আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তে দুই দিন

আমি বাংলার গান গাই আমি বাংলায় গান গাই আমি আমার আমাকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই

গ্রামের সরু পাকা রাস্তা দিয়ে গাতিপাড়ার মোড়ে দোকানের সামনে আমাদের কারটি থামার সাথে সাথে কানে এল ‘শামসু বিডিআর দাউদকে খুঁজে বের করে টাকা আদায় করে ছেড়েছে’। যিনি বলছিলেন গাট্টাগোট্টা বেটে মত লোকটি আরো কয়েকজনকে নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন রাস্তার পশ্চিম পাশের দোকানে। রাস্তার পূর্ব পাশের দোকানে বসে ছিলেন নানা বয়সী আরো কয়েকজন। এদের মধ্যে মলিন একটি গেঞ্জি গায়ে দেওয়া মধ্যবয়সী লোকটি এগিয়ে এসে আমাদের সাথে থাকা স্থানীয় এক সাংবাদিককে পাশে ডেকে নিয়ে আমাদের পরিচয় এবং আসার হেতু জানতে চাইলেন। কোনমতে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চিকন পায়ে হাটা পথ বেয়ে এগুতেই দেখা গেল একজন বিডিআর সদস্য বৃদ্ধ একজনের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে কি যেন বলছেন।

আমাদের উপস্থিতিতে তারা দু’জনেই সতর্ক হয়ে গেলেন। নিজেদের পরিচয় দিয়ে এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলার পর তিনি অনতীদূরে দাড়িয়ে তাকা আরো এক বিডিআর সদস্যকে ডেকে বললেন ‘ভাইদের ক্যাম্পে নিয়ে যাও, ক্যাম্পে বসতে দিও, যেন কোন সমস্যা হয় না’। বিডিআরের এই ক্যাম্পটি হচ্ছে যশোরের শার্শা উপজেলাধীন সাদিপুর সীমান্ত তল্লাশী চৌকি। সাদিপুর শুধু যশোরের নয়, চোরাচালের আধিক্যের কারণে সমগ্র দেশে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বিশেষ করে সংবাদপত্রে একাধিক শিরোনাম হওয়ার কারণে চোরাচালান নিয়ে যারা সচেতন তারা সাদিপুরের নাম জানেন।

এখানে বলে রাখা ভাল সীমান্তের যে স্থান দিয়ে মানব পারাপারের অবৈধ পথ রয়েছে স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে ‘ঘাট’ বলে আর দালালের মাধ্যমে এই ঘাট দিয়ে যারা যাতায়াত করে তাদেরকে বলা হয় ‘ধুড়’। চিকিৎসা, ভ্রমণ, আত্মীয় বাড়ি বেড়ানো, কেনাকাটা করার জন্য মানুষ অনেক সময় এইসব ঘাট দিয়ে যাতায়াত করে থারে। সাধারণত পাসপোর্টের ‘ঝামেলা’ এড়ানো এবং অর্থ সাশ্রয়ের জন্যই সাধারণ মানুষ ঝুকি নিয়ে দালালকে ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা দিয়ে অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করছে। তবে, এসব অবৈধ পথ চোরাচালান পন্য আনানেয়া এবং নারী ও শিশু পাচারের কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয়। বলা হয় বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পাচার হয় তার সিংহভাগই পাচার হয় যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬টি জেলার সীমান্ত দিয়ে।

অন্যান্য জেলাগুলো হল সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া। মূলত মানব পারাপারের বর্তমান অবস্থা জানার জন্যই আমাদের সীমান্ত পর্যবেক্ষণ। ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের যাত্রার প্রথম দিন ছিল যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাশিলা এবং দৌলতপুর সীমান্ত। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের এত কাছাকাছি দু’দেশের মানুষের অবস্থান এই সীমান্তের মত দেশের কম সীমাস্তই দেখা যায়। দৌলতপুরে আবার বাংলাদেশের মধ্যে ‘ঘোজ’ হয়ে ঢুকে গেছে ভারতীয় সীমানা।

ঠিক ছিটমহল না হলেও এখানে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভারতে যাতায়াত করে থাকে। একই অবস্থা শার্শার সাদিপুরেও। ঠিক বিডিআর ক্যাম্পের গায়েই সর্বোচ্চ দু’হাত আড়াআড়ি একটি নালার ওপাশে ‘তেরঘরিয়া’। ভারতীয় এই জমিতে পূর্বে ১৩টি পরিবার বসবাস করতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে তেরঘরিয়া। পাঁচটি পরিবার ভারতের ভেতরে চলে গেলেও নামের কোন পরিবর্তন হয়নি।

বিডিআর সদস্যরা আমাদেরকে কোনভাবেই ওখানে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দিলেন। কেন জানতে চাইলে তারা বললেন, অন্য দেশের মধ্যে আমাদের যাওয়া নিষেধ। ভারতীয়রা আমাদের সীমানায় আসে কিনা জানতে চাইলে বললেন ‘শুধু লবণ কিনতে আসে। আমাদের কোন লোকও সেখানে যায় না’। পায়ে হাটার দাগ দেখিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে ‘সামছু’ বিডিআর বললেন, ‘আগে যেত এখন যায় না’।

ফিরে আসার সময় তিনজন বিডিআর সদস্য আমাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন আগে দেখে যাওয়া লোকগুলো। তারা বারবার আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন ‘এখান দিয়ে কোন মানুষ যায় না, কোন কিছু আনা নেওয়া হয় না’। একই সাথে তারা আমাদের আপ্যায়ন করার জন্যও জোরাজুরি করছিলেন। তাদের সাথে সায় দিয়ে বিডিআর সদস্যরা উস্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘আগে থেকে জানবা না কে কে রোজা আছে আর কে নেই।

