আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই দক্ষিণ আফ্রিকা এই দক্ষিণ আফ্রিকা: দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর বর্ণবাদের সাদা-কালো ছায়ায় ক্রিকেট

গণতন্ত্র হল এমন এক অস্তিত্বহীন মদ, যাতে সবাই মাতাল, কিন্তু কেউ কখনো পান করে নি।
নব্বইর দশকের দ্বিতিয়ার্ধ, দক্ষিণ আফৃকার খেলা দেখাটাই ছিল এক রোমান্ঞ। কার্স্টেন, ক্রনিয়ে, ক্যালিস, রোডস, ক্লুজনারদের বিধ্বংসী ব্যাটিং, ডোনাল্ড পোলকদের প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ছিড়ে-কুড়ে খাওয়া, আর ভুবনভুলানো ফিল্ডিং। বিশাল ফারাক সেই ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফৃকা আর এই স্মিথের দক্ষিণ আফৃকার। শুধু ফিল্ডিংটাই আছে আর সবকিছুতে ছায়া।

চলতি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে স্বাগতিক দাক্ষিণ আফৃকা ২০০৩এর বিশ্বকাপের মত প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে গেল। পরাজিত হল ইংল্যান্ডের কাছ, যার বিরুদ্ধে গত এগার বছরে কোন টুর্নামেন্টে পরাজয় নেই, হারল শ্রীলংকার কাছে, যা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে প্রথম। গত আট বছরে দক্ষিন আফৃকার নেই কোন টুর্নামেন্ট শিরোপা, সর্বশেষ শন পোলকের নের্তৃত্বে সিংগাপুরে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট জিতেছিল। আর স্মিথের যুগ পুরোটাই খরা। কেন এমন হচ্ছে? এমন একটা সময় ছিল যখন দলে বোলার থাকত একজন (ডোনাল্ড) আর অল-রাউন্ডার থাকত অন্তত পাঁচজন (ক্যালিস, ক্রনিয়ে, ক্লুজনার, পোলক, সিমকক্স/বোয়ে)।

অর্থাৎ দশজন ব্যাটসম্যান, কখনো একজন স্পিনারও থাকত না, তবু দক্ষিণ আফৃকার ছিল বিশ্ব সেরা বোলিং শক্তি। ক্যালিস আর এ্যালবির অবসরের পর আর সেখানে হয়তো বিশ্বমানের কোন অলরাউন্ডার থাকবে না, তাদের বোলারদের এখন প্রায়ই খাবি খেতে দেখা যায়। স্মিথ, গিবস, ক্যালিস আর ডি ভিলিয়ার্স এই চারজন আউট হলেই বলে দেয়া যায় অলআউট। কেন এমন হচ্ছে? কারনটি খুব কঠিন নয়, আর এ নিয়ে কথাও কম হয় নি। এক সময় ওমর হেনরীদের যে দলে যায়গা পেতে সংগ্রাম করতে হতো, সেই দলে যায়গা না পেয়ে কেভিন পিটারসেন আর জ্যাক রুডলফদের দেশ ছাড়তে হয়, আর জাস্টিন ওনটংয়ের মত মানহীন ক্রিকেটার সেই জাতীয় দলে খেলে।

বর্ণবাদের কারনে দক্ষিণ আফৃকা দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক কৃকেটের বাইরে ছিল। নিষেধাজ্ঞার যুগ পেরিয়ে তারা ফিরে আসে আফৃকান সিংহের মত। কিন্তু বর্ণবাদ চলে যায় নি তখনো, অস্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের দলে যায়গা পাওয়া খুব কঠিন ছিল। দক্ষিণ আফৃকার প্রথম অস্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার ওমর হেনরীকে অপমানিত হতে হয়েছিল বারবার। আর এখন দলে বেশ ক’জন অস্বেতাঙ্গ কৃকেটার খেলছেন, এদের দু-একজনের যোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।

দলে স্বেতাঙ্গ, অস্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা একসাথে খেলছেন। বর্ণ এখনো বাদ হয়ে যায় নি, শুধু বর্ণ পাল্টেছে। বিগ ফাইভের দেশ দক্ষিণ আফৃকার টেনিস খেলোয়াড়রা বিশ্ব পর্যায়ে খেলে থাকেন, ফুটবল, হকি, রাগবি ও কৃকেটে তারা খেলেছে বিশ্বকাপ। সেখানে রাগবী খেলে থাকে স্বেতাঙ্গরা, তাই জাতীয় দলের সব খেলোয়ার স্বেতাঙ্গ, হকিতেও তাই, কৃষ্ঞাঙ্গদের মধ্যে ফুটবলে জনপ্রিয়তা বেশি, ফুটবল দলের এগার জনের নয় জনই কৃষ্ঞাঙ্গ। কৃকেট ছাড়া বাকি খেলাগুলোতে নেই কোন কোটা, নেই বর্ণবাদ, সেগুলোতে যোগ্যতার ভিত্তিতে খেলোয়াড়রা সুযোগ পায়।

