আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীলতা বলতে কি বুঝায় এবং একজন মুসলমি কিভাবে তা অর্জন করতে পারে

"সকল বস্তু তার বিপরীত বস্তুর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে"

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য আল্লাহর প্রতি আনুগত্য হওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম আনুগত্যশীলতা। একজন মুসলিম আল্লাহর প্রতি তিনভাবে আনুগত্যশীলতা প্রকাশ করতে পারে: “কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই দৃঢ়, নিখাঁদ, খাঁটি বিশ্বাস স্থাপন”, “আনুগত্যের স্বীকৃতি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন” এবং “নৈতিক বিচার বিশ্লেষণ ও আন্তরিক আচার-ব্যবহার”। বিশ্বাসটি আবার কোনভাবেই শুধু চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ রাখা যাবে না, যেমন: শুধু চিন্তা করলাম আমি বিশ্বাস করি বা আমার বিশ্বাস এই রকম হোক ইচ্ছা করি কিন্তু বাস্তবে তা অনুপস্থিত। বিশ্বাসটি হবে সেই অনুযায়ী যেভাবে আল্লাহ তাআলা চান যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য, নিয়তের প্রতি আনুগত্য এবং মহান আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রতি ভয়ের আনুগত্য। বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্যশীল কর্মসম্পাদন তখনই সম্ভব হবে যখন ভিতরের এবং বাইরের কাজগুলো এমন পন্থায় করা, যে পন্থা মহান আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন।

এই আনুগত্যশীল সম্পন্ন কাজের বর্ণনা একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন: “এটাই প্রকৃত আল-বির নয় (আল-বির বলতে বুঝায়- সকাল প্রকার সঠিক কাজ এবং আল্লাহর আনুগত্য অনুযায়ী কাজগুলো সম্পাদন করা) যে তোমরা পূর্ব অথবা পশ্চিমে তোমাদের মুখ ঘুরাও(নামাযে), তবে প্রকৃত আল-বির হচ্ছে (গুণাগুণ গুলো) একজন মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, পরকালের উপর, ফেরেশতাদের উপর, (আল্লাহর) কিতাবের উপর, নবী রাসূলদের উপর এবং আল্লাহর দেওয়া মাল সম্পদ তাঁরই ভালোবাসা পাবার মানসে আত্মীয় স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন(গরীব) ও পথিক মুসাফিরের জন্যে ব্যয় করবে, সাহায্যপ্রার্থী (দুস্থ মানুষ, সর্বোপরি) মানুষদের (কয়েদ ও দাসত্বের) বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার কাজে অর্থ ব্যয় করবে, নামায প্রতিষ্ঠা করবে, (দারিদ্র বিমোচনের জন্য) যাকাত আদায় করবে- (তাছাড়াও সেসব পূণ্যবান মানুষ রয়েছে); যারা প্রতিশ্র“তি দিলে তা পালন করে, যারা ক্ষুধা-দারিদ্রের সময়, রোগের সময় ও যুদ্ধের সময়(যখন যুদ্ধ সংগঠিত হয়) ধৈর্য ধারণ করে; এই সকল গুণাগুণগুলো সাজানোর পর আল্লাহ তাআলা বলেন: “এই ধরনের লোকেরাই হচ্ছে সত্যের পথে পরিচালিত এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত আল-মুত্তাকুন (সর্বোচ্চ ধার্মিক)”। (সূরা আল বাকারা : ১৭৭) ইবনে কাসির (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এই আয়াতে গুরুতপূর্ণ তত্ত্ব, প্রধান মূলনীতিসমূহ এবং প্রকৃত নির্ভেজাল বিশ্বাসের কথাগুলো রয়েছে। তাফসীর ইবনে কাসির, ১/৪৮৫ শায়েখ আবদ আল-রহমান আল-সাদী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: আলোচ্য আয়াতের শেষে “এই ধরনের” বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যাদের মধ্যে আলোচ্য আয়াতের উল্লেখিত গুণাগুণগুলো বিদ্যমান রয়েছে যেমন: প্রকৃত বিশ্বাস এবং তার কর্মের মধ্যে বিশ্বাসের প্রতিফলন অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন; নৈতিক বিচার বিশ্লেষণ এবং আন্তরিক আচার-ব্যবহার যা একজন মানুষকে দেয় সর্বোচ্চ সম্মানজনক অবস্থান আর এইগুলোই হচ্ছে মানবতার চূড়ান্ত পর্যায়। এরপর “লোকেরাই হচ্ছে সত্যের পথে পরিচালিত ” বলতে বুঝাচ্ছে, যাদের বিশ্বাসের মাধ্যে রয়েছে আনুগত্যশীলতা কারণ তাদের কর্মগুলোই বিশ্বাসের স্বীকৃতি দেয়।

“এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত আল-মুত্তাকুন (সর্বোচ্চ ধার্মিক)”, কারণ তারা, যে কাজগুলো করতে নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকে এবং ভাল কাজ সম্পাদন করে; আর এগুলোই হচ্ছে বিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য যারা তাদের বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন। ইবাদত করার যে পন্থা এই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ইবাদত এবং যে কেউ এই ইবাদতগুলো করবে সে নিঃসন্দেহে অন্যান্য ইবাদতগুলোও সঠিকভাবে পালন করবে। এই ধরণের লোকেরাই সঠিক পথে পরিচালিত রয়েছে, এরা সত্যের পথে আনুগত্যশীল এবং ধার্মিক। তাফসীর আল-সাদী, পৃষ্ঠা নং-৮৩ শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে সালিহ আল-উসাইমিন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: আমরা এই আয়াত উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে শিখলাম, মহান আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃত আনুগত্যশীলতাই হচ্ছে আসল আনুগত্য কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “এই ধরনের লোকেরাই হচ্ছে সত্যের পথে পরিচালিত”; তারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল তাদের বিশ্বাসে অর্থাৎ যে সব বিষয়ের উপর তারা ঈমান স্থাপন করেছে; আল্লাহর উপর, পরকালের উপর, ফেরেশতাদের উপর, (আল্লাহর) কিতাবের উপর, নবী রাসূলদের উপর এবং তারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং তাদের যেসব জিনিসগুলো সবচেয়ে উত্তম তা দানকরে আয়াতে উল্লেখিত খাতগুলোতে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি তাদের এই যে আন্তরিকতা তা মহান আল্লাহ উল্লেখ করেছেন এইভাবে “যারা প্রতিশ্র“তি দিলে তা পালন করে” আর এটাই হচ্ছে আনুগত্যশীলতার অন্যতম লক্ষ্যণ।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন, : “এই ধরনের লোকেরাই হচ্ছে সত্যের পথে পরিচালিত”, যেহেতু তারা তাদের বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্যশীল, আল্লাহ প্রদত্ত কর্ম সম্পাদনে ও অন্যান্য মানুষের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে। তাফসীর সূরাত আল-বাকারা, ২/২৯৩,২৯৪। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ এমন না যে তাকে আমরা লোক দেখানো কাজের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করবো আর সেই সাথে বিভিন্ন ভাল কাজগুলো পরিত্যাগ করবো। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীলতা বলতে বুঝাবে, আমাদের নিয়তের বিশুদ্ধতা এবং যখনই নির্দিষ্ট কাজটি সামনে আসবে তখন নিয়ত অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল থাকবে তার নিয়ত এমন হবে না যে, কোন বিষয় তাকে শুদ্ধ নিয়ত করতে বাধা দিবে, বরং সে ভাল কাজের পুরস্কার অর্জনের প্রত্যয়ে দৃঢ়, বিশুদ্ধ নিয়ত করবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আনুগত্যশীলতার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে দিবেন যদিও সে তার বিছানায় মারা যায়”। (মুসলিম হতে বর্ণিত, ১৯০৯) ইবনে আল-কাইয়ূম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: আল্লাহর নিকট দৃঢ় আনুগত্য প্রকাশ এবং আনুগত্যশীলতার সাথে কর্ম সম্পাদন করাই হচ্ছে একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ সফলতা। সে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য থাকবে এবং আনুগত্যশীলতা স্বীকৃতি স্বরূপ সে আল্লাহ প্রদত্ত কাজ দৃঢ়তার সাথে সম্পাদন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “(অথচ আদেশের) আনুগত্য করা এবং সুন্দর কথা বলাই ছিল (তাদের জন্যে) উত্তম। যখন (জিহাদের) সিদ্ধান্ত হয়েই গেছে তখন তাদের জন্যে আল্লাহর সাথে সম্পাদিত অংগীকার পূরণ করাই ভালো ছিল” (মুহাম্মদ ৪৭:২১)।

