে দেন, শরীরের কিছু অংশে পচন ধরেছে এতো বিশ্রীভাবে যে সেখানে আর কাটাছেঁড়া করা বাতুলতা! দক্ষিণ রাজস্থান মজদুর ইউনিয়ন জানাচ্ছে, পিয়ারির মতো ন’জন শিশু শ্রমিকের এবার অকালমৃত্যু ঘটেছে শুধু দু’মুঠো ভাত যোগাড় করতে গিয়ে। তুলোর খেতে কাজ করতে গেলে ফুসফুসে সংক্রমণ এক অতি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তাই বলে প্রাথমিক একটা চিকিৎসার আয়োজন থাকবে না, সেই যুক্তি কি কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে? যেটুকু জানা এবং বোঝা গেছে, ফুসফুসে সংক্রমণ থেকে উৎপত্তি টিবির, তার থেকে প্রবল জ্বর এবং অবশেষে বিনা চিকিৎসায় অকালমৃত্যু।

তুলো উৎপাদন এবং তুলোজাত সামগ্রী রিবেশনে গুজরাট সারা দেশে এক নম্বরে। কটন কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট তুলো উৎপাদনের ৩৫ শতাংশই আসে গুজরাট থেকে। আর সেই কাজে ছোট শিশুরাই প্রথম পছন্দ সংস্থাগুলির। তাদের ব্যাখ্যাও অতি সহজ, সরল। ছোট ছোট শিশুদের আঙুল এতো নরম হয়ে থাকে যা কীনা অতি সুক্ষভাবে তুলোর আঁশ বের করে আনতে পারে অপচয় ছাড়াই।

বয়স যতো বাড়ে, হাতের আঙুলের আকার এবং জোরের ফারাক অধিকাংশ ক্ষেত্রে নষ্ট করে দেয় তুলো ফল। আর ছোট শিশুদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে পড়তে হয় না কোন সমস্যায়। যাই দাও না কেন, মুখ বুঁজে হাত পেতে সেটাই নিয়ে খুশি! বড় হলেই হরেক ঝক্কি। হাজারো বায়নাক্কা। তাই অভিবাসী শ্রমিক পাঠালে প্রথম পছন্দ এই শিশু শ্রমিক।

আর সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই সাপে কাটলো ১৪ বছরের হাজুর। কাজ করছিলো খেতে। প্রতিদিনই তুলো গাছ থেকে সাবধানে ফল তুলে এনে তার আঁশ বের করে এনে রোদে দেওয়া। এভাবেই কোন এক সকালে খেতে তুলো তুলতে গিয়ে বিষাক্ত সাপের এক ছোবল সব শেষ। বাবা পুঞ্জিলাল আহারিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয়েছিলো দেড় লক্ষ টাকা, তারপর ফের নতুন শ্রমিকের সন্ধানে নেমে পড়ে ‘কোম্পানি’! ২০০৭ সালে দক্ষিণ রাজস্থান মজদুর ইউনিয়ন এই নির্মম ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নেমেছিলো পথে এবং তার জেরে মোদী সরকার সবকিছু চাপা দিতে নিয়োগ করেছিলো ১৩টি বিশেষ দল যারা কীনা খতিয়ে দেখবে সবকিছু।

তাতে লাভ সামান্য হয়েছে, অন্তত কোন শিশু শ্রমিককে আর অকালমৃত্যুর কোপে পড়তে হচ্ছে না বা পড়লেও তার পরিমাণ কম কিন্তু প্রক্রিয়া তো থেমে নেই। চাইল্ড লেবার প্রহিবিশন অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট তো মেনে চলার দরকারই মনে করছে না গুজরাট সরকার। সরকারীভাবে সেই শিশুশ্রম রদ করার উদ্যোগই নেই। ওই কয়েকটি বিশেষ কমিটি গড়েই সব শেষ! খাদু রামদের স্বস্তি কোথায় রইলো? অথবা চোদ্দ বছরের নিরুভা? ওরা কি করবে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.