বাঙলা কবিতা
আশির দশকের শেষদিকে বাঙলা কবিতায় যে-চিন্তা ও শিল্পমনস্কতা ফিরে এসেছিল, নব্বইয়ে তার বিকাশ ঘটেছে নানাভাবে; তারই পথ ধরে চলছে বর্তমান শতাব্দির প্রথম দশকের কবিতা। ফলে, এখনকার কবিতা বুঝতে হলে নব্বইয়ের কবিতার প্রবণতা চিনে নেওয়া বিশেষ জরুরি।
সংক্ষেপে তা এই :
১. তাৎণিক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রকাশ;
২. বিমূর্তায়ন;
৩. গদ্যভঙ্গি;
৪. নৃতাত্ত্বিক অনুষঙ্গের ব্যবহার;
৫. কোলাজরীতি;
৬. লোকজ উপাদানের প্রয়োগ;
৭. স্যাটায়ার;
৮. আবেগের চেয়ে বুদ্ধির সরল প্রাধান্য;
৯. বিবৃতিধর্মিতা বর্জনের চেষ্টা;
১০. চিত্রাত্মকতা;
১১. আখ্যানরূপকের ব্যবহার;
১২. ছন্দমনস্কতা ইত্যাদি।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিটিই যে এখনকার নবীনরা গ্রহণ করেছেন, তা নয়। ছন্দে তাঁরা তেমন লিখছেন না; এমন অনেক কবিকে পাওয়া যায়, যাঁরা একটা কবিতাও লেখেন নি ছন্দে; বেশ ক’জন কবির পুরো বই গদ্যে লিখিত এবং তাতে একটি স্তবকেও নেই প্রবহমান গদ্যরীতির জন্যে সবচেয়ে মানানসই অক্ষরবৃত্তের প্রয়োগ।
একে আপাতত দুঃসাহসই বলা যায়, কেননা, কোনও কবির অজ্ঞতা সম্পর্কে চটজলদি সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়; যদিও প্রথম বই বুঝিয়ে দেয় কবির প্রস্তুতিটি কেমন, তার সামর্থ্যরে সীমা, ভবিষ্যতের জন্য তার যে রসদ, সেটি তাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে। শখের বশে লিখে থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। আমরা জানি, ছন্দ কবিতার খুব প্রাথমিক একটা শর্ত। আর ছন্দে লিখতে না-চাওয়া কোনও শর্তই নয়; কিন্তু ছন্দের ঊর্ধ্বে ওঠার মালিকানা একজন কবি তখনই দাবি করতে পারেন, যখন তার অন্তত তিনটি কবিতা তিন রকম (আরও একটা আছে, সেটা কোনও এক সময় লিখলেই চলবে) ) ছন্দে পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠকের হয়েছে।
প্রথম দশকের কোনও কবি ছন্দনিষ্ঠ নন, এমনটি বলা যায় না।
শুভাশিস সিনহা ছাড়া, (আরও দু-তিনজন থাকতে পারেন) আর কারও মধ্যে ছন্দনিষ্ঠা দেখা যায় না। তবে অনেকের মধ্যেই ছন্দবোধটি আছে; তাদের কবিতায় সৃষ্ট সাঙ্গীতিক বহির্স্বর থেকে এটা বোঝা যায়। অতনু তিয়াস, অনন্ত সুজন, ঈশান সামী, নওশাদ জামিল, আমজাদ সুজন, জাকির জাফরান, ফেরদৌস মাহমুদ, রাশেদুজ্জামান, রাজীব আর্জুনি, নির্লিপ্ত নয়ন, সুমন সাজ্জাদ, জাহিদ সোহাগ, আফরোজা সোমা, মাদল হাসান, মামুন খান, মাহমুদ সীমান্ত, মানস সান্যাল, তারিক টুকু, সফেদ ফরাজী, সজল সমুদ্র, জুন্নু রাইন, আসমা বীথি সহ অনেকের নাম এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এঁরা অরবৃত্তের কম-বেশি চর্চা করেছেন।
এটা শোচনীয় যে, বাঙলা কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে ছন্দ নিয়ে আজও কিছু বলতে হয়, কবিতার এই প্রাথমিক শর্ত কে কতটা পূরণ করতে পেরেছেন, তা নিয়ে আলোচককে মাথা ঘামাতে হয়।
অর্থাৎ বাঙলা কবিতায় আজও ছন্দ একটা টেনশনের স্তরে রয়েছে। সবার কবিতায় যদি ছন্দনিষ্ঠা থাকত, ছন্দ নিয়ে আলোচনার দরকারই পড়ত না। কিন্তু আমাদের আলোচনায় এটি অবধারিত; যেন বাঙলা কবিতায় ডজন-ডজন ছন্দ আছে! আর এই তিন-চারটা নিয়েই কবিদের কী-যে অবস্থা!
