আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কট্টরপন্থী পাঠক

এডিট করুন

এক সময় প্রচুর বই পড়তাম। প্রতিদিন একটা নতুন বই না পড়লে পেটের ভাত হজম হইত না। ক্লাসের বই এক পাশে ফালাইয়া রাখতাম। ঐগুলারে ছোটখাট জিনিস মনে করতাম। ভাবতাম আমি এক বিশাল প্রতিভাবান।

বেশি বয়স না তখন। ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। সারাদিন বাসায় বিছানায় শুইয়া শুইয়া বই পড়ি। আর কোন খবর নাই আমার। খাওয়ার জন্য ডাকলে যাই না, ঘুমানির ঠিক ঠিকনা নাই।

সারাদিন শুধু বই আর বই। কিছুদিন পর পর বাবা পল্টন থিকা এক গাট্টি বই কিনা আনে আর আমি সেইগুলা নিয়া ব্যাস্ত হইয়া পড়ি। পড়া শেষ হইলে আবার তাগাদা লাগাই বাবারে বইয়ের জন্য। কোনদিন একটা বই না পড়তে পারলে এলার্জী উইঠা যায় শরীরে। সাহিত্য, ইতিহাস, আরবী না জানায় কোরান-হাদীসের বাংলা অনুবাদ, বিজ্ঞান যা পাই তাই গিলি।

শিশু সাহিত্য থিকা শুরু হইরা ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম হইয়া বুখারীর বাংলা অনুবাদ, পদার্থবিজ্ঞান সবাই পড়ো সব কিছুতেই আমার সমান রুচি। আমার বাবাও খুশী যে ছেলে অনেক বই পড়তাছে। বাসায় বই রাখার জায়গা নাই। নতুন শেলফ বানাইতাছে আব্বা কাঠমিস্ত্রি ডাকাইয়া। কাঠমিস্ত্রির সাথে কোন হেলপার নাই।

আমিই হেলপার। মোশারফ ভাই তখন আমাদের বাসার কাঠমিস্ত্রি। আমি আর মোশারফ ভাই মিলা রানদা মারি কাঠে। আমার মাথায় তখন খালি রামায়ন, মহাভারত ঘুরে। চিন্তা করি উপামহাদেশের ইতিহাস নিয়া।

মনে মনে ভাবি, আমি মোটামুটি একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি। ক্লাসের পড়ার ধারে কাছে নাই। আমার মা সারাদিন চিল্লাফাল্লা করেন। কতক্ষণ পরপর সব বইয়ে কেরোসিন ঢাইলা আগুন ধরাইয়া দেওয়ার ঘোষনা দেন। আমি কোন পাত্তা দেই না।

একদিন হাকলবেরী ফিন পড়তাছি। জটিল একটা বই। আমার মা খেইপা আমার ক্লাসের সবগুলি বই দুইতলা থিকা নীচে ফালাইয়া দিলেন। আমি যাইয়া বইগুলি কুড়াইয়া আইনা নিরাপদ এক জায়গায় জড়ো কইরা রাইখা আবার হাকলবেরী ফিন পড়তে বসলাম। কতক্ষণ পরে উনি আইসা আমার হাকলবেরী ফিন নীচে ফালাইয়া দিলেন।

আর কইলেন বাড়ী থেইকা বাইর হইয়া যা। তোর আর এই বাড়ীতে আসার দরকার নাই। আমি সুন্দর বাইর হইয়া হাকলবেরী নিয়া পাশের ফ্যাক্টরীর ছাদে রড ধইরা উইঠা ( কোন সিড়ি ছিল না, ছাদে উঠার জন্য, ছাদ থেকে কিছু রড ঝুইলা থাকত, ঐগুলা ধইরা বাইয়া বাইয়া উঠছিলাম ) হাকলবেরী পড়ায় মনোযোগ দিলাম। দিনের আলো শেষ, সন্ধ্যা হইয়া আসছে, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কষ্ট কইরা চাইয়া চাইয়া পড়তাছি।

ফ্যাক্টরীর ভিতরে একটা নারিকেল গাছ ছিল। প্রায় পঞ্চাশটা কাক সেই গাছে বইসা সমস্বরে কা কা কইরা চিল্লাইতেছে। মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। কিছু সুরকি ( ইটের টুকরা ) ছাদের উপরে ছিল। কতক্ষণ পর পর ঐগুলা দিয়া ঢিলাইয়ায় কাউয়া দূর করতাছি।

কিন্তু কতক্ষণ পর আবার আইসা কা কা লাগাইতাছে। পরে ভাবি, যা হারামীরা চিল্লাগা। আমার কি! আমি হাকলবেরীতে মনোযোগ দিলাম। শেষ যখন করছি তখন প্রায় অন্ধকার নাইমা আসছে। ভাবলাম পরিবেশটা বেশ সুন্দর।

একটা গান বানানো যাক। একটা গান নিজেই বানাইলাম, নিজেই সুর দিলাম, নিজেই গাইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাগো ফ্যাক্টরী থিকা বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া যাইতাছে। মানে বাবা বাড়ীতে আসছে। এতক্ষণ বাড়ী ছিলেন না।

আমি এইবার সাহস পাইলাম। আবার রড বাইয়া নামলাম। সাবধানে চলতে হয়। এই ফ্যাক্টরীটায় কোন লোক নাই। ঘন ঘাস হইয়া রইছে মাটিতে।

মাঝে মাঝে সাপ থাকে। কোনমতে দেওয়াল ডিঙ্গাইয়া আমাগোর ফ্যাক্টরীতে গেলাম। পরে আস্তে আস্তে আমার ঘরে গেলাম। যাইয়া দেখি আব্বা আরেক গাট্টি পল্টনের মাল নিয়া আইছে। এর মধ্যে দিলারা হাশিমের আমলকীর মৌ নামক একটা উপন্যাস ছিল, এখনো মনে পড়তাছে।

