আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে বুদ্ধজীবী ? --------শহিদুল ইসলাম (শেষ পর্ব)

মাঝে মাঝে মন নিয়ন্ত্রনহীন হতে চায়; কিন্তু...............

১ম পর্বঃ ২য় পর্বঃ ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব সাঈদের কাছে এ-চিত্র অত্যন- হতাশাব্যঞ্জক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, জ্যাকোবাই যা বলেন তা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তবে তার জন্য তিনি যেসব কারণের উল্লেখ করেছেন সেগুলো কি সত্যি ? আমরা কি তার জন্য আরো গ্রহণযোগ্য সুস্পষ্ট কোনো কারণের উল্লেখ করতে পারব? তাই সাঈদ এক্ষেত্রে জ্যাকোবাইয়ের সাথে সামান্য দ্বিমত পোষণ করেন এবং মনে করেন তার কথা পুরোপুরি সত্য নয়। তিনি ঊণবিংশ শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে কয়েকজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর দেখা পাওয়া যায়। যেমন, সার্ত্র, কাম্যু, অ্যারোন, সিমন ডি বুভ্যোয়া প্রমুখ।

বিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত পরিসি'তিতে বুদ্ধিজীবীর কাজ কেবল বিতর্ক সৃষ্টির মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বলে মনে করেন সাঈদ। যেমনটা বেনডা করেছেন। কিছুটা রাসেলও করেছেন। বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীর কাজ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমালোচনা ও মোহমুক্তির সাথে সাথে মিথ্যা পয়গম্বর ও প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মহাপুরুষদের চেহারা উন্মোচন করা আজকের বুদ্ধিজীবীর অন্যতম প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে।

পিটার নোভিকের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে সাঈদ বলেন যে, আজ কেবল বস'গত সত্য সম্পর্কে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঐকমত্য হারিয়ে যায় নি, হারিয়ে গেছে অনেক ঐতিহ্যবাহী কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে ঐকমত্য। এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কেও। সাঈদ বলেন যে, ইতিহাসবিদদের মতো একাডেমিক বুদ্ধিজীবীরা আজ সমাজে ভাষার ভূমিকা, ঐতিহ্যিক চিন-ার স'ায়িত্ব এবং ইতিহাস লেখার ধারাকে পুনর্বিন্যাস করে ফেলেছে। বুদ্ধিজীবীরা কোনো ঈশ্বর নন, তারা হার না মানা শক্তি, যে শক্তি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করে- মানব সমাজকে আলোকিত করার কাজে নিরলস লড়াইয়ের ময়দানে থাকেন। সাঈদের মতে, আজকের বুদ্ধিজীবীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ের কারণ পেশাদারিত্ব।

বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকে যারা জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা ৯টা-৫টা অফিস করেন; নিজেকে বিতর্কের ঊর্দ্ধে রাখেন এবং নিেেজকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেন এবং মনে করেন যে কেবল তারাই বস'গত সত্যের পুরোধা। সার্ত্রের মতে, বুদ্ধিজীবীরা সবকিছুর উর্দ্ধে দার্শনিকরাজা নন যে মানুষ তাদের পূজো করবে। বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। ফুকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীরা ভালো ও মন্দে বিভক্ত।

তারাই ভালো যারা সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। মানুষের মঙ্গল ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন। এদের বলা যায় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। আর মন্দ বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবিপ্লবী। তারা নুতন জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বিরোধিতা করেন।

মানুষের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে চান। তারা বর্তমান শোষণমূলক সমাজ-কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকে পরিচালিত করেন। এরা অসি'মজ্জায় প্রতিক্রিয়ার দূর্গ। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, আজকের বুদ্ধিজীবীকে প্রধানত চারটি চাপ সহ্য করতে হয়। এক. স্পেশালাইজেশান যা একজন বুদ্ধিজীবীর উত্তেজনা ও আবিষ্কারের স্পৃহাকে হত্যা করে।

অথচ উত্তেজনা ও নুতনের সন্ধান একজন বুদ্ধিজীবীর চিন-াচেতনাকে জাড়িয়ে থাকে। দুই. বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান, এক্সপার্টিজ- অ্যাকাডেমিক এবং নন-একাডেমিক। একজন এক্সপার্ট না হয়েও চমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর যা লিখেছেন, অফিসিয়াল মার্কমারা এক্সপার্টরা তা পারেন নি। তিন. কেন্দ্রীভূত শক্তি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা বুদ্ধিজীবীদের ভাগ করে নিয়েছে।

তাছাড়া সেদেশের রকফেলার, ফোর্ডস ও মেলনেরা গবেষণার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। তার একটি প্রজেক্ট পেলেই একজন বুদ্ধিজীবী লাখ ডলারের মালিক বনে যান। তাই প্রফেশনালিজম বা পেশাদারিত্ব বলতে যা বোঝায় তাকেই সাঈদ একজন বুদ্ধিজীবীর জন্য মারাত্মক ভয়ের কারণ বলে শনাক্ত করেন। সে-কথা আগেই বলেছি। তাই সাঈদ বলেন, গত দুবছরে প্রচার-মাধ্যম আমাকে বেশ কয়েকবার পেশাদার (অর্থের বিনিময়ে) উপদেষ্টা নিয়োগের প্রসত্মাব দিয়েছিল।