সুতরাং একজন মানুষের খুশী হওয়া নির্ভর করবে সে কতটুকু আনুগত্যশীল ছিল এবং সে অনুযায়ী কতটুকু কর্ম সম্পাদন করেছে। আনুগত্যশীল হয়ে কর্মসম্পাদন করতে বুঝায় সে আল্লাহ প্রদত্ত কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হবে না। যদি সে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীলতা ঠিক করতে পারে তখন একজন মানুষের চুড়ান্ত লক্ষ্য হবে আল্লাহর আনুগত্য অনুযায়ী ভিতরের-বাইরের সকল কাজ সম্পাদন করা এবং কোন কিছুই তাকে এই আনুগত্যশীলতা থেকে ফিরাতে পারবে না। আল্লাহ প্রদত্ত কর্মের লক্ষ্যের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যশীলতা তাকে দূর্বল ঈমানদার হওয়া থেকে বাঁচাবে এবং আনুগত্যশীলতা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করা তাকে অলস হওয়া বা কাজের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শন থেকে হিফাজত করবে। একজন মানুষ যদি তার সকল কাজে আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যশীল হয় তখন আল্লাহ তাকে অন্যদের চেয়ে বেশী অনুগ্রহ করবেন, তার এই আনুগত্যশীলতা ফলাফলই হলো আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা এবং আল্লাহর প্রতি সত্যিকার দৃঢ় বিশ্বাস।

তাই যে কেউ যত বেশী আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল হবে আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসা এবং বিশ্বাস আরো বেশী দৃঢ় হবে। আল-ফাওয়াঈদ, পৃষ্ঠা - ১৮৬,১৮৭ এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আমরা কিভাবে এই আনুগত্যশীলতা এবং দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করতে পারি? এর সমাধান হিসেবে বলা যায়, আপনার মনে যদি কোন সংশয়-সন্দেহ থাকে তা ঝেড়ে মুছে ফেলে দিন। প্রতিদিন একটা সময় নির্দিষ্ট করে নিন যে সময়টাতে আপনি কুরআন অর্থসহ পড়বেন এবং হাদীস চর্চা (সহীহ বুখারী ও মুসলিম অন্তত পক্ষে কিনে ফেলুন) করবেন। এছাড়াও আপনি বিভিন্ন স্কলারদের লেকচার, তাদের লিখিত বই পড়ু–ন। আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আপনার এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।

মাঝে মাঝে ছুটির দিনে স্টাডি সার্কেল এবং পারিবারিক বৈঠক করতে পারেন। যা পড়বেন বা যা শিখবেন সে অনুযায়ী আপনার নিয়ত দৃঢ় করে ফেলুন আর যখন কোন কাজ আপনার সামনে আসবে তখন আপনার নিয়ত অনুযায়ী কাজগুলো করে ফেলুন। সর্বপরি মহান আল্লাহর নিকট অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রার্থনা করুন। মহান আল্লাহ বলেন: “(হে নবী) আমার কোন বান্দাহ যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে (তাকে তুমি বলে দিয়ো), আমি (তার একান্ত) কাছেই আছি; আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই যখন সে আমাকে ডাকে, তাই তাদেরও উচিত আমার আহবানে সাড়া দেওয়া এবং (সম্পূর্ণভাবে) আমার উপরই ঈমান আনা, আশা করা যায় এতে করে তারা সঠিক পথের সন্ধান পাবে। ” (সূরা আল বাকারা - ১৮৬) সুতরাং আল্লাহর আনুগত্যশীল হয়ে কর্ম সম্পাদন করুন আর আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করুন, ইনশাল্লাহ আল্লাহ তাআলা আপনাকে সাহায্য করবেন।

আপনি আজ থেকে মন স্থির করে ফেলুন, আপনার নিয়ত যদি ঠিক থাকে যে আপনিই সত্যিই আনুগত্যশীল হবেন তাহলে ইনশাল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.