নব্বই দশকের যে-প্রবণতা প্রথম দশকের কবিরা গ্রহণ করেছেন সবচেয়ে বেশি, তা হলÑ তাৎণিক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি; এর পর গদ্যভঙ্গি, বিমূর্তায়ন, চিত্রাত্মকতা। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের সিলেকশন বা গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপার ঘটেছে। বলে রাখা দরকার, নব্বইয়ের কবিতার যে-প্রবণতাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর জন্যে দশকটির বাহাদুরির কিছু নেই; কেননা, এসব নিয়ে এই সময়পর্বের কবিদের মধ্যেও আছে চোরাগলি, ফাঁকি, চালাকিসহ নানা ধরনের গোলমাল।
যদিও এর আগের চল্লিশ বছরের যে-কোনও সময়ের তুলনায় এই দশকে ভালো কবিতার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। প্রথম দশকেও কিছু ভালো কবিতা লেখা হয়েছে। হলেও, পূর্ববর্তী কবিতায় জীবনদৃষ্টির যে-দারিদ্র্য ছিল, তা এখনকার কবিতায় আরও প্রকট হয়েছে। তীব্র হয়েছে জীবনবোধ ও শিল্পচেতনার সমন্বয়ের শূন্যতাও। এমনটি হলে তাৎণিক অনুভব প্রকাশই হয়ে পড়ে কবিতার নিয়তি; বিমূর্তায়ন (রহস্যীকরণ নয়) অবধারিত হয়ে যায়, খণ্ড-খণ্ড চিত্র উপহার দেয়া ছাড়া কবির কোনও উপায় থাকে না।
তা না-থাকুক, তাৎণিক অনুভবের প্রকাশও হয়ে উঠতে পারে কবিতা; অনেক ভালো কবিতা এই জায়গা থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়েছে অন্যতর তাৎপর্যে পাঠককে পৌঁছে দিয়ে। অর্থাৎ যে-অনুভব নিয়ে কবি লিখতে বসেছেন, তা অন্যতর অভিব্যক্তিতে উত্তরণ চাইছে, উৎসবিন্দুতে থেমে থাকতে চাইছে না; অন্তত একটা ভাববলয়ের দাবিতে বিন্দুটিকে প্রদণি করতে-করতে পরিধি নির্মাণ করছে। সমগ্রতার অভিপ্রায় এই সংগ্রামের মূলে। চেষ্টাহীনভাবে এটি ঘটে, যদি কবির অভিজ্ঞতা ও অনুভবের রসদের সঙ্গে জীবন ও শিল্পবোধের যৌথ সমর্থন থাকে। নইলে, তাৎণিকতা একটা আকস্মিকতার চেহারায় পাঠককে চমকে দিয়েই বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়, অন্যতর অর্থ ও সৌন্দর্য বা নৈঃশব্দ্য সৃষ্টি তাতে হয়ে ওঠে না; হলেই তো বলা যেত, সমগ্রতার অভিপ্রায় এতে আছে; এর রচয়িতা অন্তত খণ্ডিত অনুভব প্রকাশে সন্তুষ্ট নন।
প্রথম দশকের কবিতা এই সন্তুষ্টিকেই যেন বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে। দেখতে পাই, চমকে-দেয়া একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কবিতা শুরু হয়েছে এবং একে প্রসারতা দিতে দিতে, প্রসঙ্গটি যে-আবেদন নিয়ে শুরু হয়েছে তা-ও ফুরিয়ে গেছে। অথবা, পাঠক ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন যে, চমক সৃষ্টি ছাড়া এ-রচনার কোনও দাবি নেই। অধিকাংশ েেত্র এই ভাবনারও সুযোগ মিলছে না। কেননা, প্রসারতা দিতে গিয়ে উত্থাপিত প্রসঙ্গটি শেষ পর্যন্ত চমকের বাহাদুরি হারিয়ে পাঠকের জন্যে (যিনি কবিতার মননশীল পাঠক) একটা মামুলি বা নিরীহ অভিজ্ঞতায় এসে ঠেকেছে।