আমি বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ খুবই সোজা। তা আমাকে কেবল একটি টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের মধ্যে বন্দী রাখত। তাছাড়া তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ভাষার মধ্যে আমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হত। একইভাবে সরকারি কোন কনসালট্যান্সিতে আমার কখনই কোন আগ্রহ ছিল না।

কেননা আমি জানি না সেখানে আমার মতানুসারে আমি কতটা কাজ করতে পারতাম। দ্বিতীয়ত, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বক্তৃতা করার বিষয়েও আমি ভীষণ দ্বিধান্বিত ছিলাম। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক বক্তৃতা দেবার আহ্বান জানালে আমি সবসময়ে স্বাগত জানাই, কিন' অফিসিয়ালদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সামনে আমাকে বক্তৃতা দিতে ডাকলে আমি সবসময়ে তা প্রত্যাখ্যান করি। তৃতীয়ত, যখনই কোন প্যালেস্টাইন গ্রুপ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সাহায্য ও বক্তৃতা দিতে ডাকে, আমি সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করি এবং সেখানে আমি বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে এবং একাডেমিক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলি। সেখানে আমি আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস ব্যক্ত করতে পারি।

যে সমসত্ম মূল্যবোধও আদর্শে আমি বিশ্বাসী সেইসব মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে মিলে যায় যেসব কাজ ও আদর্শ আমি সেগুলোকেই সমর্থন করার জন্য বাছাই করি। আমার পেশার ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে আমি বাধ্য মনে করি না। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মনোভাবকে সাঈদ সবচেয়ে নিন্দনীয় ব্যাপার বলে মনে করেন। এর ফলে একজন বুদ্ধিজীবী যে-কোনো সংকটাপন্ন অবস'া ও নিজের তাত্ত্বিক অবস'ান থেকে দূরে সরে থাকেন। যদিও তিনি সে-অবস'ানকে সত্যি বলে মনে করেন।

এরা সমাজ ও দেশের কাছে নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে তুলে ধরতে পছন্দ করেন, যদিও তারা তা নন। এরা বিতর্কিত হওয়া থেকে সভয়ে দূরে সরে থাকতে চান। এরা মুনিব বা কর্র্তৃপক্ষের সুনজরে থাকতে পছন্দ করেন। তারা পক্ষপাতহীন একটি অবস'ানে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে চান। তারা নিজেকে বাসত্মববাদী ও মধ্যপন'ী বলে দাবি করেন।

তারা সবসময়ে মনে মনে আশা পোষণ করেন যে একদিন শক্তিমান কর্তৃপক্ষ তাদের ডাকবেন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এভাবে তারা ক্ষমতাবান প্রধান ধারার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পছন্দ করেন। ফলে এরা আশা করেন একদিন তাদের কপালে শিকে ছিঁড়তেও পারে। জুটে যেতে পারে কোন সম্মান, ডিগ্রি, বিরাট কোন পুরষ্কার এমনকি কূটনৈতিক পদ। এ-ধরণের মনোভাব একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে দুর্নীতিগ্রসত্ম হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

সাঈদ মনে করেন যে, এ-ধরণের মনোভাব একজন বুদ্ধিজীবীর চরিত্রহননে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন একজন বুদ্ধিজীবীর জন্য মনের এই স্বভাবগুলো চূড়ান-ভাবে ধ্বংসাত্মক। একজন প্রাণাবেগ সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীকে যদি কোন কিছু কৃত্রিম, বৈশিষ্ট্যহীন এবং শেষ পর্যন- নিথর করে তুলতে পারে তবে তা হলো এই স্বভাবগুলোর আন-র্জাতিকীকরণ। সহায়ক গ্রন' : ১. শহিদুল ইসলাম। প্রসঙ্গ: শিক্ষা ॥ শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০২।

২. বিনয় ঘোষ। বাংলার বিদ্বৎসমাজ ॥ ৪র্থ সংস্করণ, প্রকাশভবন, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০০। ৩. এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ। রিপ্রেজেন্টেশন অব ইন্টেলেকচুয়ালস ॥ প্রথম ভিনটেজ বুকস সংস্করণ, ১৯৯৬। শুধু পাশ করলেই, শুধু ডিগ্রি অর্জন করলেই শিক্ষিত বলে? যে শিক্ষা মানুষকে সাহস দেয় না, তেজ দেয় না, বীর্য দেয় না- সে আবার কিসের শিক্ষা? যতদিন দেশের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে ও অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে ততদিন তাদের চোখের জল আর রক্তের বিনিময়ে যারা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করল তারা যদি এই দারিদ্র নিপীড়িত মানুষের প্রতি দায়িত্বের কথা ভাববার একমুহূর্তও সময় না পায় আমি বলব তারা বিশ্বাসঘাতক, আমি বলব তারা দেশদ্রোহী।

-স্বামী বিবেকানন্দ শেষ পর্ব

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।