আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনের দুঃখে আজাইরা দুইডা প্যাঁচাল . . .

ব্লাডঃ এবি নেগেটিভ।
বদলীর দরখাস্তটি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে জানের কম্ম সারা। মাসে ৪/৫ টি করে জমা দেই। শেষটি জমা নে’য়ার সময় বলে দিলো- এবার হবেই, নিশ্চিন্তে বাড়ী যান। ৩/৪ দিন পর অফিস থেকে হঠাৎই ফোনে জানালেন আপনার দরখাস্তের উপর আপনার এলাকার মন্ত্রী/এমপি সহ কমপক্ষে ২/৩ জন মন্ত্রী এমপি’র সুপারিশ লাগবে।

পড়ে গেলাম বিপদে, মহা বিপদে। ছুটিও বেশীদিন নাই। এবার যদি না হয় কিংবা সুপারিশ যদি না নিয়ে দিতে পারি তাহলে বদলী না হওয়ার জন্য ঐটাই আমার দোষ হয়ে যাবে। সুতরাং গলায় গামছা বাইন্ধা আবার ঝাপা’য়া পড়লাম। কর্মস্থল এলাকার প্রভাবশালী মন্ত্রী (ফিরা মন্ত্রী) তার কাছে গিয়েতো তার বউ বাচ্চা সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও শেষমেশ তার সোনার টুকরা পোলাডার কাছে বদলীর বাজেট পেশ করতে পারলামনা বলে দরখাস্তের উপর সাইনটাও পেলামনা।

(১) প্রায় ৫০’র বেশী ফোন কলের পর অনুমতি পেলাম। মহেন্দ্রক্ষণে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রসঙ্গ বর্ণনা করলাম। একটু বেশী খাতির পাবার জন্য, পরিচয়টা গাঢ় করার জন্য বললাম স্যার আপনার ভাতিজা আমাদেরই স্কুলে পড়ে। আমার ছাত্র।

ক্লাস নাইন -এ। কোন লাভ হলোনা। অবশেষে জানলাম এসব বদলী টদলীর ব্যপারগুলো নাকী মাননীয় ভাবী মহোদয় দেখেন। আশাহত হয়েও একটু আশার আলো পেলাম। এখন ভাবীর দেখা পাই কই ? ছুটলাম ভাবীর উদ্দেশ্যে।

আরেক শুভক্ষণে পেলাম ভাবীকে। কথাবার্তার কোন এক প্রসঙ্গে আহ্লাদী সুরে জানতে চাইলেন- তুমি কি ডলিকে চিনো ? আমার মেয়ে ডলি ? ওতো তোমাদের স্কুলে ছিলো। ভাবলাম আমার কাজটা এই বুঝি হয়ে গেল। পরিচয় দিলে আমাকে তো চিনতে পারবে! আমার চোখ দু’টো চকচক করতে লাগলো। বললাম- জ্বী।

চিনি। উনাকে আমি কলিগ হিসেবে পেয়েছিলাম ৫ মাস। তারপর উনি বদলী হয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন নিয়োগ-বদলীর ঝামেলাগুলো আমার ছেলেই ভালো বুঝে। (হৃদয়). . .হীনই এগুলোর ব্যপারে ভালো জানে।

ওর কাছে যাও, আমি ওকে বলে দেব। যাক বাঁচা গেল। এবার নিশ্চিত। আমাকে আর দৌঁড়াতে হবেনা। গরু খোঁজা খুঁজে শেষে মন্ত্রীপুত্রধনকে রাতের বেলায় পেলাম।

কি অবস্থায় পেলাম তা না-ই বা বললাম। তবে কোথায় পেলাম তা বলা যায়। টি এস সির পূর্ব পার্শ্বের পার্কটার অন্ধকারে. . .। সঙ্গে আমার ভাগিনা। ভাগিনাই উনার খোঁজ নিয়ে দিল।

শুনেছি ভাগিনাকে অতিশয় স্নেহ করেন উনি। ভাগিনার মেধার নাকী উনি খুউউব কদর্য করেন। তাই আমার প্রয়োজনের কথাটা ভাগিনাকে দিয়েই পাড়লাম। সব কথা শুনে বললেন বদলীতো এখন বন্ধ। কাজ হবে কি-না দেখতে হবে।

একথা সেকথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তা আপনার বাজেট কতো ? আমি আমতা আমতা করতে করতে- বাজেট, বাআআজেট. . .। মুহূর্তেই পকেট থেকে একটা কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন কাল আমাকে ফোন করবেন। (২) পরদিন নানা কেরফা কাহিনী করে সারাদিন বসে বসে মশা-মাছি মেরে সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। না “ফিরা” মন্ত্রীর বংশের কাউরো বাসায় না। তবে তার জাতীয় ছোট ভাই।