ভাইদের দোকানের মধ্যে নিয়ে যাও’। অনেক কষ্টে তাদের ‘আথিতেয়তা’র বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার পর সামান্য দূরে একজন আমাদের পথ রোধ করে বললেন, ‘ভাইরা কি কিছু পেলেন’? কি পাব জানতে চাইলে তিনি বললেন ‘আপনারা যে ক্যাম্পে গেছিলেন তার পাশে ভারতীয় বাড়িতেই ‘তেরঘরিয়া’ এখন হাট বসে। গাঁজা, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে এমন কোন জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। অন্যান্য স্থান থেকে লোকজন আসে আর এখান থেকে পাইকারী মাল কিনে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বিডিআর সদস্যরা চার্জ কেটে রাখে’।

চৌগাছার পাশ্ববর্তী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলাধীন গোপালপুরের ওপারে রয়েছে ভারতের মশ্মমনগর। আমাদের গাইড স্থানীয় যাদবপুর ইউনিয়নের এক মেম্বর গোপালপুরের মাঠ দিয়ে যখন আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি সীমান্তের অস্তিত্ব সম্পর্কে চুলচেরা বর্ণনা দিচ্ছিলেন। একই মাঠে একটি জমি বাংলাদেশের তো পরের জমিটি ভারতের। আবার এর পরের জমিটি বাংলাদেশের তো তার পাশের জমিটি ভারতের। এভাবে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে দেখা গেল সীমান্তের কাটাতারের বেড়া খুলে বিএসএফ কয়েকজন নারী-পুরুষকে বের হয়ে আসার সুযোগ করে দিল।

এরা কারা জানতে চাইলে মেম্বর বললেন এপাশে নিজেদের জমিতে কাজ করার জন্য ওরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে এসেছে। কিন্ত, আমাদের দেখে প্রথমে কলা গাছের আড়লে এবং পরে ঝোপঝাড় দিয়ে চলে যাওয়া ছাতি হাতে লোকটি কে-এ প্রশ্নে তিনি বললেন, ‘ও দু’একটা মাঝে মধ্যি চলে আসে আবার যায়’। আমাদের যাত্রার মধ্যে আরো ছিল যশোরের শার্শা উপজেলার পুটখালী এবং রেললাইন ‘ঘাট’। সরু পাকা রাস্তা দিয়ে যখন গ্রামে প্রবেশ করছি তখন দেখা গেল মোড়ে মোড়ে লাইন দিয়ে ভ্যান দাড়িয়ে আছে, কোন যাত্রী নেই। মাঝেমধ্যে কয়েকটি দোকান নিয়ে ছোট একটা বাজারের মধ্যে যুববয়সী একাধিক মানুষের জটলা।

কারো কাছে মটরসাইকেল, কারো বা বাইসাইকেল। আবার এদিক ওদিক দিয়ে ভোঁ ভোঁ শব্দে মটরসাইকেল চালিয়ে আসাযাওয়া করছে কেউ কেউ। হাসিঠাট্টার পাশাপাশি বিড়ি-সিগারেট খাওয়াও চলছে। ‘এরা সবাই আমলীগের লোক। আগে করতো বিএমপি এখন করে আমলীগ।

সারাদিন জুয়ো খেলে, নেশা করে আর রাত হলি ফেনসিডিল পাচার করে। আর সীমান্তের অবৈধ পথ দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষের সর্ব্বোস্ব কেড়ে নেয়’-এদের পরিচয় জানতে চাইলে বৃদ্ধবয়সী এক ব্যক্তি খেদোক্তির সাথে জানালেন। মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পুরো সীমান্তই এখন ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ নামধারীরা সীমান্তের অবৈধ পথের নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়েছে। অবৈধ মানব পারাপার থেকে শুরু করে মাদক চোরাচালান-সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে তারা।

চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে সাথে চোরাচালানের অবৈধ ঘাটের নিয়ন্ত্রক শক্তিও পরিবর্তিত হয়। মাঠ পর্যায়ের কাঠামো ঠিক রেখে সাধারণত ক্ষমতাসীনরাই হয়ে যায় এর নিয়ন্ত্রক। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানালেন, ‘ঈদ-পুজোকে সামনে রেখে বাণিজ্যও হচ্ছে ভাল। বর্তমানে সীমান্ত অতিক্রম করে বেশি আসছে ফেনসিডিল।

নেতাদের অনেকে সকাল বিকেল মটরসাইকেল দাবড়িয়ে ফেনসিডিল খাওয়ার জন্য এখানে ছুটে আসে। এরা কোন টাকা নেয় না। ফেনসিডিল হলেই চলে। পুলিশ পর্যন্ত ফেনসিডিল খায়’। পুটখালী, সাদীপুরের পর বেনাপোল এসে চা খাব বলে বন্দরলাগোয়া বাজারের মধ্যে একটি দোকানে বসে আছি।

এমন সময় শোনা গেল পাশের একটি পরিবহন কাউন্টার থেকে কে যেন কাউকে উচ্চস্বরে ধমক দিচ্ছে। উকি মারতেই দেখি হলুদ গেঞ্জি পরিহিত ভুড়িওয়ালা এক যুবক মোবাইলে ‘ঘাট’ পরিস্থিতি নিয়ে অপর প্রান্তে কারো সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার বিষয়বস্ত ‘ধুড়’ পারাপার। অনেক কথার এক পর্যায়ে যুবকটি বললো ‘একজন মানুষ পার করে যদি ৫শ’ টাকার একটা বুঝ না থাকে তা হলি ওই---করে লাভ কি? আপনি---ভাইরে বলে দেবেন বেশি ঝামেলা না করতি। ’



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।