আমি ভাবিলাম, আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ কইরা দিয়া বসলাম কি কি বই আনছে দকখার জন্য। কারণ অতর্কিত আক্রমণ হইতে পারে যে কোন সময়। আবার বিছানায় শুইলাম বই নিয়া। কিছুক্ষণ পরে মা আইসা ঘরের দরজা ধাক্কা ধাক্কি করতে লাগল।

কইল দরজা ভাইঙ্গা ফালাইব না খুললে। আমি ভয়ে দরজা খুললাম। আম্মা মাইর দিল না, তবে বেশ কিছু অভিশাপ দিল। কইল, এই সন্ধ্যাবেলায় তোরে অভিশাপ দিতাছি, ............ ব্লা ব্লা ব্লা। কেডা গায়ে মাখায় এইসব।

তা এতসব বই পড়ার পর একটা রিএকশ্যান না হইলে কেমনে হয়। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ইতিহাস পইড়া আমার মাথায় আর বুকে তখন আগুন। চরম ঘৃণা ইংরেজদের প্রতি। আমি ইংরেজী পড়া ছাইড়া দিলাম।

আমার বুকে তখন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু। আমার তখন ইচ্ছা করে আবার যদি এই পুরা উপমহাদেশ এক হইয়া যাইত! আমি তখন বুঝছি যে ইংরেজ কতটা কূটনৈতিক। তারা বেশ বুদ্ধি কইরা ভাগ কইরা গেছে। যাতে সবসময় ঝগড়া বিবাদ লাইগাই থাকে। মমতাজ জাহান না কার একটা বই পরছিলাম , জাপানের ভ্রমণ কাহিনী।

উনি আসলে ছিলেন একজন বাঙ্গালী সৈনিক। ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষ নিয়া জাপানে গেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে বোমাক্রান্ত নগরী আর মানুষের একটা পরিষ্কার চিত্র আকা ছিল উনার লেখায়। আমার ঘৃণা আরো উগরাইয়া পড়ল এদের প্রতি। আমি ইংরেজী শিক্ষা বর্জন করলাম।

ক্লাসের ইংরেজী বইটারে টয়লেটের গুয়ের কুয়ার বিসর্জন দিলাম। বিসর্জন দেওয়ার সময় বললাম, গুয়ের কুয়াই তোর আসল জায়গা। ইংরেজী পরীক্ষা দেই বাধ্য হইয়া। বাপের মাইর তো আর খাইতে পারি না। ভাবলাম একেবারে বিপ্লবী হইয়া গেলে কেমন হয়।

কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবরা সব ভীতুর ডিম। একা একা বিপ্লব সম্ভব না। তাই বাদ দিলাম। তবে পুলাপানরে ভালই প্রভাবিত করছিলাম। আমার দুস্ত আশিক আবার ইংরেজীতে কবিতা লেখত।

ওরে এমন নসিহত করলাম যে পরেরদিন আইয়া কইল, দুস্ত সব কবিতা গতকাল রাইতে চুলার আগুনে দিছি। আমি কইলাম, শুধু এতে হইব না। শাস্তিস্বরুপ তুই যতগুলি ইংরেজী কবিতা লিখছিলি তার দ্বিগুন সংখ্যক বাংলা কবিতা লিখতে হইব। তবে বাপের মাইরের ডরে ইংরেজী পরীক্ষা বর্জন করতে পারি নাই। ঐটা ছিল আমাদের কৌশলগত আপোষ।

তবে অন্যদিক দিয়া পুষাইয়া দিছি। আমরা জানি পুলাপান বইপত্র পায়ে লাগলে সালাম করে, এইজাতীয় একটা আচার প্রচলিত আছে। আমরা ভাইবা দেখলাম, বই তো একটা বস্তুর বেশী কিছু না। একদলা কাগজ। এরে এত সম্মান করার কি আছে।

পরেরদিন আমাগো ক্লাসের পুলাপান সব স্কুলের মাঠে জড়ো করলাম। আশিক বীজগণিত বইটা মাটিতে রাখল। তারপর এ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিলাম আমরা। পরে আশিক বইটার উপরে জুতা সুদ্ধা পা রাইখা একটা ছাপ ফালাইল। পুলাপান অনেকেই কাইপা উঠছিল।

লাভের লাভ হইল, আশিক দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংকে খারাপ করল। ঐদিকে আমার অবস্থাও বেশী একটা ভাল না। আব্বা অবস্থা দেইখা আমারে বুঝাইলেন। আমি তর্ক আরম্ভ করলাম। আমারে গুতেনবার্গের চাচাতো ভাই উপাধি দিয়া উনি তর্ক থিকা বিদায় নিলেন।

পরে আব্বা আরেকজনরে নিয়া আইলেন আমারে বুঝানির লাইগা। আমার কোন বিকার নাই। উনি কইলেন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, নিউটন এরা আছিলেন ঈশ্বর প্রদত্ত। আমি কই নিউটন নিজেই তো কইয়া গেছে প্রতিভা বইলা কিছু নাই, সব পরিশ্রম। কথায় না পাইরা উনি আমারে দুনিয়াদারীতে টিকা থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং এর জন্য স্কুলের পড়াশোনা কতোটা জরুরী তা নিয়া কিছুক্ষণ নসিহত করলেন।

আমারে কিছুক্ষণ নসিহত কইরা বিদায় নিলেন। আমি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনী নিয়া আবার শুইয়া পড়লাম। পরে আরো লিখুমনে আমার পাগলামী, ছাগলামীর কাহিনী। আজকে এই পর্যন্তই।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।