সংসদ সদস্য। এখানে এসে দেখি আমার এক পাড়াত ভাই। সঙ্গে আরো বেশ ক’জন। বেশ সম্মানিত, অল্প বয়স্ক ব্যক্তি। নির্বাচনের আগে একবার এলাকায় গেলে চোখে পড়েছিল।

তখন উনি এত ব্যস্ত ছিলেন যে দম নেবার টাইম নাই যেন। পারেন তো প্রার্থীর অজুর পানি, টয়লেটের পানিও সামনে এনে ধরেন। এত ব্যস্ত ! রিক্সা ভ্যানে আসার সময় একটা ঔষধের দোকান থেকে ডাকলেন। কাছে আসলেন। ভ্যানে বসা থেকে দাঁড়ালাম।

কানে কানে বললেন এবার তুমি কি কোন ভোট কেন্দ্রে থাকবা না-কি ? বললাম নাম-লিস্ট নিছে, থাকতে পারি। আমরাতো বড়জোর সহঃ প্রিঃ অঃ। বললেন তাইলেই তো হইছে। মনে রাইখো তুমি কিন্তুক মুরাদ ভাইয়ের বাপের সাথে থাকছ, তার গাড়িতে ঘুরছ, হাজার হইলেও মুরাদ ভাই কিন্তু তোমাদের আত্মীয়. . .। বললাম আইচ্ছা।

এই ভ্যান, যাও। সাংসদের বাসায় এই লোকটাকে দেখে একটু সাহস পেলাম। কেন যেন এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো। চুপি চুপি জানতে চাইলেন, এখানে কেন ? ঘটনা বললাম। বললেন এইটা একটা ব্যপার হইল ? কাইলই তুমার বদলী হইব।

তুমি যায়া ঘুমায়া থাক গিয়া। মুরাদ ভাইয়ের সাথে তোমার দেখাই করার দরকার নাই। আমরা আছিনা ? তা হোক। আপাতত এই দরখাস্তটায় একটা সুপারিশ লাগবে। সাংসদ আসলেন।

আমি কিছু বলার আগেই উনি গড়গড়িয়ে বলতে লাগলেন- ভাই ওরে চিনেন ? ও অমুক। আমাদের এলাকার ওর সাথে লিডারের (সাংসদের মরহুম পিতা) সাথে খুউউব ভাব ছিলো। সারাদিন লিডারের সাথে সাথেই থাকতো। (সাংসদের ছোট বোনের নাম বলে) অমুক আর ও কিন্তু ক্লাসমেট। আপনি আগে এলাকায় বেশী যান নাই তাই চিনেন না।

ও-ই লিডারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে. . . ইত্যাদি ইত্যাদি। কান ঝালাপালা। সাংসদ এবার আমার নাম জিজ্ঞেস করে বললেন কোন বাড়ী আপনার ? দরখাস্তটা সামনে ধরতে ধরতে বললাম আমি তুহিনের মামা। আমার নাম অমুক। সাংসদ বললেন- আমি সুপারিস করতে পারি, ফোনও করে দিতে পারি কিন্তু আমার কথায় কোন কাজ হবেনা।

এরচে তুমি এক কাজ করো আজম ভাইকে ধরো উনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে আছেন। বলতে বলতে সইটা করে দিয়ে বললেন আমি তুহিনের সাথে কথা বলবো। বের হয়ে আসতেই পাড়াত ভাইটিও পিছু নিল। কোন চিন্তা কইরো না। বললাম দেখেননা একটু কিছু করা যায় কি-না।

শুনে বললো হাজার বিশেকের মধ্যেই তোমার কাজ হয়ে যাবে। তুমি টাকা জোগাড় কর। ভাইকে আমি জোর কইরা ধরমু। তোমার কাজ এইডা কইরাই দেয়ন লাগবো তার. . .। চলে গেলেন সাংসদের কক্ষে।

দরজায় ঢুকা মাত্রই সাংসদের প্রশ্ন হ্যাঁ এবার মানিক বল তোমার কী খবর ? কেন যেন একটু কৌতুহল জাগলো। একটু দাঁড়ালাম। ভিতর থেকে ভেসে এল “আমাদের বাড়ীর কারেন্ট সাপ্লাইয়ের ট্রান্সমিটারটা জ্বইলা গেছে। কয়দিন ধরে এত বলছি ঠিক করে দেয়না। আপনি একটু বলে দেন. . .।

” (৩) রাতের বেলায়ই এক চাইমচ্যার হাতে পায়ে ধরলাম যেকোন একটা মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর সাথে দেখা করিয়ে দিতে। একজন পি.এস এর নম্বর দিয়ে বললো উনার সাথে কথা বলতে। পি.এস পরদিন ভোর ৬ টায় বাসায় আসতে বললেন। ফজর নামাজ পড়েই হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিলাম। বাসায় গিয়ে দেখি আমার আগেই প্রায় ২০/২২ জন উপস্থিত।

কোনমতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ইতোমধ্যে আমরা জন সংখ্যা প্রায় ৩০/৩২ জনে উন্নীত হলাম। আমাদের মধ্যে ১৭ জনের একটি দল আছেন যারা সবাই এলজিইডিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত আছেন। একজন আছেন ৭২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ। গায়ে ময়লা একটা পাঞ্জাবী, তার উপরেই সাদা একটা টি শার্ট গায়ে জড়ানো।

শার্টটির বুকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কী কী যেন লেখা। বুকে মুক্তি যোদ্ধাদের একটা পিন লাগানো। মোটামুটি সবারই দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু এই লোকটা। বয়সের ভারে চলতে পারেন না। আর এমনিতেই মাজা বেঁকে গেছে।

চোখেও খুব একটা দেখেন না। এসেছেন নওগাঁ এলাকা থেকে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় রুমে আসলেন। যে যার যার মতো হুড়োহুড়ি করে তার কক্ষে ঢুকার চেষ্টা করলেন। পি.এস এর বাধার মুখে কেউ কেউ বাইরেই থাকলেন।

সঙ্গে বৃদ্ধ লোকটিও। আমরা বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর টেবিলের চার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এক পর্যায়ে বৃদ্ধকে ভেতরে আনা হলো। অন্যান্য কাগজ পত্রে সই করতে করতেই মন্ত্রী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন আপনার কী সমস্যা ? শুনেই বৃদ্ধ লোকটি কাঁদতে কাঁদতে তার আরজ পেশ করলেন। কান্না শুনেই মন্ত্রী মুখ তুললে।

ছাগলের ল্যাদার মতো ঝরঝরিয়ে বলতে লাগলেন- ঐসব মুক্তি যোদ্ধা-টোদ্ধা টাল বাহানা এখন ছাড়েন। নিজের জীবনটা নিজেই পরিচালনা করতে চেষ্টা করেন। সরকার কয় মুক্তিযোদ্ধারে বসায়ে বসায়ে পালবো ? ভিক্ষা করে, মাগনা মাগনা আর কয়দিন চলবেন ? বয়সতো শেষ, এখন এই ক’টা দিন আল্লা-বিল্লা করে কাটায়া দেন। সেদিন ৫০০ টাকা পান নাই ? রতন আপনাকে টাকা দেন নাই ? বৃদ্ধ বললেন জ্বী দিছে। আপনি আবার আজ আসতে বলছেন।

বউকে নিয়ে এসেছি। আজ হাসপাতালে ভর্তি করাব. . . আত্মীয় স্বজন, গুনাগুষ্ঠিকে চিকিৎসা করাবেন সেই খরচতো সরকার দিবেনা। মুক্তিযোদ্ধা হইছেন বলেই কি সরকার সব ফ্রী করে দিবে ? ব্যক্তিগত ভাবে আপনার জন্য ২০০০ টাকার কথা বলেছি। ৪ তারিখে এসে চেক নিয়ে যাবেন। রতন, উনাকে আজ দু’শ টাকা দিয়ে দিন।

বৃদ্ধের কান্না থামলো। চোখ মুছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। টাকাটা হাতে পেতে পেতে আমার সুপারিস সহ দস্তখতটা হয়ে গেল। বের হওয়ার আগে পিএস এর সাথে দু’টো কথা বলবো এ কারনে একটু অপেক্ষা করছি। ইতোমধ্যে বৃদ্ধ লোকটি টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমিও কথা বলে বেরিয়ে আসলাম। আবার লোকটির সাথে দেখা হলো রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলাম কাকা কী করেন আপনি ? কিছু না বাবা। আগে কী করতেন ? হাই স্কুলে মাস্টারী করতাম বাবা। আমার কলিজাটা চ্ছাৎ করে উঠলো।

শালার জীবনরে ! একজন মুক্তিযোদ্ধা, সারা জীবন মাস্টারী করে হাজার হাজার পোলাপান মানুষ করে আজ কাঁধে তুলেছে ভিক্ষার ঝুলি। ভাবলাম নিজের জীবনটাই বা কম কীসের ? আমি নিজেওতো একটা মাস্টার তাই ঐ জীবন আসতে আর বেশী দিন বাকী নাই। অজানা এক শংকায় মনটা ভারী হয়ে এল। কাকা দো’য়া করবেন বলে ১০০ টাকার একটা নোট চাচার হাতে গুঁজে দিয়ে বিপরীত দিকে হাঁটা ধরলাম।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.