দুটি দৃষ্টান্ত :
রাতের নিজস্ব গান আছে, শিল্পিগোষ্ঠী আছে
তোমার শরীরে বাজে উদগ্র ঝুমুর
তোমার স্তনে বাজে অপরূপ দুধের সরোদ :
প্রেমিকের রাত্রিকালীন আচরণ অনেকটাই
অসামাজিক। মধ্যরাতে তুমিও এক বিড়ালিনী
কপট কান্নায় পাড়া ভাসাও ; রাতের রূপ
আর কদর্যতা দু-ই দেখি তোমার দেহে ফুটে।
(সুজাউদ্দৌলা : রাতকাব্য-৩৬)
ইঁদুরে ছেয়েছে আকাশ
নাকি ইঁদুরের মতো মেঘে!
এখন বেলা শুয়ে আছে মাঠে, শূন্যের বিছানায়
তাঁর শীত পেতে আছে
ইঁদুর মেঘেরা তাই লেপ হয়ে থাকে;
নত্র নামের নিকটসম্পর্কের বোনেরা
উষ্ণতা রেখে যায় তার পদানুক’লে
আমি ভাবি পৃথিবীটা কোথাও
এভাবে মরে পড়ে আছে না তো!
(বিল্লাল মেহদী : অশেষ ভাবনা)
এই দুই কবিতার শুরু চমক দিয়ে, যা কোনও অন্যতর অর্থের দিকে না-গিয়ে পাঠের মাঝখানেই দম হারিয়ে ফেলেছে। গোলমালটি দু’কবিতায় ঘটেছে দু’ভাবে : প্রথমটি কোনও রকম যোগসূত্র ছাড়াই অন্য একটি প্রসঙ্গ হাজির করেছে এবং জবরদস্তি করে ‘রাতের নিজস্ব গান’কে প্রেমিকের আচরণ, ‘কপট কান্না’ আর নারীদেহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে। অধিকন্তু, কবিতাটির শেষে ‘ফোটে’-র জায়গায় অশুদ্ধ ‘ফুটে’ ব্যবহৃত হয়েছে, যা কোনও কবির জন্যে প্রীতিকর হতে পারে না।
দ্বিতীয় কবিতা এলিয়টীয় চমক দিয়ে শুরু হয়েছে; কিন্তু এর মৃত্যু ঘটেছে ‘পৃথিবীটা কোথাও’ ‘মরে পড়ে’ থাকার ভাবনা দিয়ে, যার সঙ্গে ইঁদুরকে মেঘ মনে করার কোনও সম্পর্ক নেই। যিনি লিখেছেন, তিনি অবশ্য একটা চালাকি করেছেন। রচনাটির নাম দিয়েছেন ‘অশেষ ভাবনা’। ভাবনা ‘অশেষ’ হলে কবিতায় এমনটি ঘটতে পারে, সেই ইঙ্গিত তিনি দিতে চেয়েছেন। কিন্তু কবিতা হিসেবে এভাবে একটা রচনাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত কবির অসহায়তাকেই প্রকাশ্য করে।
কবিতায় চমক অন্য জিনিস; সরকার আমিনের চার পাঁচ হাজার পিঁপড়ার দুঃখ কবিতাগ্রন্থের সমালোচনা করতে গিয়ে সম্ভবত লিখেছিলাম যে, চমক কবিতার জন্যে জরুরি নয়; জরুরি তখন, শুরুতেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ কবির যখন কাম্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সব কবিতায় এমনটি কাম্য হওয়া ঠিক নয়; নিরাপদও নয়; এটি নির্ভর করে প্রতিপাদ্যের ওপর, একে ব্যাখ্যা বা বিবৃত