অদ্ভুত কারনে কৃষ্ঞাঙ্গদের একরকম জোড় করে কৃকেটার বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। একসময় কৃকেটে কৃষ্ঞাঙ্গদের জন্য কোন কোটা ছিল না। প্রথমে কৃষ্ঞাঙ্গদের জন্য তিনটি পরে বাড়িয়ে পাঁচটি করা হয়। এর ফলে অপেক্ষাকৃত যোগ্য খেলোয়াড় বাদ পড়ে যাচ্ছে, কম যোগ্য খেলোয়াড় দলে ঢুকে যাচ্ছে। এবং দলটি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এমন কোটা পদ্ধতি কৃষ্ঞাঙ্গদের জন্যে উপকারী হচ্ছে তা নয়। যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জনের আগেই তারা দলে ঢুকে যাচ্ছে, এটা দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফল দেবে না। আর কোন জাতীয় দলে এমন কোটা থাকাটাইতো অদ্ভুত। দক্ষিণ আফৃকার বর্তমান ক্রিকেট ব্যবস্থাপনার কাজকারবারও অদ্ভুত। এরা কৃকেটারদের নিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয়রকম পরীক্ষা নীরিক্ষ আর বিলাসিতা করে।

এর চরম শিকার ল্যান্স ক্লুজনার। ক্লুজনার হচ্ছেন এমন এক ব্যাটসম্যান যিনি এক হতে এগার নাম্বার পর্যন্ত যে কোন পজিশনে খেলতে সক্ষম। তাই বলে সবসময় সাত নাম্বারে, যার ওপেনিঙে সেন্ঞুরী আছে। এবং ফর্মে থাকা অবস্থায় অসময়ে তাকে চুড়ান্তু ভাবে বাদ দেয়া হল। শেন ওয়ার্ন তার আত্মজীবনীতে ক্লুজনারকে সাত নাম্বারে খেলানোর ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

গিবসকে বার বার দল থেকে বাদ দেয়া, ওপেনিং থেকে ওয়ান ডাউনে নামিয়ে দেয়া। হাশিম আমলা যিনি টেস্টে ওয়ান ডাউনে খেলেন তাকে ওয়ানডেতে ওপেনিং করানো, ক্যালিসকে ফর্মে থাকা অবস্থায় অযৌক্তিক ভাবে বাদ দেয়া, মাঝে একবার বাউচারকে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তার বদলে আনা হয়েছিল নরবড়ে কীপার শোলেকিলে কে, এমন অসংখ্য উদাহরন আছে। এবার দেখা যাক ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ দলের সাথে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ: ১৯৯৯ সালের দল: ১. গ্যারী কার্স্টেন, ২. হার্সেল গিবস, ৩. ড্যারিল কালিনান, ৪. হ্যান্সি ক্রনিয়ে, ৫. জ্যাক ক্যালিস ৬. জন্টি রোডস, ৭. ল্যান্স ক্লুজনার, ৮. শন পোলক, ৯. মার্ক বাউচার, ১০. স্টিভ এলওয়ার্দি/ নিকি বোয়ে, ১১. এলান ডোনাল্ড। দলে উইকেট কীপার সহ পাচঁজন ব্যাটসম্যান (১, ২, ৩, ৬, ৯), চারজনজন অলরাউন্ডার (৪, ৫, ৭, ৮, বোয়ে খেললে পাঁচজন), একজন বা দুইজন বোলার (১০, ১১)। একমাত্র স্পিনার বোয়ে সব ম্যাচে খেলতেন না।

বোয়ের আগে স্পিনার প্যাট সিমকক্স ছিলেন নিয়মিত সদস্য। বর্তমান দল: ১. গ্রায়েম স্মিথ ২. হার্সেল গিবস, ৩. জ্যাক ক্যালিস ৪. ডুমিনি, ৫. আব্রাহাম ডি ভিলিয়ার্স, ৬. বাউচার, ৭. এ্যালবি মর্কেল, ৮. জোহান বোথা, ৯. মারউই, ১০. পার্নেল, ১১. ডেল স্টেইন। পজিশন ১. গ্যারী কার্স্টেন নিষেধাজ্ঞাপরবর্তীকালের সেরা ব্যাটসম্যান। বর্তমান দলের বামহাতী ওপেনার স্মিথ বামহাতী কার্স্টেনের যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট। ২. ওপেনিঙে আদি অক্ষত গিবস এখনো, শুধু পয়েন্টে জন্টির অভাব বোঝতে দিচ্ছেন না।

৩.ওয়ান ডাউনে ড্যারিল কালিনানের যায়গায় এখন ক্যালিস। ডি ভিলিয়ার্স কে যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট বলা যায়। সেই ক্যালিস আর এই ক্যালিসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে, সে ছিল নিখাদ অলরাউন্ডার, আর এই ক্যালিস অনেক ভাল ব্যাটসম্যান কিন্তু বোলিঙের মান আগের চেয়ে অনেক নিচে। একসময় তিনি বোলার র্যা ঙ্কেও টপ টেনে থাকতেন। ৪. ক্রনিয়ে: রিপ্লেসমেন্ট নাই।