করার েেত্র কী দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব কাজ করছে, তার ওপর। চমকের আদর্শ উদাহরণ টিএস এলিয়ট; তিনিও কিন্তু সব কবিতায় চমকের ব্যবহার করেন নি। করেছেন তখন, প্রতিপাদ্য যখন তা দাবি করছে এবং সেই দাবির সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনটিও মিলছে। একটা নাটকীয়তার চেহারায় তিনি হাজির করেছেন একে; কবিতা পড়তে পড়তে সেই চেহারা সরে গিয়ে মূল ভাব বা অর্থটি প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।
কৌশলটি বেশ কাজের, কিন্তু চমক সম্পর্কে মধ্য-আশি থেকে যে ভুল ধারণার চর্চা হয়ে আসছে কবিতায়, তা এখনকার কবিদের বিপজ্জনকভাবে পেয়ে বসেছে। ফলে, চমকের খোলস ভেদ করে কিছুই পাওয়া যায় না; কবিতা হয়ে পড়ে কখনও কোলাহল, কখনও মর্মবস্তুহীন কিছু বাক্য মাত্র!
এরপর গদ্যভঙ্গির প্রসঙ্গ। বাঙলা ভাষায় অরবৃত্তে এর চর্চার বয়স প্রায় সত্তর বছর হয়ে গেছে। তারও অনেক আগে, ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে, ইউরোপে এর শুরু। এটি এতই পরিচিত যে, নতুন করে চিনিয়ে দেবার দরকার পড়ে না।
নবিশিদের বেলায় এর চেয়ে সহজ আর সুবিধাজনক আঙ্গিক আর নেই। কেননা, এতে প্রচলিত ছন্দ জরুরি নয়, বাঁধা-ধরা কোনও ছক এতে না-মানলেও চলে। এই স্বাধীনতাকে প্রথম দশকের কবিরা পুঁজি করেছেন আগের যে-কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। অঞ্জন সরকার জিমি, অপূর্ব সোহাগ, অবনি অনার্য, অশোক দাশগুপ্ত, আপন মাহমুদ,আবু তাহের সরফরাজ, আহমেদ ফিরোজ, ইকতিজা আহসান, ইমরান মাঝি, এমরান কবির, গৌতম কৈরী, চন্দন চৌধুরী, চ্যবন দাশ, জাহানারা পারভীন, জাহেদ আহমদ, জুয়েল মোস্তাফিজ, তারিক টুকু, তুষার কবির, নিতুপূর্ণা, নির্লিপ্ত নয়ন, পান্থজন জাহাঙ্গীর, পিয়াস মজিদ, বিল্লাল মেহদী, মনিরুল মনির, মাজুল হাসান, মামুন রশীদ, মাসুদ হাসান, মাহমুদ শাওন, মাসুদ পথিক, মিঠুন রাকসাম, মুয়ীয মাহফুজ, মৃদুল মাহবুব, যিশু মুহাম্মদ, রাকিবুল হক ইবন, রাশেদুজ্জামান, রুদ্র অনির্বাণ, রুদ্র আরিফ, শাবিহ মাহমুদ, শিশির আজম, শুভাশিস সিনহা, সরফরাজ স্বয়ম, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, সুজাউদ্দৌলা, সুমন সুপান্থ, সেজুল হোসেন, সৈয়দ আফসার, সোহেল হাসান গালিব, স্বরূপ সুপান্থ সহ অনেক কবি এই আঙ্গিক গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ এই আঙ্গিকে এত বেশি লিখেছেন যে, তাঁদের নামোল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে রীতিটির চেহারা এসে যায়।
সিদ্ধার্থ শংকর ধর, ইমরান মাঝি, গৌতম কৈরী এক্ষেত্রে আপাতত অগ্রগণ্য।