তার বিদায়ের পর দলে আর মান সম্মত পাচঁজন অলরাউন্ডার দেখা যায় নি। ঘুষ খাওয়ার পরও ক্রনিয়ে ক্রনিয়েই, অধিনায়কত্ব কাকে বলে দেখিয়ে গেছেন। এই পজিশনে ডুমিনি মোটেও রিপ্লেসমেন্ট নন, কোটা পূরণের খেলোয়াড়, ৫০ ম্যাচে যার ১৪ উইকেট তাকে অলরাউন্ডার বলা যায়!? ৫. ক্যালিস চলে গেছেন তিন নাম্বারে, তার যায়গায় ডি ভিলিয়ার্স, মাঝে মাঝে পজিশন বিনিময় হয়। ৬. আগে এই পাজিশনে খেলতেন রোডস, নিচে থেকে উঠে এসেছেন উইকেট কীপার বাউচার। ৭. ক্লুজনারের রিপ্লেসমেন্ট খুজে লাভ নেই, অবশ্য এই পজিশনে এ্যালবি মর্কেলের মধ্যে ল্যান্স ক্লুজনারকে মাঝে মাঝে খুজে পাওয়া যায়, ওয়ানডেতে স্ট্রাইকরেট ১০১।

তবে ক্লুজনারের মত অলরাউন্ডার সারা বিশ্বেই বিরল। ৮. শন পোলকের যায়গায় জোহান বোথা, কামানের যায়গায় গদা বন্দুক। ডুমিনি আর বোথা, দুজনেই স্পিনার, আর দুজনেই নাকি অলরাউন্ডার, পরিসংখ্যান বলে ভিন্ন কথা। এদের কেউই স্পেশালিস্ট স্পিনার নন, সম্ভবনাময় স্পিনার পল হ্যারিসকে ওয়ানডেতে নেয়া হচ্ছে না। ৯. উপরের দিকে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান কমে যাওয়াতে মার্ক বাউচারের ব্যাটিং পজিশন ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেছে, যদিও তার নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে ওয়ানডাউনে ব্যাটিঙের অভিজ্ঞতা আছে।

এই যায়গাতে খেলছেন রোয়েলফ মারউই, তার পরিসংখ্যান দেখে বোঝার উপায় নেই দলে তার দ্বায়িত্বটা কি! প্রথম শ্রেনীর ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১৪টি, তারপরই জাতীয় দলে। ১০. ৯৯’র বিশ্বকাপে এই পজিশনে খেলতেন স্টিভ এলওয়ার্দি। দলের দ্বিতীয় পেজ বোলার। বিশ্বকাপে সফল তবে বেশিদিন জাতীয় দলে খেলেন নি। কোন কোন ম্যাচে তাকে বসিয়ে নিকি বোয়েকে নেয়া হতো।

তখন ব্যাটসম্যানের সংখ্যা গিয়ে দাড়াতো দশে। নিকি বোয়ে দক্ষিণ এশীয় মানের স্পিনার নন ঠিকই তবে দ. আফৃকার জন্য চলনসই ছিলেন। এখন এইখানে খেলছেন পেজ বোলার পার্নেল, সম্ভবনাময় উঠতি খেলোয়াড়। এই পজিশনের জন্য দলের বাইরে বসে লড়াই করছেন, এন্টিনি, ল্যাঙ্গভেল্ট, মর্ন মর্কেল। এই তিনজনের কারো যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন নেই, এন্টিনি দলকে দীর্ঘদিন সেবা দিয়েছেন।

১১. ডেল স্টেইন এলান ডোনাল্ডের যোগ্য রিপ্লেসেমেন্ট তবে ডোনাল্ডের পর্যায়ে যেতে অনেক পথ। দক্ষিণ আফ্রিকার দল বাছাইয়ে পরিকল্পনাহীনতা স্পস্ট, এ নিয়ে ব্যবস্থাপনার সাথে একাধিকবার অধিনায়ক স্মিথের দ্বন্দ দেখা গেছে। আর অস্ট্রেলিয়ানরা প্রায়ই এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকে। প্রশ্ন আসতে পারে দ. আফৃকা এরপরও ওয়ানডে র্যা ঙ্কিয়ে শীর্ষে ছিল, খুব সম্প্রতি শীর্ষ অবস্থান হারিয়েছে। এর কারন দুই দেশীয় সিরিজগুলোতে ভাল করে।

কিন্তু প্রতিযোগীতামূলক টুর্নামেন্টগুলোতে দক্ষিণ আফৃকার পার্ফমেন্স খারাপ। সবশেষে শুধু বলতে পারি তাদের আগের খেলা খুব মিস করি। আর একজনকে স্মরণ না করলেই নয় তিনি টোটাল কৃকেটের জনক বব উলমার, শক্তিশালী দ. আফৃকা দল তারই সৃষ্টি।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।