খুব বেশি বিমূর্তায়ন ঘটেছে প্রথম দশকের কবিতায়। ফলে, কবিতা শেষ পর্যন্ত কী বার্তা হাজির করল, বা, এর সম্ভাব্য প্রতিপাদ্যটি কী, কিংবা কী মর্মবস্তু এর কেন্দ্রে, বুঝে ওঠা মুশকিল। কখনও-কখনও মনে হয় মর্মবস্তু আদৌ কবিতাটিতে নেই; আবার এ-ও মনে হয়, সেটি আড়ালের সমস্ত চেষ্টা এতে করা হয়েছে এবং কবি সফল হয়েছেন। এই বিমূর্তায়ন এক ধরনের বিপজ্জনক চালাকি; পথটি প্রথম দেখিয়েছিলেন ফরাসি প্রতীকবাদীরা।
তাঁরা অবশ্য কবিতায় মর্মবস্তুর তিন-চতুর্থাংশ আড়াল করতেন; বাকি একভাগ থেকে পাঠককে বুঝে নিতে হতো কবিতাটি আসলে কী বলতে চাইছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সম্ভব হতো না। না-হলেও, প্রতীকবাদী কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন সৌন্দর্য। এর উৎস ছিল রহস্যময়তা। কবিতার অনেকান্ত ব্যাখ্যার সুযোগ তাঁরাই প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন।
তাঁদের হেঁয়ালিটা যদি শুধু থাকত এখনকার কবিতায়, তা হলেও বুঝতে পারা যেত কবির অভিপ্রায়টি কী, কেমন করে তা ব্যাখ্যার দাবি নিয়ে আমাদের সামনে আসতে চাইছে। কিন্তু প্রথম দশকের অধিকাংশ কবি তো বোধগম্যতার সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছেন! ফলে, বিমূর্তায়ন গেছে অপচয়ের দিকে; এক রকম চালাকি ও ফাঁকির নামান্তর হয়ে এসেছে। চার-পাঁচজন বাদে সবার মধ্যে এই বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা যায়।
বিমূর্তায়নের একটি প্রধান আশ্রয় চিত্রাত্মকতা। আর একেই চিত্রকল্প ভেবে দশকের পর দশক আলোচনা হয়ে চলেছে।
কিন্তু চিত্রকল্প কবিতার জন্যে জরুরি কিছু নয়, চিত্রাত্মকতাও নয়। আধুনিক হতে গেলে চিত্রকল্প খুব দরকার; কেননা, এটি শুরু থেকেই, আধুনিকতার একটা অংশ হয়ে আছে। যে ক্যাটাস্ট্রফি আধুনিকতার সমার্থক, তার প্রসারিত অর্থ বিপর্যয়কারী বহুমুখি চিন্তার জটিল প্রকাশ; অন্যদিকে, ইমেজিস্ট মুভমেন্টের ইশতেহারে ইমেজ বা চিত্রকল্প হলো__বুদ্ধি ও আবেগগত জটিলতার আনকোরা প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় চিত্রকল্প নেই, নজরুলেরও নেই। কারণ, আবেগ ও বুদ্ধিগত জটিলতা এঁদের কবিতায় নেই।
যত আধুনিক হোক বাঙলা কবিতা, এই জটিলতা সৃষ্টি করা খুব কম কবির পে সম্ভব হয়েছে। বিষ্ণু দে-ও এই দিক থেকে আধুনিক নন। সব মিলিয়ে আধুনিকতা কী জিনিস, তা না-বুঝে আধুনিক হতে চেয়েছেন বাঙলা ভাষার অধিকাংশ কবি; ফলে, আধুনিকতার অবিকশিত ও নিরীহ একটা চেহারাকে পুরনো ভেবে তা বাতিল করার জন্যে একদল ‘উত্তর আধুনিকের’ আবির্ভাব ঘটেছে। নব্বইয়ের শুরুতে এদের সক্রিয়তা দেখা গেছে; এখন নেই। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার উচ্ছিষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে লোকজ অনুষঙ্গ নিয়ে কবিতা রচনার মৃদু প্রবণতা।
প্রথম দশকে কবিদের কেউ কেউ এর অনুগামী হয়েছেন। তবে প্রথম দশকে যে-কবি এসবের বাইরে থাকতে চাইছেন, তিনি পলাশ দত্ত। সাধু ও মৌখিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার তিনি করেন, কবিতার সংবৃত সমাপ্তি তাঁর পছন্দ; শ্লেষ-বিদ্রƒপের প্রতিও ঝোঁক তাঁর আছে। মনে হতে পারে, তিনি ব্রাত্য রাইসুর ধারাটি গ্রহণ করেছেন; কিন্তু রাইসুর কবিতা বেশ লিরিক্যাল, আক্রমণাত্মক ও পরিহাসপ্রবণ।
উল্লেখ প্রয়োজন, প্রথম দশকের কবিরা সাহিত্যের ইতিহসের এমন এক পর্যায়ে লিখছেন, যখন আঙ্গিকগত প্রায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়ে আছে।
এটি তাদের জন্যে প্রীতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রীতিকর এইজন্য যে, কেউ কবিতা লিখতে চাইলে ভাষা কিংবা আঙ্গিক সন্ধানের জন্যে তাকে মরিয়া হতে হবে না। কেননা, আয়োজনটি পূর্ববর্তী, বিশেষত তাঁদের নিকট-পূর্বসূরি নব্বইয়ের কবিরা নানাভাবে করে রেখেছেন। ফলে, সা¤প্রতিক ও সমকালীন কবিতা-পাঠের মধ্যে যিনি আছেন, তার পে আট-দশটা প্রকাশযোগ্য কবিতা লিখে ফেলা কঠিন কোনও কাজ নয়। এই সময়ে এত কবির আবির্ভাবের কারণ সম্ভবত এটাই।
অন্যদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ এজন্যেই যে, এই পাঠ-অভিজ্ঞতা কবিতা সম্পর্কে দেয় বিচিত্র ও গোলমেলে ধারণা, তাতে যে-কোনও নবীন ধাঁধায় পড়ে যেতে পারেন; পড়ে গেলে, সিলেকশনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কঠিন হয়ে উঠতে পারে পূর্ববর্তী ও সমকালীন কবিতার পরাগায়ন রোধ করা।
শুরুতে প্রথম দশকের কবিতায় এই সমস্যা ছিল ব্যাপক। এখন অনেকেই তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সফল হচ্ছেন বলে মনে হয়।
বোধ করি সাহিত্যের জন্যে এটা বেশ প্রীতিকর ও স্বাভাবিক যে এঁরা লিখছেন একটা ধারাবাহিকতার মধ্য থেকে।
বড় কথাটি হল, কবিতা সম্পর্কে অভিজ্ঞানের দিক থেকে এঁরা পিছিয়ে নেই। প্রয়োগরুচিতে তো নয়ই।
২১. ০৩. ০৯
*** এই রচনাটি একদম আনকোরা খসড়া ; এর কিছুটা সংশোধিত লিপি পোয়েট ট্রি ৩য় সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে। মৌলিক কোনও পরিবর্তন নেই সেখানে।
লেখক শুধুমাত্র কিছু নাম সংযোজন বিয়োজন করেছেন...
রহমান হেনরী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।